একটা চার বছর বয়সী বাচ্চাকে লিচু ছিলে খাওয়ালে কোন মহাকৰ্ম অনিষ্ট হবে মীরা বুঝতে পারে না। চার বছর বয়স নাকি নিজের হাতে লিচু ছিলে খাওয়ার। জন্য যথেষ্ট। বেশ কিন্তু যদি লিচুতে পোকা থাকে আর সেটা না বুঝে মেয়ে খেয়ে ফেলে? যদি বিচি গিলে ফেলে? রাফির সঙ্গে তার পাঁচ বছরের সংসার। এই পাঁচ বছরে তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কখনো সংকটজনক কোনো ঝগড়া হয়নি। কিন্তু তাদের একমাত্র মেয়ে হিমিকে নিয়ে ঝগড়া হয়েছে হাজারও বার। এই লিচু ছিলে খাওয়ানো নিয়ে এক চোট হয়ে গেল আজ সকালে। রাফি তার মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই স্বাবলম্বী করে বড় করতে চায়। খুবই ভালো কথা, মীরাও তা চায়। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে রাফি অতিরিক্ত করে ফেলে। হিমিকে নিজের হাতে খেতে হবে। মাছ বেছে দেয়া যাবে না, ভাত মেখে দেয়া যাবে না। অদ্ভুত কথা! নিজে নিজে মাছ খেতে গিয়ে যদি গলায় কাটা বিঁধে? এই চিন্তাগুলো কি রাফির মাথায় নেই? নাকি সব চিন্তা আল্লাহ কেবল তার মাথায় দিয়ে রেখেছে। অথচ মেয়েকে দেখো-কেমন বাবা অন্তপ্রাণ!
বৃষ্টি হওয়ার কারণে রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। যেখানে মীরা সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসে, সেখানে আজ ফিরতে ফিরতে সাতটা বেজে গেল। তার মেজাজ খুবই খারাপ ছিল। অফিস থেকে ফিরে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল কারণ রাফি তখনো ফেরেনি। আসুক যখন ইচ্ছা। একেবারে অনির্দিষ্টকালের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দেবে।
—————
মীরা ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হলো। তার শাশুড়ি সালওয়া তখন ডাইনিংয়ে বসে রূপ ও হিমিকে পড়াচ্ছিলেন। রূপ মীরার একমাত্র ননদ, ক্লাস টেনে পড়ে। মীরা শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করল,
মা চা খাবেন? বানাব?
সালওয়া চওড়া হাসি দিয়ে বললেন, বানাও।
রূপ বলল, ভাবি আমিও চা খাব।
ফুপির কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিমি বলল, মা আমিও চা খাব।
মীরা কিছু বলার আগেই সালওয়া বললেন, একি দাদু? বাচ্চারা চা খেলে কী হয় ভুলে গেছো?
হিমি দাঁতে জিভ কেটে বলল, এহহে দাদু এক্কেবারে ভুলেই গেছিলাম!
এরপর মীরার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি চা খাব না মা। আমাকে আবার দিও না।
মীরা মুচকি হেসে চা বানাতে গেল। জয়েন্ট ফ্যামিলির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে। বাচ্চা লালন-পালন করা বা শাসন করার দায়িত্ব একা বাবা মায়ের ওপর থাকে না। দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুপু সবাই কোনো এক অদৃশ্য নিয়মেই নিজেদের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয়। আর মীরা তো খুবই ভাগ্যবতী তার শাশুড়ির কারণে। এমন বুঝদার মানুষ হয় না। মীরার কাছে সে এক জাদুর বাক্স। সব সমস্যার সমাধান সেই জাদুর বাক্সটাতে রয়েছে!
মীরা শাশুড়ি ও রূপকে চা দিয়ে নিজের এবং দিয়ার চা নিয়ে দিয়ার ঘরে নক করল। গল্প করে কিছুটা সময় কাটুক। মীরার একমাত্র দেবর রাহি। রাহির স্ত্রী দিয়া। রাহি চা খায় না কিন্তু দিয়াকে কখনো চায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে হয় না। রাহির ফিরতে বেশ রাত হয় কিন্তু আজ আগেই ফিরেছে। ওকে ঘরে দেখে মীরা আর ভেতরে ঢুকল না। রাহি বলল,
ভাবি ভেতরে এসো।
মীরা হেসে বলল,
না না ভাইয়া, আমার কাজ আছে। দিয়ার চা দিতে এসেছিলাম।
দিয়া চা নিতে নিতে বলল,
ভাবি তুমি সারাদিন অফিস থেকে ফিরে কষ্ট করে চা বানাতে গেলে কেন? রাফি ভাইয়া এলেই আমি সবার জন্য চা করতাম।
তাতে কী? একজন করলেই তো হলো। রাফির বোধহয় দেরি হবে তাই করে ফেললাম।
চা দিয়ে মীরা বেরিয়ে এলো। শাশুড়ির কাছে একটু বসবে সেই উপায়ও নেই। ওকে পেলে রূপ হিমি দুজনেরই আহ্লাদ শুরু হয়ে যায়। কেউই ঠিকমতো পড়াশোনা করে না। অন্যদিন সন্ধ্যার পর তার সময়টাও রাফির সঙ্গেই কাটে। অথচ আজ রাফি নেই, অমনি সবকিছুতে বিষাদ শূন্যতা। সারাদিনের রাগ ভুলে রাফিকে ফোন করল। কিন্তু রাফি ফোন না ধরে কেটে দিল। ফোন কাটার সঙ্গে অটো সেভ করা ব্যস্ততার মেসেজটা এলো। মীরার খুব অভিমান হলো। আর ফোন দেবে না সে। এমনকি রাফি ফেরার পর একটি কথাও বলবে না আজ রাতে আর। বরং কিছু কাজ করে সময় কাটানো যাক। সালওয়া মীরার বাতিল করা জামাকাপড়গুলো চেয়েছিলেন। সবার বাতিল কাপড়গুলো একসঙ্গে গ্রামে পাঠিয়ে দেবেন। মীরা তার বাতিল জামাকাপড়গুলো পরিত্যক্ত ব্যাগে ভরে বাথরুমের ওপরের ফলস ছাদে রেখেছিল। সেগুলো নামিয়ে দেয়া একটা জরুরি কাজ। আলসেমি করে নামানো হচ্ছে না। রাফিকেও বলতে মনে থাকে না। পরমুহূর্তেই ভাবল, সে রাফিকে দিয়ে নিজের কোনো কাজ আর করাবে না। নিজের কাজ নিজেই করবে। এখন থেকে রাফির সঙ্গে লেনদেন কমিয়ে ফেলতে হবে। ওর ওপর এত নির্ভরশীল হলে চলবে না। চেয়ার টেনে নিয়ে তার ওপরে টুল দিয়ে মীরা ওপরে উঠল। কিন্তু বিধি বাম কাপড়ের ব্যাগটা টান দিতেই সেটার ধাক্কা লেগে একটা ছোট সাইজের চটের বস্তা পরে গেল নিচে। আর সেটার ভেতর থেকে কিছু একাডেমিক পরিত্যক্ত বইপত্র, ম্যাগাজিন বেরিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সারাঘর হলো। উফ রাফির কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? এসব কেজি দরে বিক্রি করে দিলেও তো পারে। ঘরের আবর্জনা সাফ হয়। এখন এক কাজ করতে গিয়ে আরেক কাজ বাড়ল। কাপড়ের ব্যাগটা নিচে ফেলে নেমে এলো মীরা। বইগুলো গোছাতে গোছাতে খেয়াল করল বইগুলো কম্পিউটার সাইন্সের! হঠাৎ মায়া হলো মীরার। আহারে রাফি পড়ালেখা ছাড়লেও কম্পিউটার সাইন্সের বই পড়েছে! পরম মমতায় বইগুলো গুছিয়ে রাখল মীরা। সঙ্গে কিছু ডায়েরিও ছিল। একটা ডায়েরি ওপর থেকে পড়ার সময়েই খুলে পড়েছে। সেই ডায়েরির খোলা পাতার লেখাটায় চোখ আটকে গেল মীরার। কোথাও কোথাও কালি ছড়িয়ে গেছে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা…
মীরা আমার কাছে মরে গেছে। কিন্তু নামটা পিছু ছাড়ছে না। জীবনের প্রথম একটা টিউশনি জুটল, ছাত্রীর নাম মীরা, তাই টিউশনিটা আর করা হলো না। এমনিতেও আমার দ্বারা টিউশনি হবে বলে মনে হয় না। রাস্তায় মেয়েরা হেঁটে যায়, একজন আরেকজনকে ডাক দেয় মীরা বলে। সেদিন দেখি, ইউনিভার্সিটির পাশে একটা নতুন টি স্টল হয়েছে, নাম মীরা টি স্টল। আজ রং নাম্বারে একটা কল এলো। সেই মেয়ের নামও মীরা। বেচারি মিষ্টিকণ্ঠী মেয়েটা কি না নামের জন্য প্রথমেই ধমক খেল। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কে সে বলল, আমি মীরা। আসলে দুটো শব্দ শুনে কণ্ঠটা ঠাওর করতে পারিনি। এক্স মীরা ভেবে বকে ফেলেছি। দুনিয়াতে এত মীরা কেন ভাই? নাকি সব মীরা এসে আমার কাছে মরে?
রাফসান শিকদার
১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
·
·
·
চলবে...................................................................................