শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ২৬ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলাম আমি আজ যখন মীরাকে আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম! তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মাঝে মীরা দাঁড়িয়ে ছিল। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, যেভাবেই হোক ও জেনে এসেছে এটা আমার বাসা। তার মানে আমার কাছে এসেছে। কিন্তু এত বছর পর আমার কাছে কেন এলো? সঙ্গে একটি মেয়ে ছিল, সম্ভবত ওর কাজিন। ওই মুহূর্তে যার সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল মীরা। ওই সুযোগে আমি বাড়িতে ঢুকে যেতে পারতাম। ও আমাকে দেখতোও না। কিন্তু আমি পারলাম না। এত কাছ থেকে ওকে দেখে আমি আউলে গিয়েছিলাম। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে কি সুন্দর যে লাগছিল ওকে! মনে হচ্ছিল প্রতিটি বৃষ্টির কণা ওকে ছুঁতে পেরে মুখরিত আজ!

সঙ্গে ছাতা না থাকায় আমিও ভিজে গিয়েছিলাম। সেই অবস্থাতেই এগিয়ে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বললাম। উত্তেজনায় আমি যে কী কী বলেছি আমার এখন মনেও নেই। নিজেকে যথাসম্ভব হাসিখুশি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার কোনো প্রশ্নের কোনো উত্তর মীরা দিল না। সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর অবাক করে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

মাথার ওপর বৃষ্টি, বুকে আমার মীরা। আর কি কিছু লাগে? ৯ বছর ধরে বুকে জ্বলতে থাকা আগুন নিভে গেল এক পলকের সুখে। আবেশে আমার চোখদুটো বন্ধ হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য আমি পুরো দুনিয়া ভুলে গেলাম। সবকিছুকে তুচ্ছ করে আমি শুধু ওই মুহূর্তটা অনুভব করতে চাইছিলাম। আমি অবশ্য ওকে জড়িয়ে ধরিনি কিন্তু খুব ইচ্ছে করছিল ধরি। কিন্তু তাতে যে আমার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায়!

আমি জানি এই সুখ চিরস্থায়ী না, এই সুখের যোগ্য মালিকও আমি নই। সেই মুহূর্তেই লক্ষ করলাম, মীরা কাঁদছে। নিজেকে আর গলতে দিলাম না। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বললাম। সরিয়ে দিতে চাইলাম। কাজ হলো না। অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরেছিল। শেষপর্যন্ত কী কী বলে ছাড়িয়েছি কিছু খেয়াল নেই। কোনোভাবে ছাড়িয়ে ওদের বাসায় নিয়ে এলাম। আমি আসলে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কী হচ্ছে না হচ্ছে-কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি বেশ কয়েকবার মীরাকে দেখতে গিয়েছি। দূর থেকে দেখে চলে এসেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘোরে আমি কখনো পড়িনি। হয়তো কখনো মীরা এতটা কাছে আসেনি বলেই।

ঘোরে মীরাও পড়েছিল। তাইতো সেও অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারেনি। আমি তাও টুকটাক কথা চালিয়েছি, ও সেটাও পারেনি। অথচ ওর কাজিন বলল ওরা আমাকে খুঁজতে এসেছিল। আমাকে খুঁজতে এসেছে অথচ পাওয়ার পরে কোনো কথা নেই! শুধু বলল, আমার সঙ্গে ওর অনেক কথা আছে, একদিন সময় দিতে। আর কিছুই বলতে পারল না। আমি জানি ওর। মনে হাজারো প্রশ্ন। এবং সেসবের উত্তর এখন আমাকে দিতেই হবে। আমি অবশ্য উত্তর দিতে প্রস্তুত আছি।

ওর এই ঘোরের কারণেই একটা ব্যাপার পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেল যে ও এখনো আমাকে আগের মতোই ভালোবাসে। নিজেকে সেই মুহূর্তে একইসঙ্গে ভাগ্যবান এবং দুর্ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। ভাগ্যবান মনে হচ্ছে পাগলিটা আমাকে এখনো পাগলের মতোই ভালোবাসে তাই। দুর্ভাগ্যবান মনে হচ্ছে সেই ভালোবাসা আজও আমি দু হাতে গ্রহণ করতে পারব না তাই।

বহুদিন পর আজ রাতের ঘুম হারিয়ে গেল আমার! এত ক্লান্তির পড়েও ঘুমাতে পারছি না।

রাফসান শিকদার
০৬ জুলাই, ২০১৯

আজ মীরা দেখা করতে চাইল, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে। ওর ইচ্ছেমতো সেখানেই দেখা করে এলাম। মীরার সব প্রশ্ন ছিল আমার হারিয়ে যাওয়া বিষয়ক। মীরা তখন নাবালিকা এবং বোকা ছিল। কিন্তু এখন সাবালিকা এবং বেশ বুদ্ধিমতী। এখন ওর সঙ্গে কথায় পারা মুশকিল। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তখনকার পরিস্থিতিটা ওকে বোঝানোর। মীরা হয়তো বুঝেছে। কিন্তু আমি অবাক হলাম এটা জেনে যে ও নাকি এই ৯টা বছর ধরে আমাকে খুঁজেছে। এমনকি আমার বাড়ি খুঁজতে নাকি ব্যাংক টাউন পর্যন্তও এসেছে কিন্তু রাস্তা চিনে বাড়ি খুঁজে বের করতে পারেনি। আরো বেশি অবাক হলাম এটা জেনে যে ও এখনো আমাকে চায়! আমার আফসোস যে আরো বেড়ে গেল বকুল। সেই পাগলপারা ভালোবাসা যে এখনো অটুট কিন্তু তা গ্রহণ করার সামর্থ্য আমার নেই। বিধাতা কেন আমাকে এমন অসহায় পরিস্থিতিতে ফেললেন? বারবার কেন আমার ভালোবাসাকে দু হাতে ঠেলে সরিয়ে দিতে হয়? এই এক ভালোবাসায় আর কত পুড়তে হবে?

রাফসান শিকদার
০৮ জুলাই, ২০১৯

আচ্ছা যদি তখন মীরা বাড়ি চিনে চলে আসতে পারত তাহলে আমি কী করতাম? তখনো কি আমি পারতাম ওকে ফিরিয়ে দিতে? নাকি জীবনটা অন্যরকম হতো? সেই অন্যরকমটা আসলে কেমন? অভাব আর সমস্যার সম্মুখীন হতে হতে কি তিক্ততায় ভরে যেত দুজনের মন? নাকি একই কারণে দুজনে আরো আপন হয়ে যেতাম? জানি না তবে এটুকু জানি মীরা ভালো থাকত না। আর এই সম্পর্ক কোনো পরিণতি পেত না শুধু পালিয়ে বিয়ে না করলে। কোনো বাবার মেয়েকে তার থেকে চুরি করে আনা আমার পক্ষে তো সম্ভব না। আমার বাবা যে ভুল করেছে সেই ভুল আমি করব না। যদি কখনো বিয়ে করি আর বাবা হই তাহলে এমনভাবেই করব যাতে আমার সন্তানরা যেকোনো বিপদে দুই পরিবারের সহায়তা পায়।

রাফসান শিকদার
০৮ জুলাই, ২০১৯

মীরা প্রায় প্রতিদিন ফোন করে কেন আমাকে? ও কি সত্যিই এখনো আমাকে পাওয়ার আশা করে? তাহলে তো বলতে হবে ও এখনো বোকাই রয়ে গেছে।

আমি মনে-প্রাণে চাই ও আমাকে আর ফোন না করুক। আমার থেকে দূরে থাকুক। যখন ফোন করে বাধ্য হয়েই ইগনোর করতে হয়। ওকে ইগনোর করতে আমার অনেক কষ্ট হয়। সেই পুরনো কষ্ট! প্রতিমুহূর্তে ভয় হয়! কখন না আবার লোভে পড়ে আত্মসমর্পণ করে ফেলি!

রাফসান শিকদার
২৫ জুলাই, ২০১৯

মীরা আজ আবার এসেছিল দেখা করতে। এবার এলো দোকানে। মেয়েটা যে কী পাগলামি শুরু করেছে! আজ আমাকে কথার প্যাঁচে ফেলে স্বীকার করিয়ে ছাড়ল যে আমি এখনো ওকে ভালোবাসি। ভালোবাসলে বাসি। তাতে কার বাপের কী? আমি কাকে ভালোবাসব কতদিন ধরে ভালোবাসব সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ ব্যাপারে কাউকে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই!

রাফসান শিকদার
১২ আগস্ট, ২০১৯
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp