শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ০৬ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          নিজেকে আমি ভীষণরকম ধৈর্যবান বলেই ভাবতাম। কিন্তু আজ সেই ভাবনায় ফাটল ধরতে শুরু করেছে। কখন সকাল হবে তর সইছে না। কারণ সকালে ঢাকা যাব। কাল মীরার সঙ্গে প্রথম দেখা। ইচ্ছে করছে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে সকাল করে দিই। এটাও ইচ্ছা করছে যে রাতটাকে ভিডিওচিত্র বানিয়ে টাইমল্যাপসে দিয়ে এক মিনিটে সকাল করে দিই। কিন্তু হায়, আমি নাদান মানুষ আমার এত ক্ষমতা নেই। এমনকি আজ রাতে নিদ্রাক্ষমতাও হারিয়েছি!

রাফসান শিকদার
১১ নভেম্বর, ২০০৯

ভয়াবহ কুয়াশা পড়েছে। কুয়াশায় এক হাত সামনে কী তাও দেখা যাচ্ছে না। সারারাত এক মিনিটের জন্য চোখের পাতা এক করিনি। এক মিনিটও না। কিছুতেই ঘুম আসছিল না বলে সিনেমা দেখে সময় কাটিয়েছি। জানি না কেন। আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়লাম। ঝাড়ুদাররা এখনো রাস্তা ঝাড়ু দিতে নামেনি। দু-একটা কাক আর আমি ছাড়া অন্যকোনো প্রাণী রাস্তায় নেই। ভোরবেলা একচ্ছত্র রাজত্ব করা কুকুরগুলোও তখনো আশ্রয়স্থল থেকে বের হয়নি। আচ্ছা তবে কাক কেন বেরিয়েছে? ওদের কি শীতের অনুভূতি কম? রাতে বাসায় গিয়ে ইন্টারনেটে দেখতে হবে ব্যাপারটা। সকাল সাড়ে ছটার মতো বাজে হয়তো তখন ব্যাংক টাউন গেটে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছি। একটা বাসও নেই রাস্তায়। এটা খুব ছোট স্টপেজ। সরাসরি এখান থেকে কোনো বাস নেই। সাভার থেকে যেসব বাস ঢাকা যায় তারা কয়েক সেকেন্ডের জন্য এখানে দাঁড়ায়, তখনই উঠতে হয়। অনেক বাস এখানে দাঁড়ায়ও না। অন্যদিন এই সময়ের মধ্যে বেশকিছু বাস ছেড়ে দেয়। আজ সম্ভবত কুয়াশার জন্য দেরি করছিল। যাই হোক ৭টার দিকে বাস পাওয়া গেল। সকাল ৮টার মধ্যে আমি ফার্মগেট পৌঁছে গেলাম। মীরার সঙ্গে দেখা করার কথা ১১টায়। আমি নিজেও জানি না কেন এত তাড়াতাড়ি এলাম? আর ১১টা পর্যন্ত কীইবা করব?

টুকটুক করে হাঁটছিলাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম, আমি কলাবাগান এসে গেছি। হয়তো নিজের অবচেতন মনেই আমি কলাবাগানের দিকে হাঁটা ধরেছি। কারণ কলাবাগান ফার্স্ট লেনে মীরা থাকে। আমি ফার্স্ট লেনে ঢুকলাম। ভাবতে লাগলাম, এই রোডে যেখানে আমি হাঁটছি সেখানে কখনো মীরা হেঁটেছে! এই বাতাসে হয়তোবা কখনো মীরারও চুল উড়েছে!

আমার কথা শুনে তুই হাসছিস বকুল? আচ্ছা যা স্বীকার করেই নিলাম আমি একটু বিচলিত বোধ করছি। প্রেমিকদের প্রথম প্রথম এরকম একটু হয়। তুই প্রেমে পড়লে তোরও হবে। শোন আজ আমি একটু চালাকি করেছি। কথা ছিল আমি কালো শার্ট পরে আসব। কিন্তু সাদা শার্ট পরে এসেছি। একটা হাফ লিটারের পানির বোতল রাখার কথা আমার হাতে। কিন্তু রাখব না। কারণ আমি মীরাকে আগে দেখতে চাই। বকছিস কেন? এটা তো খারাপ কিছু না। আমি তো পরে নিজের পরিচয় দেবই। আরে এটা ধোকা কীভাবে? বেশি বুঝিস তুই। এখন খুব মীরার লোক হয়ে গেছিস!

শোন বকুল, কলাবাগান লেকে বসে লিখছি। লেকের পানির কারণে প্রচুর শীত লাগছে এখানে। আর থাকা যাচ্ছে না। এবার একটু রোদে হাঁটব। দেখা হওয়ার পর কী হলো সেসব রাতে বলব। জানি তুইও উদগ্রীব হয়ে আছিস।

রাফসান শিকদার
১২ নভেম্বর, ২০০৯

এতটুকু পড়ে মীরা ডায়েরিটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। রাফি তো দেখা যাচ্ছে তারচেয়ে বেশি অস্থির ছিল প্রথম দেখা হওয়ার সময়। অথচ সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তা। খুব স্বাভাবিক লেগেছিল তাকে! মীরা বিস্ময় কাটিয়ে আবার ডায়েরিটা পড়া শুরু করল।

বকুল আমার জীবনে এত অদ্ভুত ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। ঘটেনি মানে ঘটেইনি। কারো জীবনে এধরনের ঘটনা ঘটতেও শুনিনি বা দেখিওনি। বললে তুই নাও বিশ্বাস করতে পারিস। না না কি বলছি, তুই তো আমার সব কথাই বিশ্বাস করিস তাই এটাও করবি। ঘটনা হচ্ছে মীরার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু আমি বলতে পারব না মীরার চেহারা কেমন! মানে আমি এতটাই আউলা হয়ে গেছি যে তোকে বুঝিয়ে বলতেই পারছি না। যখন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে তখন জানতাম না ওটা মীরা। এরপর যখন জানলাম কিছুতেই মনে করতে পারছি না যে ওর মুখটা কেমন! আমি জানি, বলতে গিয়ে প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলছি। মানে কোথা থেকে শুরু করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি যেমন আগে দেখব বলে প্ল্যানমতো কালো শার্ট পরিনি। সেও একই কারণে অন্য রঙ পরে এসেছিল। যেহেতু কারো বাহ্যিক অবয়ব সম্পর্কে কেউ কিছু জানতাম না তাই কেউই কাউকে চিনতে পারিনি।

মীরা বের হচ্ছে জানিয়েছে। তারপর অনেক সময় কেটে গেছে, আমি ওকে খুঁজে মরছি। সেই সময় এক মেয়ে এসে একটা আর্জেন্ট কল করার জন্য ফোন ধার চাইলো। আমি দিলাম। তার দিকে সেভাবে তাকাইনি কারণ আমার অস্থির দু চোখ হন্যে হয়ে মীরাকে খুঁজছিল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা ফোন ফেরত দিয়ে চলে গেল। মেয়েটা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর যখন আমি আমার ফোনের দিকে তাকাই তখন দেখি আমার নাম্বারে ডায়াল করা হয়েছে। তখনই বুঝতে পারলাম যে ওটা মীরা ছিল। আমি বলতে গেলে ভোঁ দৌড় দিলাম। কিন্তু ততক্ষণে মীরা গেটের ভেতর ঢুকে গেছে। মীরা আর বের হতে পারল না। এই আমার প্রথম দেখা!

রাফসান শিকদার
১২ নভেম্বর, ২০০৯

বকুল শোন, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম মীরা অনেক লম্বা। আমাকে সবসময় সবাই বলতো আমি লম্বা মানুষ খাটো মেয়ে পাব। পেলেও আপত্তি ছিল না। শান্তনা তো খাটোই ছিল। তাতে কী? কিন্তু মীরা আর আমার হাইটের এত পারফেক্ট ম্যাচিং কিভাবে সম্ভব হলো? নারে বকুল। বিশ্বাস কর দেখতে কেমন একদমই খেয়াল করিনি। ছেলে মানুষ মেয়েদের দিকে তাকাবে না এটা হয় না। আমিও অবশ্যই তাকাই কিন্তু তখন মীরাকে খোঁজার জন্য অস্থিরচিত্ত ছিলাম। অন্য কোনো দিকে খেয়াল করতে পারিনি। মীরাকে আবার দেখলে চিনব না এমন না, চিনব অবশ্যই। তবে বিস্তারিত বলতে পারছি না। সব মিলিয়ে সম্ভবত সুন্দর!

রাফসান শিকদার
১২ নভেম্বর, ২০০৯

কাল ছুটির দিন। দেখা করা তো অসম্ভব। ১৪ তারিখেও মীরার পরীক্ষা নেই। ১৫ তারিখে দেখা করতে হবে। আমি জানি না কীভাবে এই দুটো দিন আমার কাটবে। মীরাও নিশ্চয়ই একই রকম অস্থিরতায় দিন কাটাচ্ছে! ধুর ছাতা এমন সময় ওর ফোনটাও ওর কাছে নেই। মন চাইলে একটু কথাও বলতে পারি না। ওকে একটা ফোন কিনে দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু হাতে তো সেরকম টাকা নেই। কিভাবে কিনে দিই? একটা বুদ্ধি বাতলে দে না ভাই!

রাফসান শিকদার
১২ নভেম্বর, ২০০৯
·
·
·
চলবে..................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp