ফানুস - পর্ব ৪০ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই হাত কখনো ছাড়ব না। আজীবন তোর পাশে থাকব। প্রতিজ্ঞা করছি, ধর্ম, পরিবার, সমাজ কোনো কিছু আমাকে তোর। থেকে দূরে সরাতে পারবে না। প্রতিজ্ঞা করছি, কখনো তোকে কাঁদাব না। প্রতিজ্ঞা করছি, তুই ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে আমার জীবনে আসবে না। প্রতিজ্ঞা করছি, পরীক্ষার হলে তোকে একা রেখে বের হব না। প্রতিজ্ঞা করছি, তোকে প্রতিদিন চালতার আচার কিনে দেব। প্রতিজ্ঞা করছি, বৃষ্টির মধ্যে টংদোকানে বসে চা খেতেও আপত্তি করব না আর। প্রতিজ্ঞা করছি, তোর সব প্র্যাকটিক্যাল আমি করে দেব। আর…ঐশ্বরিয়ার পেটের দিকেও তাকাব না।’

এই প্রতিজ্ঞাগুলো করেই প্রিয় পেট্রাকে নিজের জীবনে এনেছিল। কয়টা রাখতে পেরেছে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলোই রাখতে পারে নি। গভীর রাতে সিগারেট খেতে খেতে এসবই ভাবছিল প্রিয়। নিজেকে খুব নিকৃষ্ট প্রাণী বলে মনে হচ্ছিল।

তার পেছনে লাগিয়ে রাখা গুপ্তচর কবিরের সঙ্গে বাবর খানের কথা লুকিয়ে শুনেছে নিকিতা। মাত্র কয়েকদিন আগে কবিরের পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় নাকি প্রিয়র পেছনে পেছনে এবার যেতে পারে নি বাবর খানও দেশের বাইরে থাকায় নিজে যেতে পারেন নি। এর আগে প্রিয় যতবার যেখানেই গেছে, কবির নাকি ফলো করেছে। সর্বনাশ! ভাগ্যিস, আগেরগুলো সত্যি সত্যিই অফিশিয়াল ট্যর ছিল। প্রিয় এবারের মতো বেঁচে গেছে। না হলে বাবা কী করত কে জানে! লোকটা যদি তার কোনো ক্ষতি করত, তাহলে সে তাকে ভয় পেত না। লোকটা সব সময় তার প্রিয়জনদের ক্ষতি করে তাকে কষ্ট দেয়। আর সে যা-ই করে, তা টের পাওয়া যায় করার পর। আগে ঘুণাক্ষরেও জানা যায় না। তাই তাকে সত্যিই ভয় হয়। তবে কবিরের ব্যাপারটা জানায় ভালো হয়েছে। এরপর থেকে সাবধানে থাকতে হবে।

—————

পেট্রা ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই প্রিয়র ফোন এল। প্রিয়র নম্বর দেখেই যথারীতি হার্টবিট ফাস্ট হয়ে গেল, যেমনটা সব সময় হয়। পেট্রা বুঝতে পারছে না ফোন ধরাটা ঠিক হবে কি না। প্রিয় গেছে এক মাস হয়ে গেছে। এর মধ্যে সে অনেকবারই ফোন করেছে কিন্তু মাত্র দুবার ফোন ধরেছে পেট্রা। প্রিয়র সঙ্গে কথা না বলে সে থাকতে পারে। বরং কথা বলেই থাকতে পারে না। একবার কিছুক্ষণ কথা বললেই বুকের ভেতর ঝড় শুরু হয়ে যায়। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কথা বলতে ইচ্ছা করে। সবকিছু অসহনীয় হয়ে ওঠে। প্রিয় এতবার ফোন দিচ্ছে, শেষমেশ ধরল পেট্রা। ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই প্রিয়র ধমক, ‘সমস্যা কী তোর?

‘ঘুমিয়ে ছিলাম। কেমন আছিস?

‘জাহান্নামে যেমন থাকা যায়।

‘কী হলো আবার?

‘এক শবার ফোন দিছি, পেট্রা।

‘আমি ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমাই প্রিয়।’

‘বাহ দারুণ! আজকে না হয় ঘুমাচ্ছিলি। এত দিন?

‘ব্যস্ত ছিলাম।

‘শুদ্ধর সাথে প্রতিদিন কথা বলার সময় তো তুই ব্যস্ত থাকিস না।’

‘উফ। ঝগড়া করতে ফোন করেছিস?

প্রিয় এবার একটু নরম হলো। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘না, তোর অবস্থা কী? সুখবর আছে কোনো?

পেট্রা হেসে বলল, এত তাড়াতাড়ি?

‘কই তাড়াতাড়ি? এক মাস হয়ে গেছে তো?

‘আমি টেস্ট করি নি।

‘কেন?

‘ভয় লাগছে, যদি রেজাল্ট নেগেটিভ হয়!

‘বেক্কল! টেস্ট করাবি আজই। প্রতিদিন অপেক্ষা করি এই সুখবরটার জন্য। চিন্তায় আমার অবস্থা নাজেহাল।

‘আজ সম্ভব না। এই মাসেই রায়ান এসেছে, বাড়তি খরচ গেছে অনেক। তাই হাত একদম খালি। স্যালারি পাই নি এখনো।

‘আমি টাকা পাঠাই, প্লিজ?

‘না প্রিয়, প্লিজ। আমি সপ্তাহখানেকের মধ্যে স্যালারি পেয়ে যাব। তারপর টেস্ট করে তোকে জানাব।’

‘জানতাম আমার টাকা নিবি না। ঠিকাছে, আজকাল তো ঘরে বসেও টেস্ট করা যায়। করে জানা, প্লিজ।

‘আরে ধুর, ওসবে ভরসা নেই। আমি হসপিটালেই যাব।’

‘ঠিকাছে, আমাকে যত দ্রুত সম্ভব জানাবি।’

‘হুম, জানাব, তবে প্রিয়, এই জানানো পর্যন্তই। তারপর এই বাচ্চার অছিলায় তুই আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবি না। বাচ্চার সব দায়িত্ব শুধুই আমার।

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘জানতাম এটা বলবি।’

‘যৌক্তিক কথা বলেছি। এই অছিলায় তোর সাথে যোগাযোগ রাখলে তো তোর সাথে ঘর করতেও পারতাম, তাই না?

‘বাচ্চাটা তো আমারও।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি তোর কাছে চেয়ে নিয়েছি।

‘ঠিকাছে অন্তত বাচ্চার জন্ম পর্যন্ত যোগাযোগ রাখ। তেমন কিছুই তো করতে পারব না, শুধু দূর থেকে একটু সাপোর্ট দিতে দে।

পেট্রা হেসে বলল, আচ্ছা, সেটা যখনকারটা তখন দেখা যাবে।

‘আর শোন না, পেট বড় হলে তাকে কেমন লাগবে, একটু দেখতেও পারব না?

‘আরে পাগল, তুই আরেকবার আসতে গেলে তোর বাপের কাছে ধরা খাবি।’

‘উফ, তাহলে কি আমি আমার ছেলেটাকেও একবার দেখতে পাব না?’

‘ছবি পাঠাব, তা-ই দেখিস। ভিডিও কলে দেখিস। দেখা করতে এলে হয়তো…’

‘হয়তো?

পেট্রার বলতে ইচ্ছা করল, হয়তো জন্মেই মরা লাগবে বাচ্চাটার, কিন্তু এ কথা বললে প্রিয় কষ্ট পাবে। তাই বলল না। শুধু বলল, ‘সাবধানে চলবি প্রিয়, তোর বাবা যেন এই বাচ্চার কথা কখনো জানতে না পারে।

‘জানবে না। তুই দেখিস।’

‘কীভাবে এত শিওর হচ্ছিস?

প্রিয় কবিরের ব্যাপারে সব খুলে বলতেই পেট্রা বলল, ‘দেখলি তো, আমি বলেছিলাম না নিকিতা খারাপ নয়, ও শুধু ইম্যাচিওরিটি থেকে উল্টোপাল্টা কাজ করত। এখন বয়স বেড়েছে, ভুল থেকে শিখেছে, বুঝদার হয়েছে। এখন তার বাবার লাটাই তার বিরুদ্ধেই ঘুরছে।

‘হুম, এখন ও আমার স্পাই হয়ে গেছে। সারা দিন বাবার ঘরে আড়ি পেতে সব খবরাখবর আমাকে দেয়।

‘দারুণ, এই না হলে বউ!’

বউ কথাটা কানে লাগল প্রিয়র। যদিও জানে পেট্রা ওটা সরল মনেই বলেছে। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, ‘আচ্ছা শোন, তোর কি কোনো সিম্পটমস আছে?

‘কিসের সিম্পটমস?

‘ওই যে আমার ছেলেটা যে আসছে, সেই সিম্পটমস।’

পেট্রা হেসে ফেলল, তুই জেনেই বসে আছিস যে ছেলে হবে?

‘কী জানি, মনে তো হচ্ছে ছেলেই হবে।

পেট্রা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘ইশ প্রিয়, সত্যিই যদি ছেলে হয়, আমি তো খুশিতে মরেই যাব। শুদ্ধকে ছাড়া থাকার কষ্টটা ভুলতে পারব।

প্রিয়র খুব ভালো লাগছিল এত দিনে পেট্রাকে একটু খুশি দেখে।

—————

প্রিয় অফিস থেকে ফিরে দেখল, নিকিতা বারান্দায় মনমরা হয়ে বসে আছে। এটা খুব অস্বাভাবিক। সে আসার আগেই নিকিতার চঞ্চলতা শুরু হয়ে যায়। প্রজাপতির মতো উড়তে থাকে যে মেয়েটা, সে আজ চুপচাপ বসে আছে! তার আসাটা টেরই পায় নি। প্রিয় ঘর থেকেই ডাকল। ডাক শুনে ঘরে এল নিকিতা। বলল, তুমি কখন এলে?

প্রিয় ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল, ‘এইমাত্র। তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? মন খারাপ?

‘তুমি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও, পরে বলি।

প্রিয় শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, এখনই বললো, ব্যাপারটা সিরিয়াস মনে হচ্ছে।’

নিকিতা উশখুশ করছে। প্রিয়র শার্টের বোতাম অর্ধেক খোলা হয়েছিল, বাকিটা ও রকমই রইল। নিকিতার কাছে গিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?

‘সর্বনাশ হয়ে গেছে।’

‘কী?

‘আনিসা পেট্রা আপুর ভাইয়ের সাথে প্রেম করছে।

‘হোয়াট!

‘কেউ ওদের দুজনকে রাস্তায় দেখে মা-বাবাকে জানিয়েছিল। পরে বাবা আনিসাকে জিজ্ঞেস করতেই ও হড়হড় করে সব বলে দিয়েছে। কোনো ভয়ডর নেই প্রাণে। কত্ত ডেসপারেট!

‘বলো কী!’

হ্যাঁ, ওরা এক কলেজে পড়ত। সেই থেকে প্রেম। হায় খোদা, এখন কী হবে?

‘তুমি এত কিছু কীভাবে জানলে? তোমার মা-বাবা বলেছে?

‘মা বলল খ্রিষ্টান এক ছেলের সাথে প্রেম। ছেলের নাম রায়ান। ছেলে কয়েক দিন আগেই মালয়েশিয়াতে গেছে, মেডিকেলে পড়ছে। এসব শুনে আমি মিলিয়ে নিয়েছি যে পেট্রা আপুর ভাই হবে। কী হবে? কী করব আমি?

‘তুমি আবার কী করবে? তোমার মা-বাবাই সিদ্ধান্ত নেবে।’

নিকিতা প্রিয়র হাত চেপে ধরে বলল, ‘মা-বাবাকে তুমি চেনো না। ধরে বিয়ে দিয়ে দেবে এবার ওকে। এমনিতেই আমাদের পরিবারে প্রেম করে বিয়ে করা হারাম, তার ওপর খ্রিষ্টান ছেলে! ছেলে দেশেও নেই। সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হলো, আনিসা রিদিমার মতো গাধী না। ওর খুব জেদ, খুব সাহস। কী থেকে কী করে ফেলবে, ঠিক নেই। আমার বোনটাকে কীভাবে বাঁচাব, প্রিয়?

প্রিয় নিকিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি এত চিন্তা কোরো না। আমি ভেবে দেখি কী করা যায়।’

—————

পেট্রা এসির মধ্যে বসেও ঘামছে। হাত-পা কাঁপছে। এমনিতে তার সাহস ও আত্মবিশ্বাস–দুটোই প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। তাই কোনো কাজেই বিচলিত হয় না। জীবনে কখনো এতটা বিচলিত হয় নি সে, যতটা আজ। একটু পরই তার মেডিকেল রিপোর্ট দেবে। যদি প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়, তবে জীবনের সবচেয়ে বড় জ্যাকপট সে পেয়ে যাবে। কিন্তু যদি না হয়? আর ভাবতে পারছে না। চুপচাপ বসে আছে।

কিছুক্ষণ পর রিপোর্ট হাতে পেল পেট্রা। রেজাল্ট নেগেটিভ দেখার সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফেটে কান্না এল। এবং যেটা সে কখনো করে না, তা-ই করল। ডাক্তারের সামনেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ডাক্তার হাসিমুখে বোঝাল, ‘মিস রোজারিও, ভেঙে পড়বেন না। আপনার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। ট্রাই করতে থাকুন, সাকসেসফুল হবেন।

পেট্রা কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিল না। জীবনে এত কিছু হয়ে গেছে, এত কিছু হারিয়েছে, কখনো মরে যেতে ইচ্ছা করে নি। যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার চিন্তা করেছে সব সময়। এমনকি করেছে, কিন্তু এখন ঠিক এই মুহূর্তে তার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।

—————

প্রিয় লাঞ্চ করছিল। ঠিক তখনই একটা মেসেজ এল। পেট্রার মেসেজ দেখে হার্টবিট বেড়ে গেল। কতবার ফোন করেছে মেয়েটাকে, সে ধরে নি। আজ নিজেই মেসেজ পাঠিয়েছে! মেসেজটা ওপেন করতেই শুধু দুটো শব্দের একটা মেসেজ দেখতে পেল, ‘Result negative’। প্রিয়র পৃথিবীটা ভেঙে পড়ল। সৃষ্টিকর্তা এত নিষ্ঠুর? খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল। হাত ধুতে ধুতেই কল করল পেট্রাকে। প্রিয়র কল দেখে পেট্রা ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিল। এখন প্রিয়র সঙ্গে কথা বললে সে আরও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বে।

অনেকবার ফোন করার পরও পেট্রা যখন ফোন ধরল না, প্রিয় ফোন ধরার রিকোয়েস্ট করে মেসেজ পাঠাল। ততক্ষণে পেট্রার কান্না থেমে গেছে। পেট্রা ফোন করল, ‘প্রিয়, এত কল দেওয়া লাগে? আমি অফিসে ব্যস্ত ছিলাম।

‘সরি। দুশ্চিন্তায় আমার মাথা কাজ করছিল না।’

‘কেন? সব টেনশন তো শেষ। রেজাল্ট তো পেয়ে গেছিস।

‘আমি এখনো মানতে পারছি না।’

‘যা হয়, ভালোর জন্যই নাকি হয়। দেখি এতে কী ভালো হবে আমার?

‘মন খারাপ করিস না। আমরা আবার চেষ্টা করব।’

‘আর কখনো না, প্রিয় জেনে বুঝে এক ভুল বারবার করা যায় না। উচিতও নয়।

‘পেট্রা!

‘একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে রে। অফিসে মন দিয়ে কাজটাজ করে ভালোই উন্নতি করছিলাম আমি। এখন বাচ্চা হলে তো অনেক দিনের গ্যাপ পড়ে যেত।

‘আমাকে মাফ করে দে, পেট্রা। আমি সারা জীবনেও তোকে কিছু দিতে পারি নি।

‘অনেক ভালোবাসা দিয়েছিস, প্রিয়। যা সব মেয়ে পায় না। আচ্ছা, এখন রাখছি। অফিসে আমি।’

—————

সারাটা দিন প্রিয়র যে কীভাবে গেল, তা প্রিয় নিজেও বলতে পারবে না। এত অসহায় লাগছিল। তার ভিসার মেয়াদ শেষ, চাইলেও এখনই পেট্রার কাছে যেতে পারবে না। বাসা থেকে অনেকবার কল এসেছে, ধরে নি। অফিসে কী করেছে না করেছে জানে না। অফিস শেষে যখন বাসায় এল, দেখল বাসাভর্তি লোকজন। এত লোক কোত্থেকে এসেছে, কেন এসেছে, কে জানে! নিকিতার মা-বোনদেরও দেখতে পেল। সে বাসায় ঢুকতেই সবাই হইচই শুরু করে দিল। বাবর খান কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কংগ্রাচুলেশনস, মাই বয়।

প্রিয় কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের জন্য?

তিনি হেসে বললেন, তুমি বাবা হতে যাচ্ছ। নিকিতা প্রেগন্যান্ট।

প্রিয় এত বড় ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার মাথা ঘুরতে লাগল। তাকে দেখতে পেয়ে শুদ্ধ দৌড়ে এসে বলল, ‘বাবা বাবা, জানো, কী মজা, আমার একটা ছোট্ট ভাই অথবা বোন আসবে।’

প্রিয় নিকিতার দিকে তাকাল। নিকিতা শুকনো মুখে মাথা নিচু করে মায়ের পাশে বসে আছে। প্রিয় কোনো কথা না বলে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। কী হচ্ছে এসব? প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিকিতা এল ঘরে। প্রিয় বলল, এসবের মানে কী, নিকিতা?

নিকিতা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আমি কিছু জানি না, বিশ্বাস করো। কদিন ধরেই আমার শরীরটা ভালো লাগছিল না। কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারি নি। আজকে ক্যাম্পাসে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধুরা তোমাকে ফোন করেছিল। তুমি ধরো নি। পরে বাবাকে ফোন করায় বাবা গিয়ে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার এসে দেখে বলল আমি নাকি প্রেগন্যান্ট!

‘আমি তোমাকে বলেছিলাম না আমি বাচ্চা চাই না?

‘আমার কী দোষ? প্রটেকশন তো তুমি ইউজ করো। তাহলে ভুলটা কি আমার?

প্রিয় নিকিতাকে ধরে বলল, ‘নিকিতা, ভুলটা হয়তো আমারই ছিল। আমি জানি না কেন আমি তোমাকে প্রশ্নগুলো করলাম। কিন্তু আমি এই বাচ্চা চাই না। কালকেই আমি তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাব অ্যাবরশন করাতে। এখন কাউকে কিছু বলবে না। পরে বলবে মিসকারেজ হয়ে গেছে। প্লিজ আমার এই কথাটা তুমি রাখো।’

নিকিতার চোখে জল এল। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, ‘অসম্ভব, আমার প্রথম বাচ্চা।’

‘প্রথম বা শেষ বুঝি না, নিকিতা। আমার সাথে থাকতে হলে তুমি কখনো মা হতে পারবে না। শুদ্ধ আছে তো? ও আমাদের একমাত্র ছেলে হয়ে থাকবে। আর কোনো বাচ্চা আমাদের দরকার নেই।

নিকিতা হঠাৎ বসে পড়ে প্রিয়র পা জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মাফ করো আমাকে। যখন তুমি বলেছিলে কখনো বাচ্চা নেবে না, আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু অ্যাকসিডেন্টলি যখন এসে পড়েছে, আমি ওকে মারতে পারব না।’

‘ঠিকাছে, তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও। তারপর তোমার বাচ্চা নিয়ে তুমি যেখানে খুশি চলে যাও।

‘এভাবে বলছ কেন? বাচ্চাটা তো তোমারও।

‘আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমি এই বাচ্চা চাই না, নিকিতা।

‘আমি জানি তুমি শুদ্ধকে নিয়ে ভয় পাচ্ছ। বিশ্বাস করো আমি নিজের বাচ্চা হওয়ার পরও ওকে ঠিক এখনকার মতোই আদর-যত্ন করব। ও তো আমার বড় সন্তান।’

‘নিকিতা, পা ছাড়া। আমি যা বলার বলে দিয়েছি। আমি কিছুতেই এই বাচ্চার জন্ম হতে দেব না।’

নিকিতা উঠে দাঁড়াল। প্রিয়র মুখটা দুহাতে ধরে বলল, তুমি এমন কেন করছ? আমি কী অপরাধ করেছি? তুমি যা বলবে, আমি শুনব। যেভাবে বলবে, সেভাবেই চলব। তুমি যদি পেট্রা আপুর সাথেও সম্পর্ক রাখতে চাও, আমি তোমাকে সাহায্য করব, যাতে বাবা টের না পায়, সন্দেহ না করে। তবু তুমি প্লিজ, আমার বাচ্চাটাকে মারতে বোলো না। আমি পারব না।’

এ কথা বলেই নিকিতা প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। প্রিয় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘নিজের মা-বোনদের সময় দাও। আমি এখন একটু একা থাকতে চাই।’

নিকিতা তখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। প্রিয় হাতজোড় করে বলল, দয়া করে এখান থেকে যাও।’

নিকিতা প্রচণ্ড ভয় নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল। প্রিয় দরজা আটকে বসে রইল। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল তখন। চোখের জলের বাঁধ ভেঙে গেছে আজ। কাঁদতে কাঁদতে প্রিয় এটাই ভাবছিল, সে বাবা হতে পারছে

বলেই দুপুরবেলা খুব কষ্ট হচ্ছিল, আর এখন বাবা হতে যাচ্ছে বলেই এত কষ্ট হচ্ছে! যে মেয়েটার কাছে স্বামী, সন্তান, শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি-সব আছে, তাকে আল্লাহ একটা বাচ্চা দিয়ে দিল, আর যে মেয়েটা এতিম, কেউ নেই পাশে, তাকে আল্লাহ এভাবে নিরাশ করল? আর এই দুটো খবর আজ একই দিনে পাওয়া লাগল? এ সৃষ্টিকর্তার কেমন লীলাখেলা? নিকিতা তো কোনোভাবেই বাচ্চাটা নষ্ট করতে চাইছে না। কোনো মা-ই চাইবে না। প্রিয় কী করবে তাহলে? এই বাচ্চা জন্মানোর আগে ওর কি মরে যাওয়া উচিত না?
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp