ফানুস - পর্ব ০৩ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          দুঃস্বপ্ন দেখে প্রিয়র ঘুম ভেঙে গেল। পাশ ফিরে শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে আবিষ্কার করল, শুদ্ধ বিছানায় নেই। লাফিয়ে উঠে লাইট জ্বালাল–নিকিতা ঘুমাচ্ছে, ঘরে নেই শুদ্ধ। বাথরুমে দেখল, বারান্দায় দেখল। নেই, কোথাও নেই। প্রিয় ঘর থেকে বেরিয়ে পুরো বাড়ি খুঁজতে লাগল। অবশেষে বসার ঘরে পেল। প্রিয় দূর থেকেই দেখতে পেল শুদ্ধ মোবাইল হাতে নিয়ে কাঁদছে। বুঝতে বাকি রইল না যে সে মায়ের ছবি দেখছে। প্রিয় কাছে গিয়ে বসতেই শুদ্ধ বলল, ‘সরি বাবা, আমি পারমিশন না নিয়েই তোমার মোবাইলটা এনেছি। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল। একদম ঘুম আসছিল না।’

প্রিয় শুদ্ধর চোখের পানি মুছে দিয়ে তাকে কোলে উঠিয়ে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, ‘ইটস অলরাইট বাবা! কাঁদিস না। তুই কাঁদলে কিন্তু মা খুব কষ্ট পায়।’

শুদ্ধর কান্না বেড়ে গেল, কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘মায়ের ছবি দেখলেই আমি মায়ের গন্ধ পাই, বাবা। মায়ের কোলে যেতে ইচ্ছা করে, আমার কান্না পায়।

ছেলের এমন কান্না দেখে প্রিয়র মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, চল, ঘরে চল।’

প্রিয় কোলে করেই শুদ্ধকে ঘরে নিয়ে গেল। তারপর তাকে বিছানায় বসিয়ে ওয়ার্ডরোবের ওপরের ড্রয়ার খুলল। শুদ্ধর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে জানে এই ড্রয়ারে তার মায়ের অনেক জিনিসপত্র আছে। প্রিয় একটা ওড়না বের করে শুদ্ধকে দিয়ে বলল, ‘তোর মায়ের এটা।’

শুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে কান্না থামিয়ে ওড়নাটা দুহাতে নিয়ে চুমু খেল, গন্ধ নিল। তারপর হাসতে হাসতে ওড়নাটা শালের মতো গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল, এটা থেকে সত্যি সত্যি মায়ের গায়ের গন্ধ আসছে, বাবা।

প্রিয় হেসে বলল, ‘জানি তো। এ জন্যই তো দিলাম। খুব যত্ন করে রাখবি। এবার শুয়ে পড় বাবা।

শুদ্ধ শুয়ে পড়ল। প্রিয় ড্রয়ারে তালা দিয়ে লাইট বন্ধ করে বিছানায় এল। শুদ্ধ বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, তুমিও একটু মায়ের গন্ধ নাও না।’

প্রিয় শুদ্ধর গায়ে প্যাচানো ওড়নাটাতে নাক ডোবাল, ঠোঁট ছোঁয়াল। মুহূর্তের মধ্যেই চোখের কোণটা জলে ভরে উঠল তার।

—————

কাজটা তারা পেয়ে গেছে। মিটিং শেষ করে বিকেলের মধ্যেই হোটেলে ফিরে এসেছে পেট্রা ও স্মরণ। পেট্রা ঘুমিয়ে পড়েছিল। সন্ধ্যা নাগাদ স্মরণের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙল। স্মরণ বলল, ‘ঘুমাচ্ছিলে?

হ্যাঁ।

‘ওহ্, সরি।’

‘আরে না না, আমি উঠতাম এখনই। তুমি বলো না কী বলবে।

‘তোমার আপত্তি না থাকলে বাইরে কোথাও ডিনার করি? আফটার অল এত বড় একটা কাজ পেয়েছি, একটু তো সেলিব্রেট করা উচিত।

‘আচ্ছা, কখন যাবে?

‘এই ধরো এক ঘণ্টা পর।

‘ঠিকাছে, আমি রেডি হয়ে এক ঘণ্টা পর ফোন করছি।’

সমুদ্রের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে ডিনারে বসেছে স্মরণ ও পেট্রা। বসার কিছুক্ষণ পরই স্মরণের মনে হলো, এখানে বসা উচিত হয় নি। সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ এসে কানে লাগছে। ওরা যেন বলছে, ‘স্মরণ, আমাদেরও তোমার মতো মন খারাপ। আরও বিষণ্ণ লাগছে। পেট্রাও খেয়াল করেছে, সে খ্রিষ্টান, এটা জানার পর থেকেই স্মরণের মন খারাপ হয়ে গেছে। চঞ্চল-ছটফটে ছেলেটাকে বিমর্ষ দেখতে ভালো লাগছে না। এত কথা বলা ছেলেটা একদমই কথা বলছে না। পেট্রাই খেতে খেতে টুকটাক গল্প চালিয়ে যেতে লাগল। দুটো মানুষ মুখোমুখি একদম চুপচাপ তো আর থাকা যায় না। স্মরণ হঠাৎ করে বলল, ‘পেট্রা, আমার একটা গার্লফ্রেন্ড ছিল। লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ। আমি ছিলাম অস্ট্রেলিয়াতে আর সে বাংলাদেশে।

হঠাৎ এ কথায় অবাক হলো পেট্রা। বলল, ‘আচ্ছা! পরে?

‘বিয়ে করতে চেয়েছিলাম ওকে।

‘হুম।

‘আমাদের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। কিন্তু যখন সম্পর্ক হয়েছিল, আমি তখন বাইরে। ফোন, ইন্টারনেট–এই ছিল আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম। সে আমার এক বছরের বড় ছিল। যা-ই হোক, আমাদের ফার্স্ট লাভ অ্যানিভার্সারিতে দেশে এসে ওকে সারপ্রাইজ দিয়েছিলাম। যে কদিন ছিলাম, প্রতিদিন দেখা করেছি আমরা। চলে যাওয়ার পরও মনটা পড়ে ছিল ওর কাছেই। ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎই ও সবকিছু থেকে ডিসকানেক্টেড হয়ে গেল। কোনোভাবেই ওর সাথে আর যোগাযোগ করতে পারলাম না। আমার এক বন্ধুর ভাবির বোন ছিল। ওই বিয়েতেই পরিচয় হয়েছিল। ভাবিকে দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। জানি না কেন সে আমার সাথে এমন করেছিল। আমাদের কোনো ঝগড়া হয় নি, অন্য কোনো প্রবলেমও ছিল না। আমার মা-বাবা আমার বন্ধুর মতো। মা তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, সে সব জানত। তখন বিয়ে করতে চাইলে তখনই দিত। তবু কেন সে এমন করল, জানার অনেক ইচ্ছা ছিল। আজও জানতে পারি নি। সে আমাকে অ্যাভয়েড করে। স্বামী সন্তান নিয়ে নিশ্চয়ই সুখে আছে। যা-ই হোক, ধাক্কাটা কম ছিল না। তারপর থেকে প্রেমকে না বলেছি। ফ্লার্ট করেছি শুধু। ঠিক করেছিলাম, একেবারে বিয়ের পর প্রেম করব। অথচ জানি না কেমন করে তোমার প্রেমে পড়লাম আমি!

পেট্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চুপ করে। স্মরণও সরাসরি পেট্রার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। পেট্রা ভাবতে পারছে না স্মরণ কতটা অবলীলায় কথাটা বলে দিল। আর কেনই-বা বলল এখন? স্মরণ বলল, যেদিন প্রথম তোমাকে দেখেছি, জানি না কেন, কীভাবে তুমি আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিলে। তোমার মধ্যে কিছু একটা আছে, যা অদ্ভুতভাবে টানে আমাকে। আমি সত্যি জানতাম না তুমি খ্রিষ্টান। যদি প্রথম দিনই জানতে পারতাম, তাহলে হয়তো কষ্ট পেতে হতো না আজ আমার।

পেট্রা চুপ। স্মরণ পকেট থেকে মেটালের একটা ছোট জুয়েলারি বক্স বের করে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর সেটা খুলল, ভেতরে একটা আংটি। স্মরণ বলল, এই রিংটা দিয়ে এই রেস্টুরেন্টেই আমি তোমাকে ফিল্মি স্টাইলে প্রপোজ করতে চেয়েছিলাম। যখনই খবর পেয়েছি তুমি আর আমি আসব, আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, এই সুযোগে অনেকটা সময় তোমার সাথে কাটাতে পারব, অনেকটা কাছে আসতে পারব তোমার। নিজের ওপর আমার কনফিডেন্স ছিল, তাই সাথে সাথে ছুটে গিয়ে এই রিংটা কিনেছিলাম। তোমার জন্যও বাসায় ছেলে দেখছে, আমার জন্যও মেয়ে দেখছে। ভেবেছিলাম কোনো বাধা আসবে না। কিন্তু…আমার কপালটাই আসলে খারাপ।

পেট্রা বলল, ‘আই অ্যাম সরি, স্মরণ।’

‘ইটস নট ইওর ফল্ট।’

‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তুমি আমার ধর্মের ব্যাপারে জানো না। চাচ্ছিলাম না এই পরিস্থিতিটা ফেস করতে। তাই তোমাকে টেকনিক্যালি জানিয়ে দিয়েছিলাম। অথচ তুমি আমাকে এই পরিস্থিতিটা ফেস করালেই।

‘জানি পেট্রা, আমিও পারতাম ব্যাপারটা গোপন রেখেই মিটিয়ে দিতে। কিন্তু আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। পাব না জানি, তবু এই ভালোবাসার কথা না জানিয়ে আমার শান্তি ছিল না। তাই জানালাম।

পেট্রা তাকিয়ে রইল স্মরণের দিকে। সে সত্যিই কখনো চায় নি এমন পরিস্থিতি সামনে আসুক। স্মরণ বলল, ‘রিংটা আমি তোমার জন্য কিনেছিলাম। তুমি নিলে খুশি হব। যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে তো দিতে পারব না, কিন্তু তোমার উদ্দেশে কেনা, এটা তুমি ছাড়া আর কারও আঙুলে উঠবে না।’

‘আমি এটা নিতে পারব না।’

‘তাহলে এখন এটা আমি কী করব? এটার মালিক তো তুমি।

‘আপাতত রেখে দাও, আমার বিয়েতে গিফট দিয়ো।’

‘এটা ভালো বুদ্ধি, ঠিকাছে।’

স্মরণ আংটির বক্সটা যত্ন করে তুলে আবার পকেটে রাখল।
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp