নীলাম্বরে রৌদ্দুরের হাতছানি - পর্ব ২৯ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


          সন্ধ্যার পরপরই হাসপাতাল থেকে ছবির শশুর বাড়ির পথ ধরে সুরেলা। সঙ্গে তাঁর জনাব। শ্বশুর মশাই বাড়ি পথে রওনা দিয়েছেন। চাচি শাশুড়ি, রওশন ভাই হাসপাতালেই আছে। তারাও সেখানেই থাকতো মাঝে বা হাত ঢুকায় সাদমান দুলাভাই। ফোন করে তাদের বাড়িতে যেতে বলে। ওনার মা নাকি রিজের বউ দেখবে অতিসত্বর। তাই তাদের পথচলা। বর্তমানে ঢাকায় যানজটে আটকে আছে। সে মোটর বাইকের পেছনের আসনে বসে। হাতটা জনাবের কাঁধে থাকলেও দূরত্ব রয়েছে দু'জনের মাঝে। শুধু কি দূরত্ব? দীর্ঘক্ষণ নীরাবতা আর মান অভিমান। সুরেলা হামি তুলে বারবার। ঘুমে চোখ বুজে আসছে তাঁর। চোখ খুলে রাখা দায়। ঢুলু ঢুলু চোখে হেলে পড়ে। বাইকের আয়নায় সবটা খেয়াল করে নওরিজ। গমগমে আওয়াজে বলে,

"ঘুম পাচ্ছে? পিঠে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাও।!"

সুরেলা সজাগ হয়। সিনা টান টান করে বসে রকসষহীন গলায় জবাব দেয়, "আগলা পিরিতি দেহনের দরকার নাই।"

"সামনে ডাস্টবিনের ময়লায় এক পাগলী শুয়ে থাকে। বেশি কথা বললে তার কাছে রেখে যাবো। ত্যাড়ামি করো না। "

বলে নওরিজ কাঁধে থাকা সুরেলার হাত সজোরে টেনে কাছে আনে। সুরেলা আঁছড়ে পড়ে বলিষ্ঠ বুকে। সাথে আঁতকে ওঠে। পিঠে আঘাত পেয়েছিলো জনাব।

"পিঠে ব্যাথা না?"

"না।"

সুরেলা গা ঘেঁষে বসে। এক হাতে বলিষ্ঠ মেদহীন পেট জড়িয়ে পিঠে মাথা রাখে। চোখ বুজে নেয় প্রশান্তিতে। একটু আগেও ঘুমে চোখ অন্ধকার দেখছিল অথচ এখন ঘুম উধাও। অসহ্যনীয় পুরুষালী গন্ধ ঘুমাতে দেয়? সুরেলা নাক ঠেকিয়ে ঘ্রাণ শুষে নেয়। মাতাল করা ঘ্রাণ তাকে বড্ড টানে। পিঠে গাল ঠেকিয়ে সামনে তাকায়। বেবি টেক্সির ওপাশের বাইকে কপোত যুগল। শাড়ি পরিহিতা মহিলাটি খোলা চুলে পুরুষটির কাঁধে থুতনি রেখে হেসে হেসে গল্প করছে। মাঝে মাঝে পুরুষটার চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দিচ্ছে তো দাঁড়ি টেনে ধরছে। পুরুষটি মিছে বিরক্তির ভান করে; তা দেখে মহিলা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। সুরেলার মুখে হাসি; মনটা অচিরেই ভালো হয়ে গেলো। ইশ্ কি সুন্দর রোমাঞ্চকর দৃশ্য। আর তাঁর বেরসিক জনাবকে দেখো? হেলমেট মাথায় বিরক্তিকর মুখ বানিয়ে রেখেছে। খুঁতখুঁইত্যা লাট সাহেব তাঁর জীবনটাই ব্রাশময় বানিয়ে রেখেছে। সে পিঠে একটা চিমটি কেটে বলে,

"কতক্ষণ লাগবো জ্যাম ছাড়তে? খুব খিদা লাগছে আমার! মনে হইতেছে যারে পামু তারেই খামু!"

"আমাকেই খা তবে?"

নওরিজ গমগমে সুরে বলে ওঠে। সুরেলা পিঠ থেকে মাথা তুলে শার্টের কলার টেনে নিচে নামায়। মুখ থেকে অল্প নেকাব সরিয়ে উন্মুক্ত ঘারে দাঁত বসিয়ে দেয় শক্তি খাটিয়ে। এহেন আক্রমণে নওরিজ স্থবির হয়ে রয়। আশেপাশের অনেকেই তাকিয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

"ক্ষুধায় মাথা গেছে? লাগছে আমার। দাঁত না কোদাল ওগুলো! সুর ছাড়?"

সুরেলা ছেড়ে দেয়। নেকাব নামিয়ে আবারও পিঠে মাথা ঠেকিয়ে ঠোঁট চেপে হেসে বলে,

"আপনারে বিস্বাদ লাগে। একটুও স্বাদ নাই নোনতা নোনতা; শক্ত শক্ত মাংস!"

নওরিজ হেলমেটের গ্লাস উঁচিয়ে ঘার ফিরিয়ে চায়। সুরেলা চোখ উল্টে তাকায়। কাজলের সরু বক্ররেখায় আঁকা কান্তিমান নয়নাভিরাম অদ্ভুত ঢেউ খেলে হাসছে। নওরিজের গম্ভীর চাহনি গভীর হয়। নিচু ভরাট গলায় প্রত্যুত্তরে বলে,

"আমি বিস্বাদ হলেও হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর তুই সুস্বাদু হবি । আর নরম নরম মাংসে দাঁত আমিও বসাবো বুঝলি ডার্লিং? একটার বদলে একশটা এন্ড ইটস স্টিল কন্টিনিউ! তুই সজোরে বসালি আমি না হয় একটু নরম হলাম! বাট আই মাস্ট গেট মায় রিভেঞ্জ।"

বলেই চোখ টিপে নওরিজ। তবে বাচ্চাদের মতো দুই চোখই সমানতালে বুজে যায়। সুরেলা বাক্যের গভীরে যায় না। মুখ ভেটকিয়ে বলে,

"আইসেন! মারামারি না পারলেও থুতু দিয়া দৌড়ায় পলানের বহুত অভিজ্ঞতা আছে।"

নওরিজ নাক মুখ কুঁচকে সামনে ফেরে। ভাব এমন যেন সত্যিই থুতু পড়েছে মুখে। সুরেলা হেসে ওঠে। হাসির শব্দ না হলেও শরীরের মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয়। সেই কম্পনে কারো অন্দর মহলে অনুররণ সৃষ্টি হয় তার খেয়াল কেউ রাখে? শীতল তনুমনে উষ্ণ ছোঁয়া যেন অঙ্গারে পরিণত হয়। বাইকের গিয়ারে থাকা হাত শক্ত হয়। চাপা স্বরে ধমকে ওঠে,

"টেনে মারবো চর। এসব ছিঃ মার্কা কথা বলবি না আমার সামনে! আর এরকম ছিঃ মার্কা কাজ আমার সাথে করার চিন্তাভাবনাও মাথায় থাকলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিবো।"

সুরেলা হাসি বেড়ে যায় সাথে শরীরের কম্পন। নওরিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মেয়ে তাকে পুরিয়ে ছাড়বে। জ্যাম ছুটে গেলে বাইক টানে নওরিজ। সুরেলা এবার আঁটসাঁট হয়ে পিঠে আধিপত্য বিস্তার করে। সম্পূর্ণ ভর ছেঁড়ে বাঁকা হয়ে দু'হাতে পেট জড়িয়ে ঘুমে ঢুলে পড়ে। দূর্বল শরীর আর চলছে না যে। নওরিজ বাইকের গতি কমে দেয়। এক হাতে পেটে থাকা হস্তদ্বয় শক্ত করে ধরে রাখে যেন পড়ে না যায়। আলো আঁধারিতে ব্যস্ত রাস্তায় এক পুরুষ তাঁর ব্যাক্তিগত কিশোরীকে আগলে ধীর গতিতে বাইক চালায়। অধর কোণে মৃদু হাসি। ইচ্ছে তো করে ঘুরে ওই ঘুমন্ত কিশোরীর ললাটে ভালোবাসা এঁকে দিতে। নিজ ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখে। একটা চুমুতে তো তৃষ্ণা মিটবে না!

দারোয়ানের কাছে পরিচয় পর্ব সেরে বাইক নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে নওরিজ। পার্কিং জোনে বাইক থামিয়ে হেলমেট খুলে রাখে। এলোমেলো চুলে হাত চালিয়ে পিঠে লেপ্টে থাকা রমনীর পানে ফেরে। অপূর্ণ ইচ্ছে পূরণ করতে নেকাব তুলে চুমু বসায় ললাটে। গলা পরিষ্কার করে বলে,

"ডার্লিং জানি জেগে আছিস‌। ভং ধরে থাকতে হবে না।"

সুরেলা চোখ খিঁচে নেয়। শ্যামলী রমনীর মুখে মিষ্টি হাসি খেলে যায় ক্ষণ। বড্ড মধুর সেই হাসি। যেন সোনালী ধানের শীষ বাতাসে এলোমেলো উড়ে বেড়ায়। নওরিজ চোয়াল চেপে ধরতেই শুকনো অধর ফুলে ওঠে। বিড়বিড় করে কিছু বলে সুরেলা। নওরিজ শান্ত চোখে চায়। চাপ বাড়িয়ে বলে,

" ও বাড়িতে গিয়ে ছবির সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করো না যেন। লক্ষীটির মতো থেকো হুম?"

"এমনভাবে কইতাছেন যেন আমি দুবছরের কচি খুকি। আর আমি কারো সাথে লাগি না। তয় কেউ লাগতে আসলে চুপ থাকবার পারি না। ভাই কইছে কেউ একটা কইলে দশটা কইয়া বসায় রাখবি।"

বলে দাঁত কেলিয়ে হাসে সুরেলা। ঘুমের দরুণ ফুলো আঁখি যুগল ছোট হয়ে এসেছে।‌ বেশ লাগছে দেখতে। নওরিজ গাল ছেড়ে বলে,

"যেমন ভাই তাঁর তেমন বোন। দুটোরই মাথার তার ছেঁড়া। তোদের তো পাবনায় রেখে আসা উচিত।"

বলে চলে যায় চাবির রিং ঘুরাতে ঘুরাতে। সুরেলা দাঁত কটমট করে তাঁর পিছু হাঁটে। চাপা স্বরে হিসহিসিয়ে বলে,

"আপনের সাহস তো কম না! আমারে কইতেন আমি কিছু মনে নিতাম না কারণ আপনের মতো খুতখুইত্যা লাট সাহেব তার উপর লুইচ্চ্যা লোকের ঘর করুম বইল্যা কথা। কিন্তু আমার ভাইরে কইলে খবর কইরা দিমু!"

নওরিজ থেমে যায়। সুরেলার নেকাব নিচে নামিয়ে কাঁধ চেপে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় শক্ত করে। সুরেলার হাড় মাংস যেন মটমটিয়ে উঠলো। নওরিজ গম্ভীর সুরে সাবধান বাণী শোনায়,

"ডার্লিং, গলার আওয়াজ একদম নিচে হ্যাঁ? আমার সামনে গলাবাজি করবি তো ফল ভালো হবে না। আমি কিন্তু খুব খারাপ!"

সুরেলা মন ই মন একটু ডরায়। তবে তা প্রকাশ করে না। খানিকটা হাঁসফাঁস করে বলে,

"হাড্ডি ভাইঙ্গা হালাই রে গোলামের পুত। ছাড়েন কইলাম মানষে দেখলে কি কইবো? বেশরম মাইয়া জামাই বইলা এরম রং ঢং করা লাগবো! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!"

নওরিজ আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে হাঁটা দেয়। ভাবলেশহীন গলায় বলে,

"কেউ কিছুই ভাববে না ডার্লিং। এটা গ্রাম না ঢাকা শহর। বি নরমাল!"

বলিষ্ঠ বাহুর চাপাকলে পিষ্ট সুরেলা লাজে নুইয়ে যায়।নিজেকে হাতির চিপায় পড়া চামচিকার মতো লাগে। জনাবের শার্টের এককোণা মুঠোয় ভরে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটে। ঘার এদিক ওদিক তাকায়। বিশাল বড় বাড়ি। দশতলা তো হবেই।আর বাড়ির কারুকাজটাও নজরকাড়া। সে অবাক সুরে বলে,

"ইয়া আল্লাহ! এতো বড় সুন্দর বাড়ি! ওনাদের নিজস্ব?"

"হ্যাঁ। সাদমান ভাই তিন তলায় থাকে পরিবার নিয়ে। বাকি ফ্লোর ভাড়া দেওয়া।"

সুরেলা ঠোঁট উল্টায়। বাপরে বিশাল বড়লোক!সুরেলা খেয়াল করে তাঁরা সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে না। আঙুল তাক করে বলে,

"রিজ ভাই সিঁড়ি তো ওইদিকে?"

নওরিজ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে।

"আমি তোর কোন জন্মের ভাই লাগি সুর? আরেকবার ডাকলে চোয়ালে একটাও দাঁত থাকবে না।"

নওরিজের কথায় সুরেলা মাথা তুলে তাকায়। দাঁত কেলিয়ে বলে, "আপনে তো আমার পাড়াতো ভাই লাগেন। আর গাঁওয়ের ছোট থেকে বুড়া সবাই আপনেরে রিজ ভাই হিসেবেই জানে। আচ্ছা আপনের পুরা নাম যেন কি? ওমন কইরা চান ক্যান? শুধু আমি না, গাঁওয়ের বেশিরভাগ মানুষই জানে না। "

নওরিজের চোয়াল শক্ত হয়। তাঁর বিয়ে করা বউ নাকি তাঁর পুরো নাম জানে না। পৃথিবীর অষ্টম আজুর্বা! সে খানিকটা ধমকে বলে,

"এতো কথা বলছিস কেন? চুপটি করে হাঁট। এতো কথা বলিস জানলে..."

"জানলে নিশ্চয়ই বিয়া করতেন না? তাই তো বড় বুজুর্গরা কয় হুজুগে বিয়া করা লাগে না। যাইহোক খিদা লাগলে আমার মুখ বিরতিহীন ভাবে চলতেই থাকে।"

নওরিজ বিরক্ত হতেও বিরক্ত বোধ করে। সুরেলাকে নিয়ে লিফটে উঠবে এমন মুহূর্তে আরেক নাটক বাঁধে। সুরেলা চাপা স্বরে আতঙ্ক প্রকাশ করে বলে,

"এইডি কোনে নিয়া যান? আমার ডর লাগে!"

"এটা লিফট গাধা। এতে চড়ে তিনতলায় যাবো!"

নওরিজ শান্ত গলায় বলে। সুরেলার চোখের আকার বড় হয়। লিফট নামক শব্দের সাথে পরিচিত নয় সে‌। কেমন ছোট্ট ঘর! জানালাতো দূরের কথা ছোট্ট ফুটোও নেই। দরজা বন্ধ হলে শ্বাস কেমনে নিবে? দম আটকে যাবে না? লিফটে প্রবেশ করেই যেন তাঁর দম আটকে আসে। 

"আমি যামু না। দম বন্ধ লাগতেছে।"

"সিনক্রিয়েট করবি না সুর। তিন তলা শুধু ; আর তুই একা না সাথে আমিও আছি!"

সুরেলা মানে না। ভয়ে তাঁর জান যায় যায়। নওরিজের পেটে আঙুল দিয়ে খোঁচাখুচি করে সে। মিনমিনে সুরে সিঁড়ি পথে যাওয়ার জন্য কুনকুন করে। নওরিজ লিফটের দরজা বন্ধ করে দেয়। সুরেলা অস্থির হয়ে পড়ে। দরজা ধাক্কায় অনবরত।লিফট উঠতে শুরু করলে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপে।নেকাব মাথার উপর দিয়ে তুলে হা হা করে শ্বাস টানে। যেন অম্লজানের অভাব বোধ করছে। আতংকিত হয়ে বলে,

"রিজ ভাই আমি শ্বাস নিতে পারছি না!"

নওরিজ সুরেলার কান্ডে ঠোঁট টিপে হাসে। লিফটের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

"মেলো ড্রামা অফ যা! ভাই না ডাকলে তাও শ্বাস দেওয়া নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতো। মুডটাই নষ্ট করে দিলি ভাই ডেকে। ‌ ব্যাড লাক ডার্লিং!"

সুরেলার হাঁপানি রোগীদের মতো অবস্থা। এমন ভাবে শ্বাস জুড়ছে যেন এখনি অক্কা যাবে। একেই বলে মেয়ে মানুষ। নওরিজ অতি মাত্রায় স্বাভাবিক। পকেটে হাত ঢুকিয়ে শান্ত চোখে চায়। ঠোট বাঁকিয়ে হেসে বলে,

" ডার্লিং শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? শতভাগ শুদ্ধ নির্মল শ্বাস নিতে চাইলে বলো। আমি প্রস্তুত আছি!"

সুরেলা হুট করেই শান্ত হয়ে আসে। ঘন ঘন শ্বাস টানে। শ্যামলীর মুখ চোপায় রক্তিম কৃষ্ণচূড়া ফুটে উঠেছে। নওরিজ মাহবুবের অধর কোণে স্মীত হাসি।এক হাত বাড়িয়ে চোখ টিপে ইশারায় কাছে ডাকে। সুরেলা কালক্ষেপণ করে না। কটি সংযোগে হাত দিয়ে বলিষ্ঠ পিঠে হাত গলিয়ে দেয়। শার্ট মুঠোয় পুরে বুকে মাথা রেখে বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়ে আর বলে,

"আমার বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করতাছে ক্যান?ইয়া আল্লাহ! রিজ ভাই আমি মইরা যামু!"

"তোকে তো আমি মারবো তবে একটু একটু করে!"

—————

" মিনী? নাটক বাদ দিয়ে বলো বাচ্চাটা কোথায়? আনো বাচ্চাটাকে আমি দেখবো!"

"আরে বাবু জি কি সব বলছেন? কিসের বাচ্চা, কার বাচ্চা? কোনো বাচ্চা নেই এখানে!"

নোমান মাহবুব রাগী চোখে ভাইয়ের দিকে তাকান। রমজান মিয়া পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ভাইয়ের চাহনিতে নত মাথায় বলে,

"ভাইজান বিশ্বাস করেন আমার কথা? আমি নিজের চোখে দেখেছি। মিনীকে মাতে মাতে বলে ডাকছিলো।"

দামিনী হাসে খিলখিল করে।  

"আপনার দেখার ভুল হবে বাবু। এখানে আমি আর মাসিমণি থাকি শুধু। বাচ্চা কই পাবো? আমার পতি আছে নাকি যে বাচ্চা হবে? নেমকহারামটা মাঝ দরিয়ায় ফেলে চলে গেছে গো!"

বলতে বলতে কামিনীর গলার স্বর কঠিন হয়ে আসে। রমজান মিয়া ভিতু চোখে বড় ভাইয়ের দিকে তাকায়। নোমান মাহবুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

"তুমি কি চাইছো মিনী? এখান থেকে চলে যাও। তোমার সমস্ত ভরণ পোষণ সহ যাবতীয় খরচাপাতি এমনকি তুমি যা চাও তাই দিবো। এই সব নষ্ট কাজ করার প্রয়োজন পড়বে না তোমার। রানীর হালে থাকবে। অনুগ্রহ করছি চলে যাও। আমি চাই না আমার সাজানো গোছানো সংসারে কারো কালো ছায়া পড়ুক। রমজান ওকে বোঝাও নইলে পরিণতি ভালো হবে না!"

কথা শেষ করে অপেক্ষা করেন না নোমান মাহবুব। হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে। রমজান মিয়া দামিনীর দিকে কটমটে চোখে তাকিয়ে ভাইয়ের পিছনে আসে। দামিনী মুখ কষে খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। শুপ্রা বিরক্ত হয় বটে। এই দামিনী কি চাইছে টাকি?

"ভাইজান দামিনী মনে হয় না যাবে। ওর মতিগতি ভালো লাগছে না। সেদিন বললো ওর খান বাড়িতে জায়গা চাই। তাঁর প্রাপ্য..."

নোমান মাহবুবের কড়া চাহনিতে রমজান মিয়া আর কথা আগাতে পারেন না। নত অপরাধী মুখে ভাইয়ের পিছু আসে। ঘুনঘুটে অন্ধকারে টর্চা জ্বালিয়ে হেঁটে জঙ্গল পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ির কাছে উপস্থিত হয়। গাড়ির কাছটায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁরা থমকায়। মুখ বরাবর টর্চ ধরতেই দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা মুখটা দর্শন হয়। 

আকরাম নামক পাগল লোকটা চোখে লাইট লাগার ফলে ছটফট করে ওঠে। অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করে দেয়। রমজান এগিয়ে এসে ধমক দিতেই মাথা চুলকে বলে,

"ও রমজান ভাই? চেয়ারম্যান সাবও দেখতাছি! তা কই গেছিলেন এই আন্ধারে?"

"তা জেনে তোর কি কাজ? তুই এখানে কি করছিস?"

রমজানের ধমকে আকরাম হে হে সুরে হাসলো। দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে, "ওই পেয়ারি দামু্র কাছে যামু। শফিল ভাই 
সন্দেশ পাঠাইছে। এল্লা দিয়া কয়ডা ভাত চাইয়া খামু।"

নোমান মাহবুবের কপালে ভাঁজ পড়ে। রমজানের হাত থেকে টর্চ নিয়ে আকরামের হাতে লাইট ধরে। বাজারের ব্যাগ ধরে আছে। সে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে উবু করে ঢেলে দেয়। আকরাম হায়হুতাশ করা শুরু করে দেয়। কাঁচের শিশি দুই একটা ভেঙেছে। ফেনসিডিলের বোতল গুলো ঝনঝন শব্দ করছে। আরো হাবিজাবি দেখা যায়। সে রমজানের দিকে তাকায় অবাক চোখে।

"মিনীও এসব কাজে জড়িয়ে? তুই জানিস তাই না?"

রমজান মিয়া ইতস্তত বোধ করে। শুকনো ঢোঁক গিলে বলে,
"হ্যাঁ ভাইজান। বেশিদিন হয় নাই। যাত্রাপালায় শফিল ভাইয়ের সাথে দেখা হইছে সেই মিনীরে অফার দিছে। ভাবছিলাম মিনী মানা করবো কিন্তু নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেল।"

নোমান মাহবুবের চোয়াল শক্ত হয়। আকরাম মাটি হতে সব মাল ব্যাগে ভরে আনাড়ি হাতে। নোমান মাহবুব তাঁর হাতে লাথি মেরে গাড়িতে উঠে বসে। রমজান মিয়া গাড়িতে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট দেয়। 

"দেখ রমজান রিজ বাবা যদি এসব জানে বাপ চাচা মানবো না। ভাবছি এসব থেকে বেরিয়ে আসবো। টাকা পয়সার তো কমতি নেই। বয়সকালে থানা পুলিশ সম্মানটা ধুলোবালিছাই না হয়ে যায়!"

রমজান মিয়ার মুখে বিরক্তি ভর করে। খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,

"ভাইজান বসে খেলে রাজার ভান্ডারও ফুরিয়ে যায়। আর ভুলে যাবেন না যে, টাকাকড়ি যা আছে মাল পানির বদৌলতেই এসেছে। এখন সাধু সাজলে তো হবে না। আর রিজ বাবা কিছু করবে না। আপনি হুদাই ভয় পাচ্ছেন।"

নোমান মাহবুব স্মীত হেসে বলেন,

"তুই দেখছি একেবারে নেশাজগতে আঁটঘাট গেড়ে বসেছিস। আমি অবশ্য ওতশত দিকে ছিলাম না।‌টাকা নিয়ে অন্ধের মতো থাকতাম। যা করো করো। আমার এলাকায় কালা ব্যবসা করবা আর আমারে মুনাফা দিবানা তাই হয়? ওর টাকা দিতো শুধু। বয়স হয়েছে এখন দু'দিন পর কবরে যাবো। আর ছেলেটা.. সে যাইহোক আমার ছেলে তো আমি জানি কতটুকু করতে পারে। তোকে বললাম তুই ভেবে দেখিস। মতিন টা কিন্তু জেলে পঁচছে। কিছুতেই জামিনের বন্দোবস্ত করা যাচ্ছে না। ওর বউ বাচ্চা মেয়ে হারিয়ে পুলিশের কাছে সব খুলে বলেছে। মতিনের সাথে কারা কাজ করতো সেসবও জানিয়েছে। ওরা সবাই গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে। "

রমজান মিয়ার মুখাবয়ব থমথমে। দু'দিনের পুঁচকে ছেলে যাকে কোলে পিঠে করে বড় করলো তাকেই ভয় পাবে নাকি?দেখা যাবে কতটুকু কি কি করতে পারে! সবে তো শুরু। 

রেবেকা বানু বসার ঘরে বসে সুপারি কাটছিলেন আর বোনের সাথে সুখ দুঃখের গল্প জুড়ছিলেন। নীরব দর্শক আরিফা। স্বামী ও দেবরকে থমথমে মুখে বাড়ি ফিরতে দেখে রেবেকা বানু চিন্তিত বদনে শুধান,

"রিজের আব্বা? কি হয়েছে? আপনার তো কাল ফেরার কথা ছিলো। আজকেই আসলেন যে? সব ঠিকঠাক আছে তো? রিজ আব্বা , পিচ্চি দু'জনের হালচাল ভালো তো?"

নোমান মাহবুব ছোট করে সব ঠিকঠাক আছে জানিয়ে চলে যান। রেবেকা বানু দেবরের পানে ফিরে জিজ্ঞেস করে,

"রমজান কি হয়েছে? ওনার মুখ চোপা সুবিধার ঠেকছে না। তোমার মুখের অবস্থাও সুবিধার না। কোনো সমস্যা?"

"সমস্যাটা তো আপনার ছেলে নিজেই টেনে এনেছে ভাবী। ওই ফকিন্নীর ঝি মানেই অশান্তি! আপনার ছেলের মাথায় চরে নাচছে আর ওদিকে আমার ছেলেটা সেসব দেখে দুঃখের সাগরে ভাসছে। রিজ বাবা বউ ছাড়া তো ভাইয়ের দুঃখ চোখে দেখে না। ভাবী আপনার দিন ফুরিয়ে আসছে ক্ষণ। মেয়েটা ভাইয়ে ভাইয়ে অশান্তি তো লাগিয়েছেই আপনাকেও ছেলের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবে দেখে নিয়েন।"

রমজান মিয়া অনর্গল বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যান। কালো গোঁফে পাক দিয়ে বাঁকা হাসেন। তার জগতে অশান্তি সৃষ্টি করবে তো সে ছেড়ে দিবে নাকি? ছোট ছোট অবহেলিত বিষয় গুলোই জীবনে ঝড় বইয়ে আনে।

রেবেকা বানু স্থবির হয়ে বসে। তারপর চাঁপি'তে চাপ দিয়ে খট করে সুপারি কাটলো তবে তার মুখাভঙ্গি এমন যেন সুরেলা নামক আপদকে কাটলো। তাঁর পাশে বসা রাহেলা বানু সুপারি মুখে পুরে বলে,

"রেবু কথা মন্দ না।‌ তোর বউয়ের চাপা সুরত দুইডাই আছে। তুই কইছিলি কাইল্যা ভুত! কিন্তু বউয়ের গাঁয়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম, আমগোরে আরিফার মতোই পরায়। দুইদিন রাণীর হালে থাকলে আরো চড়া হইবো। তোর ছল এমনিতেই লাড্ডু! বউ ছাড়া কিছুই চোক্ষে দেখবো না। তাই বলি কি ব্যাটার বউয়ের লগে মাইনা চলিস।"

রেবেকা বানু ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। বোঝাই যাচ্ছে মাথায় রুটি বেলে দিলে পুরে যাবে। রাহেলা বানু নিজ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

"আমার মাইয়া তোর ব্যাটার বউ হইলে রেবু তোর চিন্তার কিছুই ছিলো না। কিন্তু তুই তো তোর কচি আগুন সুন্দরী ভাস্তির আশায় মুখ কালা করলি! তোর পোড়া কপাল!"

চুক চুক শব্দ করে রাহেলা বানু। যেন রেবেকা বানুর ক্ষতে মরিচের ছিঁটা দিলো। ওদিকে আরিফা লজ্জায় চোখ তুলেও চাইতে পারে না। মায়ের এহেন আচরণে নরম মনটা লজ্জায় কাঁদে। চোখের কোণেও জল চিকচিক করে। তা লুকাতে উঠে চলে যায়। রেবেকা বানু দাঁত কপাটি পিষ্ট করে চাঁপিতে খট খট শব্দে সুপারি কাটে আর বলে,

"ফকিন্নীর ঝি খুব শখ খান বাড়ির বড় বউ হয়ে আরাম আয়েশে দিন কাটার, তাই না? তোর শখ আমি পাটায় পিষে গুলে খাওয়াবো। আয় এ বাড়িতে! আমি রেবেকা বানু কি জিনিস হারে হারে টের পাবি।"

রাহেলা বানু সুপারি ফেলে ঝুড়িতে রাখা আপেলে কামড় বসায়। তাঁর খান বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এরকম বাংলা সিনেমা ফেলে বাড়ি যাওয়া যায়? তাঁর বোন হলো দজ্জাল রিনা খান আর রিজের বউ মৌসুমী। পুরাই 'বাংলার বউ' সিনেমা। এখন দেখা যাক আগে কি হয়? 

—————

তুফানের আগমুহূর্ত; এক অপার্থিব থমথমে, আতঙ্ক আর প্রকৃতির গোপন সঙ্কেতে ভরা এক মুহূর্ত। খাবার টেবিলের দুই পাশে দুই মানবী। দু'জনের মধ্যকার পরিস্থিতি ঠিক এমনই মুহূর্ত বিরাজমান। থালা বাসনের টুংটাং আওয়াজ পরিবেশটা আরো সংকির্ণ বানিয়ে দিচ্ছে। নীরাবতার জাল ছিন্ন করে রূপালী দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

"হয়েছে আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। তুই সর আমার চোখের সামনে থেকে। তোকে দেখলেই গাঁ জ্বলে ওঠে আমার!"

"ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল পাউডার লাগাইয়েন আপা। গা গতর আর জ্বলবো না। আপনের ভাই মানে উনার ঘরে আছে একটা। সেদিন গরমে অসহ্য লাগতেছিল লাগাইলাম তারপর কি শান্তি!"

সুরেলা সহজ সরল চোপা বানিয়ে বলে‌। লাজুক লাজুক হেসে খাবার টেবিলে থালাবাটি সাজায়। রূপালী রাগে গজগজ করে। টেবিল থেকে ছুরিটা তুলে সুরেলার দিকে তাক করে বলে,

"ডায়নী, পেতনি, শাকচুন্নী, পিশাচিনী, নেমকহারামি, কুচুটি.."

"কি হচ্ছে এখানে?"

চিরচেনা গলার স্বর কানে বিঁধতেই থেমে যায় রূপালী।‌হাত কেঁপে ছোরাটা পড়ে যায়। সুরেলা কে চোখ পাকিয়ে কাঁচুমাচু মুখে সাদমানে দিকে তাকায়। গম্ভীর মানবের সাথে নয়ন মিলতেই নয়ন যুগল নত হয় স্বাভাবিকভাবেই। সাদমান এগিয়ে এসে রূপালীর পাশে দাঁড়ায়। মেঝেতে পড়ে থাকা ছুরিটা তুলে রাখে। চেয়ার টেনে রূপালীকে বসতে ইশারা করে বলে,

"বসে বসেও কাজ করা যায়। সিট?"

রূপালী বিনা বাক্যব্যয়ে কাঠ পুতুলের মতো বসে পড়ে উঁচু পেট নিয়ে। সাদমান টিস্যু ধরিয়ে দেয় রূপালীর হাতে। রূপালী সুরেলার দিকে একপল তাকিয়ে কপালে, নাকের ঘাম মুছে। সাদমান গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলে,

"জনাবা আপনার জনাবকে ডেকে আনুন। আর কত গোসল করবে? এগারোটা বাজতে চললো। সাহরিতেও তো উঠতে হবে নাকি?"

সুরেলা এতক্ষণ ননদ ননদাই কে দেখে যাচ্ছিলো। ছবি আপার হঠাৎ রূপ বদলে সে অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে। ছবি আপুকে চিনে সে। তাঁর ভাষ্যমতে বিষে ভরা নাগিন যে শুধু ফোঁস ফোঁস করবে। অথচ সাদমান ভাই নামক সাপুড়ে দেখে বশীভূত হয়ে গেলো? সে সাদমানের দিকে তাকায়। লোকটা অবশ্য রাগী রাগী দেখতে। সে মাথা কাত করে চলে যায় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত কামরায়। গোসলখানার দরজা বন্ধ। তারমানে খুঁতখুঁতইত্যা লোকটা এখনো গোসল করছে! হায় আল্লাহ! সে দরজা ধাক্কিয়ে ডাকে,

"রিজ ভাই? দরজা খুলেন, ক্ষেতা কম্বল দিয়া আসি। কি হলো?"

ভেতর থেকে জবাব আসে না। পানি পড়ার কুল কুল শব্দ শোনা যায়। সে জোরে ধাক্কা মেরে বলে,

"খুঁতখুইত্যা লাট সাহেব? জলদি বাইর হন কইলাম। খিদায় আমার পেট জ্বলে উনি জন্মের ডুব দিতাছে। খুলবেন দরজা?'

আকস্মিক দরজা খুলে যাওয়ায় পরবর্তী ধাক্কা বলিষ্ঠ বুকে লাগে। সুরেলা ভড়কায় বেশ। তবে উন্মুক্ত লোম বিহীন ফর্সা বুকে জলকণার আবির্ভাব দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঈর্ষা জন্মে মন বাগিচায়! নির্লজ্জ বেহায়া জলকণা। অন্যের স্বামীর বুকে লেপ্টে আছে। সেখানে তো তাঁর লুকোচুরি খেলার কথা।

"মারবো টেনে চর! মাছের বাজার পেয়েছিস? মেহমান হয়ে এসেছিস কারো বাড়িতে; তার উপর নতুন বউ। এভাবে গলা কে ফাঁড়ে?"

আচানক ধমকে সুরেলা রঙিন দুনিয়া থেকে বাস্তবে টপকায়। বুক থেকে দৃষ্টি তুলে আঁখিতে আঁখি মেলায়। নওরিজ খানিকটা জোরে বাহু চেপে ধরে। নিচু গলায় ধমকে বলে,

"ভাইয়ের মতোই খিটখিটে হয়েছিস। বলি আক্কেল নেই? দরজা খোলা, কেউ শুনলে কি ভাববে?"

সুরেলা প্রত্যুত্তর করে না। শান্ত চোখে চোখ রেখে ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল। ফোঁস ফোঁস করে ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায় ঘরের বাইরে। নওরিজ সুক্ষ্ম চোখে তাঁর প্রস্থান দেখে। 

কামরা থেকে বেরিয়ে আসতেইনয়নাভিরাম ভরে ওঠে সুরেলার। সম্মুখে দন্ডায়মান মানবীকে দেখে বড় বড় করে চেয়ে আবেগী মনটাকে পিষে ফেলে। হাসিমুখে বলে,

"খালাম্মা কিছু বলবেন?"

"হ্যাঁ। কষ্ট করে একটু ডায়নিং প্লেসে নিয়ে যাবে? নয়তো সাদুকে ডেকে দাও।"

ভদ্রমহিলা রূপালীর শাশুড়ি। সাদমান ভাইয়ের মতোই গম্ভীর আর রাগী রাগী দেখতে। নিঃসন্দেহে বলা চলে সাদমান ভাই তার মায়ের মতই। সুরেলা মুচকি হেসে বলে,

"আমিই নিয়ে যাই খালাম্মা।"

হুইলচেয়ার ঠেলে সুরেলা পুরো বাড়ি ঘুরে। তবে মনে করতে পারে না খালাম্মা কোথায় যেতে চেয়েছিল। কি যেন বললো? ডানি পেলেস মনে হয়। কিন্তু সেটা আবার কোন জায়গা! বড় লোকের বড়লোকি জায়গা। সে ফকিন্নীর ঝি কিভাবে জানবে?
 ভদ্রমহিলার গম্ভীর গমগমে আওয়াজ শোনা যায়,

"এই মেয়ে কখন থেকে দেখছি গোল গোল ঘোরাচ্ছো! ডায়নিং প্লেসে নিয়ে যাচ্ছো না কেন?"

সুরেলা পড়ে ফ্যাসাদে। কিছু বলবে এর আগে রূপালীর গলা শোনা যায়। সুরেলা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে,

"ছবি আপা? তোমাগোরে ডানি পেলেস কোন জায়গায়?"

ভদ্রমহিলা ঘার ঘুরিয়ে বাঁকা চোখে চায় সুরেলার দিকে। ছবি ওরফে রূপালী শাণিত চোখে চায়। শাশুড়ির সামনে কিছু বলতেও পারে না। তবে হাসি মুখে দাঁত চেপে বলে,

"ভাবীজান ডানি পেলেস না ডায়নিং প্লেস! খাবার খায় যেখানে।"

লজ্জায় লাল হয় সুরেলা। হুইলচেয়ারে বস ভদ্রমহিলা রূপালীর দিকে তাকিয়ে বলে,

"তোমার ভাই বউ দেখছি গাইয়া ভাষায় কথা বলে। মর্জিনার মতো।"

মর্জিনা এ বাড়ির কাজের লোক। সুরেলা ভদ্রমহিলার গম্ভীর মুখপানে তাকায়। তিনি সেখানেই থেমে থাকলো না। সুরেলার দিকে তাকিয়ে বলে,

" পড়াশোনা করো নি? না করলেও শুদ্ধ ভাষায় কথা বলাটা শিখে নিও। বড় বাড়ির বউ তুমি। তোমার হাসবেন্ড উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁর ঘরনী হয়ে এরকম আঞ্চলিক টোনে কথা বললে লোকে হাসবে।"

রূপালীর কপালে বিরক্তের রেশ।সুরেলা তাঁর অপছন্দের তালিকায় প্রথমে হলেও শাশুড়ির কথা ভালো লাগে না। সুরেলা যে এখন তাঁর বাপের বাড়ির একজন। সে কিছু বলতে উদ্যত হবে তার আগেই সুরেলা অল্প হেসে বলে,

 "খালাম্মা আমি সামনের বছর এসএসসি দিবো ইনশাল্লাহ। আর আমি শুদ্ধ ভাষায়ও কথা বলতে পারি। এই যে এখন বলছি। কিন্তু বলে তৃপ্তি পাই না।আঞ্চলিক ভাষায় নাক ছিটকানোর আছে? এটাও তো মাতৃভাষা। আমি আমার মা, ভাইয়ের কথা শুনেই তো কথা বলতে শিখলাম। তাদের ভাষায় বললে আলাদা শান্তি পাওয়া যায়। মন‌প্রান সবটাই জুড়ায়।"

ভদ্রমহিলার মুখ চোপায় অসন্তুষ্টির ছাপ। মুখের উপর কথা বলা তাঁর পছন্দ না। মেয়েটাকে তিনি এক নিমিষেই বেয়াদবের কাতারে ফেলেন। রূপালীকে আদেশ করে খাবার টেবিলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রূপালী নাক চুলকে হাসি লুকায়। শাশুড়ির ভোঁতা মুখ দেখে কি যে শান্তি পাওয়া যায়! 

সুরেলা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। এখন বুঝলো কেন ছবি আপা মিউমিউ করে চলে! তাঁর মনটাই খারাপ হয়ে যায়। রাক্ষুসে ক্ষুধাটাও মরে গেলো। 

খাবার টেবিলে বসে সুরেলা পাতে আঙুল ঘুরায়। একটু আগেও ক্ষুধা মাথায় চড়লেও এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। মন খারাপ হচ্ছে সাথে ঘুম পাচ্ছে। রাগও হচ্ছে কারো কারো উপর। পাশে বসা নওরিজ সুরেলার হাঁটুতে খোঁচা দেয়। সুরেলা চকিত চাহনিতে পাশে ফিরলে নওরিজ ভ্রু উঁচিয়ে কি ইশারা করে খেতে বলে। সুরেলা গোমরাহ মুখে মাংস মুখে পুরে। সাদমান মাংসের বাটি সুরেলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

"নিজের বাড়ি মনে করে নিজে বেড়ে খাবেন। রিজ দেখো কি লাগবে? উনি বোধহয় লজ্জা পাচ্ছে।"

সুরেলা এতক্ষণ লজ্জা না পেলেও এ যাত্রায় অস্বস্তিতে পড়ে। তাঁর অস্বস্তি তরতর করে বেড়ে যায় নওরিজের কান্ডে। পাতে খাসির মাংস ভরিয়ে দেয়। সুরেলা চোখে সর্ষে ফুল দেখে। অনেক কষ্টে খাবার গিলতে থাকে সে। নতুন বউ খাবার এঁটে করলে কেমন দেখায়? তার উপর রূপালীর শাশুড়ি এমন করে তাকাচ্ছে বাপরে! ভুরি ভোজন শেষ হলে রূপালী একে একে এঁটো প্লেট রান্নাঘরে নিয়ে যায়। সুরেলা সেটা দেখে বলে,

"আপা আপনি রেস্ট নিন। আমি ধুইয়ে দিচ্ছি সব।"

"বলেছি না আমার সামনে আগলা দরদ দেখাই.."

সাদমানের আগমণে রূপালীর বাক্য অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। তবে তাঁর শাণিত চাহনি যেন সবটাই বলে দিলো। সুরেলা তবুও এঁটো বাসন কোসনে হাত দেয়। সাদমান ভরাট গলায় বলে,

"মেহমান আপনি! আপনাকে দিয়ে কাজ কিভাবে করাই? যান রেস্ট নিন। রূপালী রুমে গিয়ে রাতের ওষুধ পত্র খেয়ে নাও। সব আমি দেখছি!"

রূপালী টু শব্দ না করে চলে যায়। সুরেলার চোয়াল ঝুলে পড়ে সাদমানকে থালা বাসন মাজতে দেখে। পুরুষ মানুষ থালা বাসন মাজে সে আজ প্রথম দেখলো! 

"দুলাভাই আপনি যান আমি করে নেবো সব। দু মিনিটের ব্যাপার তো!"

সুরেলার প্রস্তাব অতি ভদ্রতার সাথে নাকচ করে নিজ কাজ চালিয়ে যায় সাদমান সাদিক। অগত্যা সুরেলা কামরায় আসে। একটু হাঁফ ছাড়তেই কেউ হাতে শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট, তোয়ালে, ফেইস ওয়াশ, সাবান ধরিয়ে দেয়। সুরেলা কিছু বলবে জনাব সেই সুযোগ অবদি দেয় না। ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে তাঁর মুখে পুরে দিয়ে বলে,

" যাও গোসল সেরে আসো। ফ্রেশ লাগবে।"

সুরেলার ইচ্ছে করে লোকটাকে তুলে আছাড় মারতে। নিজ শক্তির মাত্রা কতটুক জানে বিধায় কিছু করে না। থমথমে মুখে চলে যায় গোসল খানায়। কোথাও একটু শান্তি নেই। 

আধাঘণ্টার মধ্যেই গোসল সেরে বেরিয়ে আসে সুরেলা সালেহ। তোয়ালে পেঁচিয়ে ভেজা চুল বাড়ি দেয়। মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে আশেপাশে তাকায়। জনাবের দেখা নেই ‌বিধায় ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে। ঘুমে চোখ ছোট ছোট হয়ে আসে তাঁর। নিজ ব্যাগ হাতড়ে সেফটি পিন খুঁজে আনে। গতরে জড়িয়ে থাকা আটপৌরে শাড়ির আঁচল বানিয়ে সেফটি পিন লাগাবে সেই মুহূর্তে ঝড়ের বেগে আসে নওরিজ মাহবুব খান। এসেই ক্ষান্ত হয়নি। মাথায় বাঁধা তোয়ালে খুলে নেয়। সুরেলা ভ্রু কুঁচকে চায়। বলিষ্ঠ হাতের থাবা কাঁধ হতে আঁচল ফেলে দিলো। জড়িয়ে থাকা আটপৌরে শাড়ির কোচা খুলে দেওয়া হয় ধচং বচং করে। সুরেলা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু। মস্তিষ্ক তাঁর অপরাগতা স্বীকার করেছে। নানীবুর শেখানো সব ক্রিয়া কৌশলে পানি ঢেলে দেওয়া হয়। উদরে ধারালো নখের আঁচড়ে সুরেলা হুঁশে ফিরে। তবে তাকে প্রতিরোধ করার সুযোগ দেওয়া হয় না। পাঁজাকোলে তুলে নরম বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে। গায়ে কাঁথার আবরণ এসে পড়ে। সুরেলা কাঁথা গলা অবদি টেনে আড়চোখে চাইতেই বুকটায় ঝড় বইতে শুরু করে। কি হতে চলেছে? শুকনো ঢোঁক গিলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে সুরেলা সালেহ। শার্টের অবশিষ্ট বোতাম খুলে গতর হতে শার্ট আলাদা করে নওরিজ। উজ্জ্বল ঘর অন্ধকার বানিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কাঁথার ভেতর নিজেকে মানিয়ে নেয়। বেহায়া হাত উন্মুক্ত উদরে ঘুরে বেড়ায়; খেই হারিয়ে ছুঁয়ে দেয় কিশোরীর সর্বাঙ্গে। উষ্ণ রুক্ষ ওষ্ঠাপুট পিঠজুড়ে দোলা দেয়। কিশোরী দাঁতে দাঁত চেপে, বিছানা খামচে সহ্য করে যায় অসহ্যনীয় পুরুষালী ছোঁয়া। ক্ষণপল পরেই তাঁর সহ্যের মাত্রা অতিক্রম করে। পালাতে উদ্যত হয় এই অসহ্যনীয় অনুভূতির বেড়াজাল থেকে। তবে বেরোতে পারে না । নওরিজ শক্ত করে জড়িয়ে নেয় পেছন থেকে। ঘারে আলতোভাবে দাঁত বসিয়ে বলে,

"কামড়ের প্রতিশোধ নিতে এসেছি ডার্লিং ।"

সুরেলা হা করে শ্বাস জুড়ে। এ কোন মরণ দশা। বলার জন্য জিভ লকলক করলেও গলায় যেন শব্দরা আটকে গেছে। বিড়বিড় করে বলে, "লুইচ্চ্যা লোক!"

নওরিজ মাহবুব সুরেলার উপর চড়াও হয়। ছোট দেহখানা বলিষ্ঠ বুকের নিচে পিষ্ট হয়। গলার ভাঁজে ভাঁজে উষ্ণ চুমুর বর্ষণ শুরু। সুরেলা গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করে ওঠে। নওরিজ মাহবুব মাথা তুলে তাকায়। আবছা আঁধারের ভিড়ে গন্তব্য খুঁজে পেতে বেগ পোহাতে হয় না। ওই নরম ওষ্ঠাপুটে নিজ আধিপত্য জানান দিবে সুরেলা বিড়বিড় শব্দে থেমে যায়। 

"আমি ব্রাশ করি নাই। সত্যিই কইতাছি!"
·
·
·
চলবে.....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp