তাবাসসুম ঘরদোর আটকিয়ে পড়তে বসেছে৷ এদিকে তনু শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঘরের দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে। যেন ভেঙে ফেলার নিয়ত করেছে। তাবাসসুম আর বসে না থেকে গিয়ে দরজা খুলে দিল৷ তনু মিটিমিটি হেসে ভিতরে ঢুকল। বলল—
“কিরে কি করছিলে?”
তাবাসসুম ভ্রু কুঁচকিয়ে, মেকি রেগে বলল—
“পড়ছিলাম। তোর জ্বালায়তো সেটাও শান্তিতে করতে পারছি না।”
“শাফান ভাইয়েরা চলে গেছে জানো?”
“জানবো না কেন? ফুফু তো আমাকে বলেই গেল।”
“শাফান ভাই বলে যায়নি?”
“নাহ।”
ভালো আছি নাকি? সেটাই কোনোদিন শাফান ভাই তাকে জিজ্ঞেস করলো না। আর চলে যাবেন, সেটা নাকি তাকে বলে যাবে। মানুষ আর পেলো না তার বোন।
তনু এবার মন খারাপ করে বলল—
“ওহ! সত্যি বলে যায়নি?”
তাবাসসুম চোখ বাকিয়ে তাকালো বোনের পানে। জহরি চোখে বোনকে দেখে বলল—
“তোর ব্যাপার কি? এই মিটিমিটি হাসছিস, আবার এই মন খারাপ করছিস? হুম?”
তনু বিছানায় বসে হাসিমুখে বলল—
“ব্যাপার তো অনেক কিছুই ঘটল রে। তুমি তো শুনলা না। শুনলাম তো আমি।”
তাবাসসুম এবার তনুর পাশে গিয়ে বসল। কৌতুহলী স্বর নিয়ে বলল—
“কি ঘটেছে রে?”
“ঘটেনি তবে ঘটবে। বিয়ে ঘটবে।”
“কার বিয়ে?”
পরক্ষণেই তাবাসসুমের কিছু মনে হতেই একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠে বলল—
“এই ফুফু আবার তার কোনো ভাগনি, ভাস্তির সাথে ওই ঝগড়ুটে কচুর বিয়ে ঠিক করেনি তো?”
তনু ভ্রু কুঁচকে বলল—
“ঝগড়ুটে কচু আবার কে?”
তাবাসসুম মুখ বাকিয়ে বলল—
“আপনার রুশান ভাই।”
তনু ফিক করে হেঁসে উঠল। ঝগড়াটে কচু৷ কচু আবার ঝগড়া করে নাকি? কচু তো উদ্ভিদ। সে তো ঝগড়া করতে পারেনা৷ তার বোন কি তা জানেনা? নাহলে কচুকে কেউ ঝগড়াটে বানায়?
“হাসছিস কেন? চুপ কর।”
তাবাসসুমের ধমকে তনু চুপ হয়ে গেল। মুখে আঙুল দিয়ে বলল—
“আচ্ছা হলাম চুপ। তবে রুশান ভাইয়ের কেন বিয়ে ঠিক হবে? আর ফুফু রুশান ভাইয়ের বিয়ের কথা উঠালেও, রুশান ভাই কি ফুফুর পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে করবে নাকি? রুশান ভাই তো একজনকে ভালোবাসে। সেই মেয়ের থেকে শতগুণে সুন্দরী ধরে এনে দিলেও সে বিয়ে করবে না৷ কত লয়াল রুশান ভাই দেখেছো?”
তাবাসসুম কেঁশে উঠল। অবাক স্বরে বলল—
“ওই লোকের মতো ঝগড়াটেরও গার্লফ্রেন্ড আছে? বেচারী না জানি কত বিপদে আছে? ভাবতেই কষ্ট লাগছে আমার।”
“কষ্টে থাকবে কেন? রুশান ভাই কত লয়াল দেখেছো? নিশ্চয়ই সেই মেয়ে ভাগ্যবতী। ভাইয়ার কাছে কতবার জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটা কে? বলল, এটা নাকি সিক্রেট। বিয়ের সময় দেখতে পারবে।”
তনু মুখ ফুলালো। তাবাসসুম তনুর দিকে তাকালো। তার মা আর বোনের সাথে ওই লোকটার এত মিল কিসের জন্য থাকবে? ঝগড়াটে লোক একটা। নিশ্চয়ই তার মা আর বোনের কানে তার নামে বাজে বাজে কথা বলে। তাইতো ওই ঝগড়াটের কথা উঠালেই তার মা, বোন তার উপর ক্ষেপে যায়। বেয়াদব লোক একটা।
তাবাসসুম চাপা স্বরে বলল—
“ওই ঝগড়াটে লোকের কথা বাদ দিয়ে। এখন বল কার বিয়ে?”
তনু এবার উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল—
“শাফান ভাইয়ের।”
তাবাসসুম অবাক কন্ঠে বলল—
“শাফান ভাইয়ের বিয়ে? কই ফুফু তো আমাকে কিছু বললো না। আর কার সাথে বিয়ে?”
তনু এবার মিটিমিটি হাসলো। বলল—
“সেটা সিক্রেট। বিয়ের দিন দেখতে পাবে কার সাথে বিয়ে।”
বলেই তনু বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার মটু-পাতলু শুরু হয়েছে। তাবাসসুম পিছন থেকে ডাকল তনুকে। তনু শুনল না। সে এক দৌড়ে ফু।
তাবাসসুম ওভাবেই বিছানায় বসে রইল। শাফান ভাইয়ের বিয়ে? কিন্তু কার সাথে?
—————
মুনায়া বেগম, তাবাসসুম আর তনু আজকে শপিং করতে বেরিয়েছে। আর মাত্র কয়েকদিন আছে ঈদের। তনুর জোরাজুরিতে আজকে তাদের শপিং করতে আসতে হলো। তার ধারণা, আগে আগে শপিং করতে না আসলে, তার ভাগ্যের জামাখানা অন্য কেউ নিজের করে নিবে৷ তখন সে সারা মার্কেট ঘুরেও সেই জামা পাবে না। তাই সাতদিন আগেই সে মার্কেটে নিজের জামা খুঁজতে এসেছে। তনু পুরো দু'টো দোকান ঘুরেও তার কোনো জামা পছন্দ হলো না৷ তৃতীয় দোকানে এসে জামাগুলো দেখে, তার মন খারাপ হয়ে গেলো। তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে বলল—
“আমার ভাগ্যের জামা এখনো বোধহয় মার্কেটে আসেনি। বুঝলে?”
তাবাসসুম মুখ বাঁকিয়ে বলল—
“বাড়ি থেকে তো খুব লাফালি। তোর ভাগ্যের জামা অন্য কেউ নিয়ে সবে। ব ল দ কোথাকার।”
“তুমি আমাকে বলদ বলে ইনসাল্ট করতে পারো না।”
“তাহলে কি বলে ইনসাল্ট করবো বলে দে?”
তনু মুখ ফুলালো। পরক্ষণেই কিছু মনে হতে বলে উঠল—
“এই চল এবার ঈদে আমরা দুজন একরকম শাড়ি কিনি?”
তাবাসসুম বোনের দিকে তাকালো। নাকচ করে বলল—
“আমি শাড়ি পড়ে থাকতে পারি না।”
“আমার জন্য একটা দিন থাকতে পারবা প্লিজ আপু? প্লিজ?”
“বললাম তো।”
“প্লিজ?”
“কি শুরু করেছিস তোরা দুটো?”
মাঝখান থেকে মুনায়া বেগমের কন্ঠে দুজনই মুনায়া বেগমের পানে তাকালো। তাবাসসুম বলল—
“তোমার মেয়ে আমাকে শাড়ি কিনতে বলছে। সেও কিনবে ম্যাচিং করে।”
“তো কিন। আমিও তোদের মাথে ম্যাচিং করে কিনবো তাহলে। তিন মা মেয়ে এবার একরকম সাজবো। কি বলিস?”
তনু খুশি হয়ে বলল—
“ইয়েস।”
তাবাসসুম ঠোঁট উল্টালো। হতাশ স্বরে বলল—
“মা তুমিও?”
“হ্যাঁ আমিও। এবার শাড়ি চুজ কর তোরা।”
তনু উৎসাহ নিয়ে বলল—
“আমি চুজ করছি মা।”
তনু দোকানদারকে শাড়ি দেখাতে বলল। মুনায়া বেগমও এগিয়ে গেলেন। তাবাসসুম মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এমনিতেই কেউ তাকে বলছে না শাফান ভাইয়ের সাথে কার বিয়ে? তার মা জননীও বলছেন না। আবার ঈদের মধ্যেও নাকি তাদের ইচ্ছেতে শাড়ি পড়ে প্যাকেট হতে হবে। তার দিনগুলি কি অনেক খারাপ কাটছে?
মুনায়া বেগম মেয়েকে ডাকলেন শাড়ি দেখানোর জন্য। তাবাসসুম একবার ভাবলো যাবে না। পরক্ষণেই মা আর বোনের হাসি আনন্দ মুখ দেখে নিজেও হেসে পা বাড়ালো সেদিকে। কয়েক পা ফেলতেই কারো পায়ের সাথে ধাক্কা লেগে তাবাসসুম উলটে পড়ল ফ্লোরে। তৎক্ষণাৎ দোকানে অবস্থানরত ছোটদের খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ তাবাসসুমের কানে এলো। তারা বোধহয় তাবাসসুমের পড়ে যাওয়াতে বেশ আনন্দ পেয়েছে। সাথে বড়দের চাপা হাসির শব্দ কানে আসতে তাবাসসুম মুখ উঠালো। আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ থাকেন যারা কোনো লজ্জিত ব্যক্তিকে আরও খানিক অপমান করতে, লজ্জা দিতে মুখিয়ে থাকেন। তাবাসসুম ভাবলো এদের কয়েকটা কঠিন বাক্য শোনাবে। সে তো এখানে সার্কাস দেখাচ্ছে না। যে হাসবে তারা। হঠাৎ কারো পায়ের সাথে বেঁধে পড়ে গেছে এই যা।
কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে পিছনে ফিরতে তার পিছনে রুশানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাবাসসুমের বুঝতে বাকি রইল না, কাজটি হঠাতের নয়, বরং ইচ্ছাকৃত তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে এতগুলো লোকের সামনে। যেন সে অপমানিত, লজ্জিত হয়। তাবাসসুমের চোখজোড়ায় রাগে লাল হলো এবার। রাগের দরুণ চোখের কোণে চিকচিক করে উঠল অশ্রুজল। হাসতে থাকা লোকদের আর কিছু বলা হলো না তার। তাবাসুম ফ্লোর থেকে উঠে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে।
·
·
·
চলবে……………………………………………………