ফানুস - পর্ব ৪১ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          কদিন ধরে নিকিতার শরীর বেশ খারাপ। প্রিয় অফিস থেকে ফিরতেই শুদ্ধ দৌড়ে এল, ‘বাবা, নিকিমা খুব অসুস্থ। আমার ভাইবোন চাই না, ডক্টর নিয়ে আসো, নিকিমাকে সুস্থ করে দিতে বলো। প্লিজ বাবা।

‘কী হয়েছে আবার?

‘জানি না, খুব অসুস্থ, শুধু শুয়ে শুয়ে কান্না করে।’

প্রিয় ঘরে ঢুকে দেখল, নিকিতা বিছানার মাঝখানে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। প্রিয় কাছে গিয়ে বসে মাথায় হাত রাখতেই নিকিতা চোখ মেলল। উঠতে চাইলে প্রিয় বলল, ‘কী হয়েছে? অসুস্থ লাগছে? ডাক্তার ডাকব?

‘ডাক্তার লাগবে না। অনেকবার বমি হয়েছে, খারাপ লাগছিল, তাই শুয়ে ছিলাম।

ততক্ষণে শুদ্ধ নিকিতার মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কেটে দিতে শুরু করেছে। নিকিতা চোখ তুলে তাকিয়ে শুদ্ধর হাতটা ধরে সেই হাতে চুমু খেল। প্রিয় বলল, ‘বিশ্রাম নাও তাহলে!’

প্রিয় ফ্রেশ হয়ে কাজের মেয়ের কাছে চা চাইতে গেল। তখন মেয়েটা বলল, ভাইজান, ভাবি কিন্তু সারা দিন কিছু খায় নাই। প্রতিদিন তো তার মা বইনেরা আইসা খাওয়াইয়া যায়, আজকে ক্যান জানি কেউ আসে নাই। সে ও রইছে না খাইয়া। খালি পেটে কত্তবার বমি করছে, তাইলে বুঝেন অবস্থা!

‘আচ্ছা, ওর খাবার রেডি করে দাও, আমি খাইয়ে দেব।’

টিচার আসায় শুদ্ধ পড়তে বসেছে। নিকিতা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। বিছানায়। প্রিয় অফিসের টুকটাক কাজ করছিল। কাজের মেয়ে খাবার দিয়ে যেতেই ওসব রেখে প্লেটটা নিয়ে প্রিয় নিকিতার কাছে গেল। নিকিতা ঘুমিয়ে আছে। খেতে ডাকতেই সে বলল, আমি খাব না।’

‘না খেলে সুস্থ বাচ্চার জন্ম দেবে কীভাবে?

নিকিতা চুপ। প্রিয় বলল, ‘শুনলাম সারা দিন কিছু খাও নি। এভাবে খেয়ে থাকলে বাচ্চা আর তুমি দুজনই দুর্বল হয়ে পড়বে। তারপরের ঝামেলা পড়বে আমার ঘাড়ে। ওসব ঝামেলা নিতে পারব না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি, খেয়ে নাও।

প্রিয় নিকিতার মুখে খাবার তুলে দিতে গেলেই নিকিতার চোখেমুখে আতঙ্ক দেখতে পেল প্রিয়। নিকিতা নিজের মুখ চেপে ধরে বলল, ‘আমি খাব না।”

প্রিয় অবাক। সে খাইয়ে দিতে চাচ্ছে অথচ নিকিতা খাচ্ছে না! নিকিতার এমন আচরণ দেখে প্রিয়র খটকা লাগল। তাই আর জোর করল না। যা হওয়ার হবে, তার কী? সে তো খাওয়াতে চেষ্টা করেছে। প্রিয় হাতের কাজ শেষ করে শুয়ে পড়ল। তবে ঘুম আসছিল না। হাজার রকম চিন্তা মাথায় ঘুরছে। তবু চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল প্রিয়। হঠাৎ মনে হলো নিকিতা নড়ে উঠল। চোখ মেলে আবছা আলোয় প্রিয় দেখতে পেল নিকিতা বিছানা থেকে উঠে যাচ্ছে। ঘর থেকে বের হতেই প্রিয়ও উঠল। চোরের মতো পেছন পেছন গিয়ে দূর থেকে দেখল নিকিতা ডিম ভাজছে। ডিম ভেজে সে ভাত খেতে বসল। এটুকু দেখে প্রিয় নিজের ঘরে ফিরে এল। তখনই মনে পড়ল, গত শুক্রবার প্রিয় শখ করে রান্না করেছিল, নিকিতা তার করা একটা খাবারও খায় নি। সে বাইরে থেকে কোনো খাবার আনলেও খায় না।

প্রিয় দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। নিকিতা ঘরে ঢুকতেই প্রিয় তার হাত ধরে একটানে বাহুডোরে নিয়ে নিল। নিকিতা এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। প্রিয় বলল, ‘তোমার কী মনে হয়, আমি খাবারে কিছু মিশিয়ে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলব?’

হুট করে প্রিয়র এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল নিকিতা। প্রিয় কীভাবে টের পেল সে কথা ভাবতে লাগল। প্রিয় আবার জিজ্ঞেস করল, ‘বলো? সত্যি কথা বলো।

নিকিতা চুপ করে রইল। কিছু বলার সাহস তার নেই। প্রিয় বলল, ‘এত অমানুষ মনে হয় আমাকে? আমি তোমাকে বলেছিলাম যে আমি বাচ্চাটা চাই না। তার মানে এই না যে আমি এ রকম কিছু করব।

নিকিতা কান্না করে দিল। প্রিয় বলল, কাঁদছ কেন আবার?

প্রিয় নিকিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আল্লাহ আমার জীবনের সাথে তোমাকে না জড়ালেও পারতেন। একটা স্বাভাবিক বিয়ে হলে আজ তুমি অনেক সুখী হতে পারতে।’

নিকিতার যে কী হলো! সে প্রিয়কে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কান্নাও বেড়ে গেল। প্রিয় নিকিতার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল, ‘বাচ্চাটা যে আমি কেন চাই না, তা তুমি কখনো বুঝতে পারবে না, নিকিতা। আমার সমস্যাটা অনেক জটিল। বাচ্চা যদি রাখোই, তাহলে এভাবে আতঙ্ক নিয়ে থেকো না। এমনিতেই প্রেগন্যান্সিতে অনেক রকম ডিপ্রেশন কাজ করে, তার ওপর এসব আলগা প্যারা নিয়ো না। দরকার হলে বাপের বাড়িতে চলে যাও কিছুদিনের জন্য।’

নিকিতা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আমি তোমাকে রেখে কোথাও যাব না।’

—————

অনেক দিন কেটে গেছে। এখনো পেট্রা স্বাভাবিক হতে পারে নি। কারও বাচ্চা মিসকারেজ হলে যে অবস্থা হয়, তার এখন সেই অবস্থা। ঠিকমতো খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। একদম ভেঙে পড়েছে, অনেক বেশি স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল। প্রিয় অসংখ্যবার ফোন করেছে, সে ধরে নি। সম্পর্কটা পুরোপুরি শেষ কেন হচ্ছে না? ডিনারের পর যখন শুতে যাচ্ছিল পেট্রা, তখন রায়ান ডাকল, ‘দি, একটা কথা ছিল। জানি, শুনলে তুই কষ্ট পাবি, তবু না বলে পারছি না।’

‘কী কথা?

‘তুই যার কথা ভেবে এখনো কষ্ট পাচ্ছিস, সে কিন্তু খুব সুখে আছে। তুইও তোর ভালোটা বুঝে নে দি। বিয়ে করে ফেল, এখনো সময় আছে।

‘রায়ান, আমি তোকে বারণ করেছি আমার বিয়ে নিয়ে তুই কোনো কথা বলবি না। এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি সিদ্ধান্ত নেব।

‘আমি এসব বলছি, কারণ, আনিসার কাছ থেকে শুনলাম নিকিতা আপু প্রেগন্যান্ট।

পেট্রা মনে মনে অবাক হলো কিন্তু রায়ানকে বুঝতে দিল না। বলল, আমি জানি সে কথা। তাতে কী হয়েছে? বিয়ের চার বছর হয়ে গেছে, এখন বাচ্চা হবে না তো কবে হবে? তা ছাড়া, তোর গায়ে লাগছে কেন? ওদের ফ্যামিলি প্ল্যানিং কি তুই করে দিবি?

রায়ান অবাক হয়ে বলল, ‘দি, তোর মতো মানুষ আমি আর একটাও দেখি নি।

পেট্রা আর কোনো কথা না বলে শুতে চলে গেল। নিকিতা প্রেগন্যান্ট শুনে ওর খারাপ লাগছে না ভালো লাগছে, ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে একদিক দিয়ে ভালোই লাগছে, প্রিয় এবার পাগলামি কমাবে। সে না চাইলেও নিকিতার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়বে।

আনিসার বিয়ে খুব দ্রুতই ঠিক করা হয়েছিল। প্রিয় নিকিতার বাবার সঙ্গে কথা বলে আনিসার বিয়েটা পেছাল। পরে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, ওরা আরেকটু বড় হোক। নিকিতার বাবাও বড় জামাইয়ের কথা ফেলতে পারে নি। প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছেলে বলে কথা! প্রিয় আনিসাকেও আলাদাভাবে বলেছে রায়ানের সঙ্গে যোগাযোগটা যাতে সাবধানে করে। অফিস থেকে ফেরার পথেই প্রিয় নিকিতাদের বাসায় গিয়েছিল আনিসার ব্যাপারে কথা বলতে। নিকিতার বাবার সঙ্গে কথা বলে প্রিয় বাসায় চলে গেল। নিকিতার প্রেগন্যান্সির এখন ছয় মাস চলছে। মেয়েটা এমনিতেই খুব সুন্দরী, কিন্তু প্রিয় সৌন্দর্যে কখনো মুগ্ধ হয় না। নিকিতার বেলায়ও হয় নি। তবে খেয়াল করেছে, নিকিতা ইদানীং অনেক বেশি সুন্দর হয়ে গেছে। ইয়া বড় একটা পেট তার সৌন্দর্য চার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আগের চেয়ে আরও বেশি ফরসা হয়েছে, মোটা হয়েছে, একটু চোখমুখ ফুলেছে। সব মিলিয়ে মনে হয় যেন নুরের পরশ পেয়েছে সে। পেট্রাকেও কি প্রেগন্যান্ট হলে এমনই লাগত? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুতার ফিতা খুলছিল প্রিয়। হঠাৎই তার ঘর থেকে একটা শব্দ ভেসে এল। হালকা শব্দ। কিন্তু তার ঘরে এটা কিসের শব্দ? জুতা না খুলেই প্রিয় দৌড়ে গেল। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল নিকিতা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে!
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp