অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে স্মরণ পেট্রার জন্য অপেক্ষা করছিল। পেট্রা লিফট থেকে নেমেই দূর থেকে তাকে দেখতে পেল। সে মনে মনে বলল, হে ঈশ্বর, স্মরণ যেন আমাকে ডেকে না বসে! কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। স্মরণ ঠিকই ডাক দিয়ে কাছে এগিয়ে এল। পেট্রা প্লাস্টিক হাসি ঝোলাল ঠোঁটে। স্মরণ হেসে বলল, ‘কেমন গেল ক্রিসমাস?
‘অনেক ভালো।’
‘একদিনে খুব মাস্তি করেছ? নাকি অন্য কিছু? আসলে তোমাকে দেখে মনে হলো অনেক দিন রাতে ঘুমাও না।
‘হুম, ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না।
‘এখন বাসায় গিয়ে ঘুমাবে?
পেট্রা হেসে বলল, ‘না না, অসময়ে ঘুমাতে পারি না।
‘তাহলে, তোমার যদি কোনো সমস্যা না থাকে, চলো ডিনার আজ একসাথে করি।’
‘সরি। আমার ছোট বোন প্রেগন্যান্ট, ওকে দেখতে যাওয়ার কথা আজ আমার।
স্মরণ হেসে বলল, তাহলে কাল?
পেট্রা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। স্মরণ গলাখাঁকারি দিল। পেট্রা কী ভাবছে কে জানে! পেট্রা হেসে বলল, ‘আচ্ছা কালকেরটা কাল দেখা যাবে।’
স্মরণ হেসে বলল, ‘থ্যাংক ইউ।
‘আজ তাহলে আমি চলি?
‘ক্যান আই ড্রপ ইউ?
পেট্রা হেসে বলল, ‘আচ্ছা।’
থ্যাংক ইউ পেট্রা।
চলো। স্মরণ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোন দিকে যাব?
পেট্রা প্রিয়াঙ্কার বাসার ঠিকানা বলল, স্মরণ সেদিকেই রওনা হলো।
—————
শুদ্ধ বেড়াতে যাওয়ার পর থেকে দিনের বেলায় নিকিতার খুব একা লাগে। শুদ্ধর জন্য অনেক কাজ করতে হয়, মাঝেমধ্যে বিরক্ত লাগে। কিন্তু এখন ছেলেটা বাসায় নেই, মিস করে সে। ও থাকলে সত্যিই সময় কোন দিক দিয়ে যায়, টের পাওয়া যায় না। প্রিয় হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। কিন্তু এসেই আবার বডি বানাতে জিমে চলে যাবে। এত বড়ি বানিয়ে করবেটা কী ও, যদি নিজের বউকেই দেখতে, ধরতে না দেয়! যত্ত সব!
নিকিতা এসব ভাবতে ভাবতে উল দিয়ে মাফলার বুনছিল। উলের কাজ মোটেও পারত না সে। এসব ভালোও লাগে না। কিন্তু শ্বশুর সাহেব লোক রেখে উল বোনা শিখিয়েছেন এবং বলেছেন প্রিয়কে একটা মাফলার বানিয়ে দিতে। কারণ, পেট্রা প্রতিবছর প্রিয়কে সোয়েটার, মাফলার, টুপি এসব বুনে দিত, যা পরে প্রিয় ভীষণ গর্ববোধ করত। অদ্ভুত! ছেলে কী চায়, না চায়, তা তো ভাবেনই নি। উল্টো এখন ওকে দিয়ে বিভিন্নভাবে ছেলের মন ভোলানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ওর নিজস্বতা ভুলে এখন ওকে পেট্রার মতো হতে হচ্ছে। প্রিয়কে ভালো না বেসে ফেললে নিকিতা এই সংসার ছেড়ে কবেই চলে যেত!
কিছুক্ষণের মধ্যে প্রিয় চলে এল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই নিকিতা প্রিয়কে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু খাবে?
প্রিয় বিছানায় বসে মুখের পানি মুছতে মুছতে বলল, ‘শুধু চা।
নিকিতা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। প্রিয়র হঠাৎ বিছানায় চোখ পড়তেই উল এবং আধবোনা মাফলারটা দেখতে পেল। মাফলার কে বুনছিল? নিকিতা? ও এসব পারে? কার জন্য বুনছিল? কিছুক্ষণ পর নিকিতা চা নিয়ে ঘরে ঢুকল।
প্রিয় চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মাফলার তুমি বুনছিলে?
‘হ্যাঁ।
‘কার জন্য?
‘তোমার জন্য।
‘বাহ, তাহলে তো দেখতে পারি আমি, তাই না?
নিকিতার মনটা আনন্দে নেচে উঠল। উৎসাহ নিয়ে মাফলারটা তুলে প্রিয়র হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নাও, দেখো।
প্রিয় চা খেতে খেতে মাফলারটা মনোযোগ দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এই প্রথম বানাচ্ছ?
হ্যাঁ। ভালো হয় নি?
প্রিয় হেসে বলল, ‘ভালো, প্রথমবার হিসেবে অনেক ভালো, শুধু ফিনিশিংটা একটু আনকোরা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আনাড়ি হাতে বানানো।
নিকিতার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাফলারটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, একটা মাফলার বানানোর যোগ্যতাও নেই তার? প্রিয় নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নিকিতা, আমার দিকে তাকাও।’
নিকিতা তাকাল। প্রিয় স্বাভাবিক গলায় বলল, তুমি তোমার মতো থাকো। তোমার কারও মতো হওয়ার দরকার নেই। পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। আল্লাহই আমাদের একেকজনকে একেক রকম করে বানিয়েছেন। সব সময় নিজেকে সম্মান করবে। তুমি যদি তোমাকে সম্মান না করো, তাহলে অন্যরাও তোমাকে সম্মান করবে না। ঠেসে ঠেসে নিচে নামাতে চাইবে। আর হ্যাঁ, তোমার শ্বশুরকে বলে দিয়ে, তোমাকে ভালোবাসতে হলে তুমি আমার স্ত্রী, এই কারণটাই যথেষ্ট। কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি কখনো তোমাকে ভালোবাসব না দুটো কারণে। প্রথমত, পেট্রা ছাড়া আমি কাউকে ভালোবাসতে পারব না, এটা আমার আয়ত্তেই নেই। দ্বিতীয়ত, তোমার শ্বশুরকে আমার বোঝাতে হবে যে সে ভুল করেছে।’
কথাগুলো শুনে ভীষণ ভালো লাগল নিকিতার। তাকে প্রিয় ভালো না বাসুক, সম্মান তো করে!
—————
রাতে ঘুমানোর সময় নিকিতা জিজ্ঞেস করল, ‘বাকি কাহিনি বলবে না?
প্রিয় সিগারেট খাচ্ছিল। ধোয়া ছেড়ে তাকাল নিকিতার দিকে। নিকিতা বলল, ‘না, মানে তুমি যেদিন প্রপোজ করলে, সেদিন তো পেট্রা আপু রিজেক্ট করল, তারপর রাজি হলো কবে?
প্রিয় সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, ‘পরদিন সকালে স্কুলে পেট্রা এত স্বাভাবিক ছিল যেন কিছুই হয় নি আগের রাতে। আমি কিন্তু হাল ছাড়ি নি। তবে প্রতিদিনই ভালোবাসার কথা বলতাম না। ভাইজান শিখিয়ে দিয়েছিল, মেয়েদের নাকি বারবার ভালোবাসার কথা বললে রাজি করানো যায় না। উল্টো বিরক্ত হয়। তার চেয়ে একবার ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিয়ে তারপর শুধু বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করলেই কাজ হয়ে যায়। আমি ভাইজানের শেখানো রাস্তাতেই হেঁটেছিলাম।’
নিকিতা জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, ছেলেদেরও কি একইভাবে রাজি করানো যায়?
প্রিয় অবাক হয়ে তাকাল নিকিতার দিকে, তারপর সজোরে হেসে দিল। নিকিতা মুচকি হাসছিল। প্রিয় বলল, ‘অ্যানিওয়ে, এসবে কাজ হচ্ছিল না। শেষমেশ ভাইজান শিখিয়ে দিল যে আমার কোনো মেয়ে-বন্ধুর সাথে যেন একটু বেশি মিশি। পেট্রার চেয়েও বেশি। এবং পেট্রাকে যেন সময় কম দিই।
‘মানে জেলাস করাতে বলেছিল?
‘হ্যাঁ।’
‘পরে?
‘আমি তা-ই করেছি। এমনকি স্কুল ছুটির পর ওই মেয়েটিকে সাইকেলে করে বাসায় দিয়ে আসতাম। আমাদের দুই ভাইয়ের দুটো সাইকেল ছিল। সাইকেলে করেই যেতাম-আসতাম। পেট্রাকে তখন অবধি কখনো বাসায় দিয়ে আসা হয় নি। যা-ই হোক, ফাইনাল পরীক্ষার সময় প্রথম পরীক্ষার দিন পেট্রাকে রেখেই হল থেকে বেরিয়ে গেলাম এবং পরীক্ষা নিয়ে পেট্রার সাথে আলোচনা না করেই ওই মেয়েকে সাইকেলে চড়িয়ে বাসায় দিতে গেলাম। এসবের কারণে পেট্রা খুব রেগে গেল। আমি ওই মেয়েকে বাসায় দিয়ে নিজের বাসায় ফিরতেই দেখি সে আমার বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, বাসার ঠিক উল্টো পাশে। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আরে, তুই এখানে? পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
সে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, এখন মনে পড়েছে আমার কথা? ওই মেয়ের সাথে তোর কাহিনিটা কী? আর ওকে সাইকেলে চড়িয়ে দুনিয়া ঘোরানোরই-বা মানে কী?
আমি অবুঝ বালকের মতো প্রশ্ন করলাম, তুই কেন রাগ করছিস? তুই তো বলেছিলি আমরা শুধুই বন্ধু। তাই, আমি কার সাথে মিশব, কী করব, সে ব্যাপারে কিছু বলার অধিকার তোর নেই।
পেট্রা রেগে আগুন। চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, তাই? তাহলে সেদিন রাতে প্রতিজ্ঞা করেছিলি কেন আমাকে যে তোর জীবনে আমি ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে আসবে না? পরীক্ষার হলে আমাকে একা রেখে বের হবি না? আরও কত কত প্রতিজ্ঞা! কেন করেছিলি?
আমি বলেছিলাম, বা রে, সেসব প্রতিজ্ঞা মন থেকেই তো করেছিলাম। কিন্তু তুই আমাকে ভালোবেসেও স্বীকার করতে চাস না। তাহলে তো আর সেসব প্রতিজ্ঞা রাখার কোনো দরকার নেই, তাই না?
নিকিতা জিজ্ঞেস করল, কোন প্রতিজ্ঞা?’
প্রিয়র মনে পড়ে গেল, প্রপোজের সময় করা প্রতিজ্ঞাগুলোর কথা নিকিতাকে বলা হয় নি। চুমুর ব্যাপারটা স্কিপ করতে গিয়ে এটাও স্কিপ হয়ে গেছে। প্রিয় প্রতিজ্ঞাগুলোর কথা বলতেই নিকিতা বলল, ‘সত্যিই তুমি এত রোমান্টিক ছিলে?
প্রিয় হাসল। তারপর বলল, যা-ই হোক, এরপর পেট্রা আমাকে জিজ্ঞেস করল ওই মেয়ের সাথে প্রেম হয়েছে কি না। আমি বললাম, এখনো হয় নি। এরপর পেট্রা আরও রেগে গেল। এরপর জানতে চাইল ওকে আমি ভালোবাসি কি না। আমি জানালাম, ভালো আমি সারা জীবন একজনকেই বাসব। সে বুঝল আমি তার কথাই বলছি। হঠাৎ আমার সাইকেলে উঠে বসে বলল, এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে চল।
আমি তখন ভীষণ খুশি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল কাজ হয়ে গেছে। আমি ওকে কাছেই একটা মেহগনি বাগানে নিয়ে গেলাম। আসলে এসব জায়গাই একমাত্র সেফ ছিল। অন্যান্য জায়গায় কে কখন দেখে ফেলবে, সেই ভয় ছিল। একে তো বাপ রাজনীতি করে, তার উপর আমার তো গুষ্ঠিসুদ্ধ ওখানে। ওখানে পৌঁছে পেট্রা জানতে চাইল, তুই এসব আমাকে দেখানোর জন্য করছিস, তাই না? আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য?
আমি কী বলব ভাবছিলাম, এর মধ্যেই সে বলল, এই সাইকেলে আমি ছাড়া আর কাউকে উঠাবি না। আমাকে ইগনোর করে ওই মেয়ের সাথে মিশলে খুন করে ফেলব। আর সেদিন রাতে যে প্রতিজ্ঞাগুলো করেছিলি, সবগুলো রাখবি।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন? সে রেগেমেগে বলেছিল, কারণ তুই আমার। সব জেনেবুঝে আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস!
আমি খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলেছিল, কিন্তু আগে থেকেই জেনে রাখ, আমরা প্রেমই করতে পারব, বিয়ে কোনোদিন করতে পারব না। না আমার ফ্যামিলি মানবে, না তোর ফ্যামিলি মানবে। সুতরাং, কষ্ট একদিন পেতেই হবে। তোর ঘর করতে হবে কোনো এক মুসলিম মেয়ের সাথে, আর আমার ঘর করতে হবে কোনো খ্রিষ্টান ছেলের সাথে। এই মানসিক প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে থাক।
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, এসব কী বলছিস, পেট্রা? আমি আমার পরিবারকে মানিয়ে নেব দেখিস।
ও বলেছিল, পারবি না। আর আমিও আমার বাবাকে রাজি করাতে পারব না। কিন্তু সেই সময়ের এখনো অনেক দূর। এত দিন আমি তোকে ভালোবাসতে চাই, তোর ভালোবাসা পেতে চাই। অন্তত তোকে চোখের সামনে অন্য কোনো মেয়ের সাথে দেখতে পারব না।
আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, পেট্রা, দেখিস, সময়মতো আমি সবকিছু কীভাবে ম্যানেজ করি। দুই পরিবারকেই আমি রাজি করাব। আমরা সারা জীবন একসাথে থাকব।
জানো নিকিতা, পেট্রা সেদিন আর কোনো কথা বলে নি আমার এই কথার ওপর। মনে মনে বিশ্বাস রেখেছিল যে আমি আমার কথা রাখতে পারব, কিন্তু পারি নি!
প্রিয় এ পর্যন্ত বলে চুপ হয়ে গেল। নিকিতাও আর কিছু বলতে পারল না। নিকিতা এখন একটু হলেও বুঝতে পারছে ব্যাপারটা। কেন যেন প্রচণ্ড খারাপও লাগছে। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছে অথচ কিছুই বলতে পারছে না।
নিকিতা প্রিয়র একটা হাত চেপে ধরে বলল, ‘মন খারাপ কোরো না। কে বলেছে তুমি কথা রাখতে পারো নি? তুমি তো পেট্রা আপুকে বিয়ে করেছিলে, তাই না? তুমি চেষ্টা করেছিলে।
‘বিয়েটা আমাদের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না, নিকিতা। সারা জীবন একসাথে থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার জীবনের প্রথম নারী সে, তার জীবনের প্রথম পুরুষ আমি। আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। আমাদের একটু একটু করে বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুজনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, এমনকি ভালোবাসার ধরনও পরিবর্তিত হয়েছে; কিন্তু আমাদের ভালোবাসার মানুষটা পরিবর্তন হয় নি। আমরা আরও বেশি আকৃষ্ট হয়েছি দুজন দুজনের প্রতি। কখনো মনে হয় নি একে অন্যের কাছে পুরোনো হয়েছি। আমাদের খুব ঝগড়া হতো। কারণ, দুজনেরই মাথা গরম ছিল। কিন্তু একজন আরেকজনের কাছে গিয়ে বলতাম, ‘এই, তুই ঝগড়া করেছিস। সরি বল, মানা আমাকে।” খুব সুখী ছিলাম আমরা অথচ দেখো মাত্র ১২-১৩ বছরেই শেষ হয়ে গেল আমাদের সুখ। বিয়েটা করে তো সমস্যা আরও বেড়েছে। না পাওয়ার ব্যথার চেয়ে পেয়ে হারানোর ব্যথা হাজার গুণ বেশি নিকিতা।’
‘এটাই বোধ হয় আল্লাহর ইচ্ছা ছিল।’
‘দুনিয়ার সবই তো আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। তাহলে পেট্রার প্রতি আমার ভালোবাসা, আমাদের বিয়ে, আমাদের ছেলে সবকিছুই তো আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে। আমাদের আলাদা করাই যদি তাঁর ইচ্ছা ছিল, তাহলে আমাদের এক কেন করেছিল?
নিকিতা অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল। প্রিয় এবার একটু উঁচু স্বরেই জিজ্ঞেস করল, ‘আছে কোনো উত্তর তোমার কাছে?
নিকিতার খুব মায়া হচ্ছিল প্রিয়র জন্য। বলতে ইচ্ছা করছিল, একবার ভালোবাসার সুযোগ দাও আমাকে, আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সব কষ্ট আমি দূর করে দেব।
কিন্তু এসব বলার সাহস সে পেল না। চুপ করেই রইল। প্রিয় লেপ সরিয়ে বিছানা থেকে উঠল। আলমারি থেকে একটা জ্যাকেট বের করে পরল। গাড়ির চাবি এবং ওয়ালেট পকেটে ঢোকাল।
নিকিতা বিছানা থেকে নেমে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ এত রাতে?
‘একটা বাজে মাত্র, বেশি রাত হয় নি। আমি আধা ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসব।’
প্রিয় ঘর থেকে বের হলো। নিকিতা পেছন পেছন গিয়ে বলল, ‘কোথায় যাবে, সেটা তো বলে যাও।
প্রিয় পেছনে ঘুরে সরাসরি নিকিতার চোখের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল, ‘আমি তোমার সাথে গল্প করছি, তার মানে এই না যে আমি কোথায় যাব, কী করব, তার কৈফিয়ত তোমাকে দেব।’
নিকিতা ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, ‘সরি। কৈফিয়ত না, চিন্তা হচ্ছিল, তাই জিজ্ঞেস করেছি।’
‘চিন্তা যখন হচ্ছেই, দোয়া করতে থাকো, যেন একটা ট্রাক এসে মেরে দেয়, আর ফিরে না আসি। এ সময়ে রাস্তায় অনেক ট্রাক চলে।
এ কথা শুনে নিকিতা আঁতকে উঠল, প্রিয় বেরিয়ে গেল।
আধা ঘণ্টা পর হুইস্কির বোতল নিয়ে ফিরে এল সে। নিকিতা অবাক হলো না। প্রিয় প্রায়ই গভীর রাতে ঘরে বসে ড্রিংক করে। তবে কখনো মাতলামি করে না। ড্রিংক করলে প্রিয় একদম চুপ হয়ে যায়, কোনো কথা বলে না। চুপচাপ শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রিয় একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘ফিরে এলাম। কিছুই হলো না।
নিকিতা কী জবাব দেবে এমন রসিকতার? চুপ করে রইল। প্রিয় টি টেবিলের ওপর হুইস্কির বোতল রেখে গ্লাস নিয়ে সোফায় বসে পড়ল। হুইস্কি খেতে খেতে বলল, ‘খাবে?
নিকিতা বলল, ‘না, আমি খাই না।’
‘ওকে, নো প্রবলেম। শুয়ে পড়ো তাহলে।
নিকিতা শুয়ে পড়ল। প্রিয় একদম চুপ করে খেয়ে যাচ্ছে। নিকিতা বিকেলে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। এখন ওর কিছুতেই ঘুম আসছে না। তবু শুয়ে রইল। ঘণ্টাখানেক পর নিকিতা জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হলো?
প্রিয় হুইস্কির গ্লাস ও বোতলটা হাতে নিয়ে বিছানায় চলে এল। বোতলটা বিছানার পাশে রাখল। তারপর গ্লাস হাতে নিকিতার দিকে ফিরে বসল। নিকিতা শোয়া থেকে উঠে বালিশে হেলান দিল। প্রিয় গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘দূর থেকে গল্প জমে না। গল্প করতে হয় কাছাকাছি বসে।
নিকিতার মনে হলো প্রিয়র নেশা হয়ে গেছে। ওদিকে হুইস্কির গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠল। প্রিয় বলতে শুরু করল, ‘আমি এইচএসসির পর ভার্সিটি কোচিং করতে ঢাকায় চলে আসি। ভাইজান তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। হলে না থেকে সে একটা ছোট বাসা নিয়ে থাকত। আমিও ভাইজানের সাথেই থাকতে শুরু করি। পেট্রা ওর আন্টির বাসায় থেকে কোচিং করত। যথারীতি দুজনে একই কোচিংয়ে পড়তাম। পেট্রার বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে। পেট্রা এবং আমারও স্বপ্ন ছিল আমরা ডাক্তার হব। তাই আমাদের মেইন টার্গেট ছিল মেডিকেল। কিন্তু বুয়েটের জন্যও প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম। শেষমেশ আমরা কে কোথায় চান্স পেয়েছিলাম, জানো?
‘না। কোথায়?
প্রিয় হেসে বলেছিল, ‘পেট্রা ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছিল কিন্তু আমি পাই নি। আমি চান্স পেয়েছিলাম ওসমানী মেডিকেলে।
‘ওসমানী মেডিকেলটা আবার কোথায়?
‘সিলেটে।
‘তাহলে তুমি ডাক্তারি পড়ো নি কেন?
‘বুয়েট আমরা দুজনেই চান্স পেয়েছিলাম। তাই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অতটা ইন্টারেস্ট না থাকলেও দুজনই বুয়েটে ভর্তি হলাম। আমাদের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন মাটিচাপা দিলাম। কারণ, আমরা দুজন আলাদা থাকার কথা ভাবতেও পারতাম না। দুজন দুই শহরে থাকা তো দূরের কথা, দুজন দুই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কথাও ভাবতে পারতাম না। আমাদের দুজনের। পড়ার ধরন এক ছিল, পড়াশোনাতেও অনেক সাহায্য করতাম একে অন্যকে। আমরা আলাদা পড়াশোনা করব, এটা অসম্ভব ছিল। মেডিকেলে চান্স পাওয়ার কথা দুজনই বাসায় হাইড করেছিলাম। ভুল করেছিলাম, মেডিকেলে পড়লে আজ পেট্রা ডাক্তার হতো। ওর জীবনে এত সমস্যা থাকত না।’
‘তাতে কী হয়েছে? বুয়েট তো আর মেডিকেলের থেকে খারাপ না।
‘তুমি বুঝবে না। ওর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একদমই আগ্রহ ছিল না, তাই রেজাল্ট খুব একটা ভালো করতে পারে নি। কিন্তু আমি জানি, ডাক্তারি পড়লে ভালোই করত। কারণ ওটাতে ওর আগ্রহ ছিল।’
‘তুমি তো বললে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তোমারও ইন্টারেস্ট ছিল না, তাহলে তুমি কী করে এত ভালো রেজাল্ট করলে?’।
‘আমার তো আর মেডিকেলের প্রতি এত ডেডিকেশন ছিল না, যতটা ওর ছিল! ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমার ওটাই ভালো লাগতে শুরু করেছিল।
‘তাহলে এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলে? তুমি বুয়েট আর আপু ঢাকা মেডিকেলে পড়লেই হতো। দুইটা তো কাছেই।
‘বুঝতে পারি নি। আর কাছে হলেও এক ভার্সিটি, এক ক্লাস তো আর না। একমুহূর্ত ওকে ছাড়া চলত না আমার। আর নিয়তি কেমন খেলা করল দেখো, সারা জীবনের জন্য দুজনকে আলাদা করে দিল!’
কথাটা বলেই প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনেক বড় একটা বোঝা কাঁধে যেন হেঁটে চলেছে ও, পথ অন্তহীন।
·
·
·
চলবে...................................................................................