কিছু মানুষের জন্মই হয় ভালোবাসা না পাওয়ার জন্য, কিছু মানুষ জন্ম নেয় ভালোবাসা পেয়ে হারানোর জন্য, আর কিছু মানুষ আছে, যারা কখনো ভালোবাসা পায়ই না। সবার বুকের ভেতরই যন্ত্রণা। সবার যন্ত্রণার মাত্রা কি সমান? নাকি কারও বেশি, কারও কম? পেট্রার লেখা বহু আগের একটা চিঠি হাতে নিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিল প্রিয়। উত্তর জানা গেল না অবশ্য।
ঘুমের ঘোরে শুদ্ধ গায়ে পা তুলে দিতেই নিকিতার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। নিকিতা শুদ্ধর পা নামিয়ে পাশ ফিরতেই দেখতে পেল প্রিয়কে। ওয়ার্ডরোবের সামনে দাঁড়িয়ে ওপরে রাখা টেবিলল্যাম্পের আলোয় কী যেন পড়ছে। চিঠি নাকি? কার চিঠি? পেট্রার? পেট্রা এখনো চিঠি লিখে ওকে? আচ্ছা বেহায়া মেয়ে তো! পরক্ষণেই ভাবল, ধুর, না জেনেই কাউকে এভাবে দোষারোপ করা ঠিক না। আধো আলোয় নিকিতা ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। চোখ পিটপিট করে দূর থেকেই প্রিয়কে খেয়াল করছে সে। কী আছে এই ওয়ার্ডরোবের ভেতরে যে প্রিয় এত যত্ন করে। চাবি কোথায় রাখে, তা একমাত্র প্রিয় ছাড়া কেউ জানে না! কিন্তু জানতে হবে নিকিতাকে।
প্রিয় ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটার পর একটা চিঠি। বের করছে। পড়া শেষ হতেই আবার রেখে দিচ্ছে। প্রিয় কি প্রতিদিন রাতে এমন করে, ও টের পায় না? নাকি শুধু আজই এমন করছে? অসহ্য লাগছে নিকিতার। এসব আর কত সহ্য করবে এভাবে? মাঝেমধ্যেই ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যেতে। কিন্তু জেদের বশে পারে না। তা ছাড়া কোথায়ই-বা যাবে? আচ্ছা, জেদ ধরে সে যে পড়ে আছে প্রিয়কে তার করেই ছাড়বে! এটা অন্ধ জেদ নয়তো? শেষ পর্যন্ত হার মানতে হবে না তো? এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে একটা ভয় যখন থাবা বসাল নিকিতার মনে, ঠিক তখনই শ্বশুরের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল, ‘তোমার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তুমি প্রিয়র স্ত্রী।
এই কথাটা মনে পড়তেই নিকিতা মনে জোর পেল। নিকিতা খেয়াল করল, প্রিয় সবগুলো ড্রয়ার লক করল, তারপর আবার চেক করল লক হয়েছে কি না! তারপর চাবিটা তার ল্যাপটপের ব্যাগের ভেতর রেখে দিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে নিকিতা ওয়ার্ডরোবের তালার চাবি বানানোর জন্য মিস্ত্রি নিয়ে এল। প্রতিটা ড্রয়ারের জন্য বানানো হলো ডুপ্লিকেট চাবি। বিকেলবেলা শুদ্ধর টিচার এলে নিকিতা শুদ্ধকে পড়তে দিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে ওপরের ড্রয়ারটা খুলল। ড্রয়ারভর্তি অসংখ্য জিনিসপত্র। বোঝাই যাচ্ছে, পেট্রার স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র সব। হঠাৎ একটা শার্টে চোখ আটকে গেল। শার্টটা নিকিতা নিজে কিনে এনেছিল। প্রিয়কে একদিন শুধু পরতে দেখেছে, তারপর আর দেখে নি। শার্টটা খুঁজে না পেয়ে প্রিয়কে জিজ্ঞেস করতেই বলেছিল, সে জানে না। অথচ এই ড্রয়ারে রেখে দিয়েছে! কিন্তু কেন এমন মিথ্যা বলল? নিকিতা শার্টটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলতেই দেখতে পেল শার্টের কলারে লিপস্টিকের দাগ! হঠাৎ নিকিতার পুরো শরীরে ঝাঁকুনি দিল। মুহূর্তের মধ্যে চোখ ভরে উঠলে জলে! প্রিয় আর পেট্রার যোগাযোগ নেই, এই কথাটা তাহলে মিথ্যে? তা নয়তো কী! প্রিয় আর যা-ই হোক, চরিত্রহীন না। এই লিপস্টিক অন্য কোনো মেয়ের নয়, পেট্রারই। তাই তো এত যত্ন! তার কিনে দেওয়া শার্টেও অন্য মেয়ের অস্তিত্ব!
কাল রাতের চিঠির কথা মনে পড়তেই শার্টটা যেভাবে ছিল, আবার সেভাবেই রেখে দিল নিকিতা। তারপর দ্বিতীয় ড্রয়ারের চাবি ঘোরাল। চিঠিটা এই ড্রয়ারেই রেখেছে প্রিয়। ড্রয়ার খোলামাত্রই নিকিতা হার্ট অ্যাটাক হতে হতেও বেঁচে গেল। এত চিঠি! এত চিঠি কত বছর বসে লিখেছে? কোনটা রেখে কোনটাই-বা পড়বে? নিকিতা চোখ বন্ধ করে একটা চিঠি তুলে নিল। তারপর ভাজ খুলে পড়তে লাগল,
‘আমার প্রিয়,
তোকে একটা কথা সামনাসামনি বলার সাহস আমি পাচ্ছি না। মানে একটা অনুরোধ, যদি তুই আপত্তি করিস, খুব কষ্ট পাব, কেঁদেও ফেলতে পারি। তাই এখানেই লিখছি…চল না শুদ্ধকে আমরা রেখে দিই। ওর প্রতি আমার অদ্ভুত একটা টান জন্মেছে। জন্মের পর ও প্রথম আমার কোলে উঠেছে। আমার আঙুল হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরেছে! কী মায়া!
জানিস, আমি প্রিয়াঙ্কা ও রায়ান ছাড়া এত ছোট বাচ্চা কখনো কোলে নিই নি। তা ছাড়া ওরা তো আমার ভাই-বোন, আর আমিও ছোট ছিলাম। বড় হওয়ার পর এই প্রথম এত ছোট বাচ্চা কোলে নিলাম। জানিস, কেমন একটা মা মা অনুভূতি হচ্ছিল। চল না আমরাই ওর বাবা-মা হয়ে যাই? রাগ করছিস? আমাদের এখনো বিয়ে হয় নি আর আমরা কিনা বাবা-মা হব? ওসব চিন্তা বাদ দে। চেষ্টা করলে সব হবে, শুধু শুদ্ধকে দত্তক দিস না। ওই দজ্জাল দেখতে মহিলা শুদ্ধকে নিয়ে সোজা সুইজারল্যান্ড চলে যাবে, আমরা আর কোনোদিন ওর মুখটাও দেখতে পাব না। অথচ এত শুভ্রের মতো নিষ্পাপ মুখ। দেখলেই হাজারটা বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে।
ওই মহিলাটাকে দেখেছিস তুই? কেমন রুড! শুদ্ধকে কীভাবে রাখবে, তার ঠিক নেই। আমি শুদ্ধকে পালব। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। আর হ্যাঁ, এই কথাটা রাখলে তোর এমন কোনো একটা কথা আমি রাখব, যেটা তুই অনেক দিন ধরে আমার কাছে চেয়ে এসেছিস! বুঝে নে।
-তোর পেট্রা
চিঠিটা পড়ে উত্তেজনায় নিকিতার সমস্ত শরীর কাঁপছিল। শুদ্ধ তার মানে প্রিয় ও পেট্রার বাচ্চা নয়? ওদের বিয়েটাও কি তাহলে হয় নি? হঠাৎ নিকিতার খেয়াল হলো, প্রিয় যে তাদের ভালোবাসার গল্প শুনিয়েছে সেখানে তাদের বিয়ে এবং শুদ্ধের জন্মের সময়টা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেনি। কীভাবে কী হয়েছে সেটা বলে নি। আগেপিছে যা বলেছে সেখানে কতটুকু সত্যি আর কতটুকু মিথ্যা ছিল, তা নিয়েই সন্দেহ হচ্ছে এখন। সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে!
—————
পেট্রা অফিসে ঢুকে ডেস্কে বসতেই দেখতে পেল দুটো সাদা গোলাপ রাখা। স্মরণ দূর থেকে নজর রাখছিল ফুল পেয়ে পেট্রার কী অভিব্যক্তি হয়, দেখার জন্য। মেয়েটা ফুল দুটো হাতে নিল, গন্ধ শুকল। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ওর মুখটা এতই স্বাভাবিক, যেন এটা প্রতিদিনই হচ্ছে। না একটু অবাক হলো, না একটু হাসল, না সামান্য ভুরু কোঁচকাল!
ফুল দুটো কে রেখেছে, তা বুঝতে অবশ্য পেট্রার অসুবিধা হচ্ছে না। সেদিন হুট করেই স্মরণ তার মায়ের সঙ্গে কথা বলাল। হুট করে ফোন ধরিয়ে দিল, কথা না বললেই-বা কেমন দেখায়, তাই কথা বলতে বাধ্য হলো। এত ছেলেমানুষী কেন করে স্মরণ? সে আসলে কী প্রমাণ করতে চায়? স্মরণ যতই অবুঝ হোক, পেট্রা অবুঝ না। সে বোঝে তাদের বিয়ে হলে কতটা অসুখী হবে তারা। একটা না, হাজারটা কারণ দেখাতে পারবে সে। জীবনটাকে বহুভাবে উল্টেপাল্টে দেখা হয়ে গেছে। তা ছাড়া ওর নিজের মায়ের কাছেও কথা শুনতে হবে তাকে। এ জীবনে আর কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়, নয় আর একটি প্রেমও। এ জীবনে সে শুধু আরেকবার বিয়ে করবে তার মায়ের পছন্দ করা কাউকে এবং সংসার করবে। এখন জীবনটা একভাবে কেটে গেলেই হলো। ভালোবাসা দিয়ে কী হবে? ভালোবাসা বলে আসলে কিছু নেই। হয়তো প্রিয় বলে কেউ আছে, শুদ্ধ বলে কেউ আছে। যারা মানুষ কিন্তু তার জন্য নেশাদ্রব্য। কিছুতেই ছাড়া যায় না। ছাড়লে যন্ত্রণা হয় কিন্তু মৃত্যু হয় না। মাকড়সার জালে আটকে পড়া ছোট্ট পোকাদের মতো অসহায় হয়ে, দুঃসহ সব স্মৃতি নিয়ে, মুক্তির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে মানুষ নামক নেশাদ্রব্যের নেশাখোরেরা। এই নেশাখোরদের অপেক্ষার কখনো সমাপ্তি হয় না। তবে সমাপ্তি নিশ্চয়ই হয়। এই পৃথিবীতে সবকিছুরই সমাপ্তি আছে। সেই সমাপ্তির জন্যও সে এখন আর অপেক্ষা করে না। হবে হয়তো কোনো একদিন। হাহুতাশ করলে তো আর দ্রুত হবে না।
·
·
·
চলবে....................................................................................