ফানুস - পর্ব ১১ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          হুইস্কির গ্লাসটা নামিয়ে রেখে লেপ টেনে নিকিতার দিকে ফিরে শুয়ে পড়ল প্রিয়। প্রিয়র চোখ দুটো সামান্য লাল হয়ে আছে, মুখে হাসি। নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা যখন বুয়েটে থার্ড ইয়ারে পড়ি, তখন শুদ্ধর জন্ম হলো। তারপর থেকেই সব প্রবলেম শুরু।’

নিকিতার বুঝতে বাকি রইল না যে প্রিয়র নেশা হয়ে গেছে। বলল, ‘তোমাদের বিয়ে?

‘ও বিয়ে? তার আগের বছর হয়েছিল।

নিকিতা অবাক হয়ে বলল, ‘পড়াশোনা শেষ না করেই বিয়ে কেন করেছিলে? তাও এত অল্পবয়সে?

‘দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারছিলাম যে!’

‘তারপর?

‘বিয়ের পর পেট্রাকে আমি আমার বাসায় নিয়ে এলাম। এর আগে পেট্রা হলে থাকত। কারণ তখনো তার পরিবারের সবাই সাভারে।

এই বাসায়?

‘না, আমার বাসায়, আমি একা থাকতাম।

‘দুই ভাই দুই বাসায় থাকতে?

‘তত দিনে ভাইজান আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। ভাইজান মাকে নিয়ে ঢাকা থেকে সাভার যাচ্ছিল। ভাইজান নিজেই ড্রাইভ করছিল। ওর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে মায়ের সাথে কথাকাটাকাটি হচ্ছিল। তখনই ভাইজান বেখেয়ালি হয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে। স্পট ডেট, মা কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে মারা যায়।

‘ইশ! বাসায় গিয়ে কথা বললে কী হতো?

‘দুজনেরই মাথা গরম ছিল। আসলে মা ঢাকায় এসে ভাবি-আপুর কথা জানতে পারে।

নিকিতা অবাক হয়ে বলে, ‘ভাবি-আপু!

‘হ্যাঁ, আপু ছিল। একই স্কুলের, একই এলাকার। মফস্বলে যেমন হয়, সবাই সবাইকে চেনে। পরে ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড হওয়ার পর ভাবি-আপু ডাকতাম। মা মেনে নিতে পারে নি। কারণ, ভাবি-আপু ছিল মায়ের ছোটবেলার এক বান্ধবীর মেয়ে, যার সাথে মায়ের খুব বড় রকমের সমস্যা হয়েছিল এবং তারা দুজন বান্ধবী থেকে শত্রু হয়ে গিয়েছিল।

‘ওহ, শিট! আচ্ছা তোমাদের বিয়ের কথা বাসায় জানাজানি হলো কীভাবে?

‘পড়াশোনা শেষে আমরাই জানিয়েছিলাম, তারপরই সব সর্বনাশের শুরু। স্কুলে প্রেম হওয়ার পর থেকেই সবাই জানত আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড, দুজনই দুজনের বাড়িতে অবাধে যাওয়া-আসা করতাম। দুজনের দুই ধর্ম বলে আমাদের কেউ কখনো সন্দেহও করে নি। প্রেম, বিয়ে–এসব শুনে আমাদের দুই পরিবারের মাথা খারাপ হয়ে গেল। পেট্রার বাবা কিছুতেই মানবেন না আমাকে। আমার বাপও মানবেন না পেট্রাকে। এদিকে আমরা দুজন কেউ কাউকে ছাড়ব না। শেষমেশ আমার বাপ পেট্রাকে মুসলিম হতে বললেন। পেট্রা আমাকে বলল, প্রিয়, তুই আজ পর্যন্ত যা চেয়েছিস, সব করেছি আমি। কিন্তু নিজের ধর্ম বদলাতে পারব না।… আমি কখনো চাই নি পেট্রা ধর্মান্তরিত হোক। কারণ, আমি নিজে তো এটা করতে পারব না। তাহলে আমি ওকে কী করে বলি? আমরা দুজনই চেয়েছিলাম যার যার ধর্মে সে সে থাকব। যা-ই হোক, এসব কথা শুনে পেট্রার বাবাও আমাকে একই অফার দেন, আমি খ্রিষ্টান হলে তিনি মেনে নেবেন। আমিও রাজি হই নি।

‘তারপর কী হলো?

তারপর আর বিস্তারিত বলার মতো বিশেষ কিছু নেই। অনেক ঘটনা, অনেক ট্র্যাজেডি। বারবার একই ঘটনা ঘটেছে, আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করেছি, আর আমাদের পরিবার তাদের মতো। তিন বছর পর মন্ত্রীসাহেব ব্ল্যাকমেল করে আমাদের ডিভোর্স করিয়েছে।’

নিকিতা জানতে চাইলে, ‘শুদ্ধকে কেন নিয়ে এলে?

প্রিয় এই কারণটাও নিকিতাকে বলতে চায় না, তাই সে বলল, ‘কিছুদিন পর পেট্রার বাবা মারা গেল। পেট্রা ফ্যামিলির হাল ধরেছে। তখন শুদ্ধকে আমি চাইলাম। কারণ, না হলে পেট্রার অনেক বেশি প্রেশার পড়ে যেত। ওর ছোট দুটো ভাই-বোন, তার ওপর শুদ্ধ। ও প্রথমে রাজি না হলেও পরে শুদ্ধকে দিয়ে দিয়েছে। তিন বছরের একটা ছেলেকে হঠাৎ করে মা ছাড়া রাখা অসম্ভব ছিল। ছেলেটা লক্ষ্মী, পেট্রা যা বুঝিয়েছে, তা-ই বুঝেছে। কিন্তু মায়ের জন্য শুদ্ধর যে কান্না, যে হাহাকার, সেটা আমি দেখেছি। অনেক কষ্টে শুদ্ধকে আজ এই পর্যায়ে এনেছি।

কথা শেষ করে প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিকিতার বুক ফেটে কান্না আসছে।

‘গুড নাইট, নিকিতা।

প্রিয় উল্টোদিকে ঘুরল। তার চোখে জল। নিকিতা পেছন থেকে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। প্রিয় পেছনে তাকিয়ে নিকিতার হাত সরিয়ে হেসে বলল, ‘এই, ধরো না, ধরো না। আমার পেট্রা কষ্ট পাবে। জানো না আমি শুধু পেট্রার? গুড নাইট নিকিতা।

—————

পেট্রা শুয়ে ছিল, রাত অনেক হয়েছে। কিন্তু যথারীতি ঘুম আসছিল না। তার। তাই মোবাইলে প্রিয় ও শুদ্ধর ছবি দেখছিল। এখন যদিও দেখছে না। তবু চোখ মোবাইলের স্ক্রিনেই। প্রিয় একটার পর একটা কল করে যাচ্ছে। ধরবে কি না বুঝতে পারছে না। কালও অনেকবার ফোন করেছিল, সে ধরে নি। এ জন্যই দেখা করতে চায় না সে। দেখা হলেই পাগল হয়ে যায় প্রিয়। প্রিয় এমন কেন? সব তো শেষ হয়েই গেছে, এখন কেন মেনে নিচ্ছে না? নিজে মানছে না, তাকেও শক্ত হতে দিচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত ফোন ধরেই ফেলল পেট্রা, ‘হ্যালো।’

‘পেট্রা! মাই লাভ, আই মিস ইউ।’ পেট্রা অবাক হয়ে বলল, ‘তুই ড্রিংক করেছিস?

‘একটুখানি বেবি।’

পেট্রা রাগী স্বরে বলল, ‘আমি তোর ভয়েস শুনেই বুঝতে পারছি তুই কতটা গিলেছিস!’

‘হ্যাঁ, মদ কি চিবিয়ে খাওয়া যায়? গিলেই তো খেতে হয়।’

‘তুই ফোন রাখ।

‘না না না, প্লিজ, ফোন রাখিস না। এতবার কল দেওয়ার পর ধরছিস, রেখে দিস না। আমি তো খুব অসহায়। অসহায় মানুষ সাথে এমন করতে হয় না।’

পেট্রা মনে মনে বলল, তুই অসহায়? তোর কাছে অন্তত ভালো চাকরি আছে, ছেলে আছে। আমার কাছে তো তা-ও নেই। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারল না। প্রিয় আবার বলল, ‘রাগ করছিস? চুপ করে আছিস যে! শোন, রাগ করিস না, আগে কখনো ড্রিংক করেছি, বল? এমনকি একটা সিগারেটও তো খাই নি কখনো, তোর চেয়ে ভালো কে জানে! এখন একটুসখানিই খাই। আমি তো আর দেবদাস হওয়ার জন্য খাই না। তোর কথা মনে পড়লে কিছুতেই আর ঘুম আসে না, তাই একটু খাই যাতে ঘুমাতে পারি।’

‘আমারও তো তোর কথা মনে পড়ে। কই, আমি তো তোর মতো এসব হাবিজাবি খাই না।’

‘তাহলে তুই আমার সাথে জঙ্গলে চল, আর কখনো খাব না, প্রমিজ।

পেট্রার ভালো লাগছিল না মাতাল প্রিয়কে। বলল, ‘নিকিতা কই? ওর সামনে এসব বলছিস?

‘ও তো ঘরে, নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।

‘তুই কই?

‘আমি তো ড্রয়িংরুমে। তোর সাথে দুষ্টু দুষ্টু কথা বলার জন্য এখানে চলে এসেছি। জানিস, একটু আগে নিকিতা আমাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল, আমি সরিয়ে দিয়েছি। ও কেন ধরবে আমাকে? শুধু তুই ধরতে পারবি।’

‘না, এখন আর আমি পারব না, এখন থেকে শুধু ওই পারবে তোকে ধরতে।

পেট্রার খারাপ লাগছিল এ কথা বলতে। নিঃশ্বাসটা বুকের ভেতর জমাট বেঁধে যাচ্ছে। তবু বলতে বাধ্য হলো। প্রিয় অবুঝের মতো ধমক দিয়ে বলল, ‘কেন?

কারণ, এখন নিকিতা তোর বউ। আমি তোর প্রাক্তন। আমাকে নিয়ে তোর এসব ভাবাও এখন পাপ।

‘তাহলে আমি পাপই করব।’

‘তুই না ঘুমানোর জন্য ড্রিংক করেছিস? তাহলে ঘুমাচ্ছিস না কেন?

‘সেটাই তো জানতে তোকে ফোন করলাম। ড্রিংক করলে আমার ঘুম। এসে যায়, আজকে কেন আসছে না?

পেট্রার রাগও লাগছে, মায়াও লাগছে। বলল, জানি না।

‘আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবি? আগের মতো করে?

‘প্রিয়, তুই আমার কাছে নেই যে ঘুম পাড়িয়ে দেব।’

প্রিয় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তাহলে আমি কী করব এখন? কালকেও ঘুমাই নি। আমি কি মরে যাব? তাহলে তোরা সবাই খুশি হয়ে যাবি?’

‘প্রিয়, আমার কথাটা একটু মন দিয়ে শুনবি?

‘হুম, এক শ বার শুনব।’

‘আচ্ছা শোন, তোর আর নিকিতার বিয়ে হয়ে গেছে। আর আমাদেরও ডিভোর্স হয়ে গেছে।’

প্রিয় মন খারাপ করা গলায় বলল, ‘আমি জানি।’

পেট্রা ঠান্ডা গলায় বোঝাতে লাগল, আমারও কিছুদিন পর অন্য কারও সাথে বিয়ে হয়ে যাবে। মেনে নে সবকিছু, পেট্রা-প্রিয়র সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আয়। হাজার চেষ্টা করলেও তো আমরা আর এক হতে পারব না। যদি পারতামই, তাহলে তো বিয়ের পরও আমাদের আলাদা হতে হতো না, ডিভোর্স হতো না। তুই তো বুঝতে পারছিস, তাই না?

‘না, আমি এসব বুঝতে চাই না। কীভাবে পারিস এত কঠিন হতে? তোর কি কষ্ট হয় না, পেট্রা?

‘বুঝতে হবে।’

‘তোর যার সাথে বিয়ে হয়ে যাবে, তুই তাকে ভালোবাসবি?

‘আমার মধ্যে এখন আর ভালোবাসা নেই, প্রিয়। দেখিস না তোর সাথেও কেমন করি?

‘তাকে তোর গা ছুঁতে দিবি?

পেট্রা কী উত্তর দেবে এই পাগলকে! উত্তর না পেয়ে প্রিয় নিজেই আবার বলল, আমাদের বাসায় যে চাপাতিগুলো আছে, ওগুলো দিয়ে কোরবানির সময় মাংস কাটি। ওগুলো দিয়ে টুকরা টুকরা করে ফেলব যদি তোকে কেউ ছোঁয়।’

পেট্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রিয় বলল, ‘কেন দিবি? আমি তো দিই নি। দুই বছরে এক দিনও দিই নি। একজনকে কিছু দিলে সেটা ফিরিয়ে আবার আরেকজনকে দেওয়া যায় নাকি? দেওয়া যায় না। আমাদের পরিবার তো ছোটবেলা থেকে এটাই শিখিয়েছে আমাদের। তাহলে এখন তারা উল্টো কথা কেন বলবে? বললেও তো তাদের বোঝাতে হবে যে তারা ভুল বলছে।

‘প্রিয়, তোর ঘুম দরকার। এক্ষুনি তুই ঘুমাবি।

‘একা ঘুমাতে পারছি না আমি। তাই তো ঘুম পাড়িয়ে দিতে বলছি। হলে তোর কাছে কে আসত!’

‘আচ্ছা, সরি, এত দূর থেকে কী করে ঘুম পাড়াব বল? তুই বরং আজকের জন্য নিকিতার কাছে যা, ওকে বল ঘুম পাড়িয়ে দিতে।

‘তুই মর হারামি। জীবনেও আর তোর মুখ দেখতে চাই না আমি।’

এ কথা বলেই প্রিয় ফোন রেখে দিল। তারপর রাগে গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকেই নিকিতাকে দেখতে পেল। সে নিকিতাকে বলবে ঘুম পাড়িয়ে দিতে? মরে গেলেও না। পেট্রা মরুক, সত্যি মরে যাক। অন্য কারও বউ হওয়ার আগে ওর মরে যাওয়াই ভালো। এসব ভাবতে ভাবতে বালিশ কোলে নিয়ে শুয়ে পড়ল প্রিয়। পেট্রাকে গালি দিতে দিতে ঘুমিয়েও পড়ল একসময়।

ওদিকে পেট্রা কম্বলে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে লাগল। কী করবে সে! প্রিয় তো সারা জীবনই এমন অবুঝ ছিল, ওকেই তো সব সামলাতে হয়েছে, হচ্ছে। ওর অবুঝ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই! কাঁদতে কাঁদতেই সকাল হয়ে গেল।
·
·
·
চলবে..................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp