ফানুস - পর্ব ৪৪ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে প্রিয়-নিকিতার। প্রিয়র মতো দেখতে হয়েছে। তবে গায়ের রঙটা নিকিতার মতো ধবধবে ফরসা। ছেলেটাকে কোলে নিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো প্রিয়র। মনে হলো কিছু নরম তুলো হাতে নিয়েছে। পৃথিবীর সব আলো, সকল ফুলের সৌরভ যেন এসে পড়েছে তার কোলের মধ্যে। শুদ্ধকে যখন প্রথমবার কোলে নিয়েছিল প্রিয়, তখন শুদ্ধর বয়স দশ দিন। আর প্রসন্ন তো কিছুক্ষণ আগে পৃথিবীর মুখ দেখল। তাই এই অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত নয় প্রিয়। প্রসন্ন কেমন গটগটে চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়র দিকে। হয়তো অভিমানী গলায় বলছে, ‘মেরে ফেলতে চেয়েছিলে, না? এখন এত মায়া দেখানো হচ্ছে কেন? নামাও আমাকে কোল থেকে। এ কথা ভাবতেই প্রিয় সশব্দে হেসে উঠল। বাবর খান, নিকিতা, নিকিতার বাপের বাড়ির লোকজন সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে প্রিয়কে।

প্রিয়কে স্বাভাবিক দেখে বাবর খান কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছেন। শুধু কি স্বাভাবিক, পেট্রার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ নেই তার। এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে? তবে পাহারা সরান নি ছেলের ওপর থেকে। কবির প্রিয়র হাতে ধরা খাওয়ার পর তিনি অন্য প্রাইভেট গোয়েন্দা নিয়োগ দিয়েছেন। যার কথা এখনো জানে না প্রিয় হয়তো কখনো জানতে পারবেও না। এবার তিনি আরও সাবধান। প্রিয় কী যেন বলতে চায়। সেই নিয়েই বারান্দায় বাপ-ছেলের মিটিং বসেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাবর খান প্রিয়কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো প্রিয়, কী বলতে চাও।’

‘বাবা, আশা করি আমি এখন তোমার মনের মতো হতে পেরেছি?

বাবর খান চমকে উঠলেন, প্রিয় অনেক বছর পর তাকে বাবা বলে ডাকল। কম করে হলেও পাঁচ-ছয় বছর হয়ে গেছে প্রিয়র মুখ থেকে বাবা ডাকটা শুনতে পান নি তিনি। দিনের পর দিন অপেক্ষা করে গেছেন কবে প্রিয় আবার বাবা বলে ডাকবে তাকে। কিন্তু ছেলেটা বরাবরই নাম ধরে ডেকেছে অথবা বলেছে ‘মন্ত্রীসাহেব’। আজ এতদিন পর বাবা ডাক শুনতে পেয়ে তার ভীষণ আনন্দ হলো। তিনি হেসে বলল, তুমি সব সময়ই আমার মনের মতো ছিলে, প্রিয়। শুধু মাঝখানে কয়েকটা বছর না বুঝে কিছু ভুল করেছ। তোমরা ছোট মানুষ, ভুল করবেই। আমাদের দায়িত্ব সেসব ভুল থেকে তোমাদের সরিয়ে আনা। তার জন্য আমাদের মাঝেমধ্যে কঠোর হতে হয়।’

তারপরও বাবা, আমি তো এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে পুরোপুরি সংসারী হয়ে গেছি। এখন নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে তোমার আর কোনো সংশয় নেই।’

‘না, নেই।

এবার আমি তোমার কাছে কিছু চাই, বাবা।

‘কী চাও, বলো।’

‘শুদ্ধকে পেট্রার কাছে পাঠাতে চাই।’

বাবর খান চমকে উঠলেন। গরম চা ছলকে পড়ল সাদা পাঞ্জাবিতে। প্রিয় বলল, তুমি ভুল বুঝো না, বাবা। শুদ্ধ মুসলিম ধর্মই পালন করবে।

আমাদেরই থাকবে শুদ্ধ। শুধু বাস করবে পেট্রার সাথে।

‘এ কেমন অবুঝ আবদার, প্রিয়?

‘অবুঝ আবদার না, বাবা। পেট্রা এতিম একটা মেয়ে। ভরসা করার মতো কেউ নেই ওর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন নেই। শুদ্ধকে পেলে ও ভালো থাকবে, বাবা। এইটুকুই শুধু চাই তোমার কাছে।

‘অসম্ভব। পেট্রাকে বলো বিয়ে করে সংসারী হতে। পরের বাচ্চা আর কত পালবে?

‘বাবা, আমার মনে হয় না ও কখনো বিয়ে করবে। আর যদি করেও শুদ্ধকে না হয় তখন আবার নিয়ে আসব।

‘প্রিয়, এ বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না। শুদ্ধ এখানেই থাকবে।’

‘প্লিজ বাবা, আমাকে বলার সুযোগ দাও। আমি জানি তুমি ভাবছ শুদ্ধকে দিলে আমাদের মধ্যে আবার যোগাযোগ শুরু হবে, সম্পর্ক তৈরি হবে। কিন্তু পেট্রা নিজেই চায় না আমাকে আর। ও যদি একবার বলত, প্রিয়, আমি তোকে চাই। তুমি কেন, পুরো পৃথিবী আমাকে আটকে রাখতে পারত না, বাবা। এই পৃথিবীতে আমি ওর থেকে বেশি ভালো আর কাউকেই বাসি না। এ অদ্ভুত এক ভালোবাসা। এই ভালোবাসা যেন হৃদয়ের না বাবা, এই ভালোবাসা যেন রক্তের। নিকিতা কী ছিল আর কী হয়ে গেছে, চিন্তা করো। এটাও কিন্তু পেট্রারই অবদান। পেট্রাই কিন্তু কলকাঠি নেড়ে আমার আর নিকিতার সম্পর্কটা সাবলীল করেছে। ও যে কত বড় মনের মানুষ, তুমি জানো না। একটা এতিম মেয়েকে তুমি দয়া করো বাবা, শুদ্ধকে দিয়ে দাও। শুদ্ধর জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে ও শুদ্ধকে বুকে তুলে নিয়েছে। অবিবাহিত হয়েও শুদ্ধর মা হওয়ার চ্যালেঞ্জটা নিয়েছে। ও না থাকলে শুদ্ধ আজ কোথায় থাকত, আমরা তা জানতামও না। যে বাচ্চাটাকে ও নিজের বাচ্চার মতো করে পেলেপুষে বড় করল, তার ওপর কি ওর একটু অধিকারও নেই?

‘প্রিয়, পেট্রার জন্য আমি আমার বড় ছেলেকে হারিয়েছি। তারই সন্তানকে আমি পেট্রার হাতে তুলে দেব? অসম্ভব।

‘বাবা, এটা তোমার ভুল ধারণা। ভাইজান আর সাদিয়া আপুর সম্পর্কের ব্যাপারে পেট্রার কোনো হাত নেই। ও কিছুই জানত না। ওরা একই হলে রুমমেট ছিল। এর বাইরে ওদের কোনো সম্পর্কই ছিল না। তুমি সাদিয়া আপুকে মানো নি বলে ভাইজান জেদ করে বিয়েটা করেছিল।

‘এত কিছু আমি এখন শুনতে চাই না, প্রিয়। আমার বড় ছেলের একমাত্র স্মৃতি শুদ্ধ। ওকে আমি কারও কাছে দেব না।’

‘বাবা প্লিজ। মনে করা শুদ্ধ পড়তে যাচ্ছে বাইরে। ও প্রতিবছর আসবে বাংলাদেশে। ও তো আমাদেরই থাকবে।

‘না। এটা সম্ভব না।

‘শুদ্ধও এতে ভালো থাকবে, বাবা। তুমি কি জানো পেট্রার কথা ভেবে শুদ্ধ কত চোখের জল ফেলে? ও তো জন্মের পর থেকে পেট্রাকেই মা বলে জেনেছে, পেট্রাকেই পেয়েছে। তুমি একবার নিজের মায়ের কথা চিন্তা করে দেখো তো, বাবা। তুমি কি পারতে শুদ্ধর মতো দশ বছর বয়সে নিজের মাকে ছাড়া থাকতে? শুদ্ধ সেই তিন-চার বছর থেকে আছে। ও হাঁপিয়ে উঠেছে, বাবা।

‘কেন, নিকিতাকে তো ও নিজের মায়ের মতোই দেখে আর নিকিতাও তো ওকে আদর করে। মা তো আছেই।

‘বাবা, নিকিতাকে ও মা ডাকে কিন্তু পেট্রা ওর মা। ওর চোখের জল তুমি দেখো না, বাবা?

‘পেট্রা একটা খ্রিষ্টান মেয়ে। শুদ্ধকে ও কিছু শেখাতে পারবে না।

‘যা শেখার তা তো শুদ্ধ শিখেই নিয়েছে, বাবা। তা ছাড়া আমরা প্রায় তিন বছর একসাথে ছিলাম। দুজন দুজনের ধর্ম পালন করেছি, কখনো কোনো সমস্যা হয় নি। পেট্রা কখনো ইসলাম ধর্মকে অসম্মান করে নি। শুদ্ধ নিজের মতো ধর্ম পালন করবে, পেট্রা তাতে সাহায্য করবে, তুমি দেখো, বাবা।’

‘কয় টাকা ইনকাম পেট্রার? আমার নাতিকে পড়াশোনা করাবে কীভাবে? অভাবে বড় হবে আমার নাতি?

‘সেটা না হয় আমি দেব। আমার ছেলের খরচ আমারই তো দেওয়া উচিত।’

বাবর খান আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই নিকিতা প্রসন্নকে কোলে করে বারান্দায় এল। নিকিতাকে দেখে উনি আলোচনা থামিয়ে দিলেন। কিন্তু নিকিতাই নতুন করে আলোচনা শুরু করল, ‘বাবা, বেয়াদবি হলে মাফ করবেন, আমি একটা কথা বলি। আনিসার সাথে পেট্রা আপুর ভাইয়ের দু-তিন বছর ধরে সম্পর্ক চলছে। ওরা বিয়েও করবে। আনিসা কিছুদিনের মধ্যেই ওখানে চলে যাচ্ছে। আনিসা মুসলিম ধর্ম পালন করবে, রায়ান তার ধর্ম। আনিসা ওখানে থাকলে শুদ্ধর তো এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা হওয়ার কথাই না।’

বাবর খান এবার বেশ অবাক হলেন। প্রিয় বলল, ‘হ্যাঁ, বাবা, তাই তো। আর দেখো প্রসন্নকে। তোমার এক নাতি তত তোমার কাছে থাকবেই। আমি আর নিকিতা তোমাকে আরও অনেক নাতি-নাতনি দেব। তুমি শুধু শুদ্ধকে পেট্রার কাছে যাওয়ার অনুমতি দাও।’

এ কথায় নিকিতা লজ্জা পেল। প্রিয়র আসলে মাথাটা গেছে। বাবাকে রাজি করানোর জন্য সে মরিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। বাবর খান এতক্ষণ ঠান্ডা মাথায় কথা বললেও এবার রেগে গেলেন। চেঁচামেচি করে ওদের ঘর থেকে বের করে দিলেন।

নিজের ঘরে এসে প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুকে একটা চাপা কষ্ট অনুভব করছে। খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কান্না কি এতই সহজ?

—————

কদিন পর বাবর খান প্রিয় ও নিকিতাকে ডেকে পাঠালেন তার ঘরে। ওরা গিয়ে বসতেই তিনি বললেন, আমি শুদ্ধর সাথে কথা বলেছি। ও পেট্রার কাছে যেতে চায়।’

প্রিয় একটা আশার আলো দেখতে পেল। বাবর খান আবার বললেন, ‘পেট্রার কথা বলতেই শুদ্ধ খুব কান্নাকাটি করল, অনুরোধ করল যাতে ওকে যেতে দিই। কিন্তু আমার মন এখনো সায় দিচ্ছে না।

প্রিয় চুপ করে শুনছিল। বাবর খান এবার বললেন, ‘তবু শুদ্ধর মুখের দিকে তাকিয়ে যেতে দিতে পারি, তবে কয়েকটা শর্ত আছে।

‘তোমার সব শর্ত মানতে আমি রাজি, বাবা। বলো কী শর্ত।

‘প্রথম শর্ত হলো, তুমি যখন শুদ্ধকে মালয়েশিয়াতে নিয়ে যাবে, তখন তোমার সাথে আমি এবং নিকিতাও যাব।’

‘যাবে বাবা, আমার কোনো আপত্তি নেই।

‘দ্বিতীয় শর্ত হলো শুদ্ধকে যখন আসতে বলব, তখনই আসতে হবে। খরচ আমি দেব। আর শুদ্ধকে মুসলিম ধর্মই মানতে হবে সঠিকভাবে। আনিসা সাহায্য করলে ভালো।

‘হ্যাঁ, সেটা তো অবশ্যই।

‘তৃতীয় শর্ত হলো শুদ্ধর সব খরচ তুমি বা আমি পাঠাব। আমার নাতি যাতে অভাবে বড় না হয়।’

‘আচ্ছা বাবা, তা-ই হবে।’

‘আচ্ছা, এবার চতুর্থ কিন্তু প্রধান শর্ত হলো, পেট্রার সাথে তোমার ডিভোর্স পেপারে তোমাকে সাইন করতে হবে।

চমকে উঠল প্রিয়, সঙ্গে নিকিতাও। প্রিয় বলল, ‘বাবা, আমাদের ডিভোের্স হয়ে গেছে। যে-কোনো এক পক্ষ সাইন করলেই তো তিন মাস পর ডিভোর্স আপনা-আপনি কার্যকর হয়ে যায়। পেট্রা তো সাইন করেছেই?

‘কিন্তু প্রিয় তোমার সাইনটা আমার কাছে জরুরি। এই শর্ত মানলেই শুদ্ধ পেট্রার কাছে যাবে।

প্রিয় চুপ করে রইল। বাবর খানও ধীরেসুস্থে উত্তরের জন্য বসে রইলেন। নিকিতাকে তিনি কিছু বলছেন না, তাহলে কেন ডাকলেন, তা বুঝতে পারছে না। সে অসহায়ের মতো চুপচাপ বসে আছে। কিছুক্ষণ পর প্রিয় বলল, আমি রাজি, বাবা।’

গলা দিয়ে যেন কথা বের হলো না প্রিয়র, আগুন বের হলো। সেই আগুনে তার নিজেরই ভেতরটা পুড়ে খাক হয়ে গেল। বাবা বললেন, ‘দ্যাটস লাইক মাই গুড বয়।

ডিভোর্স পেপারটা বাবর খান যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি সেটা বের করে দিলেন। প্রিয় সাইন করতে গিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। বাবর খান নির্বিকারভাবে চেয়ে রইলেন। নিকিতা পাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখল। সাইন করে প্রিয় আর একমুহূর্ত দাঁড়াল না, সোজা নিজের ঘরে চলে গেল।

নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল প্রিয়। সে নিজেও জানে না আজ কেন এতটা খারাপ লাগছে। সম্পর্ক তো ছিলই, এমনকি যোগাযোগটাও ছিল না। ডিভোর্সও বহু বছর আগেই কার্যকর হয়ে গিয়েছিল। তবু এই না করা স্বাক্ষরটা প্রিয়র কাছে ছেলেভুলানোর মতো একটা ব্যাপার ছিল, যা দিয়ে সে নিজেই নিজেকে ভোলাত। আজ থেকে কী দিয়ে ভোলাবে সে নিজেকে? বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে, সব শেষ, সব। ওদিকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নিকিতা কাঁদছে। সে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে, যা হয়েছে তাতে তার কেন এত খারাপ লাগছে?

—————

প্রিয় অনেকক্ষণ ধরে ফোন করছে পেট্রাকে। পেট্রা ফোন ধরছে না। প্রিয় একটা মেসেজ পাঠাল, একটা কথা বলব শুধু, জালাব না।’ এবার পেট্রা ফোন ধরল।

‘হ্যালো।

‘প্রিয়, কী খবর?

‘একটা কথা বলতে ফোন করেছি।’

‘বল।

‘তুই হয়তো এখন আর সেভাবে বিশ্বাস করবি না কিন্তু এখনো আমি তোকে ভালোবাসি, শুধু তোকে।

‘আমি জানি, প্রিয়। অবিশ্বাস করার মতো কিছু হয় নি।

‘ঠিকাছে, আমার একটা কথা বলা শেষ। এখন রাখি।

‘এই শোন শোন…রাখিস না।

‘কী?

‘রাখতে চাচ্ছিস কেন? ফোনে টাকা নেই?

পেট্রার এই রসিকতায় প্রিয় হেসে দিল। পেট্রাও হেসে দিল। তারপর কিছুক্ষণ অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয় কথা হলো এবং প্রিয় শান্ত হলো।
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp