আর কী কী দেখা বাকি আছে আমার এই জীবনে, সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান। মাকে হারিয়েছি, আজ বাবাকেও হারালাম। মা ফিরে আসবেন কি না-আমি জানি না তবে বাবা আর ফিরবেন না। সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছিলেন বাবা, তুরস্ক যাওয়ার জন্য যে টাকা ধার করেছিলেন তাও পেয়ে গিয়েছিলেন দুদিন আগে। এখনই কেন হার্টঅ্যাটাকে দুম করে মরে যেতে হলো? দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে স্বার্থপরের মতো পালাচ্ছে একেকজন। কেন সব দায়িত্ব আমার একার নিতে হবে? রূপ বারবার জিজ্ঞেস করছে বাবা কখন আসবে? বাবার অফিস শেষ হচ্ছে না কেন? কী উত্তর দেব আমি ওকে?
সহজ সুন্দর পৃথিবীটা হঠাৎ করে এত কঠিন হয়ে উঠল কেন আমার? রাহি তো আমার চেয়ে খুব বেশি ছোট নয়। তবে সেও কেন রূপের মতো আমার কাছে এসে পাগলের মত কাঁদছে? আমি কার কাছে গিয়ে কাঁদব?
রাফসান শিকদার
১১ অক্টোবর, ২০১০
বাবা নেই সংসার কিভাবে চলবে জানি না। এরই মধ্যে আজ জানতে পারলাম আমাদের বাড়ির লোনটা নাকি শোধ হয়নি এখনো। এখন আমার মাথায় বারবার কিছু প্রশ্ন চক্রাকারে ঘুরছে। সংসার কিভাবে চলবে? আমাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনা কিভাবে চলবে? কদিন বাদে রূপকেও তো স্কুলে দিতে হবে।
বাবা-মা, তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ? তোমাদের এই শক্তপোক্ত ছেলেটা কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে? বাবা, তুমি তো আল্লাহর কাছে আছো, আল্লাহকে বলো না আমাকে একটা পথ দেখাতে। প্লিজ বাবা প্লিজ।
রাফসান শিকদার
১৮ অক্টোবর, ২০১০
আজ অনেকদিন পর মীরার সঙ্গে দেখা করলাম। অনেকদিন না বলে অনেক মাস বলা ভালো। বাবা মারা যাবার পর এ কদিনে ও আর দেখা করার জন্য জোরাজুরি করেনি। আমিই দেখা করার কথা বললাম। বাবার অফিসে যাওয়ার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলাম আজ। আবার কবে না কবে যেতে পারব তার কোনো ঠিক নেই।
ওকে দেখে ওর কথাবার্তা শুনে মনে হলো আমার জীবনে হঠাৎ এত পরিবর্তন ওর মধ্যেও অনেক প্রভাব ফেলেছে। ও হয়তো বা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। আগে যেখানে দিনের মধ্যে চৌদ্দ বার ওকে ফোন করতাম সেখানে এখন রাতে একবার ফোন করি। কোনোদিন সে সুযোগও পাই না। আমি ফোন করার আগেই ও করে। ভেবে দেখলাম ওর অভিযোগ সত্যি। আমি বদলে গেছি। আগে ঘন ঘন দেখা করতে চাইতাম, কত মধুর কথা বলতাম। এখন এর কোনোটাই পারি না। কেবল ওর প্রতি ভালোবাসাটা আগের মতোই রয়ে গেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো কিছু। ও আগে শুধু আমার ভালোবাসা ছিল, এখন আমার ভাইবোনের মতোই আমার বাঁচার অবলম্বনও!
মা নিখোঁজ একথাটা ওকে আজ বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর এই অবস্থা দেখে শেষ পর্যন্ত আর বলিনি। বললে হয়তো আরো বেশি দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে। আরো বেশি অনিরাপদ বোধ করবে। আরেকটু বড় হোক, এরপর নাহয় ওর ওপর ভর করে আমি নির্ভার হব।
রাফসান শিকদার
২৫ অক্টোবর, ২০১০
আমাদের সবার পড়াশোনা কীভাবে চলবে, ইউটিলিটি বিল, বাজার খরচ এসব কোত্থেকে আসবে সেসব নিয়ে ভাববার একেবারেই সুযোগ পাচ্ছি না। মাথার ওপর হোম লোনের বোঝাটা সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে আছে। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা বেশ ভালো অ্যামাউন্ট এসেছে। কিন্তু তার চেহারাও দেখব না। টাকাটা হোম লোন পরিশোধে কাটা যাবে। কিন্তু তাতেও ব্যাপারটার দফারফা হবে না। আরো কিছু টাকা লাগবে লোন শোধ করতে। এই টাকাটা যে কোত্থেকে দেব সেটা বুঝতে পারছি না। রাহি বলছে বড় চাচার থেকে ধার নিতে। অবশ্য আমাদের ধার নেয়ার মতো আর কেউ নেইও। কিন্তু কারো থেকে টাকা-পয়সা ধার চাওয়ার অভ্যাস আমার নেই। তার ওপর ধার শোধ করব কীভাবে তাও জানি না! এমন ধার কি চাওয়া যায়?
রাফসান শিকদার
২৬ অক্টোবর, ২০১০
জীবনের এক অচেনা পথে হাঁটছি। পথটা কোন দিকে গেছে জানি না। কিভাবে চলতে হয় এ পথে তাও জানি না। হারিয়ে যাব না তো? অবশ্য হারিয়েই বা যাব কোথায়?
রাফসান শিকদার
০২ নভেম্বর, ২০১০
সন্ধ্যার পর মীরা খুব উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
কাল সকালে কি কোনো ভাবে দেখা হতে পারে রাফি?
আমার অবস্থা কাউকে বোঝাতে সবসময়ই আমি অপারগ। আমার ভেতর কত ধরনের দুশ্চিন্তা চলছে তার কিছুই তো মীরা জানে না। বলতেও পারি না। উল্টো বলে ফেললাম,
কেন কিছুদিন আগেই না দেখা হলো?
ওর বোধহয় মন খারাপ হলো। বলল,
কাল একটা বিশেষ দিন তাই বলছিলাম।
কাল কী?
ওর মন খারাপ এবার তীব্রতর হলো। বলল,
তুমি কালকের দিনটা ভুলে গেলে?
আমি শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিলাম না কাল কী এমন বিশেষ দিন? মীরার জন্মদিন তো না। বললাম,
সরি মনে করতে পারছি না। কাল কী?
কাল আমাদের সম্পর্কের এক বছর হবে।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ও হয়তো ভাবছিল আমি আজকের দিনে দেখা করব, ওর জন্য বিশেষ কিছু করব! ভাবাই স্বাভাবিক। অন্য ছেলেরা তো করে। আগের রাফি হলে আমিও করতাম। অথচ এখন আমি দিনটা মনেও রাখতে পারলাম না। এমনকি আমি কাল কিছুই করতে পারব না ওর জন্য। দেখা করাটাও সম্ভব হবে না। কাল বড়চাচা টাকা দেবেন বলেছেন। টাকা আনতে ধামরাই যেতে হবে। সেখানে কতক্ষণ লাগবে তার কোনো ঠিক নেই।
আচ্ছা বকুল, দিন দিন আমি কি এমনই অনুভূতিহীন হয়ে যাব? আমি কি আর কোনোদিন স্বাভাবিক মানুষ হয়ে উঠতে পারব না?
রাফসান শিকদার
০৬ নভেম্বর, ২০১০
·
·
·
চলবে...................................................................................