নিকিতা সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর সবার মুখে হাসি ফুটল। বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয় নি। কিন্তু নিকিতার দড়িতে ঝুলে পড়ার পর জিহ্বা বের হয়ে যাওয়ায় পঁাতে চাপ লেগে জিহ্বা খানিকটা কেটে গিয়েছিল। দড়ির ধারে গলার চামড়া ছিলে গিয়েছিল। তবে প্রিয় যতক্ষণ না জানতে পারছে নিকিতা কেন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল, ততক্ষণ তার শান্তি নেই। হাসপাতালে ইচ্ছা করেই কিছু জিজ্ঞেস করে নি। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে দেয়ও নি। বাসায় ফিরে রাতের বেলা যখন তারা একা হলো, তখন সে ধরল নিকিতাকে।
‘তোমার সাহস হলো কী করে ছয় মাসের বাচ্চা পেটে নিয়ে তুমি মরতে গেলে?
নিকিতা মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। প্রিয় বলল, ‘তাকাও আমার দিকে। পরিষ্কার করে বলো কেন করলে এটা?
নিকিতা চোখ তুলে তাকাল, সে কাঁদছে। তার চাহনিতে অদ্ভুত রকমের ভেঙে পড়ার আলামত রয়েছে। প্রিয় এবার একটু নরম হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে বলো নিকিতা। এত অবহেলা, অপমান করেছি, সহ্য করেছ। সেই তুমি আমার বাচ্চার মা হয়ে, আমার আদর পেয়ে এভাবে চলে যেতে চাচ্ছিলে কেন? বাচ্চা একটা মেয়ে তুমি, তোমার এখনই কেন মরতে হবে?
এবার নিকিতার কান্নার মাত্রা বেড়ে গেল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সে কী বলল, কিছুই বুঝল না প্রিয়। প্রিয় নিকিতার চোখ মুছে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘শান্ত হও নিকিতা, ধীরে সুস্থে বলো কী হয়েছে?
‘আমার বাবা আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ, সবচেয়ে বিশ্বাস আর ভরসার মানুষ।’
‘কী হয়েছে আঙ্কেলের?
‘বাবা আমাকে তোমার বাবার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন প্রিয়।
প্রিয় চমকে উঠে বলল, ‘কী বলছ?
‘তোমার বাবা তোমাকে পথে ফেরানোর জন্য আমাকে কিনে এনেছেন। যাতে বউ কখনো অবাধ্য না হয়, সে জন্য গরিব ঘরের মেয়েকে টাকার বিনিময়ে কিনে এনেছেন। আসলে আমি তো তোমার বউ হওয়ার যোগ্য নই। পেট্রা আপুর কথা আমার বাবা আমাদের বিয়ের আগে থেকেই জানত, জানো? অথচ আমাকে বলেছিল তোমার বউ বাচ্চা রেখে মরে গেছে। বাবা সব জেনেশুনে টাকা নিয়ে তোমার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছে। বাবা জানত আমার সংসারে অশান্তি হবে, আমি কখনো ভালোবাসা পাব না।’
প্রিয়র মাথা ঘুরছে। সে জানে তার বাবা অনেক নিচ, সব পারে সে। তাই বলে নিকিতার বাবাও? নাকি কোনো ভুল হচ্ছে নিকিতার? প্রিয় বলল, ‘এসব কথা কীভাবে জেনেছ তুমি?
নিকিতা কাঁদতে কাঁদতেই বলল আবার, তোমার বাবা বলেছে। তারপর আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি। সে-ও সব স্বীকার করেছে।
‘বাবা হঠাৎ এসব তোমাকে কেন বলতে গেল?
নিকিতার কান্না কোনোভাবেই থামছিল না। বলল, ‘বাবা কোনোভাবে তোমার মালয়েশিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিল। তারপর সেদিন বিকেলে বাবা আমাকে ডেকে বলছিল আমি কেন তোমার খোঁজখবর রাখি না? তুমি কোথায় যাও, কী করো, আমি যতটুকু জানব যেন ওনাকে জানাই। আরও কী কী সব বলছিল। আমি মাথা ঠান্ডা রাখতে পারি নি। বলে বসেছি আমার স্বামী আরও চৌদ্দটা প্রেম করুক, আমি মানতে পারলে আপনার সমস্যা কী?
‘সর্বনাশ করেছ, নিকিতা। তারপর?
‘তারপর উনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। আর আমাকে শোনাতে লাগলেন আমি নাকি তোমার জন্য টাকা দিয়ে কিনে আনা রক্ষিতা, আমাকে তিনি তোমার জন্য কিনে এনেছেন আমার বাপের কাছ থেকে। এখন উনি যা বলবেন, তা-ই শুনতে হবে।
‘ছি!”
তারপর আমার মাথা আরও গরম হয়ে যায়। আমি বাবাকে ফোন করে বাবার সাথে চেঁচামেচি করি। তখন বাবা বলে যে সংসারে টানাটানি ছিল, তাই সে এই কাজ করেছে। প্রিয়, আমার বাবা আমাকে ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে। আমার দাম ৫০ লাখ টাকা।
কথাগুলো কোনোরকমে শেষ করেই নিকিতা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। প্রিয় বিস্ময় কাটিয়ে নিকিতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, ‘বাবর খান অনেক ভয়ংকর মানুষ। তোমার উচিত হয় নি তার সাথে জেদ দেখানো। যা হয়েছে, খুব খারাপ হয়েছে। কিন্তু এ জন্য মরতে হবে, নিকিতা? আমাদের ছোট্ট ছেলেটার কথা একবারও ভাবলে না? আর আমাদের বড় ছেলে? ওর কথাও ভাবলে না? তুমি জানো ও কত কেঁদেছে তোমার জন্য?
‘এসব ভাবার মতো অবস্থা আমার ছিল না তখন। আমার বাবাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি, জানি, ভালোবাসি, শ্রদ্ধা-ভক্তি করি। সে এমন একটা কাজ করেছে, আমি মানব কীভাবে প্রিয়? তোমার বাবার সাথে তোমার সম্পর্ক খারাপ। তাই সে খারাপ কিছু করলে তুমি মেনে নিতে পারো, তুমি অভ্যস্ত হয়ে গেছ। কিন্তু আমার সাথে তো আমার বাবার সম্পর্ক খারাপ ছিল না। বাবার চেয়ে আপন দুনিয়াতে আর কে থাকে? বাবা যদি এমনটা করতে পারে, তাহলে তো দুনিয়ায় কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। ওই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল আমি জন্মেই পাপ করেছি। তুমি সব সময় বলেছ–তুমি এই বিয়ে মানো না, আমি তোমার বউ না। তারপরও যখন কাছে এসেছ, আদর করেছ, আমার একফোঁটাও খারাপ লাগে নি। কারণ, আমি তো জানি তুমি আমার স্বামী! কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার সবকিছু ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, হ্যাঁ সত্যিই আমি শুধুই রক্ষিতা তোমার।
প্রিয় আচমকা নিকিতাকে একটা চড় মারল। নিকিতা ভড়কে গেল। পরমুহূর্তেই প্রিয় তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমার বউ, আমার বাচ্চাদের মা। খবরদার, আর কোনোদিনও যেন না শুনি এসব কথা।
নিকিতা চমকে তাকাল প্রিয়র দিকে। প্রিয় নিকিতার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসতে পারব না এটা যেমন সত্যি, তুমি আমার স্ত্রী এটাও সত্যি। আমি নিজের অজান্তেই তোমাকে স্ত্রীর জায়গা দিয়ে ফেলেছি আরও বহু আগেই। বলা হয় নি শুধু। কী করে বলব, আমি নিজেই তো টের পাই নি।
এ কথা বলে প্রিয় নিকিতার কপালে ঠোঁট চেপে ধরে একটা গাঢ় চুমু দিল। নিকিতার চোখে জমে থাকা ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। এ জীবনে আর কিছু চায় না সে।
—————
অনেক রাতে ভিডিও কলে কথা হচ্ছিল পেট্রা ও শুদ্ধর! মা-ছেলেতে খুব হাসাহাসি হচ্ছিল। ঠিক তখনই নিকিতা শুদ্ধকে দেখতে এল, ছেলেটা ঠিকভাবে শুয়েছে কি না, কে জানে! নিকিতাকে দেখে শুদ্ধর কথা বলা থেমে গেল। নিকিতা বলল, ‘বাবা, তুমি এখনো ঘুমোও নি কেন?
‘নিকিমা, আমি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ব।’
ওপাশ থেকে পেট্রা ডাক দিল, ‘নিকিতা…’
নিকিতা পেট্রার গলা শুনে কোনো কারণ ছাড়াই বিচলিতবোধ করল। তবু ডেকেছে যখন, যাওয়া উচিত। নিকিতা শুদ্ধর পাশে গিয়ে বসল। পেট্রা হেসে বলল, ‘ওম্মা, কী সুন্দর হয়েছ দেখতে!’
নিকিতা হেসে বলল, ‘কেমন আছ, আপু?
‘ভালো। তুমি কেমন আছ? শরীর ঠিক আছে?
‘হ্যাঁ, ভালো আছি।’
‘ওভাবে উঁকি মেরে কথা বলছ কেন? একটু পেটটা দেখাও না। দেখি তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে।
নিকিতা কী করবে বুঝতে পারছিল না। ওর খুব লজ্জা লাগছিল। পেট্রার খেয়াল হলো, শুদ্ধ আছে এখানে। তাই বলল, ‘শুদ্ধ, মা, একটু অন্য রুমে যাবে? আমি একটু নিকিতা মার সাথে কথা বলি?
‘ওকে মা, টা টা।
শুদ্ধ চলে যেতেই পেট্রা বলল, ‘আরে বাবা, অস্বস্তিবোধ করছ কেন? সামনে এসো একটু দেখি।
নিকিতা সামনে আসতেই পেট্রা আহ্লাদ করে বলল, ‘আহা! কী মিষ্টি লাগছে! তুমি সামনে থাকলে তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম।
নিকিতা এখন আরও বেশি লজ্জা পাচ্ছে। পেট্রা হেসে বলল, ‘নিকিতা, প্লিজ একটু ফ্রি হও। তুমি আমার প্রাক্তন স্বামীর স্ত্রী বলে প্রেগন্যান্সি নিয়ে আমার কাছে এত অস্বস্তিবোধ করার কিছু নেই। বাচ্চা হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সে তোমার পেটেই হোক বা আমার পেটেই হোক, আমার একই রকম খুশি লাগছে। প্রিয়র বাচ্চা যে!’
নিকিতা হাসল। পেট্রা বলল, ‘জানো, তোমার প্রেগন্যান্সির খবর পেয়ে অনেক দিন চেয়েছি তোমার সাথে কথা বলতে। তারপর আবার নানান ব্যাপার চিন্তা করে বলি নি। তোমার যে মার্কামারা শ্বশুর!
নিকিতা এবার সশব্দে হেসে দিল। পেট্রা প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, ‘ডেলিভারি ডেট দিয়েছে?
‘হ্যাঁ, সামনের মাসের ১২ তারিখ।
‘বাচ্চাকে ভিডিও কলে দেখিয়ো কিন্তু।
‘দেখাব আপু।
‘নাম ঠিক করেছ?
‘প্রসন্ন।’
‘বাহ, খুব সুন্দর নাম। বড়ভাইয়ের নামের সঙ্গে অর্থগতভাবে মিলে গেছে।
‘মিলিয়েই রেখেছে প্রিয়।
পেট্রা হেসে মাথা ঝুলিয়ে বলল, ‘ও। আচ্ছা শোনো, প্রিয়কে বলো না আমার সাথে কথা হয়েছে। শুনলে রেগে যাবে, ওর ফোন ধরি না তো। মেসেজে বা মেইলে হাজারটা কথা শোনাবে আমাকে।
‘আচ্ছা আপু, বলব না।
‘ঠিকাছে, আজকে তাহলে রাখি। টেক কেয়ার।
·
·
·
চলবে....................................................................................