আতাউর মির্জা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। ওনার চোখ-মুখ কেমন অদ্ভুত লাগছে দেখতে, চোখ দুটোকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। বাপ-ছেলে মিলে এমন ধোঁকা দেবে, কখনো ভাবেন নি তিনি। এবার কী করে মুখ দেখাবেন সকলকে? মানুষ তো নানান কথা বলবে। আর মানুষ এমন এক জীব যারা সুযোগ পেলে কটু কথা বলতে এক ইঞ্চিও জায়গা ছাড় দেয় না। মেহুল! মেহুলের কী হবে যখন সবটা জানতে পারবে এই ব্যাপারে? মেয়েটা তো ভেঙে পড়বে। আতাউর মির্জার মাথা কাজ করছে না। ওনার একটা ভুল সিদ্ধান্তে নাতনির পুরো জীবনটা তছনছ হয়ে গেলো। ইতিমধ্যে চারিদিকে নানা রকম কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে—এই গুঞ্জন যে মেহুলের কানে অব্দি পৌঁছাছে না, সেটা তো বলাই বাহুল্য। এক রকম হতাশাগ্রস্ত হয়ে তিনি ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে আমিনুল মতুর্জাকে কল করেন। তিন তিন বার কল করেন কিন্তু আমিনুল মতুর্জা কল ধরেন না। চতুর্থ বারের মতো আমিনুল মতুর্জা কল রিসিভ করে তড়িঘড়ি করে বলে।
“চাচামশাই, আমার একটু পরেই রওনা হচ্ছি। আসলে এখানে একটু ঝামেলা হয়ে গিয়েছিলো, তাই একটু দেরি হচ্ছে। আপনার কলটাও ধরতে পারছি না এজন্যই।”
আতাউর মির্জা ভারী গলায় বললেন, “কী ঝামেলা হয়েছে, শুনি একটু?”
আমিনুল মতুর্জা একটু আমতা আমতা করে বলল, “ও কিছু না…”
আতাউর মির্জা এবার সোজাসুজি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “তোমার ছেলে কোথায়, আমিনুল?”
আমিনুল মতুর্জার এলোমেলো গলার স্বর ভেসে আসে, “ওই তো… আমার একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে।”
“তাহলে ওকে ফোনটা দাও। আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
আমিনুল মতুর্জা থমকে গেলো, “কি বলবেন আমায় বলুন, আমি বলে দিচ্ছি ওকে আর একটু পরেই তো আসছিই আমরা…”
আতাউর মির্জার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো এবার। কণ্ঠ কঠোর হয়ে উঠলো, “একটার পর একটা মিথ্যা বলেই যাচ্ছো, আমিনুল! একটুও থামছে না তোমার এই জিহ্বা।”
আমিনুল মতুর্জা চমকে উঠলেন, “মানে।”
আতাউর মির্জা লম্বা শ্বাস টেনে বললেন, “তোমার ছেলে বাড়িতে নেই, তাই না?”
আমিনুল মতুর্জা ইতিউতি করে বললেন, “কি বলছেন এসব! ও তো বাড়িতেই আছে।”
আতাউর মির্জা শব্দ করে হেসে উঠলেন, “থাক, আর মিথ্যা বলে নিজের পাপের ভার বাড়িও না, আমিনুল। তোমার ছেলে যে বাড়িতে নেই, সেটা আমি ভালো করেই জানি।”
আমিনুল মতুর্জা বিস্মিত গলায় বললেন, “কিভাবে জানলেন?”
আতাউর মির্জা মুখের সামনে চিঠিটা তুলে ধরে বললেন, “তোমার ছেলে নিজ হাতে একটা চিঠি লিখে পাঠিয়েছে আমার কাছে। সুন্দর করে সেখানটায় লিখে দিয়েছে, সে নাকি এই বিয়েটা করতে পারবে না।”
আমিনুল মতুর্জা চিৎকার করে উঠলেন, “কি!”
আতাউর মির্জা শান্ত গলায় বললেন, “হুম, ঠিকই শুনেছো। আর কেন বিয়ে করতে পারবে না তোমার ছেলে সেটা কি তুমি জানো? তোমার ছেলে একজন এইডস আক্রান্ত রোগী। এই খবরটা আজই নাকি সে জেনেছে। এজন্যই নাকি সে হাসপাতালে গিয়েছিল বিয়ে বাড়ি থেকে—সবটাই চিঠিতে লিখেছে সে।”
আমিনুল মতুর্জা চেঁচিয়ে উঠল, “এইডস মানে! কি বলছেন সেটা কি আপনি ভেবে বলছেন কথাটা চাচামশাই?”
আতাউর মির্জা ঠান্ডা গলায় বললেন, “হ্যাঁ। আমি ভেবেই বলছি কথাটা কারণ তোমার ছেলের রিপোর্ট আমার হাতে আর রিপোর্টটা তোমার ছেলেই পাঠিয়েছে প্রমাণ হিসাবে। আর শুধু তাই নয় চিঠিতে আরও অনেক কিছু লিখেছে তোমার ছেলে…”
এই পর্যন্ত কথা বলে থেমে যান আতাউর মির্জা। ওদিকে আমিনুল মতুর্জার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে এসব কথা শুনে। ছেলে এসব কি লিখেছে চিঠিতে আর এইডস হয়েছে মানেটা কি? এটার মানে তো অনেক কিছু দাঁড়ায়! আমিনুল মতুর্জার মাথা কাজ করছে না। ছেলে আর কি কি লিখেছে চিঠিতে, তার বলা মিথ্যা কথাটা লিখে দেয় নি তো আবার?
আমিনুল মতুর্জা কম্পিত কণ্ঠে বললেন, “আর কি কি লিখেছে ও? মানে… ওর কি আরও কোনো অসুখ-বিসুখ আছে নাকি?”
আতাউর মির্জা তীর্যক স্বরে বললেন, “ওর আরও কোনো অসুখ-বিসুখ আছে কি না, সেটা চিঠিতে ও লেখে নি। তবে তোমার বলা মিথ্যা কথাটা ঠিকই লিখেছে।”
আমিনুল মতুর্জা শুকনো ঢোঁক গিলে বললেন, “কি বলছেন এসব! আমি আবার কি মিথ্যা কথা বলেছি? আমি কখন কোনো মিথ্যা কথা বলে নি।”
আতাউর মির্জা রুক্ষ স্বরে বললেন, “তোমার লজ্জা করে না আমিনুল এতো বড় বড় কথা বলতে। তোমার মৃ ত ভাইকে নিয়ে কি করে এতো বড় একটা মিথ্যা কথানবলতে পারলে আমিনুল আমাকে? বড় ভাইয়ের সম্পত্তির লোভে পড়ে এমন একটা জঘন্য মিথ্যা কথা বলতে তোমার বিবেকে একটুও বাধলো না?”
আমিনুল মতুর্জা তড়িঘড়ি করে বললেন, “আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে চাচা মশাই। আমি কোনো মিথ্যা কথা বলে নি। আমার ছেলে এসব কেন লিখেছে, কিসের জন্য লিখেছে আমি সত্যি জানি না সেটা। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি এক ফোটাও মিথ্যা কথা বলে নি আমার মৃত ভাইকে নিয়ে।”
আতাউর মির্জা ধমকের স্বরে বলে উঠলেন, “একদম সাফাই গাইবে না আমিনুল। তোমার মিথ্যাচার ধরা পড়ে গেছে। আর তোমার ভাষ্যমতে যদি এটা সত্যিও হয়ে থাকে তাহলেও আমি আমার নাতনিকে তোমার ছেলের সাথে বিয়ে দিব না। আমি আমার নাতনির এত বড় ক্ষতি করতে পারব না তোমার ওই অসুস্থ, নোংরা, চরিত্রহীন ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে। আজ এই মুহূর্ত থেকে তোমাদের সঙ্গে আমাদের সব সম্পর্ক শেষ। কোনো সম্পর্ক নেই তোমাদের সাথে আমাদের বুঝেছো।”
বলেই আমিনুল মতুর্জার মুখের ওপর কল কেটে দিলেন আতাউর মির্জা। কুঁচকানো চোখ জোড়া বন্ধ করে নিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়েন। বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠে নাতনির শুকনো মুখটা। সেই ছোট্ট বেলা থেকে মেয়েটা নানান ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে এসেছে। এই কাল ঝড় যেন মেয়েটার পিছুই ছাড়ছে না। তবে আজকের এই ঝড়ের পেছনে শেরাজের কোনো হাত নেই তো। কোনো ভাবে কি মেহুলের বিয়েটা আটকানোর জন্য ছেলেটা এই সব কিছু করে নি তো? এতটুকু তিনি খুব ভালো করেই জানেন শেরাজ যা খুশি করার ক্ষমতা রাখে মেহুলকে নিজের করে পাওয়ার জন্য। কিন্তু ওনার কাছে শেরাজ প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়ে আছে মেহুলের বিয়েতে কোনো রকম ঝামেলা করবে না সে নিজে থেকে। জানতে হবে সবটা এর পেছনে সত্যি কি শেরাজ আছে নাকি নেই? কিন্তু নাতি এখনো আসছে না কেন?
শেরাজ দাদাভাইয়ের রুমে এসে হাজির হয়। দাদাভাইয়ের থমথমে মুখটা দেখে সে যা বোঝার বুঝে গেছে—বোমা ইতিমধ্যেই ফেটে গেছে আর তার প্রতিক্রিয়াও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ধীর গতিতে। শেরাজ ঘাড় কাত করে ঠোঁটের কোণে এক টুকরো বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু নিজেকে যথা সাধ্য শান্ত রাখতে হবে উত্তেজিত হলে চলবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে সবটা এগিয়ে নিতে হবে সামনের দিকে। শেরাজ গলা খাকারি দিয়ে বলল।
“দাদাভাই, আমায় ডেকেছো?”
আতাউর মির্জা নাতিকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন বললেন, “দরজাটা লাগিয়ে আসো।”
শেরাজ দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দু কদম এগিয়ে আসে। আতাউর মির্জা শেরাজের সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চিঠিটা নাতির মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন, “এটা কী?”
শেরাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “একটা কাগজ।”
আতাউর মির্জা কিছুটা কপট রেগে বললেন, “সেটা আমি জানি। কিন্তু এটা একটা চিঠি।”
শেরাজ অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “চিঠি? কিসের চিঠি এটা? কে দিয়েছে এটা?”
আতাউর মির্জা লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন, “এটা তোমার চাল, তাই না?”
শেরাজ মুখ ফুলিয়ে বলল, “চাল? কিসের চাল?”
আতাউর মির্জা স্পষ্ট গলায় বললেন, “এই চিঠির কারবারটা তুমি করিয়েছো তাই না যাতে করে মেহুলের বিয়েটা না হয় আসিফের সাথে।”
শেরাজ চিঠিটা দাদাভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে চিঠিটাতে চোখ বুলাতে শুরু করল। কিছুক্ষণ চিঠিটার উপর চোখ বুলিয়ে দাদাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল, “এসব কী! আসিফ বিয়ে করবে না মেহুলকে?”
আতাউর মির্জা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “এই ঘটনার পেছনে তুমি নেই তো?”
শেরাজ ঠোঁট বেঁকিয়ে হালকা হাসল, “তোমার কী মনে হয়?”
আতাউর মির্জা সোজাসাপটা বললেন, “আমার মনে যা কিছু আসুক তুমি শুধু এতটুকু বলো এর পেছনে তোমার কোনো হাত আছে কি না।”
শেরাজ ঠাণ্ডা গলায় বলল, “অদ্ভুত! এর পেছনে আমার হাত থাকতে যাবে কোন দুঃখে? বাপ-ছেলে মিলে তোমায় ঠকিয়েছে। আর এখন উল্টো বলছো এর পেছনে আমার হাত আছে কি না? হাস্যকর ব্যাপার-স্যাপার!”
আতাউর মির্জা চোখ সরু করে তাকিয়ে বললেন, “তার মানে বলতে চাইছো তোমার কোনো হাত নেই এর পেছনে?”
শেরাজ রহস্যময় কণ্ঠে বলল, “যদি থেকেও থাকে, তাহলে তোমার নাতনির জীবন বাঁচানোর জন্য আমাকে তোমার ধন্যবাদ জানানো উচিত।”
আতাউর মির্জা হেসে উঠলেন বললেন, “তোমাকে যা চেনার, সেই কয়েক বছর আগেই চিনে গেছি আমি রাজ। তুমি যে গভীর জলের মাছ, সেটা আর জানতে বাকি নেই আমার। এর পেছনে তোমারি হাত আছে তাই না।”
শেরাজ এবার গলার স্বর কঠিন করে বলল, “হ্যাঁ, এই ঘটনার পেছনে আমারই হাত আছে। আর এই হাত থাকার কারণেই তুমি আজ সত্যিটা জানতে পেরেছো মিস্টার আতাউর মির্জা। না হলে জীবনেও জানতে পারতে না। আমি তো শুধু একটু মাত্র খোঁচা দিয়েছি আর কিছুই না। তোমার কাছে একটা লোক এসে মিথ্যা কথা বলল আর তুমি সেই কথাটা যাচাই না করেই বিশ্বাস করে বসলে তার কথা আর নাচতে নাচতে বিয়েতে মতও দিয়ে দিলে। ভাবলে কি করে, আমি মেহুলের বিয়ে অন্য কারো সঙ্গে হতে দিবো?”
শেরাজের চোখে আগুন জ্বলছে যেন, কণ্ঠে এক প্রকার জেদের আভাস, “মেহুলের বিয়ে আমার সাথেই হবে শুধুই আমার সাথে। এই দুনিয়ার কোনো পুরুষ আমার মতো মেহুলকে ভালোবাসতে পারবে না—এটা তুমি ভালো করেই জানো, দাদাভাই। ও আমার কাছে ভালো থাকবে, নিরাপদে থাকবে।”
একটু থেমে কণ্ঠে পাগলাটে এক আবেগ মিশিয়ে বলল, “একবার ভেবে দেখো দাদাভাই, মেহুলের যদি আমার সাথে বিয়ে হয়, তাহলে ও তোমার চোখের সামনেই থাকবে। কোনোদিন চোখের আড়াল হবে না তোমার। প্লিজ দাদাভাই মেহুলের বিয়েটা আমার সাথে দিয়ে দাও। এখন তো তোমার আর কোনো পিছুটান নেই। আর কেউ তো এসে এ কথা বলবে না—‘আপনি আমায় কথা দিয়েছিলেন, মেহুলের বিয়ে আমার ছেলের সঙ্গে দিবেন।’ ওরা বাপ ছেলে মিলে তোমায় ধোঁকা দিয়েছে মেহুলের সম্পত্তি হাতানোর জন্য আর কিছুই না।”
আতাউর মির্জা কঠোর কণ্ঠে বললেন, “তুমি মেহুলের জন্য বিপদজনক।”
শেরাজ ঘাড় কাত করে ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলল, “আমি? আমি মেহুলের জন্য বিপদজনক?”
আতাউর মির্জা স্পষ্ট, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “হ্যাঁ তুমি মেহুলের জন্য বিপদজনক। পাঁচ বছর আগের সেই ঘটনাটার কথা ভুলে গেছে। ওই একটা ঘটনা মেয়েটাকে কতটা ট্রমার ভেতরে ফেলে দিয়েছিলো তুমি কি সেটা জানো? অবশ্য তুমি জানবে কি করে তোমাকে তো প্যারিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।”
শেরাজ মাথার চুল খামচে ধরে চিৎকার করে উঠল, “পাঁচ বছর, পাঁচ বছর, পাঁচ বছর! ওই এক ঘটনার কথা শুনতে শুনতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি দাদাভাই! আর আমি প্যারিসে যেতে চাই নি তোমরা জোর করে পাঠিয়েছিলে আমায়।”
“না পাঠালে আজ তুমি জেলে থাকতে।”
শেরাজের রাগে, ক্ষোভে চোখ রক্তিম হয়ে উঠল, “শোনো, দাদাভাই! যদি মেহুলের বিয়ে আমার সাথে না হয়, আই প্রমিজ, এই বাড়িতে রক্তারক্তি কান্ড ঘটাব আমি!”
আতাউর মির্জা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কি করবে? আমাকে মে রে ফেলবে?”
শেরাজ হঠাৎই ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। দু’হাতে দাদাভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরে নরম কণ্ঠে বলল, “প্লিজ, দাদাভাই… দয়া করো আমায়। আমি মেহুলকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। ও আমার প্রাণ। ওকে আমার থেকে কেড়ে নিও না। গত পাঁচটা বছর আমি কিভাবে কাটিয়েছি তোমরা কেউ জানো না। প্রতিটা রাত, প্রতিটা দিন ছিল আমার জন্য এক মরণ যন্ত্রণা। আমি শুধু দিন গুনেছি—কবে দেশে ফিরবো, কবে মেহুলকে দেখবো, কবে এই মরণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো? প্লিজ, দাদাভাই, এতটা কঠোর হয়ে যেও না তুমি। আমি তোমার কাছে মেহুলকে ভিক্ষা চাইছি।”
আতাউর মির্জা মুখে কুলুপ এটে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। শেরাজ ধীরে মাথা তোলে তাকায়, চোখের কোণে নোনা জল। দাদাভাইয়ের মুখটা দেখা মাত্রই শেরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। উঠে দাঁড়ায় চোয়াল শক্ত, চোখ জ্বলজ্বল করছে নোনা জলে। দেখে মনে হচ্ছে ভয়ংকর কোনো সিদ্ধান্ত নিছে।
আকস্মিকভাবে শেরাজ শার্টের আড়ালে কোমরে গুজে রাখা একটা পি স্ত ল টা বের করে আতাউর মির্জার দিকে তাক করে ধরে। আতাউর মির্জা স্তব্ধ হয়ে যান এ দৃশ্য দেখে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “রাজ... কি করছো তুমি এসব? পাগল হয়ে গেছো নাকি!”
শেরাজ ট্রিগারে তর্জনী রেখে চোখে উন্মাদনা এনে বলল, “হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গেছি। অর্ধেক পাগল হয়েছি মেহুলের জন্য, আর অর্ধেক পাগল হয়েছি তোমার কারণে। তুমি আমাদের মাঝে একটা বিশাল বড়ো কাঁটা দাদাভাই।”
আতাউর মির্জার কণ্ঠ নালি কাঁপছে “রাজ, শান্ত হও। গু লি বেরিয়ে যাবে কিন্তু যেকোনো সময়।”
শেরাজ ঠান্ডা গলায় বলল, “আমি চাই গু লি বেরিয়ে যাক। এই একটা গু লিই পারে মেহুলকে চিরকালের জন্য আমার করতে।”
আতাউর মির্জা নাতির কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। কথা বলার খেই হারিয়ে ফেললেন। নাতি পুরো সাইকো হয়ে গেছে ওনার, ওনারই আরেক নাতনির কারণে। যেকোনো সময় কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। আতাউর মির্জার মাথা ঝিমঝিম করছে। কী করবেন এখন? কিভাবে এই ছেলেকে শান্ত করবে তা ভেবে কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছেন না।
এদিকে শেরাজ ঘাড় কাত করে দাদাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি একদম স্থির, নির্জীব। যেকোনো সময় ট্রিগার তর্জনী দ্বারা চাপ দিয়ে বসতে পারে আর ঠিক তাই হলো শেরাজ ট্রিগারে চাপ দিয়ে বসেছে আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক আওয়াজে পুরো মির্জা বাড়ি কেঁপে উঠল।
গু লি র শব্দে পুরো মির্জা বাড়িতে এক প্রকার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সবাই থমকে যায়, একে অপরের দিকে হতবাক দৃষ্টিতে তাকায়। মেহুল বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এই গু লি র শব্দটা কোথা থেকে এলো?
সবাই মির্জা বাড়ির অন্দর মহলের দিকে যেতে শুরু করল, গু লি র শব্দ অনুসরণ করে। মেহুল আর এক মুহূর্তও দেরি না করে গায়ে পরিহিত ভারী বেনারসি শাড়িটা উঁচু করে তুলে ধরে দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে আসে। নানাভাইয়ের ঘরের সামনে মামা, মামি, ইফা সহ আরও অনেককে দেখে মেহুল অবাক হয়ে যায়। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে—ঘরের ভেতরে শেরাজ আর আতাউর মির্জা আছেন যে। আর গুলির শব্দটা এই বন্ধ ঘর থেকেই এসেছে, এটাও বুঝে গেছে সবাই। সবাই দরজা খোলার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করে যাচ্ছে, অথচ ভেতর থেকে কোনো প্রকার সাড়া আসছে না। মেহুলের বুকের ভেতরটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে। সে ভিড় ঠেলে দরজার কাছে এসে দরজায় করাঘাত করে বলল।
“নানাভাই কি হয়েছে? দরজা খোলা প্লিজ। ভেতরে কী হয়েছে? শেরাজ ভাই! প্লিজ দরজা খোলো! কি করেছো তুমি নানা ভাইয়ের সাথে?"
শাহানা বেগম মেহুলের কথাটা শুনে ধমকের স্বরে বলে উঠলেন, “কি বলছিস তুই এসব? আমার ছেলে ওর দাদাভাইয়ের সাথে কি করবে? একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না বলে দিলাম শয়তান মেয়ে।”
তখনই ধুম করে দরজাটা খুলে গেলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো শেরাজ। শেরাজের চোখ মুখ অদ্ভুত দেখা যাচ্ছে। সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শেরাজের দিকে। শাহানা বেগম কাতর কণ্ঠে বলল, “রাজ বাবা কি হয়েছে এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?”
শেরাজ কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই দু এক পা এগিয়ে এসে মেহুলের কব্জি চেপে ধরে ভারী কণ্ঠে বলল, “চল।”
মেহুল কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করে শেরাজ। সবাই স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। মেহুল শেরাজের শক্ত হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করতে করতে বলে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে? আমি নানাভাইয়ের কাছে যাব! কী করেছো তুমি নানাভাইয়ের সাথে? আমার হাত ছাড়ো বলছি শেরাজ ভাই!”
শেরাজ মেহুলের কোনো কথা পাত্তা না দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল বাড়ির বাইরে। পেছন পেছন শাহানা বেগমও ছেলেকে ডাকতে ডাকতে যাচ্ছে।
·
·
·
চলবে................................................................................