দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় রূপ বলল,
আমি ভাত কাবো না কাবো না কাবো না। বাবাকে আসতে বলো আগে। বাবা না আসলে আমি কিছুতেই ভাত কাবো না।
রাহি আমাকে বলল,
বলে দাও। ও তো বড় হচ্ছে। কতদিন এভাবে চলবে?
রূপ জানতে চাইল,
কীবাবে চলবে?
আমারও মনে হলো রূপকে আসলে বলে দেয়াই উচিত। আর কত মিথ্যে বলে ভোলাব? এমন চলতে থাকলে ওর অপেক্ষা তো আর শেষ হবে না। বললাম,
বাবা মরে গেছে আপু। আর কখনো আসবে না।
রূপ কাঁদল না। ও হয়তো মরে যাওয়াটা বোঝে না। শুধু বোঝে মরে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল এরপর হাত উলটে বলল
কিন্তু বাবা মরে যাওয়াল আগে আমাকে যে বলে গেল না?
রাফসান শিকদার
১৬ নভেম্বর, ২০১০
আমার হাতে যে কটা টাকা ছিল তা শেষ। এখন বাকি দিনগুলো কীভাবে চলবে- বুঝতে পারছিলাম না। এর মধ্যে মীরা দেখা করার জন্য প্রচণ্ড চাপাচাপি করছে। এইতো কিছুক্ষণ আগে কথা হচ্ছিল।
রাফি একবার দেখা করো প্লিজ।
এখন সম্ভব না।
কেন?
পরিস্থিতি অনুকূলে নেই।
অনুকূলে আনেনা।
অন্য কোনো কথা না থাকলে এখন রাখি মীরা।
দুই মাস হয়ে গেছে আমাদের দেখা হয়েছে।
দুই বছরও হতে পারে। প্রেম করলে দুদিন পর পর দেখা করতে হবে এ কথা কোন কিতাবে লেখা আছে?
তোমার কি এখন আর আমাকে ভালো লাগে না?
তোমার যদি তাই মনে হয় তাহলে তাই।
রাফি তুমি বুঝতে পারছো কত বড় কথা তুমি বললে?
তুমিই বলালে। কথাটা তুমি তুলেছে।
এমনটাই ছিল মীরার সঙ্গে আমার আজকের কথোপকথন। আমাদের সম্পর্কের কতটা অবনতি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। এর জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু আমি কিছুই ঠিক করতে পারছি না। সবকিছু কেমন আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। মীরাকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু প্রতিনিয়ত শুধু কষ্টই দিচ্ছি।
রাফসান শিকদার
২৪ নভেম্বর,২০১০
অনেক চিন্তা করেও কোনো আয়ের উৎস খুঁজে পাইনি। রূপ মুরগির মাংস ছাড়া ভাত খেতে চায় না। কিছুদিন আগে ফ্রিজে থাকা শেষ মুরগিটুকু রান্না করেছিলাম। আমরা না খেয়ে একটু একটু করে রূপকে দিয়েছি। গতকাল তাও শেষ। রাতে মুরগির মাংস ছিল না বলে রূপকে ভাত খাওয়াতে পারিনি। আজকে একটা ব্যবস্থা না করলেই না। ভোরবেলা রাহি ঘুম থেকে ওঠার আগে আমি উঠে বাগানে চলে গেলাম। যত গাছে ফল ছিল সব পাড়লাম, নারকেল, বারোমাসি পেয়ারা, জলপাই, আমলকী। ফলগুলো নিয়ে বাজারে গেলাম। আমাদের এদিকে ভোরবেলা রাস্তার দু ধারে বাজার বসে। অদূরের গ্রামের লোকেরা তাদের গাছের ফল ও সবজি ঝুড়িতে করে নিয়ে রাস্তার দু-ধারে বসে থাকে। আমিও তাদের সঙ্গে বসে গেলাম। পরিচিত অনেকেই আমাকে সেখানে দেখে ভালোমন্দ অনেক কথা বলতে লাগলেন।
আহারে হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায় ছেলেটার কি দশা হলো!
ছি ছি রাফি তুমি এখানে এসব নিয়ে বসে আছো কেন? একটা চাকরি খোজো। আমাদের মহল্লার ছেলে এসব করলে কেমন দেখায়?
তোমার শেষ পর্যন্ত এই দশা? বাবা কি তোমাদের জন্য কিছু রেখে যাননি নাকি?
সত্যি করে বলতে রাফি তোমার মা ফিরছেন না কেন? তোমার বাবা-মার কি ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল নাকি?
সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করেও শেষ কথাটা সহ্য করতে পারলাম না। কথাটা বলেছে আমাদের গলিরই এক চাচা। আমি রক্তচক্ষু করে তাকে বললাম,
চাচা আপনি এখান থেকে যান, নাহলে আমার হাত উঠে যাবে। আর কোনদিন আমাকে দেখলে কথা বলবেন না।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, কত্ত বড় বেয়াদব ছেলে!
আপনার চেয়ে কম বেয়াদব আছি। আমি অন্যের বাপ-মা তুলে আজেবাজে কথা বলি না। যান এখান থেকে।
অসভ্য লোকটা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
আজকের অভিজ্ঞতা এখানেই শেষ নয়। ওই সময়টাতে পাশের বাসার টগর সম্ভবত কলেজে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রথমে অবাক হলেও পরে স্বাভাবিকভাবেই আমাকে জিজ্ঞেস করল,
আপনি কি এগুলো বিক্রি করছেন?
আমি সম্মতি জানাতেই বলল,
এগুলো আপনার গাছের লাল পেয়ারা না? ওইযে ভেতরটা লালচে হয়?
হ্যাঁ।
এত ভালো স্বাদ! রাহি একবার দিয়েছিল। লাল পেয়ারাগুলো যা আছে সব আমাকে দিন।
আমার একটু বিরক্ত লাগল করুণা করছে ভেবে। বললাম,
আপনি সব নেবেন কেন? আপনার যতটুক দরকার আপনি ততটুক নেবেন।
টগর বলল,
আমার সব দরকার তাই সব নেব। আপনার কি সমস্যা? আপনি তো বিক্রিই করছেন। তাই কিনতে চাচ্ছি।
কথা সত্য। বিক্রি করছি বলেই কিনতে এসেছে। করুণা কেন হবে? আমিই বেশি ভাবছি। আর কথা বাড়ালাম না। মেপে দেখলাম দুই কেজির কিছু কম আছে। সেই হিসাবেই দিলাম। টগর পেয়ারা কিনে নিয়ে চলে গেল। সব ফল বিক্রি হতে হতে বেশ বেলা হলো। এরপর বাজার করে বাসায় ফিরলাম। কিন্তু গাছের সব ফল তো শেষ, এরপর কী করব?
রাফসান শিকদার
২৯ নভেম্বর, ২০১০
বাজার করার পর সামান্য কিছু টাকা আমার হাতে ছিল। কিন্তু পরবর্তী প্রয়োজনটা এমনই এসে দাঁড়াল, যা সেই টাকায় মিটবে না। রাহি জানাল ওর এইচএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করতে হবে। এদিকে আমার সম্ভবত এই সেমিস্টার গ্যাপ যাবে। রেজিস্ট্রেশনের সময় হয়ে এসেছে, এত টাকা তো নেই। কিন্তু রাহিরটা তো না করলেই নয়। আমি এক সেমিস্টার গ্যাপ দিলেও খুব একটা ক্ষতি হবে না। পরবর্তী সেমিস্টারগুলোতে একটা করে বাড়তি কোর্স নিলে সময়ের মধ্যেই শেষ করা যাবে। কিন্তু রাহির গ্যাপ পড়ে গেলে তো পুরো একটা বছর পেছনে পরে যাবে। ডিপ্রেশনে পড়ে যাবে বেচারা। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। যেভাবেই হোক টাকা ম্যানেজ করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে?
রাফসান শিকদার
৩০ নভেম্বর, ২০১০
দেখা করা নিয়ে আবার চাপাচাপি শুরু করল মীরা। আমার একদম কিছু ভালো। লাগছে না। শেষমেশ বলেই ফেললাম আমার কাছে টাকা নেই। মীরা বলল,
টাকা লাগবে কেন? আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব। টিএসসি গিয়ে বসে থাকব।
এখান থেকে ঢাকা যেতে তো টাকা লাগবে। আমার হাত একদম খালি মীরা।
তুমি কোনোভাবে কারো থেকে ধার করে ঢাকা আসো। আমার কাছে কিছু। জমানো টাকা আছে। ওটা তোমাকে দিয়ে দেব।
তোমার টাকা আমি কেন নেব?
আমার একটু মেজাজ খারাপ হলো। মীরা নরম গলায় বলল,
আমার টাকা আর তোমার টাকা তো একই হলো।
কখনোই না। তোমার টাকা তোমার টাকাই, আর আমার টাকা আমার টাকাই। এটা তোমার বাবার টাকা তুমি কোনোভাবে জমিয়েছে। যদি তোমার নিজের আয় করা টাকাও হতো তবুও সেটা তোমার টাকাই হতো। সুতরাং তোমার টাকা আমি কখনোই নেব না। আর কখনো এসব বলবে না।
মীরা দমে গেল। আর কথা বাড়াল না। টাকা যে এত প্রয়োজনীয় জিনিস তা আগে কোনোদিন বুঝিনি। কোন গাধা বলেছে টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না? দুনিয়াতে একমাত্র টাকা দিয়েই সুখ কেনা যায়।
রাফসান শিকদার
০২ ডিসেম্বর, ২০১০
মীরা কিছুক্ষণ আগে আমাকে মনে করাল আজকের দিনে নাকি ও আমাদের বাসায় এসেছিল। অন্যসময় হলে হয়তো সেদিনের মধুর স্মৃতি মনে পড়ত। কিন্তু আজ মনে পড়ল, মাকে ছাড়া আছি এক বছর!
রাফসান শিকদার
০৭ ডিসেম্বর, ২০১০
আচ্ছা মা কি কখনোই ফিরবে না? আমি অনেকবার ভেবেছি ঠিক কি কারণে মা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে না? আমি কোনো কারণ খুঁজে পাই না। আমার শুধু মনে হয় এমন কিছু একটা হয়েছে, যা আমরা কেউ ভাবতে পারছি না। মায়ের বিষয়ে ভাবতে গেলে এখন দিনরাত কেবল দুটো চিন্তা আসে। এক, যদি মা কখনো ফিরে না আসে তাহলে আমি ছোট ছোট দুটো ভাইবোন নিয়ে কীভাবে জীবনধারণ করব? দুই, যদি মা ফিরে আসে বাবার মৃত্যুর খবরটা তাকে কীভাবে দেব?
রাফসান শিকদার
১০ ডিসেম্বর, ২০১০
·
·
·
চলবে..................................................................................