হাসপাতালের সম্মুখে সাদা রঙের গাড়িটি থামলো। চারপাশে কোলাহল। অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ , রোগীদের নিয়ে দৌড়াদৌড়ি এইসব ই চলছে। কৌশিকও কোনো দেরি না করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। এক মুহূর্তও নষ্ট না করে অনন্যাকে আলতো করে কোলে তুলে নিল সে।মেয়েটা তখনও নিথর হয়ে পড়ে আছে। মুখে কোনো চেতনার চিহ্ন নেই। কৌশিক কোলে নিলেও শরীরের ভারটা একদম ছেড়ে দিয়েছে ওর ওপর। কিন্তু কৌশিকের কোনো সমস্যা হলো না। বরং অনন্যাকে কম ওজনের বলেই মনে হলো ওর কাছে।
হাসপাতালের অভ্যন্তরে কৌশিক হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো। সোজা চিৎকার করে উঠল,
“কেউ একজন আসুন! ডাক্তার! প্লিজ, কেউ ডাক্তার ডাকুন!”
চারপাশে রোগীদের আত্মীয় স্বজনের ছড়াছড়ি। কারো কান্নাকাটি করা চোখ, তো কারো ভাবলেশহীন মুখ! আবার কেউ চিন্তায় বিভোর হয়ে বসে আছে তার প্রিয়জনকে নিয়ে। এর ই মাঝে চলছে নার্সদের ছোটাছুটি। ভবনের নিস্তব্ধ বিহীন অবস্থা আরো একটু বাড়াতে ছুটে এল কয়েকজন নার্স। একজন তাড়াতাড়ি স্ট্রেচার এনে দিল। অনন্যাকে সাবধানে শুইয়ে দেওয়া হলো সেই স্ট্রেচারে। কৌশিকের চোখেমুখে আতঙ্ক এবং অস্থিরতা! চারপাশে ব্যস্ত পায়ের শব্দ। আর চলছে ডাক্তার-নার্সদের ছোটাছুটি।
অনন্যাকে পর্যবেক্ষণের জন্য বড় একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। এই রুমে অনেক রোগীদের ছড়াছড়ি। একজন সিনিয়র ডাক্তার এসে অনন্যাকে দ্রুত পরীক্ষা করা শুরু করলেন। প্রথমে নাড়ি দেখলেন। চোখে টর্চ ফেললেন।
তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,
“একটা ইনজেকশন দিচ্ছি, রেসপন্স দেখুন। নার্স, স্যালাইন প্রস্তুত করো তৎক্ষণাৎ।”
ডাক্তারের নির্দেশে কাজ চলতে লাগল দ্রুত। এই সময়ে নুহাশ অবশেষে গাড়ি পার্ক করে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকল। চোখ ঘুরিয়ে খোঁজাখুঁজি করে আর দুশ্চিন্তা নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই কৌশিককে দেখতে পেল।
দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ভাইয়ের পাশে দাঁড়াল।
কৌশিক শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনন্যার দিকে। তার নিঃশ্বাসটাও এখন নির্ভর করছে সেই মেয়েটার জেগে ওঠার উপর।
ডাক্তার কৌশিকের দিকে তাকিয়ে এক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“পেশেন্টের হাসবেন্ড কে?”
কৌশিক, নুহাশ দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। চোখাচোখি করে নিল তারা। মাথায় হাজার শব্দ এলোমেলো হয়ে ভিড় করছে কৌশিকের। কিন্তু ঠোঁট একটাও শব্দ খুঁজে পেল না।
ডাক্তার একটু বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন,
“আচ্ছা, আপনারা কি ইনার অভিভাবক? নাকি বাড়ির কাউকে ডাকা লাগবে?”
এইবার কৌশিক এক ধাপ এগিয়ে এল।
মুখে একটা স্থিরতা এনে বলল,
“আমি! আমি ওর অভিভাবক। আপনি আমাকে সব বলুন। ওর কী হয়েছে? খুব সিরিয়াস কিছু?”
ডাক্তার একবার ফাইলের দিকে তাকালেন, তারপর সরাসরি কৌশিকের চোখে চোখ রেখে বললেন,
“অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু অবহেলার কারণে অবস্থাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। প্রচণ্ড দুর্বলতা, ব্লাড প্রেসার অনেক নিচে নেমে গেছে। মনে হচ্ছে গত কয়েকদিন ভালোভাবে খাওয়া-দাওয়া করেনি। স্ট্রেস আর ফিজিক্যাল এক্সরশনের কারণে শরীরের অবস্থা ভেঙে পড়েছে। তাছাড়া বিষয়টি বাচ্চার উপরে ইফেক্ট পড়বে তাই সাবধানে।”
একটু থেমে তিনি আবার বললেন,
“তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা স্যালাইন দিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও জ্ঞান ফিরে পাবে। তবে মানসিক চাপ অনেকখানি কাজ করেছে। ওর সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করুন, কী এমন ঘটছে যার জন্য এই অবস্থা।”
কৌশিক একদৃষ্টিতে ডাক্তারের কথা শুনছিল। ডাক্তার কথা বলে চলে গেলো। নার্স বাকি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
নুহাশ ভাইয়ের বাহু ধরে বললো,
"এই মেয়েটিকে চেনো তুমি?"
"হুম! আমার স্টুডেন্ট!"
আধাঘণ্টা কেটে গেছে নিঃশব্দ উদ্বেগে। হাসপাতালের কেবিনে নিঃশব্দে বসে ছিল কৌশিক। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অনন্যার নিথর মুখের দিকে। নুহাশ বাইরে গেছে কিছু হালকা খাবার আনতে। এই সময়েই ধীরে ধীরে অনন্যার চোখের পাতায় নড়াচড়া দেখা গেল। মেয়েটার নিঃশ্বাসে ছন্দ ফিরতে লাগল। চোখ দুটো কষ্ট করে মেলে ধরল সে। মনে হচ্ছে আলোটা সহ্য করতে পারছে না। মাথাটা একটু নাড়াতে গিয়েই কুঞ্চিত হলো কপাল। কষ্ট হচ্ছিল বুঝাই যাচ্ছিল।
কৌশিক সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসে পাশে ঝুঁকে পড়ল।
ওর গলার আওয়াজ নরম হয়ে এলো। কাঁপা আর অদ্ভুত রকমের সংবেদনশীলতায় ভরা গলায় বলে ফেললো,
“আস্তে! উঠতে হবে না এখন। তুমি সেফ আছো।”
অনন্যার দৃষ্টি ধীরে ধীরে ফোকাস পেল। চোখ ঘুরিয়ে তাকাল কৌশিকের দিকে। আর মুহূর্তেই চোখ দুটো বড় হয়ে উঠল। শরীর শিউরে উঠল এক লহমায়। আশেপাশে তাকিয়ে খেই হারিয়ে ফেললো সে। এখানে কীভাবে এসে পৌঁছালো অনন্যা? আর এই বদলোকটাই বা এখানে কি করছে? অনন্যা একটু সরে আসলো।
আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে বললো,
"আমি এখানে কি করছি?"
"তো ম্যাডাম রাস্তায় কী আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে চাইছেন? অনেক আরাম পেয়েছেন বোধহয়। "
অনন্যা ধপ করে উঠে বসলো। হাতে একটু টান লাগলো তার। কিন্তু এসবে ওর ধ্যান নেই।
চোখ পাকিয়ে বলল,
"মাথা ঠিক আছে আপনার? কি আজগুবি কথা বলছেন!"
"তো কি শুনতে চাইছেন? আসার সময় তো দেখলাম রাস্তায় পড়ে ছিলেন! আমি না দেখলে এখন কোথায় থাকতেন হিসেব আছে?"
অনন্যা চেঁচিয়ে উঠলো,
"চুপ থাকুন। যান তো এখান থেকে। আপনাকে একদম দেখতে ইচ্ছে করছে না।"
কৌশিক অনন্যার হাতটা আয়েশ করে ধরলো। দেখলো কোথাও ব্যথা পেয়েছে নাকি মেয়েটা।
নিচু গলায় বললো,
"এই না তখন বলছিলেন ভালোবাসেন আমাকে?"
অনন্যা ফটাস করে হাতটা সরিয়ে নিলো। কটমট করে তাকিয়ে বললো,
"আপনার এই দুমুখো স্বভাব আর ভালো লাগছে না। শান্তি দিন আমাকে।"
অনন্যা ধীরে ধীরে পাশ ফিরে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। চোখ দুটো অদূরে কোথাও স্থির রেখে দিয়েছে। কিন্তু মনে চলছে হাজারো অনিশ্চয়তার ঢেউ। শরীরটা নিঃসন্দেহে দুর্বল। কিন্তু তার চেয়েও ক্লান্ত এই মনটা। সে কারো মুখোমুখি হতে চাইছে না এই মুহূর্তে। সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছে। এই সময়ে পর্দা ঠেলে ভেতরে এলো নুহাশ। হাতে দু’তিনটা প্যাকেট। হালকা স্যুপ এনেছে সবার জন্য। সে জানে, হাসপাতালের খাবার এমনিতেই মেয়েটার ভালো লাগবে না। তাই সে-ই কৌশিকের নির্দেশে বাইরে থেকে খাবার এনে ফেলেছে।
কেবিনে ঢুকেই নুহাশ থমকে গেল। দৃশ্যটা কোনও সিনেমার দৃশ্যের মতো। তার ভাই কৌশিক চুপচাপ বসে হাত ভাঁজ করে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। উল্টোদিকে অনন্যা মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। একান্ত নিজের ভেতর ডুবে আছে। চিন্তায় কুঁচকে গেছে তার কপাল। মনে হচ্ছে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের মান অভিমান চলছে। মনে মনেই হেসে ফেললো সে। অতঃপর একটু কেশে বললো,
"খাবার এসে গেছে!"
কৌশিক মুখ ফিরিয়ে তাকালো নুহাশের দিকে। একই সময়ে অনন্যাও হালকা ভর দিয়ে উঠে একটু সোজা হলো। তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল অচেনা ছেলেটার মুখে।
ভ্রু কুঁচকে গেল। এই ছেলেটা কে? চেহারাটা পুরোপুরি বাঙালিদের মতো নয়। একটা বিদেশি ছোঁয়া আছে কৌশিক স্যারের মতো। ঠিক যেমনটা চোখে-মুখে, ত্বকে এবং হাঁটাচলায়। তবে যখন কথা বলল ছেলেটার বাংলা উচ্চারণ ছিল নিখুঁত এবং স্পষ্ট।
অনন্যা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি আবার কে?”
নুহাশ কিছু বলার আগেই কৌশিক শান্ত গলায় বলল,
“আমার ছোট ভাই।”
অনন্যা চোখ কিছুক্ষণ স্থির রাখলো নুহাশের মুখে। অতঃপর আবার মাথা ঘুরিয়ে শোয়ায় মনোযোগ দিলো।কিন্তু মাথায় ঠিক ই চিন্তা ঘিরে ধরলো। এই কৌশিক স্যারের আবার ভাই ও আছে?
কৌশিক উঠে নুহাশের কাছ থেকে প্যাকেটগুলো নিলো। নার্সকে বলে কিছু প্লেট, বাটির ব্যবস্থা করলো। খাবার গুছিয়ে কৌশিক অনন্যার দিকে এগিয়ে গেলো। অনন্যা যেই পাশে মুখ করে বসে আছে ঠিক সেই পাশে টুল নিয়ে বসলো কৌশিক। অনন্যা কৌশিককে দেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
কৌশিক অনন্যার এই দুষ্টুমি ভাব দেখে কঠোর গলায় বললো,
"চুপচাপ উঠে বসুন, ম্যাডাম। বেশি করলে কিন্তু এখনি রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসবো।"
অনন্যা দ্রুত চোখ খুললো। চোখ পিটপিট করে বললো,
"আমার সাথে এভাবে কথা বলার সাহস কীভাবে পেলেন? কে আপনি? কেউ তো নন! "
কৌশিক তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো,
"কেউ নই?"
অনন্যা দুদিকে মাথা নাড়লো।
"না!"
কৌশিকের কণ্ঠে একধরনের রুক্ষতা ঝরে পড়ল,
"আপনার ভার্সিটির স্যার আমি!"
অনন্যা হেসে বললো,
"কোন ভার্সিটির স্যার এভাবে তার স্টুডেন্টকে খাইয়ে দিতে চায়?"
কৌশিক খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো। অনন্যার কথায় কিছু একটা বেঁধে গেলো ওর ভিতরে। সে চোখ সরিয়ে নুহাশের দিকে তাকালো। ছেলেটা একটুও খেয়াল করছে না এদিকে। টেবিলের ওপর রাখা স্যুপের বাটিতে চামচ ডুবিয়ে ফুঁ দিচ্ছে আর চোখ গেঁথে রেখেছে ফোনের স্ক্রিনে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে দুনিয়ায় ওর চেয়ে ব্যস্ত কেউ নেই।
কৌশিক চোখ ফেরাল অনন্যার দিকে।
" অধিকার চাইছেন? ওকে, খুব তাড়াতাড়িই আপনাকে অধিকার বুঝিয়ে দেবো। নিজেকে প্রস্তুত রাখুন। দেখবেন আবার ভয় পাবেন না যেন। কারণ যখন আমি অধিকার নিয়ে হাজির হবো, এক পাও নিজের ইচ্ছেতে পেছাতে পারবেন না। তাই এখন চুপচাপ খাবার খেয়ে নিন।"
অনন্যা কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল। লোকটার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না সে। বকলো নাকি অধিকার জাহির করলো কোনটা?কৌশিক চোখ কুঁচকে তাকাতেই অনন্যা আস্তে আস্তে উঠে বসলো। কৌশিক নিজে অনন্যাকে খাইয়ে দিতে লাগলো।
অনন্যা কৌশিক স্যারের যত্ন দেখে বেশ অবাকই হলো। স্যারের দিকে গভীরভাবে খেয়াল করলো। বেশ ভালই লাগছিল তার। পুরোনো প্রিন্সটার কথা মনে পড়ে গেলো। যে নাকি অনন্যার কিছু হলে নিজেই মাথা খারাপ করে বসে থাকতো আজ তাকে খুব মিস করছে অনন্যা। কেনো চলে গেলেন তিনি? চলে গেলেও অনন্যাকে নিয়ে যেতেন। হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। এই মানুষটাকে দেখে আবারও বারবার প্রিন্সের কথা মনে পড়ে। ইনি না থাকলেও অনন্যা তার প্রিন্সের মাঝেই ডুবে থাকতো। কিন্তু কৌশিক স্যার আবারো এসে অনন্যার মনে আশা জাগিয়ে দিয়েছিল কিন্তু বারে বার তা ভেঙ্গে যায়। এই কষ্ট অনন্যা নিতে পারে না। প্রিন্সটা নেই এটা ভাবতেই অনন্যার মাথা ঠিক থাকে না।
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৌশিক স্যারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো,
"এই মানুষটা আসলে কী? একসময় গম্ভীর, রাগী ভাব দেখায় আবার এখন এতো কোমল এবং যত্নশীল হয়ে উঠেছে! কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না।"
কৌশিক চামচে স্যুপ তুলে সামনে ধরতেই অনন্যা ধীরে ধীরে খেতে শুরু করলো। কোনো প্রশ্ন করলো না। শুধু চুপচাপ কৌশিকের চোখে চোখ রাখলো। কৌশিক একরকম স্থির দৃষ্টিতে অনন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। অনন্যাকে এখন আর অচেনা মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল এই মেয়েটিই বুঝি তার জীবনের একমাত্র অজানা পরিচয়। যাকে সে হারাতে চায় না, অথচ কাছে টানতেও এতো দ্বিধা বোধ করছে।
কৌশিক খেয়াল করেনি কিন্তু নুহাশ ঠিকই চুপচাপ তাদের এই নীরব মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইলো। সে শুধু দূর থেকে দেখে গেলো দুজন মানুষের ভেতর জমে থাকা
অধিকার, অভিমান আর অনুচ্চারিত ভালোবাসা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে এক অদ্ভুত বন্ধনে।
******
রাত নেমেছে। তবুও আলো জ্বলছে এই বিশাল রুমে। শত রোগীরা ভীড় করছে এই রুমে। পর্দায় ঢাকা আছে প্রতিটি বিছানার চারপাশ। ডাক্তার এসে আবারো চেক করে গেলেন অনন্যাকে। জানিয়ে গেলেন এখন চাইলে ছেড়ে দেওয়া যাবে, তবে যত্ন নিতে হবে নিজের। ওষুধ ঠিকমতো খেতে হবে, বিশ্রাম নিতে হবে, আর না খেয়ে থাকা যাবে না কোনোভাবেই।
কৌশিক একমনে সব শুনলো। অনন্যার সুস্থতার কথা শুনে অদ্ভুত এক শান্তি পেলো সে। কিন্তু ভেতরে তাও খুঁতখুঁতে অনুভব হচ্ছে। তাই বাইরে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে আরেকটু কথা বলে নিলো সে। এই ফাঁকে অনন্যা চুপচাপ উঠে হাসপাতালের পোশাক ছেড়ে নিজের পোশাকে পড়ে নিলো। কাঁধে এলোমেলো চুলের ছড়াছড়ি। চোখে অল্প ক্লান্তি। কিন্তু মনটা এখন ভালোই আছে। হয়তো কৌশিক স্যারের যত্ন পেয়ে সেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেছে!
কৌশিক অনন্যার অনুমতি নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করলো। অনন্যা এখনো গলায় ওড়না জড়ায় নি। তাই কৌশিক ওর দিকে একবার তাকালেও চোখ ফিরিয়ে নিলো সাথে সাথে। অনন্যার দিকে না তাকিয়েই এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে। দরকারি কাগজপত্র হাতে নিয়ে বলে উঠলো,
"ঠিকঠাক হয়ে বাইরে আসুন। নুহাশ গাড়িতে বসে আছে।"
অনন্যা চটজলদি বিছানা থেকে ওড়না টেনে গলায় জড়িয়ে নিলো। কৌশিক স্যার মুখ তুলে একবার চোখাচোখি করলেন অনন্যার সঙ্গে অতঃপর বেরিয়ে গেলেন। অনন্যাও তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। স্যারের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
"ধন্যবাদ, স্যার। আপনি না থাকলে আমার যে কি হতো!"
কৌশিক গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,
"কি আর হতো! রাস্তায় পড়ে থাকতেন তারপর পিশাচেরা আপনাকে ছিঁড়ে খেতো। "
অনন্যা শিউরে উঠলো। সাথে সাথেই কৌশিকের দিকে তাকালো সে। লোকটা এই পর্যন্ত ভেবে ফেলেছে?
কৌশিক বাইরে বেরিয়ে আসলো। কিন্তু অনন্যা সেদিকেই দাঁড়িয়ে থাকলো। আচ্ছা কৌশিক স্যার হঠাৎ বেশি চিন্তা করছে না অনন্যাকে নিয়ে? দুই দিন আগেও তো এমন দেখেনি অনন্যা। ওকে নিয়ে এতো চিন্তিত হয়ে যাবে অনন্যা কখনো ভাবতে পারেনি। তবে যাই হোক বেশ ভালোই লাগছে অনন্যার।
অনন্যা পিছনের সিটে বসেছে। তার দৃষ্টি বাইরের দিকে। নুহাশ খুব জোরে ড্রাইভ করছে। ওর ড্রাইভিং দেখে মনে হচ্ছে বেশ তাড়ায় আছে ছেলেটা। অনন্যা তো ঠিকমতো বাইরে দৃষ্টিও রাখতে পারছে না।
নুহাশ স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
"এরপর আমরা ঘুরতে যাবো।"
কৌশিক অভিব্যক্তি বিহীন কণ্ঠে বললো,
"চুপ থাক! সোজা বাড়ি যাবো আমরা।"
"ভাই! তুমি কেন যে এতো আনরোমান্টিক বুঝি না আমি। কালকে তো বন্ধ ই। আজ একটু দেরি করে গেলে কি হবে?"
"কোনো কাজ না করলে সবকিছুই সহজ মনে হয়। আমি সারাদিন কাজ করে এখন ঘুরতে বের হবো? ইমপসিবল! তাছাড়া তোর সাথে আমি রোমান্টিসিজম দেখাতে যাবো কোন দুঃখে?"
নুহাশের মুখ ভার হয়ে গেল, সুন্দর ফর্সা মুখটা একটুখানি হয়ে গেল। সে শব্দ না করে গাড়ি চালাতে লাগল। কিছুক্ষণের খোঁজাখুঁজির পর এসে থামলো অনন্যার বাড়ির সামনে। কৌশিক চুপচাপ গাড়ি থেকে নামলো। দরজা খুলে অনন্যার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।
অনন্যা এমনিই নেমে আসলো আর ধীর স্বরে বললো, “ধন্যবাদ।”
তারপর মাথা নিচু করে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। কৌশিক দাঁড়িয়ে রইলো খানিকটা সময়। তারপর কিছু না ভেবেই পা বাড়াল অনন্যার পেছন পেছন।পেছনে স্যারের পায়ের শব্দ শুনে থেমে গেল অনন্যা।
চমকে তাকালো। কৌশিক তার পাশে এসে থামতেই অনন্যা জিজ্ঞেস করলো,
"আপনি পেছনে আসছেন কেন?"
কৌশিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
"কে জানে, যদি মাঝরাস্তায় আবার পড়ে যান! তাই ভাবলাম, দরজা অবধি না হয় এগিয়েই দিই।"
অনন্যা চোখ বড় বড় করে তাকালো। এই পেয়েছে একটা কথা। এটা নিয়েই সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করছে এই লোকটা। অনন্যা তাও শান্ত স্বরে বললো,
"আরে না, লাগবে না একদম! বাকি পথ আমি নিজেই ঠিক ঠাক চলে যাবো।"
কৌশিক নিজেই সামনে এগিয়ে হাঁটতে লাগলো। অনন্যাদের বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকে গেলো সে। অনন্যা ছুটে আসলো তার পিছন পিছন। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। কৌশিক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। অনন্যা তার পিছু পিছু যাচ্ছে। নিজেদের ফ্লোরে এসে পড়লে অনন্যা আগেই জানিয়ে দিলো।
হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে আসলে কৌশিক পিছন ফিরে বললো,
"ওকে! তাহলে আবার রবিবারে দেখা হচ্ছে। নিজের খেয়াল নিবেন।"
অনন্যা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো। সামনে এগিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলতে লাগল। কৌশিক এখনো পিছনে দাঁড়িয়ে। অনন্যা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেলে কৌশিক জিজ্ঞেস করলো,
"বাড়িতে কে কে আছে?"
অনন্যা কৌশিক স্যারের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। একবার পিছনে তাকিয়ে ঘরটা দেখে নিলো। বললো,
"আপাতত কেউ নেই। সবাই বাইরের দেশে আছে।"
"হোয়াট!"
কৌশিক চেঁচিয়ে উঠলো। অনন্যা থতমত খেয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,
"চেঁচাচ্ছেন কেনো? যান বাড়ি যান।"
সে দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে কৌশিক দ্রুত হাত বাড়িয়ে দরজায় ঠেকিয়ে দিলো। অনন্যা দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে বললো,
"কি সমস্যা?"
কৌশিক দরজা সম্পূর্ণ খুলে ফেললো। ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
"এর মানে বলতে চাইছেন আপনি এই অবস্থায় এই বাড়িতে একা থাকছেন? আপনার খেয়াল রাখার কেউ নেই?"
অনন্যা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
"কৌশিক স্যার! আমি একাই নিজের জন্য যথেষ্ট। বুঝলেন? তাছাড়া আপনি কোন অবস্থার কথা বলছেন?"
"আপনি যে প্রেগন্যান্ট তা ভালো করেই জানি। আর নিজের জন্য একাই যে যথেষ্ট তাও এই দু চোখে ভালোমতোই দেখতে পাচ্ছি।"
অনন্যা হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলো। এই লোকটা তার প্রেগন্যান্সির কথা জানে? ইশশ! এখন তো ভার্সিটির মানুষ ও জেনে যাবে। কৌশিক অনন্যার অপর হাত টেনে ধরে বললো,
"চলুন আমার সাথে।"
অনন্যা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শুধালো,
"কোথায়?"
"আমার বাসায়!"
·
·
·
চলবে..................................................................................