কথাটা শেষ করতে পারলো না বণিক। তার পূর্বেই তার গলায় অনুভব করলো ধারালো কিছু। অন্ধকারে দেখতে না পেলেও বুঝলো কালো পোশাকধারী কিছু মানুষ তাকে ঘিরে ধরলো। চোখের পলকে ছোঁ-রার আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তার দাসেরা। তার পেছনের ঘাতক শীতল স্বরে বললো,
“তোমার পরিকল্পনা এবার সরাসরি হুজুরকে জানাবে”
বণিক বুঝলো পালাবার পথ নেই। তার সকল পরিকল্পনা সব জলে গেছে। এখন একটি উপায়ই অবশিষ্ট, শত্রুর হাতে ধরা পড়ার পূর্বে আত্মহুতি দেওয়া। ভাববে নিজের রাজ্যের জন্য জান কুরবান করেছে। তাই দ্রুত নিজের বা হাতের অনামিক আঙুলের আংটির ভেতরের লুকায়িত বিষটুকু সেবন করতে উদগ্রীব হলো। বিষটুকু মুখেও পুরে ফেললো। কিন্তু ঘাতকের মস্তিষ্ক যে তার থেকে ধূর্ত। সে আন্দাজ করতেই সাথে সাথে বণিকের গলায় আঙুল দিয়ে তাকে বমি করিয়ে ফেললো। ছুরিখানা ডু-কিয়ে দিলো বণিকের বা হাতে। বণিকের আর্তচিৎকারে খন্ডিত হলো শান্ত আঁধারের বাতাবরণ। উড়ে গেলো কিছু পাখি, যারা ক্লান্ত রাতে আশ্রয় নিয়েছিলো গাছের ডালে। বাতাসে রক্তের গন্ধ মিশে আছে। ঘাতক চুল মুঠোবন্দি করে গমগমে স্বরে বললো,
“তোর প্রাণ এখন হুজুরের। তার আদেশ ছাড়া তোর মৃত্যু নেই”
—————
কালো অন্ধকার ঘর। বণিক তার ক্লান্ত, ফোলা চোখজোড়া মেললো বটেই, কিন্তু অন্ধকার বাদে কিছুই নজরে এলো না। ঘরটিতে রক্তপঁচা গন্ধ ছেয়ে আছে। সেই সাথে অনুভব করা যাচ্ছে এখানের শত শত নিপীড়িত চিৎকার। বণিকের হাত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। জ্বলছে সমস্ত দেহ। করাঘাতে তার ঠোঁট কেটে ঝুলে গেছে। চোখের ডান দিকটার মাংস উঠে গেছে। পা দুটোর হাড় গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে। পায়ে এখন কোনো অনুভূতি নেই। পিঠে অগণিত চাবুকের দাগ। মাংসগুলো কেঁটে হা হয়ে গেছে। এই বুঝি কঙ্কালটাও দেখা যাবে। একটি আঙুল কেঁটে ফেলা হয়েছে। তার আশেপাশে রক্তের স্রোত। যা শুকিয়ে কালচে হয়ে যাচ্ছে। পিঁপড়া ধরছে হয়তো। কিছু একটা কামরাচ্ছে তার পায়ে, হয়তো ইঁদুর। বণিকের শুধু প্রাণটাই নেওয়া বাকি। হঠাৎ ধপ করে জ্বলে উঠলো মশাল। ছোট ঘর আলোকিত হয়ে গেলো। বণিক আর ফোলা চোখটা মেললো। দৃষ্টি ঝাপসা। তার সম্মুখে সাদা থান জড়ানো এক পুরুষ দাঁড়িয়ে। মুখখানা বুঝা যাচ্ছে না। তবে তার গায়ের রঙ কালো। সে তার তলোয়ারের কোন দিয়ে তুললো বণিকের মুখ। শান্ত স্বরে শুধালো,
“কিছু উগড়েছে হুদ?”
হুদ বিনয়ী স্বরে বললো,
“না হুজুর। মুখ খুলে নি। যে পন্থা অবলম্বন করেছি তাতে যে কেউ মুখ খুলে”
ইরহান কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর পা দিয়ে বণিকের কাটা হাত চেপে ধরলো। সাথে সাথেই বণিক চিৎকার করে উঠলো। আর্তনাদে ঘর ছেড়ে গেলো। হুদ মুখ বিকৃত করলেও ইরহানের মুখশ্রীতে সামান্য ভাবাবেগ হলো না। হিসহিসিয়ে বললো,
“যদি ভেবে থাকিস আমি তোর উপর দয়া করবো, তবে ভুল। শেষ সুযোগ দিচ্ছি, বল কে পাঠিয়েছে তোকে?”
“আ……আম…আমাকে মে…মের…মেরে ফেলো। স…সময় নষ…নষ্ট করছেন শুধু”
ইরহান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে বণিকের দিকে। তারপর তলোয়ারের এক ঘায়ে কেটে ফেললো বণিকের লিঙ্গ। বণিক কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগলো। চিৎকারে মিশে আছে যন্ত্রণা। চেঁচিয়ে বললো,
“আমাকে… মেরে ফেল”
“এতো সহজ মৃত্যু ইরহান আলী শাহ দেয় না। তোর চৌদ্দ পুরুষ মনে রাখবে এই ইরহান আলী শাহর নাম। কাঁপবে ভয়ে”
বণিক হাসলো, থুথু মারলো ইরহানের মুখে, তারপর গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বললো,
“আ…মার কেউ নেই, তো……রা সব… শে…শেষ করে দিয়ে…ছিস। আল্লা…হ আছেন। উ…নি স…ব দেখছেন। আমি পা…রি নি। টা…না ছয়… মাস, ছ…য় মাস.. ধ..রে প্র..হর… গু…গুনেছি। প্র…হর গুনে……ছি এই সাম…সাম্রা…জ্যের পত…ন দেখবো ব…লে। এক…টাই… ভুল…ওই দা…সী মেয়ে…টাকে নিজে…দে…র সাথে নেওয়া… ও নিজে মরেছে… আমাদের ক…ব…র খুড়েছে। নয়তো এখন সুল……তানের জা…নাযা…… পরতি তোরা”
বণিক আর কথা বলতে পারলো না। হাপাচ্ছে সে। বুক ব্যথা করছে। ইরহানের কপালে ভাঁজ পড়ল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর হিনহিনে স্বরে বললো,
“হুদ, ওর চিকিৎসা করাও। খবরদার বণিক যাতে না মরে। ওকে এমন জীবন দাও যেন নিঃশ্বাসেও মৃত্যু কামনা করে। খুব মালিকের প্রতি প্রেম ওর। সেই প্রেমের পুরষ্কার দাও ওকে। আমিও দেখতে চাই ওর ধৈর্য”
যাবার সময় হুদ খুব ধীর স্বরে বললো,
“হুজুর হুসনাতকে কি করবো? বোঝাই যাচ্ছে হুসনাত ওদের দলের”
ইরহান ফিঁচেল হাসি কালো ঠোঁটে এঁটে বললো,
“শিকারকে লেজে নাড়িয়ে শিকার করার যে মজা, সেটা খপাৎ করে গলা কাঁ-টার মধ্যেই নেই হুদ”
হুদ বুঝলো ইরহানের কথার মর্মার্থ। তাই কথা বাড়ালো না। ইরহান কারাগার থেকে বেরিয়ে গেলো। এই ঘরটা ইরহানের ব্যক্তিগত কারাগার। এই পাতালঘরের কথা কেউ জানে না। স্বয়ং মালেক শাহও না। এই ঘরের প্রতিটা ইট সাক্ষী ইরহানের ইরহান আলী শাহ হয়ে উঠার গল্পের। কারাগার থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বণিক মৃত্যু চাইছে। এই যন্ত্রনা যে জাহান্নামের মত লাগছে।
!!১৩!!
এসফাইনের আলীউদ্দিনের প্রাসাদ ঘেরাও দিয়ে রেখেছে সাধারণ সৈন্য। যেকোনো মুহূর্তেই আগুন জ্বালিয়ে দিবে তারা। খোরতাইন সাম্রাজ্যের পতনের পর আলীউদ্দিন এসফাইনের প্রাদেশিক প্রধান হয়। আলীউদ্দিন ছিলেন খোরতাইন সুলতান আরসালানের উজির প্রধান। আলীউদ্দিনের কানপড়ায় জনগন খোরতাইন সুলতানের উপর প্রসন্ন ছিলো না। তাদের ধারনা সুলতান হিসেবে তিনি ছিলেন হঠকারী, নির্বোধ এবং অহংকারী। যখন আরসালান তার সাম্রাজ্যকে বাঁচাতে মেহমুদ সাম্রাজ্যের সৈন্যদের সাথে লড়ছিলেন, তখন আলীউদ্দিন ক্ষমতা লোভে শত্রুদের সাথে হাত মেলান। ফলে যুদ্ধনীতি থেকে শুরু করে সকল খবর মেহমুদদের কাছে পৌছে যায়। ফলে খোরতাইন সাম্রাজ্যের পতনের পর জনমতেই আলীউদ্দিন প্রাদেশিক প্রধান হন। কিন্তু যখন মেহমুদ সাম্রাজ্যের নামে আলীউদ্দিন নিজেকেই সুলতান ঘোষণা করে প্রজাদের কর বাড়িয়ে দেয় তখন সৈন্যরা বিদ্রোহ করে বসে। তাদের মনে হতে থাকে আলীউদ্দিনের থেকে খোরতাইন সুলতান-ই ভালো ছিলো। অন্তত খাওয়া তো জুটতো। অনর্থক নির্যাতিত হতে হত না।
আলীউদ্দিন প্রাসাদের জানালা দিয়ে দেখলো বাহিরে সৈন্যরা মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আলীউদ্দিনের ছেলে লাম বললো,
“আব্বা, আমাদের যে সৈন্য আছে তাতে এই বিপুল সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়া সম্ভব নয়”
“এখন লড়ার সময় নয়, এখন জীবন বাঁচাতে হবে। সুলতানের কানে নিশ্চয়ই খবর পৌছে গেছে। আমি উজির আবদালীকে চিঠি পাঠিয়েছি। উনি উত্তর দেন নি। আমাদের বাঁচাতে হলে কেবল আবদালীই বাঁচাতে পারেন”
“কিন্তু মুখ্যদ্বারে তো সৈন্যরা”
“আমাদের গোপন সুরঙ্গ দিয়ে বের হতে হবে। কিছুদিন লুকিয়ে থাকতে হবে। আবদালী নিশ্চয়ই ততদিনে আমাদের বাঁচার একটা ব্যবস্থা করে দিবে”
আলীউদ্দিন নিজের খাস দাসকে একটি পত্র ধরিয়ে বলে,
“আবদালীর কাছে পত্র পৌছে দাও”
গোপন সুরঙ্গ দিয়ে আলীউদ্দিন এবং তার ছেলে লাম পালিয়ে যায়। একটা সময় প্রাসাদে আগুণ ধরিয়ে দেওয়া হয়। এসফাইন এখন সম্পূর্ণ সৈন্যদের হাতে। তারা চাইলে মেহমুদ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে।
—————
হুসনাতের জন্য আজ সকালটা একটু ভিন্নভাবে শুরু হলো। হুসনাত তখন মাত্র নিজের বিছানা গুছিয়ে কাপড় ধুঁতে যাচ্ছিলো এমন সময় হারেম প্রধান উসমা এলো। তার মুখে তীব্র অপ্রসন্নতা। এই মহিলা মোটেই সহ্য করতে পারে না হুসনাতকে। ব্যপারটা সে ইরহানের ভয়ে প্রকাশ করতে পারে না মুখে, কিন্তু তার মুখভাব বা শারিরীক আচরণে স্পষ্ট বোঝা যায়। হুসনাত তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কিছু বলবেন উসমা খাতুন?”
খুব বেজার কণ্ঠে সে উত্তর দিলো,
“সুলতানা তোমাকে ডেকেছেন”
“আমাকে? আমি কি করেছি?”
হুসনাতের কণ্ঠে ক্ষীন ভয় উঁকি দিলো। গতবারের স্মৃতি এখনো চোখ থেকে সরে নি। তাকে বিষ দেওয়া হয়েছিলো। ভাগ্যিস সে প্রতিষেধক খেয়ে গিয়েছিলো। নয়তো মৃত্যু নিশ্চিত ছিলো। তার মালিক খুব উদারমনা নন। তিনি যে তাকে বাঁচাতেন সেই নিশ্চয়তাও ছিলো না। উসমা হুসনাতের প্রশ্নে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“ন্যাকা, জানে না কিছুই”
হুসনাত মাথা নত করে বললো,
“ক্ষমা করবেন”
উসমা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“শোনো, সুলতানা তোমাকে মারতে ডাকে নি। তোমার পদন্নতি হয়েছে। এখন তুমি এখানের সাধারণ দাসী নও। যদিও তুমি কোনোকালেই সাধারণ দাসী নও। তোমার চোখ তো শেহজাদার পত্নী হবার। আরেকটা সিড়ি পেলে, এখন তুমি শেহজাদী রুমেলিয়ার খাস দাসী। শোনো আমাদের শেহজাদী যে সে মেয়ে নয়। তাকে প্রসন্ন রাখলে তোমার সুবিধা। আর তেড়িবেড়ি করলে, গর্দান ঘচাং”
বলেই নিজের গলা কাঁটার ইশারা করলো উসমা। হুসনাত দাঁড়িয়ে গেলো। বললো,
“চলুন”
—————
তাবিয়ার মুখোমুখি হতেই কুর্নিশ করে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে রইলো হুসনাত। তাবিয়া চোখের ইশারা করতেই উসমা চলে গেলো। ঘরে কেবল রোকসানা এবং তাবিয়া। তাবিয়া নিজের অলংকার বাক্স থেকে একটা পান্নার আংটি ছুড়ে দিলো হুসনাতের দিকে। আর বললো,
“আমি তোমার সাহসে খুব প্রসন্ন। এমন সাহসী কেউ ই দরকার আমার মেয়ের সেবায়”
হুসনাত আংটিটি তুলে, তাবিয়ার কাফতান আর হাতে চুমু খেলো। বিনয়ী স্বরে বললো,
“আপনার সেবা করাই আমার কর্তব্য, বেগম সুলতানা”
তাবিয়া তার সামনের একটি আঙ্গুর মুখে দিয়ে বললো,
“শুনেছি সেদিন রাতে তুমি শেহজাদার কামড়াতেই ছিলে? কথা সত্য?”
সাথে সাথেই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে অনুরোধের স্বরে হুসনাত বললো,
“বেগম সুলতানা ক্ষমা করবেন, হুজুর আমাকে চিকিৎসারত অবস্থায় ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন। আমি এ ভুল আর কখনো করবো না। আর কখনো আমি হুজুরের কক্ষে যাব না”
“যাবে, তুমি হুজুরের কক্ষে যাবে। শেহজাদার প্রিয় নারী হয়েই থাকবে তুমি। বুঝেছো?”
হুসনাত অমীমাংসিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। তাবিয়া হাসলো। তারপর বললো,
“শেহজাদার বিশ্বস্ত হয়ে প্রতিটা পদক্ষেপের খবর আমার চাই। শেহজাদা যেন জানতে না পারে আমি তোমাকে তার পেছনে নজর রাখার জন্য পাঠিয়েছি। আমার হয়ে থাকলে আমি তোমাকে সেই সুখ দিব যা তুমি কল্পনাও কর নি কখনো। আর যদি তুমি বেইমানি কর, তবে কোনো মরুভূমিতে তোমার লাশ চিল, শকুনে খাবে। কথাটা মনে থাকবে?”
হুসনাত মাথা নত করে বললো,
“আমি আপনার দাস সুলতানা, আমি আপনার সাথে বেইমানি করবো না। আমাকে মারবেন না দয়া করে”
“সেটা তো সময় বলে দিবে। মুখ বন্ধ রাখবে, চোখ খোলা। মনে থাকবে?”
হুসনাত মাথা কাঁত করে বললো,
“জি বেগম সুলতানা”
তাবিয়া আঙ্গুরের থোকাটা উঠিয়ে বললো,
“আর একটা কথা, খবরদার শেহজাদার প্রেমে পড়ার ভুল কর না। ইরহান আলী শাহর প্রেম মানে মৃত্যুদ্বার”
হুসনাতের থেকে ভালো কে জানে এই কথাটা। তার গলায় এখনো সেদিনের তলোয়ারের দাগ স্পষ্ট হয়েছে। সেই যন্ত্রণাময় রাতের কথা কি এতো সহজে ভোলা যায়? সেও ভুলতে পারবে না। আর কত রাত এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে শুধু বিধাতাই জানেন।
—————
হারেমে ফিরতেই নিষ্ঠুর একটি দৃশ্যের মুখোমুখি হলো হুসনাত। একজন নারী অন্যজন নারীকে ক্রুরভাবে পেটাচ্ছে। সে মার খাচ্ছে তার আর্তচিৎকার হারেমের দেওয়াল অবধি পৌছাচ্ছে না। কারণ মহলের এই দিকটা মানবশূণ্য। ওখানে অবশ্য শুধু দুজন নয়। আরোও পাঁচ-ছয় আছে। কিন্তু সবাই যেন কালা! অন্ধ! বোবা। কিন্তু হুসনাত নিশ্চুপ থাকতে পারলো না। কারণ মেয়েটি যে আয়েশা। তার গাল কেটে রক্ত বের হচ্ছে। চোখ ফুলে গেছে। তার চুল ধরে অমানবিক ভাবে মারছে মেয়েটা। হুসনাত সাথে সাথেই ছুটে গেলো। আয়েশাকে আড়াল করে বলল,
“ও কে আর মারবেন না, ও মরে যাবে”
মেয়েটির যেন সহ্য হলো না হুসনাতের এমন কথা। সে হুসনাতের চুল মুঠোবন্দি করে টেনে ধরল,
“বাঁচতে চাইলে সর। এই মহলে চোরের শাস্তি মৃত্যুদন্ড”
চুলে টান লাগায় হুসনাত ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো। আয়েশা তখন সাথে সাথেই বললো,
“আমি চুরি করি নি”
প্রহারকারী মেয়েটি হুসনাতের চুল ছেড়ে, আয়েশার গাল চেপে ধরলো। রাগী স্বরে বললো,
“তাহলে আমার আংটি কি হাওয়ায় মিশে গেলো? আমার ঘর তুই পরিষ্কার করার পর থেকে আমার আংটি নেই”
“বিশ্বাস কর আমি চুরি করি নি”
হুসনাত আয়েশাকে ছাড়িয়ে নিলো মেয়েটার থেকে। জড়িয়ে ধরে বললো,
“ও তো বলছে ও চুরি করে নি। আপনি উসমা খাতুনকে জানান। উনিই চোর খুঁজে বের করতে পারবেন”
“এখন তোর থেকে আমার জ্ঞান নিতে হবে? তুই জানিস আমি কে? সরে যা নয়তো এই হারেমে তোর জীবন আমি দূর্বিষহ করে ফেলবো”
“ক্ষমা করবেন আমি জানি না, তবে আপনি আয়েশাকে অমানুষের মত মারছিলেন। এটা তো হারেমের নিয়মের বাহিরে। উসমা খাতুন জানলে…”
“কে জানাবে? তুই?”
হুসনাত জবাব দেবার আগেই একজনের স্বর শুনতে পাওয়া গেলো,
“কি হচ্ছে ওখানে? কারা ওখানে?”
প্রহারকারী মেয়েটার সাঙ্গরা তখন বলে উঠলো,
“হামিদা, চলো এখান থেকে। জানাজানি হলে বেগম সুলতানা আস্তো রাখবেন না”
হামিদার মুখ শক্ত হয়ে গেলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছেড়ে দিলো সে হুসনাত আর আয়েশাকে। তারপর আয়েশার ক্ষতবিক্ষত মুখখানায় হাত বুলিয়ে বললো,
“তুমি ঠিক আছো?”
“আমি আংটিটা চুরি করি নি, বিশ্বাস কর”
“আমি বিশ্বাস করছি, চলো হামেকের কাছে। নয়তো ক্ষত আরোও ভয়ংকর রুপ নিবে”
“আমার জন্য তুমি ঝামেলায় জড়ালে। হামিদা তোমার জীবন দূর্বিষহ করে তুলবে। ও খারাপ, খুব খারাপ। কেন ঝামেলায় নিজেকে জড়ালে? কি লাভ?”
“বন্ধুত্বে লাভ লোকসান দেখা হয় না আয়েশা, ব্যবসায় দেখা হয়। বন্ধুত্বের সাথে যে ব্যবসা করা যায় না। তুমি আমার বন্ধু আয়েশা”
আয়েশা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। হুসনাত তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কেঁদো না, চল হাকেমের কাছে”
—————
আয়েশাকে ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো হুসনাত। ঠিক তখন উসমা খাতুন এসে জানালেন,
“শেহজাদা তোমাকে ডেকেছেন। গোসল করে যাও”
হুসনাত বুঝলো এই ভাষ্যের অর্থ। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নতুন একটা জামা নিয়ে সে স্নানাগারে গেলো।
ইরহানের দরজার বাহিরে হুদ দাঁড়িয়ে আছে। হুসনাতকে দেখতেই সে দরজা খুলে দিলো। ঘরে প্রবেশ করলো হুসনাত। ঘরের আলো একেবারে ক্ষীন। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইরহান। তার পরণে সাদা থান। বুক, পিঠ উদাম। ক্ষীন আলোতে পিঠের ক্ষতগুলো নজরে এলো হুসনাতের। এর পূর্বে সে খেয়াল করে নি। তবে ইরহানের দেহে অগণিত কাটা, ক্ষতর দাগ। ইরহান তার নয়নজোড়া আকাশের দিকে নিবদ্ধ করে রেখে। হুসনাতের গায়ের মিষ্টি গন্ধ যখন নাকে বাঁধলো তখন সে পেছনে ফিরে তাকালো। হুসনাত জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুগত স্বরে বললো,
“হুজুর, আপনার দাসী আপনার সেবায় নিয়োজিত”
ইরহান এগিয়ে এলো তার সামনে। আঙুল নিয়ে থুতনি তুললো। হুসনাত মৃদু কাঁপছে। ইরহান তার কাঁপুনিটা অনুভব করলো যেন, তারপর কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বললো,
“আমার প্রতি কদমের খবরাখবর সুলতানার কাছে পৌঁছে দিতে প্রস্তুত তো?”
হুসনাত উত্তর দিলো না। দৃষ্টি নামিয়েই রাখলো। ইরহান তার শরীর থেকে কাপড় খুলতে খুলতে বললো,
“আজকে রাতে যা হবে। তা যেন অক্ষরে অক্ষরে সুলতানার কানে যায়। কোনো মুহূর্ত বাদ না যায়। মনে থাকবে?”
হুসনাতের ভেতরটা অস্বস্তিতে ভরে যাচ্ছে। তার শরীরের প্রতিটা অংশে ইরহানের আধিপত্য। স্পর্শগুলো আজ ভিন্ন। খুব একটা যন্ত্রণাময় নয় তবে কেমন গা গুলানো। রাতের গভীরতার সাথে ইরহানের স্পর্শ ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। হুসনাতের নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছে। বদ্ধ কক্ষে আদিমখেলায় মত্ত নরনারীর মাঝে শুধু শ্বাসের শব্দটুকুই জীবন্ত।
সকাল বেলা ইরহানের ঘুম ভাঙ্গার আগে নিজেকে প্রস্তুত করে ফেললো হুসনাত। বাহিরে বের হতেই হুদ একটা ঔষধির বাটি এগিয়ে বললো,
"এটা খেয়ে নাও, হুজুরের আদেশ"
হুসনাত কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো বাটিটার দিকে। স্মিত স্বরে শুধালো,
"এটা কি? বিষ?"
"না না, বিষ নয়। জন্মনিরোধক"
হুসনাত বুঝলো এর অর্থ, ইরহান তার গর্ভে নিজের ঔরসজাত সন্তান চায় না। হুসনাত হাসলো। তার হাসিতে অদ্ভুত উপহাস। মৃদু স্বরে বললো,
"আপনার হুজুরকে বলবেন চিন্তা না করতে। আপনার হুজুর চাইলেও আমি মা হতে পারবো না।"
·
·
·
চলবে..........................................................................