এত বড় একটা অস্ত্র পেয়ে গেছে নিকিতা যে যুদ্ধটা কীভাবে শুরু করবে, তা-ই ভেবে পাচ্ছে না। এমনই কপাল, পরামর্শ করার মতোও কেউ নেই। শ্বশুরকে শুদ্ধর ব্যাপারটা জানাতেই তিনি বললেন তিনি কিছু জানেন না, অথচ তিনি বিন্দুমাত্র অবাক হন নি! এমন একটা কথা শুনে তো যে-কোনো মানুষের অবাক হওয়ার কথা। তার মানে কি তিনি সব আগে থেকেই জানতেন? সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, তিনি সোজা জানিয়ে দিয়েছেন শুদ্ধর কোনো ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করতে। কিন্তু এটাই তো প্রিয়র সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এটাকে কাজে না লাগাতে পারলে সে কখনো প্রিয়কে পাবে না। নিকিতা কদিন ধরে দিনরাত শুধু এটা নিয়েই ভাবতে লাগল যে কীভাবে অস্ত্রটা কাজে লাগানো যায়!
খাওয়ার পর বারান্দায় বসে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাল। তখনই নিকিতা এল বারান্দায়। প্রিয় সিগারেটে টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘শুদ্ধ কখন ঘুমিয়েছে?
‘তুমি জিমে যাওয়ার পরপরই।
‘তাহলে তো এখন আর উঠবে না।’
‘না।’
‘তুমিও শুয়ে পড়ো।’
‘এখানে একটু বসি?
‘বসবে? বসো।’
নিকিতা প্রিয়র পাশে বসল। প্রিয় বলল, তুমি এক কাজ করো না, নিকিতা।
‘কী কাজ?
‘তুমি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাও।
নিকিতা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?
‘সারাক্ষণ এই সংসারের গণ্ডির মধ্যে থাকো, ভালো লাগে?
‘লাগে। পড়াশোনার থেকে ভালো। পড়াশোনা, পরীক্ষা–এসব খুবই বিরক্ত লাগে আমার। আজীবন টেনেটুনে পাস করেছি। এ জন্য কোনো টিচারের ভালো নজরেও আসতে পারি নি।
প্রিয় হেসে বলল, ‘শোনো, এই রেজাল্ট দিয়ে তোমাকে কেউ বিশ্বজয় করতে পাঠাবে না। স্কুল, কলেজ আর ভার্সিটির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। ভার্সিটিতে ভালো রেজাল্ট করা কঠিন কিন্তু পাস করা খুব সোজা। অ্যাসাইনমেন্ট আর প্রজেক্ট ওয়ার্কগুলো যদিও খুব প্যারা দেয়, ওগুলোতে আমি তোমাকে সাহায্য করব। তুমি ভর্তি হয়ে যাও। বিশ্বাস করো, অন্য একটা জীবন পাবে। অনেক বন্ধু হবে, আনন্দে কাটবে তোমার সময়।
নিকিতা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, তোমার মতলবটা কী, বলো তো?
প্রিয় সামান্য হেসে বলল, ‘কিছু না। তোমার ভালোর জন্যই বলছি। তোমার সময় ভালো কাটবে।
‘ঠিকাছে, তুমি যখন বলছ, ভর্তি হব।’
‘এখন ম্যাক্সিমাম প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন চলছে। আমি কাল ফরম নিয়ে আসব। এখনই ভর্তি হয়ে যাও।’
‘আচ্ছা।
‘থ্যাংকস।
‘কেন?
‘কথা রাখার জন্য।’
‘আমার একটা কথা রাখবে?
‘বলো।’
‘সিগারেট খেতে চাই।’
প্রিয় অবাক হয়ে বলল, ‘সিরিয়াসলি?
নিকিতা মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘হুম।
প্রিয় আধখাওয়া সিগারেটটা এগিয়ে দিল। নিকিতা একটা টান দিয়েই কাশতে কাশতে বমি করে দেওয়ার মতো অবস্থা হলো, তবে করল না। প্রিয় হাসতে হাসতে সিগারেটটা ফেরত নিয়ে নিল।
সিগারেট শেষ করে ঘরে ঢুকবে এমন সময়ে নিকিতা প্রিয়র হাত ধরে আটকে ফেলল, তারপর জড়িয়ে ধরল। শুদ্ধর ব্যাপারটা জানার পর এখন অন্যরকম একটা জোর পায় নিকিতা। তবে অস্ত্রটা এক্ষুনি বের করা যাবে না, সঠিক সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে। প্রিয় বিব্রত হয়ে বলল, ‘কী হচ্ছে, নিকিতা?
নিকিতা চোখ তুলে প্রিয়র দিকে তাকাল। প্রিয় রাগ করল না দেখে সে আরও সাহস পেয়ে গেল। বলল, আমাকে একটু আদর করবে, প্লিজ।
প্রিয় নিকিতার কাঁধে হাত রেখে বলল, আমার ইচ্ছা নেই। এসব একজনের ইচ্ছায় হয় না, নিকিতা। প্লিজ, আমার কাছে এসব আশা কোরো না।
প্রিয় নিকিতাকে রেখে ঘরে চলে গেল। নিকিতা খুব খুশি হলো। সে জানে এত সহজেই সে কিছু পাবে না, কিন্তু এক শ বার চেষ্টা করলে একবার তো পাবে। প্রিয় যে রাগ করে নি, এতেই সে সুখে মরে যাচ্ছে! এভাবে একটু একটু করেই এগোতে হবে। কিন্তু শুদ্ধ ওদের সঙ্গে থাকে, এটাই একটা বড় সমস্যা।
একদিন সন্ধ্যাবেলা শুদ্ধ হোমওয়ার্কগুলো শেষ করে টিভির সামনে বসতেই নিকিতা এসে পাশে বসল। শুদ্ধ কার্টুন দেখছিল। তাই নিকিতাকে জিজ্ঞেস করল, আন্টি, তুমি কি অন্য কিছু দেখতে চাও?
নিকিতা শুদ্ধর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘না বাবা, তুমি দেখো। আমার বাচ্চাটা কত্ত বড় হয়ে গেছে। কত ম্যানার্স শিখে ফেলেছে!
শুদ্ধ হাসল। বলল, ‘হুম, আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।’
‘আরে! তাই নাকি? আসলেই তো অনেক বড় হয়ে গেছ। আচ্ছা, বলো তোমার বড়দের মতো কী কী চাই?
শুদ্ধ আবার হেসে বলল, ‘মোবাইল, ফেসবুক আর বাইক।
‘এ বাবা, মোবাইল দিয়ে কী করবে, তোমার না আইপ্যাড আছে?
হ্যাঁ, কিন্তু ওটাতে তো সিম কার্ড নেই।’
নিকিতা অবাক হয়ে বলল, তুমি সিম দিয়ে কী করবে?
শুদ্ধর চোখের সামনে মায়ের মুখটা ভেসে উঠল কিন্তু মুখে বলল, ‘বন্ধুদের সাথে কথা বলব।’
‘আচ্ছা বুঝলাম, তো এবার বলো ফেসবুক দিয়ে কী করবে? তোমার তো ফেসবুক চালানোর বয়স হয় নি।
‘এহ! আমার সব বন্ধুদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। আমারও চাই।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, কিন্তু বাবু, তোমার নিজের রুম চাই না? শুদ্ধ অবাক হলো, তারপর বলল, ‘না।
‘কেন? তোমার বয়সে তো সবাই নিজের রুম চায়। দেয়ালে অনেক কার্টুন ক্যারেক্টারের ছবি আঁকা থাকবে। ঢুকলেই মনে হবে তুমি তোমার ড্রিমল্যান্ডে চলে এসেছ।
শুদ্ধ জানে না কেন নিকিতা আন্টির এই কথাগুলো তার সহ্য হচ্ছিল না। বলল, আমি চাই না। আমি বাবাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না।
কিন্তু বাবাকে ছাড়া তো তোমার ঘুমাতে হবে, বাবু। তুমি এখন বড় হয়ে গেছ। বাচ্চারা যখন তোমার মতো বড় হয়ে যায়, তখন আর মা বাবার সাথে ঘুমায় না। আলাদা ঘুমায়!’
‘আমি তাহলে চাই না বড় হতে। আমি সারা জীবন বাবার সাথে ঘুমাব।’
এ কথা বলে শুদ্ধ রিমোটটা রেখে অন্যঘরে চলে গেল টিভি দেখতে। আর ভালো লাগছে না তার এখন। কিছুই ভালো লাগছে না।
·
·
·
চলবে...................................................................................