ফানুস - পর্ব ১৬ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          নিকিতা প্রিয়র গাড়ির কাছাকাছি চলে যেতেই আচমকা কেউ এসে কাপড় দিয়ে তার মুখ বেঁধে ফেলল। ভয়ে হাত-পা সব অবশ হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু দেখতে পেল লোকটি হাশেম ভাই এবং সে মুখ বেঁধে ওকে গাড়িতে তুলে ফেলল। গাড়িতে তুলে হাত দুটো পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপর যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি স্টার্ট দিল। নিকিতা অবাক হয়ে যাচ্ছিল এটা ভেবে যে, একজন ড্রাইভারের এত সাহস হয় কী করে? আর সে এভাবে হাত-মুখ বেঁধে নিকিতাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? শুদ্ধ ঘুমাচ্ছে, নিকিতা নড়তেও পারছে না।

—————

প্রিয়র ঠোঁট বিষ ঢালছে পেট্রার ঠোঁটে। বিষ ছাড়া কীই-বা বলা যেতে পারে? অসময়ে বা মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে কিংবা মাত্রাতিরিক্ত সবকিছুই তো বিষ। প্রিয়র প্রতিটি স্পর্শেই পেট্রা চলে যায় আগের দিনগুলোতে। একটা সময় ছিল, যখন পেট্রার সকাল হতো প্রিয়র ঘুমন্ত মুখটি দেখে। আর রাত? কখনো বালিশে ঘুমায় নি পেট্রা, সব সময় প্রিয়র হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমাত। অবশ্য অর্ধেক রাত প্রিয় তাকে ঘুমাতে দিত না। মাঝেমধ্যে পেট্রা ঘুমাতে না পেরে বিরক্ত হতো। অথচ তখন কি জানত এভাবে প্রিয়কে সারা জীবনের জন্য হারাতে হবে? জানলে অর্ধেক না, সারা রাত জেগে থাকত! প্রিয়কে আর পাওয়া হবে না ওভাবে। প্রিয়, প্রিয়র সবকিছু আজ অন্য কারও, বরং ওর নেই বিন্দুমাত্রও। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন পেট্রার চোখ ভিজে উঠেছে। এত কাছে এত আবেগময় মুহর্তে পেট্রাকে কাঁদতে দেখে প্রিয় বলল, ‘কী হলো? কাঁদছিস যে! আমি কি জোর করে করলাম? তুই কি চাচ্ছিলি না?

পেট্রা হঠাৎ জড়িয়ে ধরল প্রিয়কে। প্রিয়র মনে হলো, এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। পেট্রা কত দিন পর ওর বুকে মাথা রেখেছে! বুকের যন্ত্রণাও যেন থেমে গেল। প্রিয় পেট্রার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন কাঁদছিস? কী চাস, বল আমাকে।

পেট্রা একইভাবে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘আর কত এভাবে দেখা করব আমরা? এর শেষ কোথায়?

‘শেষ হওয়ার দরকার কী, পেট্রা?

‘আমরা যা করছি, তা ঠিক না।

‘আমরা তো আর নিয়ম করে ফোনালাপ করছি না, নিয়ম করে দেখাও করছি না। বছরে দু-একবার এমন নিয়মের বাইরে গিয়ে হুটহাট দেখা করলে ক্ষতি কী? মাঝেমধ্যে মনটা কিছুতেই মানতে চায় না রে।’

‘ক্ষতি আছে। আমার মধ্যে প্রচণ্ড অপরাধবোধ কাজ করে। শুদ্ধকেও খুব দেখতে ইচ্ছা করে আর আমি আরও বেশি করে টের পাই তুই এখন আর আমার নেই।

‘আমি তোরই, পেট্রা। ছিলাম, আছি, আজীবন থাকব।

পেট্রা তো অবুঝ শিশু নয়। তাই মিছে তর্কে গেল না আর। প্রিয়র বুকে মুখ গুঁজে বসে রইল। কিছু ভালো লাগছে না তার। সে জানে, যা তার ছিল, সেসব নেই আজ আর তার, থাকবেও না কখনো। বাস্তবতার সঙ্গে তার অনেক দিনের পরিচয়।

—————

বাবর খানের সামনে দাঁড়িয়ে নিকিতা অসহায় বোধ করছে। মনে মনে অবাক হচ্ছে এটা জেনে যে হাশেম আলীকে বাবর খানই নির্দেশ দিয়েছিল নিকিতাকে ফেরাতে, দরকার হলে বেঁধে নিয়ে আসতে, আশ্চর্য! যখন সে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিল, তখনই নাকি হাশেম আলী উপায় না দেখে তার শ্বশুরকে ফোন করে সব ঘটনা খুলে বলেছে। এবং তৎক্ষণাৎ শ্বশুর সাহেব হাশেম আলীকে এই নির্দেশ দেন। বাবর খান কিছুটা ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার এত সাহস হলো কী করে যে তুমি পেট্রা সাথে থাকা অবস্থায় প্রিয়র মুখোমুখি হতে চেয়েছিলে? তুমি জানো এর পরিণাম কী হতে পারত?

কী হতো? প্রিয় রেগে যেত? আমাকে ছেড়ে দিত? দিলে দিত। সে আমাকে মিথ্যা বলেছে যে পেট্রার সাথে তার যোগাযোগ নেই। এমনকি আপনিও আমার সাথে এই একই মিথ্যা বলেছেন।

বাবর খান কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ভুলে গেছ তুমি কার সাথে কথা বলছ? এসব কী ধরনের কথা!

নিকিতা যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, সেটা বোঝা গেল ওর পরের কথাটা শুনে। বলল, ‘একদম ভুলি নি। আমি এক বাবার সাথে কথা বলছি যে নিজের ছেলের দোষ ঢাকার জন্য অনায়াসে মিথ্যাচার করে।’

বাবর খান থমথমে গলায় বললেন, ‘শোনো মেয়ে, আমি মিথ্যা বলি। নি। প্রিয়র প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে আমি অবগত। তোমাদের বিয়ের পর আজকেরটা নিয়ে চারবার দেখা করেছে তারা। তাদের মধ্যে ফোনেও কথা হয় না। আড়াই বছরে চারবার দেখা করাটাকে তুমি যোগাযোগ রাখা বলল? তারা দুজন ছোটবেলার বন্ধু। বন্ধু হিসেবেও তারা দেখা করতে পারে। অনেক দরকার থাকতে পারে।’

‘বাবা, তারা বন্ধু হিসেবে দেখা করে না। আজ আমার জায়গায় আপনি যদি তাদের দেখতেন, তাহলে ব্যাপারটা বুঝতেন। শুধু শুধু নিজের ছেলের দোষ ঢাকবেন না।

নিকিতা তখনো রাগে ফুঁসছিল। বাবর খান বললেন, আমি আমার ছেলের দোষ ঢাকি না। যা করার ঠান্ডা মাথায় করি এবং এবারও তা-ই করব। আমি জানি তুমি যা করতে যাচ্ছিলে, তা করলে আমার ছেলে রেগে যেত। সে রেগে গেলে ছেলেসহ বাড়ি ছেড়ে চলে যেত। আমি ছেলে হারাতাম আর তুমি স্বামী হারাতে। অনেক ছক কষে, নানারকম চাল চেলে প্রিয়কে সামলাই আমি। আশা করি এরপর থেকে বিবেচনা করে কাজ করবে। প্রিয় যদি জানত তুমি শুদ্ধকে গাড়িতে ফেলে নেমে গিয়েছিলে, কী প্রতিক্রিয়া হতো তার, ভাবতে পারছ? নিজেই একবার চিন্তা করা শুদ্ধ তোমার নিজের ছেলে হলে এই কাজটা করতে পারতে কি না।

নিকিতা চুপ করে রইল। বাবর খান আবার বললেন, এ রকম করলে প্রিয়র ঘর করতে পারবে না তুমি। প্রিয়র ঘর করতে চাইলে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করবে।

এ কথা বলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। নিকিতা শ্বশুরের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, আপনার কথা শুনে চলে আজ আমি সব হারাতে বসেছি। এখন থেকে আমি আপনার দেখানো পথে না, আমার তৈরি করা পথে হাঁটব।

প্রিয় ফুরফুরে মন নিয়ে বাসায় ঢুকতেই হাশেম আলীর সঙ্গে দেখা হলো। প্রিয় বলল, ‘হাশেম ভাই, ফোন করেছিলে কেন? আমি ব্যস্ত ছিলাম, তাই ধরতে পারি নি।

হাশেম আলী পড়ল এক মহাবিপদে। বড় সাহেব বারবার নিষেধ করেছেন কিছু না বলতে। তাই বলল, ‘ভাইজান ক্যান যে ফোন দিছিলাম, ওইটা তো আমি নিজেই ভুইল্যা গেছি।’

প্রিয় হেসে বলল, ‘প্রেমে-ট্রেমে পড়েছ নাকি!

‘কী যে কন, ভাইজান!

হাশেম আলী অযথাই লজ্জা পেল। প্রিয় হাসতে হাসতে বাসায় ঢুকল। আজ পেট্রার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সবকিছুই খুব ভালো লাগছে। ভালো না লাগার বিষয়গুলোও আজ ভালো লাগছে।

নিকিতা ঘরে ঢুকে চেঞ্জও করে নি। একধ্যানে বসে ছিল। প্রিয় ঘরে ঢুকে ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল, ‘আরে, কোথাও গিয়েছিলে নাকি? সুন্দর লাগছে তো।

শেষ কথাটায় খুশি লাগার কথা নিকিতার। কিন্তু আজ লাগল না। স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘দাওয়াত ছিল, সকালে বললাম না?

‘ভুলে গিয়েছিলাম। কোথায় ছিল প্রোগ্রাম?

‘বসুন্ধরা কনভেনশন হল।’

‘আরে, তাই নাকি! আজ আমিও অফিসের পর গিয়েছিলাম ওদিকে। নিকিতা আগ্রহী চোখে তাকিয়ে বলল, ওদিকে বলতে?

‘৩০০ ফিট।’

‘ওদিকে কেন?

শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে প্রিয় বলল, ‘এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে।

নিকিতা আর কথা বাড়াল। বলল, ‘খাবার দেব?

‘নাহ, খেয়ে এসেছি। তুমি খেয়েছ?

‘আমি তো দাওয়াতেই খেয়ে এসেছি।’

‘ওহ, তাই তো?’

প্রিয় পকেট থেকে মোবাইল বের করে বিছানায় বসল এবং কাউকে মেসেজ দিল। নিকিতা তাকিয়ে থাকার কারণে প্রিয়র মোবাইলের লক প্যাটার্নটা দেখতে পেল।

প্রিয় ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকতেই নিকিতা প্রিয়র মোবাইল নিয়ে লক খুলে মেসেজ অপশনে ঢুকল এবং দেখল প্রিয় মেসেজ করেছে, ‘Thanks for today, thanks for everything. but I’m missing you my love…’ নিকিতা নিশ্চিত হলো, এটা পেট্রার নম্বর। নিজের মোবাইলে সে নম্বরটা সেভ করল।
·
·
·
চলবে.................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp