মাত্র চার দিন আগেই গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ। আমি মীরাকে পেলাম। সারাজীবনের জন্য লিখিতভাবে পেলাম। মীরাও এখন এই ঘরের একজন সদস্য। ওকে ফাঁকি দিয়ে তোকে লিখতে বসতেই পারিনি এ কদিন। জানিস বকুল, আমি এক প্রস্ফুটিত ফুলের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু পেয়ে গেছি এক বুনোফুল। এই বুনোফুলকে যত্ন করে সামলাতে হয়। ভাবতেই অবাক লাগে আমার সেই নিষিদ্ধ ইচ্ছেগুলো এখন বৈধ। এখন আমি যেকোনো সময় ঝড় তুফান নামিয়ে ফেলতে পারি আমার মীরাতে। কিসব যে লিখছি! মাথা খারাপ হয়ে গেছে সম্ভবত। আজ বাদ দিই। পরে আবার কথা হবে। ভালো থাকিস প্রিয় বকুল।
রাফসান শিকদার
১১ ডিসেম্বর, ২০১৯
বউ একটা পেয়েছি। সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। এক সময় আমার দিকে তাকাতো না বলে আমার কত আফসোস ছিল। আর এখন এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যে আমারই লজ্জা লাগে। আজ জিজ্ঞেস করলাম,
এমন ড্যাবড্যাব করে তাকাও কীভাবে?
মীরা বলল,
তুমি এত সুন্দর আমি কী করব?
আমি হেসে বললাম,
৯ বছর আগে সুন্দর ছিলাম না?
৯ বছর আগে তো তোমাকে পাওয়ার এমন তৃষ্ণা ছিল না। কিছু বোঝার আগেই প্রেম হয়ে গেছে। কিছু বোঝার আগেই হারিয়ে ফেলছি। আর এখন তো সব বুঝ হওয়ার পর পেয়েছি।
৯ বছর কষ্ট করলেও এখন নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান বলে মনে হয় বকুল। তোর কী মনে হয় বল তো?
রাফসান শিকদার
১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯
মীরাকে ঘামতে দেখলে আমার ইচ্ছে করে দুনিয়া থেকে ইলেকট্রিসিটি তুলে দেয়া হোক। গরমে যখন চুলগুলোকে মাথার ওপর তুলে একটা এলোমেলো খোঁপা করে, মুখটা লাল হয়ে যায়… এত সুন্দর লাগে ওকে! কপাল আর ঘাড় বেয়ে নেমে আসা ঘামের ফোঁটাগুলো আরো সুন্দর করে তোলে ওকে। তারচেয়েও সুন্দর প্রচণ্ড গরমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যখন উফ করে ঘাম মুছে ফেলে সেই দৃশ্যটা। কিন্তু বেচারির গরমে কষ্ট হবে ভেবে আবার শান্ত থাকি। নাহলে কবেই আমি ইলেকট্রিসিটির গুষ্টি উদ্ধার করতাম।
রাফসান শিকদার
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
এই অংশটা পড়ে মীরা একটু লজ্জা পেল। রাফি তাকে কখনো এভাবে খেয়াল করেছে বলে সে মনে করতে পারে না। অথচ করেছে। এই ছেলেটা এত বেশি গুপ্ত যে ওকে বোঝাই যায় না। মীরা আবার পড়তে শুরু করল।
প্রিয় বকুল,
আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুই আবার আমাকে ভুল বুঝিস না। ভাবিস না যেন দুঃসময়ের বন্ধু ছিলি একা তুই। আর এখন সুসময়ে তোকেই ভুলে যাচ্ছি। যদিও জানি তুই এমন ভাববি না। অনেক লম্বা সময়ের বন্ধু তুই আমার। সবচেয়ে কাছের বন্ধু, বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি কখনোই চাই না তোকে বলা কথাগুলো মীরা জানুক। ও যেহেতু এখন এই ঘরেই থাকে তোকে এখানে রাখাটা বিপজ্জনক। তাই তোকে আর সঙ্গে রাখতে চাচ্ছি না। গত পরশুদিন মীরা লিখতে দেখে ফেলেছে। হিসাব বলে চালিয়েছি। কিন্তু লুকিয়ে ফেলেছি বলে ও সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে। সেই বোকা মীরা তো নেই আর। সেয়ানা হয়ে গেছে। তাই তোকে নিরাপদ জায়গায় রাখছি। এত বছর তুই নিঃস্বার্থভাবে আমার সব কথা না শুনলে আমি হয়তো দম ফেটে মারা যেতাম! কোনো মানুষের সঙ্গে সুখ-দুঃখের সব কথা শেয়ার করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল, এখনো আছে। তোর কাছে আমি চিরঋণী। এই ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই। সঙ্গে না থাকলেও তুই আমার অন্তরে থাকবি। তোকে আমি অনেক ভালোবাসি বকুল। ভালো থাকিস তুই। খোদা হাফেজ।
রাফসান শিকদার
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
এরপর পুরো ডায়েরিতে আর একটি লাইনও লেখা নেই। মীরা ডায়েরিটি বন্ধ করে তাতে একটা চুমু খেল। এরপর বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। মনে হতে লাগল তার অবর্তমানে এই ডায়েরিটিই রাফিকে আগলে রেখেছিল। রাফির কষ্টের কথাগুলো মনে পড়ে সে আবারও কেঁদে ফেলল। ঠিক সেই সময়ে রাফি ঘরে ঢুকল। মীরাকে বকুল নামক সেই ডায়েরিটি নিয়ে বসে কাঁদতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেল। আতঙ্কে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। যে ভয়ে বকুলকে এতবছর দূরে সরিয়ে রাখল তাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো! কিন্তু মীরা ডায়েরিটি পেল কীভাবে! মীরা ডায়েরি রেখে সামনে এসে কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
তুমি মীরাপুকে চুমু খেয়েছো কেন?
রাফি অবাক হয়ে বলল,
আরে কিসের চুমু? কী বলে না বলে!
ডায়েরিতে লিখেছো তুমি। তোমার জ্বরের সময়…
মীরাকে কথা শেষ করতে দিল না রাফি। বলল,
“আরে আমি করিনি, ও করেছিল। আর ওটাকে চুমু বলে না। জাস্ট এক সেকেন্ডের টাচ। তুমি এখন ওইজন্য কাঁদছো নাকি?
মীরা ক্ষেপে গেল,
তুই ওই এক সেকেন্ডের টাচ করতে দিবি কেন? আর এত খুশিই বা হবি কেন?
কি বলে না বলে পাগলের মতো। তখন তো ও আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল। তখনকার জন্য ওটাই স্বাভাবিক ছিল।
তো আমি তোর গার্লফ্রেন্ড ছিলাম না? আমাকে জীবনেও করছিস?
রাফি হেসে বলল,
অগণিত। হিসাব নেই।
সেটা তো বিয়ের পরে। প্রেমের সময় তো জীবনেও করিস নাই। অথচ এক্স গার্লফ্রেন্ডকে করে একদম গদগদ। কতবড় সাহস!
রাফি এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
ওটা যখনকার ঘটনা তখন ও আমার এক্স ছিল না। তা ছাড়া ও অনেক এডাল্ট ছিল। তুমি তো বাচ্চা ছিলে।
চুপ।
ধমক দিল মীরা। রাফি এবার সিরিয়াস হয়ে বলল, আরে বাবারে বাবা। আমার ডায়েরি অনুমতি ছাড়া পড়েছে এজন্য কোথায় আমি একটু বকা দেব তা না উলটো তুমি বকছো আমাকে। উলটো দুনিয়া! কেয়ামত সন্নিকটে বুঝতে পারছ?
মীরা রাফিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
এত কষ্ট করেছ অথচ আমাকে বুঝতে দাওনি! এত ভালোবাসো সেটাও তো কখনো বুঝতে দাওনি। এমন কেন তুমি?
রাফি এবার ধরতে পারল কান্নার আসল কারণ। সে মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
কী করব আল্লাহ এমন করে বানিয়েছেন।
মীরা রাফির মুখটা ধরে বলল,
ওই ৯টা বছর আমি যা কষ্ট করেছি তারচেয়ে অনেক বেশি কষ্ট তুমি করেছ রাফি। এই ডায়েরিটা না পড়লে কখনো জানতে পারতাম না।
সব জানলেই তো রহস্য শেষ। এই যে আমার সব দুর্বলতা জেনে গেলে এটা কী কোনো ভালো কথা হলো?
মীরা হেসে বলল,
বকুলকে হিমির কথা বলবে না?
বলব। হিমি জন্মানোর পর থেকেই ভাবছি বলব। কিন্তু তোমার আড়ালে সুযোগ করে উঠতে পারিনি।
এখন বলে দিও। আবার নিয়মিত কথা বলো ওর সঙ্গে। একটা নির্দিষ্ট ড্রয়ারে তালাবন্ধ করে রাখো। চাবি থাকবে শুধু তোমার কাছে। সুযোগ হলেও আমি কখনো পড়ব না। আমার যা জানার ছিল তা জানা হয়ে গেছে। কিন্তু বকুল ফলস সিলিংয়ে বস্তাবন্দি হয়ে থাকাটা ডিজার্ভ করে না। তোমার কাছে থাকাটা ডিজার্ভ করে।
—————
রাফি সেদিন রাতেই ডায়েরি লিখতে বসল। প্রিয় বকুল, কেমন আছিস? ভালো তো? এতদিন ফলস ছাদে বন্দি থাকতে কষ্ট হয়েছে? কী বললি মানুষের মতো কষ্ট নেই তোদের? তাহলে তো তোরা ভীষণ সৌভাগ্যবান। এতদিন তোকে না লিখলেও ফলস ছাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তোর সঙ্গে মনে মনে কথা কিন্তু বলেছি। তুই কি শুনতে পেয়েছিস?
জানিস আমার এখন একটা পুতুল আছে। জ্যন্ত পুতুল। আমাকে বাবা বলে । ডাকে। পুতুলটার নাম রেখেছি হিমি। হিমি কী করে জানিস?
·
·
·
রাফি ও তার বকুলের গল্প চলবে অবিরাম..................................