শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ২৮ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          আজ দুপুরবেলা আমি যে খবরটা পেলাম সেটা প্রথমে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। যখন বিশ্বাস হলো তখন আমার মনে হলো আমার এক্ষুণি ধামরাই যাওয়া প্রয়োজন। আমি নিশ্চিত ছিলাম না এই পরন্ত বিকেলে ধামরাই থানায় গিয়েই শান্তনা কে পাব কি না। ও ব্যস্ত মানুষ। তবে থানায় না পেলেও কোয়ার্টারে পেলাম। থানার লোক আমাকে ওর কোয়ার্টার দেখিয়ে দিল। দরজা খুলে আমাকে দেখে শান্তনা একটা চিৎকার দিল,

রাফি! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুই আমার বাসায় এসেছিস?

আমি হেসে বললাম,

কি অসামাজিক আচরণ! এতদূর থেকে এসেছি বসিয়ে চা-পানি দিবিতা দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস!

ও সরে দাঁড়িয়ে বলল,

সরি ভেতরে আয়।

শান্তনা উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছিল না। পাগলের মতো কিসব যে বলছিল! আমি ড্রয়িংরুমে বসে ওর শান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এর মধ্যে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল,

মা কে এসেছে?

শান্তনা কেমন আমতা আমতা করছিল। আমি ওর মেয়েকে বললাম,

আমি তোমার একটা মামা।

শান্তনা এ কথায় প্রচণ্ড লজ্জা পেল। হাসিও আটকাতে পারছিল না। ওর মেয়ে বলল,

কিন্তু আমি তোমাকে আগে কখনো দেখিনি।

শান্তনা বলল,

ও তোমার রূপ খালামণির ভাইয়া।

সেতো রাহি মামা।

ও রাহির বড় ভাই। ওর নাম রাফি।

আই সি।

এরপর মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

রাফি মামা আমি রূপ খালামণির কাছে তোমার নাম শুনেছি। কিন্তু কখনো দেখিনি তো তাই ভুলে গিয়েছিলাম।

আমি হেসে বললাম,

কোনো সমস্যা নেই মা।

ঠিকাছে আমি এখন খেলতে যাচ্ছি। তুমি থাকো পরে কথা হবে।

মেয়ে চলে গেলে শান্তনা বলল,

তুই কি কোনো বিশেষ কারণে এসেছিস?

হ্যাঁ তোকে ধন্যবাদ এবং ক্ষমা দিতে এসেছি।

ক্ষমাটা বুঝলাম কিন্তু ধন্যবাদ কেন?

কারণ মীরাকে আমার ঠিকানা তুই দিয়েছিস। থ্যাংক ইউ সো মাচ।

কিন্তু এখানে তো আমার কোনো ক্রেডিট নেই। মীরা নিজেই চাচ্চুকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছিল। ও এসে চেয়েছে বলেই দিয়েছি। তেমন কিছুই তো করিনি।

হ্যাঁ ও এসেছিল কিন্তু ধর তুই যদি ঠিকানা না দিতি তাহলে তো ও আমাকে পেত না। অবশ্যই তোর ক্রেডিট আছে। তুই এতবার ক্ষমা চাওয়ার পরেও আমি তোকে ক্ষমা করতে পারিনি। কিন্তু এবার তুই যা করেছিস তা জানা মাত্র ক্ষমা আপনা আপনি চলে এসেছে।

আল্লাহ বাঁচিয়েছে। অবশেষে ক্ষমা পেলাম।

হ্যাঁ একদম মন থেকে।

কত ভালোবাসিস ওকে!

তোর তো অবাক হওয়ার কথা? আমার ভালোবাসা সম্পর্কে তোর চেয়ে বেশি কারো জানার কথা নয়।

দুটো ভালোবাসায় আকাশ পাতাল তফাৎ। আমার পরেও তুই আবার কাউকে ভালোবাসতে পেরেছিস কিন্তু ওর পর তো আর কেউকে ভালোবাসতে পারিসনি।

সেটা আমার ভালোবাসার কারণে নয়। ওর ভালোবাসার কারণে। যে শুদ্ধ এবং তীব্র ভালোবাসা ও আমাকে দিয়েছে তার পর মন আর নড়াতে পারিনি। বিচ্ছেদ আমার দোষে হয়েছে। ওর কিছু দোষ যদি থাকত তাহলে ভুলে যাওয়া সহজ হতো।

বললি ক্ষমা করে দিয়েছিস তারপর আবার খোটাটা ঠিকই দিলি।

না না ভুল বুঝিস না। আমি কথার প্রসঙ্গে কথাটা বলেছি। তোকে ইঙ্গিত করে বলিনি। আমি যদি ক্ষমা না করতাম তাহলে তোর বাসায় এসে সামনে বসে কথা বলতাম না।

রাফি আমি এখন বেশ সুখী মানুষ। কিন্তু এই একটা কষ্ট আমার ভেতর ছিল যে তোর সঙ্গে আমি অন্যায় করেছি। অনুতপ্ত হওয়ার পরেও ক্ষমা পাইনি। কিন্তু আজ থেকে সব কষ্ট মুছে গেল।

আরে হ্যাঁ, তোর খবর শুনে তো আমি অবাক হতাম। আজকে দেখে আরো বেশি অবাক হলাম। কেমন লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে একজনের সঙ্গে এতবছর ধরে সংসার করছিস। আবার এক মেয়ের মা।

শান্তনা হেসে বলল,

আমার মতো লাফাঙ্গা মেয়ের সম্পর্কে এরকম খবর শুনলে অবাক হবারই কথা। কিন্তু বিশ্বাস কর মেয়েটা হবার পর আমি হঠাৎ কেমন বদলে যেতে লাগলাম। এর আগ পর্যন্ত সংসারে আমার মন ছিল না।

আমি হেসে বললাম,

ভাগ্যিস বদলালি।

শান্তনাও হাসল। এরপর আমি ওকে আমাদের বিয়ের কার্ড দিলাম। কার্ড পড়ে সে পুরোনো ঢঙে বলল,

আমার বিয়েতে তো তুই আসিসনি। তোর বিয়েতে কেন যাব?

আমি হেসে বললাম,

তখন তোর প্রতি আমার ঘৃণা ছিল। তার ওপর ওই সময়টা বলতে গেলে আমি দুনিয়ার বাইরে ছিলাম। সেই সময়ের সঙ্গে এখনকার তুলনা চলে না।

হ্যাঁ একটা ঈদেও তো তোকে দাদাবাড়িতে দেখা যেত না। কীসের এত অভিমান তোর সবার ওপর বল তো? চাচ্চু মারা যাবার পর আত্মীয়স্বজন একদম ভুলেই গেলি!

বাপ-চাচাঁদের নির্মম ব্যবহারের কথা শান্তনার শুনতে এবং আমার বলতে ভালো লাগবে না। তাই এড়িয়ে গেলাম। চা খেতে খেতে শান্তনার স্বামী অফিস থেকে ফিরে এলো। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আবারও অবাক হলাম। কি অমায়িক ব্যবহার! সাচ আ জেন্টলম্যান। ভালো লাগল।

কারো প্রতি রাগ ঘৃণা পুষে রাখার মধ্যেও একটা সূক্ষ্ম কষ্ট আছে। আজ এতবছর পর ওকে ক্ষমা করে দিতে পেরে আমার নিজেরও ভালো লাগছে।

রাফসান শিকদার
০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

যে বউ আমার কপালে জুটতে চলেছে, ব্যবসা লাটে উঠবে। প্রতি শুক্র-শনি অর্থাৎ তার ছুটির দিনে সে দোকানে এসে হাজির। দোকানের ছেলেরা তাকে ভাবি ভাবি বলে ডাকে এতে নাকি সে অত্যাধিক আনন্দ পায়। আমিও অবশ্য মঙ্গলবার অর্থাৎ আমার ছুটির দিনে তার অফিস ছুটির সময় অফিসের সামনে হাজির হই।

শপিংয়ে একদম আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও তার সঙ্গে আমাকে বিয়ের শপিংয়ে যেতে হয়। বিরক্তি লুকিয়ে দোকানের সব শাড়ি এক লাগার পরেও আন্দাজে পছন্দ করে দিই। কারণ আমাকেই নাকি পছন্দ করে দিতে হবে। এই যে শুরু? বাকি জীবন চেষ্টা করব এভাবেই ওর সব ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে। ৯ বছরের কষ্টের ক্ষতিপূরণ ৯ জীবনেও দেয়া সম্ভব না। কিন্তু আমাদের যেহেতু ৯ জীবন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই এক জীবনই তার নামে লিখে দিলাম।

রাফসান শিকদার
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

এই অংশটা পড়ে মীরা হেসে দিল। ৯ জীবন লাগবে না। এই ডায়েরি পড়েই তার ৯ বছরের সব কষ্ট মুছে গেছে।
·
·
·
চলবে.....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp