আলমারি গোছাতে গিয়ে বিয়ের শাড়িটায় চোখ পড়ল নিকিতার। শাড়িটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। প্রত্যেকটা মেয়ের মনেই কিশোর বয়স থেকে বিয়ে ও বিয়ের দিনটি নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। তারও ছিল। প্রথম দিকে বিয়েতে আপত্তি ছিল তার। উপরন্তু পাত্র এক বাচ্চার বাবা। কে চায় এক বাচ্চার বাবাকে বিয়ে করতে? কিন্তু প্রিয়র ছবি ও পরিবার দেখে নিকিতার খুব পছন্দ হয়ে যায়। এমন রাজপুত্রের মতো ছেলে সচরাচর পাওয়া যায় না। তার ওপর ভালো চাকরি করে, বাড়ি-গাড়ি আছে। শ্বশুর বিশিষ্ট মন্ত্রী। মা-বাবাও খুব চাচ্ছিল, সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় নিকিতা। বিয়ের আগে প্রিয়র সঙ্গে তার দেখা হয় নি, এমনকি কথাও হয় নি। আজকালকার যুগের ছেলে পাত্রী না দেখে বিয়ে করে, এটা অবাস্তব একটা ব্যাপার। কিন্তু এটাই ঘটেছিল তার সঙ্গে।
বিয়ের আগে দেখা হয় নি, হুট করে বাসরঘরে কী করে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে? প্রথম দেখাতেই একটা অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কীভাবে এক বিছানায় শোবে? যদি প্রথম দিনই ইন্টিমেট হতে চায়। বাসরঘরে বসে যখন এমন নানান চিন্তায় গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, বুক ঢিপঢিপ করছিল, তখন প্রিয় ঘরে এসে অবাক করে দিল নিকিতাকে। কারণ, প্রিয় তার কাছেও আসে নি, কোনো কথাও বলে নি। বারান্দায় বসে একনাগাড়ে সিগারেট খাচ্ছিল। নিকিতার আগবাড়িয়ে কিছু বলতে সংকোচ হচ্ছিল। আবার এত ভারী শাড়ি ও গয়নাগাটি পরে বসে থাকতে পারছিল না আর। এমনিতেই ভীষণ ক্লান্ত ছিল।
ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর নিকিতা বারান্দায় গিয়ে বলেছিল, ‘আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে।
প্রিয় শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, আমি কী করতে পারি?
প্রিয়র তাকানো, বাচনভঙ্গি, কণ্ঠস্বর–সবকিছুতে ঘোর লেগে গেল নিকিতার। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি ঘুমিয়ে পড়ব?
‘অ্যাজ ইউর উইশ।’
নিকিতা ঘরে ফিরে এল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গয়না খুলতে খুলতে ভাবতে লাগল, মানুষটার কি তবে তাকে পছন্দ হয় নি? নাকি বিয়েতে রাজি ছিল না? সে জন্যই কি দেখা করে নি বিয়ের আগে? নাকি সে এখনো তার প্রাক্তন স্ত্রীকে ভুলতে পারে নি বিধায় শোক পালন করছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে তাকে কেন বিয়ে করল? এমন হাজারো প্রশ্ন মাথায় নিয়ে রাগে কাঁপতে লাগল নিকিতা। বাসরঘরে এমন হয় কোনো স্বামীর ব্যবহার!
মেকআপ তুলে ফ্রেশ হয়ে এসে যখন বিছানায় গেল, তখনই ঘরে এল প্রিয়। কিন্তু তার দিকে তাকাল না। আরেক দফা অবাক হলো নিকিতা। প্রিয় না তাকালেও নিকিতা তাকিয়েছিল প্রিয়র দিকে, তখনই দেখল প্রিয়র চোখটা ভেজা। কাঁদছিল নাকি? কিন্তু কেন কাঁদছিল? কেমন জানি মনটা নরম হয়ে গেল নিকিতার। বলে বসল, তুমি কাঁদছ কেন?
প্রিয় চমকে তাকাল। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, আমি কাঁদি বা হাসি, বাঁচি বা মরি, তাতে তোমার কিছু বলার অধিকার নেই।’
এমন কথায় মাথা গরম হয়ে গেল নিকিতার। সে কোনো অবলা নারী নয়। ছোটবেলা থেকেই রগচটা, জেদি। কাউকে পাত্তা দেয় নি কখনো। কথার বেলায় নিজের বাপকেও ছাড়ে না। প্রিয়কে ছাড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। বলল, ‘অধিকার অবশ্যই আছে। কারণ আমি তোমার স্ত্রী। কিছুক্ষণ আগেই তুমি আমাকে বিয়ে করেছ।
‘আমি তোমাকে বলেছিলাম আমাকে বিয়ে কোরো না, স্ত্রীর জায়গা কখনো পাবে না। এখন স্ত্রীগিরি ফলাচ্ছ?
অবাক হলো নিকিতা, ‘মানে? তোমার সাথে তো আমার দেখাই হয় নি, বললে কবে আবার?
‘হ্যাঁ, দেখা হয় নি ঠিক, কিন্তু ফোনে তো বলেছি।
নিকিতা আরও অবাক হয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলল, আমার সাথে মোটেও তোমার ফোনে কথা হয় নি। আমি চেয়েছিলাম কথা বলতে, আমার মা বলেছে, তুমি যেখানে কথা বলতে চাও না, সেখানে আমার বলতে চাওয়াটা নির্লজ্জতা হবে।’
‘তাহলে কার সাথে কথা হয়েছিল আমার?
‘আমি কী জানি!’
‘আমার কাছে সম্ভবত রেকর্ডিংও আছে। খুঁজলে হয়তো পাব।’
নিকিতা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘তাই নাকি? তাহলে রেকর্ডিং খুঁজে বের করুন। শুনি আপনার সাথে আমার কেমন কথা হয়েছে?
প্রিয় বিরক্ত হয়ে রেকর্ডিংটা খুঁজতে লাগল। পাশাপাশি ভয় হতে লাগল। নিকিতা কি সত্যি বলছে? তাহলে কি মন্ত্রীসাহেব নাটক করিয়েছে কাউকে মেয়েটি সাজিয়ে? রেকর্ডিংটা খুঁজে পেয়েই প্লে করল প্রিয়। তারপর ফোনটা নিকিতার হাতে দিল। কনভারসেশনটা অনেকটা এ রকম ছিল,..
‘হ্যালো।
‘হ্যালো, নিকিতা বলছেন?
‘হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন?
নিকিতা অবাক হলো। এটা ওর কণ্ঠ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ও তো জানে কথা হয় নি, তাহলে এই মেয়েটা কে! এসব ভাবতে ভাবতেই আবার রেকর্ডিংয়ে মনোযোগ দিল নিকিতা।
‘আমি প্রিয়। চিনতে পেরেছেন?
‘হ্যাঁ। কেমন আছেন আপনি?’
‘ভালো। আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল।’
‘হ্যাঁ, বলুন।
‘আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না, প্লিজ। আমি এই বিয়েতে রাজি নই।
কিন্তু আপনার বাসার লোকজন বলেছে আপনি রাজি আছেন।
‘তারা এটাই বলবে। কিন্তু আমি প্রিয়, আমি স্বজ্ঞানে বলছি, আমি রাজি নই। আমার পাঁচ বছরের একটা ছোট ছেলে আছে, সে-ও রাজি নয়। এই বিয়ে হলে আপনার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে আর আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে যাবে।
‘আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। পরিষ্কার করে বলুন।
‘আমি আমার প্রাক্তন স্ত্রীকে এখনো ভালোবাসি। সারা জীবন ভালোবাসব। এমনকি আমি আমাদের সম্পর্কটা আবার ঠিক করতে চেষ্টা করছি। তা ছাড়া আমার ছেলেও কোনো দিন অন্য কাউকে মা বলে মানতে পারবে না।’
‘আমি শুনেছি আপনার স্ত্রী বেঁচে নেই।
‘আলবত বেঁচে আছে।
‘এখন আমার কী করার থাকতে পারে?
‘বিয়ে ভেঙে দিন।’
‘সেটা আমি কী করে করব? আমার ফ্যামিলি ঠিক করেছে এই বিয়ে। আর আমি কখনোই তাদের ওপর কোনো কথা বলি না।
‘তাদের বলুন আমি এই বিয়েতে রাজি নই। ইচ্ছা করলে আমার নামে ইচ্ছেমতো বদনামও বলতে পারেন।
‘আচ্ছা, বলব।
থ্যাংক ইউ। প্লিজ, বিয়েটা করবেন না। যদি করেন আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।
‘আরে, আপনি নিজে আপনার ফ্যামিলিকে বলতে পারছেন না যে আপনি বিয়ে করবেন না?
‘বলেছি। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলে পড়ে গেছি। আমার হাতে আর কিছু নেই, তাই আপনার সাহায্য চাচ্ছি।
‘আচ্ছা, আমি চেষ্টা করব।’
রেকর্ডিংটা শেষ হতেই নিকিতা বলল, এটা আমি নই। আমাকে কি পাগলা কুকুরে কামড়েছে যে পাত্র রাজি নয় শুনেও বিয়ে করব? আমার কি পাত্রের অভাব?
প্রিয় মেজাজ খারাপ করে বলল, কী বলতে চাচ্ছ তুমি?
নিকিতা নিজের ফোনটা বিছানার ওপর থেকে তুলে প্রিয়র হাতে দিয়ে বলল, ‘নম্বর টাইপ করো।’
‘কার নম্বর?
‘তোমার নম্বর, আবার কার?
‘এই মেয়ে, খবরদার, চেঁচাবে না আমার সাথে।
এবার নিকিতা রাগের বশে ঢং করে বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে, জান, বাবু, কলিজা আমার, তোমার নম্বরটা একটু টাইপ করো।
‘হোয়াট রাবিশ!’
প্রিয় প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ফোনটা নিয়ে নিজের নম্বর টাইপ করে ফেরত দিল। নিকিতা প্রিয়র নম্বরে ডায়াল করে বারান্দায় চলে গেল। প্রিয় বুঝতে পারল নিকিতা কী করতে চাচ্ছে এবং নিশ্চিত হলো, ওর বাবাই প্যাঁচটা লাগিয়েছে। রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। ফোন বেজে উঠল। প্রিয় ফোন ধরতেই নিকিতা বলল, ‘হ্যালো মিস্টার প্রিয়, আমি নিকিতা। আমার কণ্ঠস্বর ভালোমতো শোনো। এটাও রেকর্ড হচ্ছে। একটু পরে দুটো রেকর্ডিং মেলাতে হবে তোমাকে। ওকে? শুনেছ ভালোমতো? হ্যালো হ্যালো।’
প্রিয় ফোন কেটে দিল। নিকিতা ঘরে ফিরে এল। প্রিয় বলল, ‘আমি তাহলে অন্য কারও সাথে কথা বলেছি!’
‘জি। আচ্ছা, ওই নম্বরটা দেখতে পারি?
হ্যাঁ, শিওর।
প্রিয় নম্বরটা বের করে দিল। নিকিতা বলল, ‘চিনি না। আর আমার তো এই একটাই নম্বর, যেটা দিয়ে আপনাকে মাত্র কল করলাম।
‘বুঝতে পারছি।
প্রিয় ওই নম্বরটাতে কল করল। কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। কয়েকবার কল করার পর নম্বরটা বন্ধ পেল। প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আসলে মন্ত্রীসাহেব অনেক দিন ধরেই আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। সব সময় এভাবেই পাত্রীর সাথে কথা বলে বিয়ে ভেঙে দিয়েছি। সেটা বুঝতে পেরেই তিনি এবার এই কাজটা করলেন।
‘তার জন্য আমাকে ভুগতে হবে কেন, মিস্টার প্রিয়?
‘সরি নিকিতা। আমার কিছু করার নেই। আমার দিক থেকে আমি ঠিক ছিলাম, বুঝতেই পারছ নিশ্চয়ই। আমি ভুল মানুষের সাথে কথা বলেছিলাম, সেটা তো আমি জানতাম না।’
‘আমি কালকেই চলে যাব।’
‘শিওর, অ্যাজ ইওর উইশ।
নিকিতা মুখ ঝামটা দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর প্রিয় শুতেই লাফিয়ে উঠল নিকিতা। বলল, আমি তোমার সাথে এক বিছানায় শোব নাকি? ঘর করলে শুতাম। ঘর তো করব না। কালই চলে যাব। এরপর তালাক দিয়ে দেব। আর শোনো, আমি তোমার মতো বিবাহিত নই, একটাই বয়ফ্রেন্ড ছিল, ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনো ভার্জিন। সুতরাং, খবরদার, আমাকে ছোবে না।
রাগে প্রিয়র শরীরের রক্ত টগবগ করতে লাগল। নিকিতার দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন একটা মরা ইঁদুরের দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু কিছু বলল না। হয়তো ভাবছিল কাল চলে যাবে, আপদ ঘাড় থেকে নামবে, এটাই বড় শান্তির কথা।
প্রিয় বালিশ তুলে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর আড়চোখে দেখল, নিকিতা ফলের ঝুড়ি থেকে ছুরি তুলে বালিশের পাশে নিয়ে শুল। মেজাজটা প্রচণ্ড খারাপ হলো। নিকিতাও প্রিয়র তাকানোটা খেয়াল করল। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। আতঙ্ক নিয়ে ঘুমিয়েছিল সারা রাত।
এভাবেই কেটেছিল তাদের বাসর রাত। সেদিনের কথা মনে পড়লে এখন হাসি পায় নিকিতার। কত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলেছিল সেদিন সে। অথচ মাত্র দুবছরে কত বদলে গেছে সে! মানুষটাকে পাওয়ার জন্য কত কিছুই না করেছে এ দুবছরে কিন্তু মানুষটা আজ অবধি তাকে স্পর্শ করেনি।
·
·
·
চলবে...................................................................................