"ভেনোরা! ওনাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসো। আমাদের কিছু প্রশ্ন আছে। সেগুলোর উত্তর মিললেই আমাদের মন শান্ত হবে। যেহেতু উনি জানে তো উনাকে আসার জন্য বলতে পারবে, সন্ধ্যা ব্রো?"
নোহারা নিজের জামার কাপড় শক্ত করে ধরে নিকের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো।
নিক কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। চোখে মুখের ঠান্ডা হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে আসলে কি বলতে চায়। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ফোনের দিকে তাকালো সে। অতঃপর ভেনোরার নাম্বারে কল করলো। টুট টুট আওয়াজ হলো কয়েকবার। কেউ ধরলো না ফোনটা। নিক উঠে দাঁড়ালো। এভাবেই আনমনে চিন্তিত চেহারায় হাঁটতে লাগলো। অনন্যা, নোহারা চুপটি মেরে নিকের কার্যক্রম দেখে যাচ্ছে। নিক চিন্তায় ডুব দিয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ। হঠাৎই থেমে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,
"ভেনোরাকে আমি ডাকতে পারছি না। কৌশিক চলে যাওয়ার পূর্বে আমাকে মানুষে পরিণত করে দিয়ে গেছে। কিন্তু ভেনোরা! ও ঠিক আগের মতোই আছে। ভেনোরাকে সাহায্যের জন্য ডাকতে হলে প্রথমে আমাদের ভিন্নধর্মী প্রাণী হতে হবে। ভেনোরা শুধু তাদের ডাকেই সাড়া দিতে পারে যারা সাধারণ মানুষ নয়। যেহেতু আমি এখন আর ভ্যাম্পায়ার নই ভেনোরা আমার ডাকে আর আসবে না। সত্যি বলতে কৌশিক চলে যাওয়ার পর ভেনোরার সাথে এরপর আমার আর কোন যোগাযোগ নেই। আমি কন্টাক্ট করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সম্ভব হচ্ছিল না। এখনো হচ্ছে না।"
নোহারা কপাল চাপড়ালো। আর অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। সত্যিটা জানার একটা আশা পেয়েছিলো সে। কিন্তু সেটাও এখন হারিয়ে গেলো। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস রুমের পরিবেশে ছেড়ে দিলো অনন্যা। কিছুক্ষণ পর কলিং বেল বেজে উঠলো। নিকই এগিয়ে দরজা খুললো। খাবার এসে পড়েছে। নোহারা সবচেয়ে বেশি এক্সাইটেড। খাবারের দিকে ওর লোভ বেশি। কিন্তু নিকের উপর রাগ এখনো কমেনি। ইচ্ছে করেই কমাবে না সে। এতো দিন একবার ও নিজে থেকে এসে কথা বলার চেষ্টা করেছে? না তো! তাহলে কেনো রাগ করবে না!!
ভরপুর খাওয়া দাওয়া সারলো নোহারা। কিন্তু অনন্যা কোনোরকম একটু খেয়েই উঠে গেছে। সেই কত দিন ধরে কোনো কিছুতেই মন বসছে না ওর। নিক ভেবেছিল নোহারাকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু নোহারা অনন্যার সঙ্গে যে গল্প জুড়ে দিয়েছে শেষ করার আর নামও নিচ্ছে না। নিক সোফায় বসে অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাত নেমেছে। অনন্যাও ক্লান্ত চোখ নিয়ে তাকাতে পারছিল না। এমনিতেই ও ঘুমায় বেশি। এর উপর ক্লান্ত শরীর আর ওষুধের কারণে ঘুমটা আরো বেশি করে ধরে। নোহারা আর জ্বালাতন করলো না। অনন্যাকে ঘুমাতে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। ও ভেবেছিল নিক হয়তো ইতিমধ্যে চলেই গেছে। কিন্তু না নিক সোফায় কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিককে শান্ত হয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে লম্বা হয়ে সোফায় শুয়ে থাকতে দেখে নোহারার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। ও ভেবেছিল আজ রাতটা অনন্যার সঙ্গে থেকে যাবে। কিন্তু নিক যে ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে তা বুঝতে পারেনি অনন্যা।
নোহারা ধীর কদমে পা টিপতে টিপতে এগিয়ে গেলো সোফার দিকে। আওয়াজ না করে হাঁটু গেড়ে সোফার সামনে বসে পড়লো নরমসরম শরীরটা নিয়ে। চক্ষুদ্বয়ে বিস্ময় মিশিয়ে বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সে। সত্যি এই ছেলেটার মধ্যে শখানেক পরিবর্তন এসেছে। মাথা নাড়িয়ে ভাবলো নোহারা। এই তো নিকোলাই ভেস্পারের ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি উঠেছে। কিন্তু মনে হয় প্রায়ই দাঁড়িগুলোকে ছেঁটে ফেলা হয়। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু নোহারা ছুঁলো না। হাতটা সেদিকে নিয়ে গেলেও নিজেকে থামিয়ে রাখলো। সরিয়ে নিলো সে হাত। নোহারার মনে হঠাৎ এক চিন্তা এসে ভর করলো, সন্ধ্যা ভাইয়া নিজের ইচ্ছের বিসর্জন দিয়ে নীল চুলগুলোকে কালো করে ফেললো কেনো? নোহারার কথা ভেবে নাকি অন্যকোনো কারণ লুকিয়ে আছে এর পেছনে? যদিও নীল চুলগুলো খারাপ লাগতো না নোহারার কাছে। শুধু লোকেরাই কেনো যে উল্টাপাল্টা ভাবে বোঝে না নোহারা। সবচেয়ে বড় কথা ওর ফ্যামিলি কি করে পারলো এই সুন্দর ছেলেটাকে রিজেক্ট করে দিতে? আহ! বুক পুড়ে যাচ্ছে নোহারার। এই ছেলেটা এখন জব করে। নিশ্চয়ই কত শত মেয়ে মুগ্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যা ব্রোয়ের দিকে তাকিয়ে। আগেও তো হতো! নোহারা তাও বুকে পাথর চাপা দিয়ে মেনে নিয়েছিল সবটা। কিন্তু এখন! এখনো কীসের বাধা?! কৌশিক স্যার তো বুদ্ধিমানের কাজ করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু তারপরও দুই হৃদয়ের মধ্যিখানে কেনো এতো বড় দেয়াল দাঁড়িয়ে?
নোহারা ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘুরে চলে যাচ্ছিলো সে। কিন্তু খপ করে হাতটা ধরে ফেললো সোফায় আরামে শুয়ে থাকা ব্যক্তিটি। শুধু তাই নয়, হেঁচকা টান দিলো তাকে। নোহারা টাল সামলাতে না পেরে নিকের উপর হুমড়ে পড়ে গেলো।
সেকেন্ড পারে হতে লাগলো। তা ধীরে ধীরে মিনিটে রূপ নিলো। সোফার একপাশে কোনোমতে হাত রেখে নিজেকে সামলিয়ে রেখেছে। ওর একদম নিচে বাদরটা রয়েছে। নিক মুচকি হাসলো, এক হাত দিয়ে নোহারাকে ভালোমতো চেপে ধরলো। নোহারার ছোট চুলগুলো অপর হাত দিয়ে যত্ন সহকারে সামলিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো,
"আই নো আই এম আ হ্যান্ডসাম বয়!"
নোহারা সোফায় হাত দিয়ে নিজেকে আটকিয়ে রেখেছিল, নিজেদের মধ্যে বেশ খানিক দূরত্ব বজায় রেখেছিল। একসময় জোর করে উঠে চলে যেতে চাইলো সে। কিন্তু নিক উঠতে দিলো না। এক হাত কোমড়ে রেখে আরো শক্ত করে টেনে জড়িয়ে ধরলো। নোহারা রাগে লাল নীল হয়ে যাচ্ছে। সে উঠতে পারলে নির্ঘাত এই ছেলের মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু শত চেষ্টা করেও ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। নিক আরাম করে জড়িয়ে ধরে আছে নোহারাকে।
নোহারা চিৎকার করে বললো,
"এই ছাগল, ছাড় আমাকে। তোর সাথে কোনোরূপ কথা নেই আমার।"
"ছাগল বলেছ? আরো আগে ছাড়ছি না। এমনিতেও ছাড়তাম না।"
নিক আবারো মুচকি হাসলো। আরো শক্ত করে দুই হাত দিয়ে বিড়ালের মতো নোহারার নরম শরীর চেপে ধরলো। এমনিতেও পেশিবহুল দেহ নিকের। এই শক্তিশালী দেহটার নিচে নোহারা যেন পিষে যাচ্ছে। পড়েছেও এক মহাবিপদে। ইশশ কোন দুঃখে যে এই অসভ্যটার থোবড়া দেখতে এসেছিল। মনে হচ্ছে আজ সব মান ইজ্জত শেষ করেই সে ছাড় পাবে। কিন্তু এভাবে নোহারা কোনো কিছুই চায় না। ওর ভবিষ্যৎ যার কাছে লেখা আছে তার সাথেই সব হোক। শুধু শুধু ভুল দিকে নোহারা পা বাড়াতে চায় না।
শেষমেশ অবাধ্য হয়ে নোহারা এক হাত দিয়ে নিককে কিল মারতে লাগলো। কিন্তু নিক শরীরে নোহারার কিল ও পিঁপড়ার সমান। কাঁদতে ইচ্ছে করলো নোহারার। এই বিপত্তিকর অবস্থায় নোহারাকে আরো বিপত্তিতে ফেলতে এসে হাজির হলো অনন্যা। নিজের রুম থেকে চোখ বন্ধ করে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলো ডাইনিং রুমের দিকে। গ্লাসে পানি ভরে সম্পূর্ণ এক গ্লাস পানি পান করলো মেয়েটা। অতঃপর আবারো হাঁটতে হাঁটতে ড্রয়িং রুমে ফিরে এলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। নোহারা তো শক্ত করে নিকের শার্ট খিচে ধরে রেখেছে আর নিকের পেশিবহুল শরীরের মাঝে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। কি লজ্জা লাগছে। অনন্যা যদি এই অবস্থায় ওদেরকে দেখে ফেলে সারাক্ষণ জ্বালাবে ওকে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। পিছনে ঘুরে ওদের দিকে তাকালোও না অনন্যা। সে সুইচ বোর্ডের দিকে এগিয়ে লাইটের সুইচ অফ করলো। হাত বাড়িয়ে ফ্যানের সুইচ ও অফ করলো তারপর আবার ঘুরে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো সে।
অন্ধকার রুমের মধ্যে দুজন মানব মানবী একে অপরকে ঝাপটে ধরে আছে। শোনা যাচ্ছে দুজনের শ্বাসের শব্দ আর! আর দুই মানব মানবীর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি শব্দ! নিক এই সময়ে মাথা উঁচু করে অনন্যার কার্যকলাপ দেখছিলো। অনন্যা যখন চলে গেলো নোহারা সাথে সাথেই থাপ্পড় মারলো নিকের পিঠে। নিক নোহারাকে তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিলো। নোহারা তড়িঘড়ি করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো এবং চেহারায় কপট রাগ দেখালো। কটমট করে তাকিয়ে কঠিন শব্দ ব্যবহার করলো সে,
"তোমাকে কি বলেছিলাম তখন? ছুঁতে না বলেছিলাম না? তাও কেনো শরীরের সাথে চিপকে যাচ্ছো?"
নিক মাথায় হাত চেপে উঠে দাঁড়ালো। নোহারার দিকে ছোট ছোট চক্ষু ফেলে উত্তর দিলো,
"এরকম করছো কেন? একটু ভুল হতেই পারে তাই বলে তুমি এরকম আচরণ করবে? এটা তো ঠিক নয়। আমি তো সব ঠিক করতে চাইছি আর তুমি তো উল্টো রেগে যাচ্ছো।"
"ঠিক করতে হবে না। তুমি বলেছিলে না অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলতে? ওকে করে ফেলবো। তাই তুমিও আমাকে আগ বাড়িয়ে ডিস্টার্ব করতে আসবে না।জব করছো একবার জানানোর ও প্রয়োজনবোধ করোনি।"
অন্ধকারেও নিক নোহারার উষ্ণ রাগ অনুভব করতে পারছে। অনুভব করতে পারছে মেয়েটা কি পরিমাণ রেগে আছে। কিন্তু নোহারা যদি জানতো নিক এই চাকরিটা পেতে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। দিনরাত সে বাইরে বাইরে ঘুরে বোঝার চেষ্টা করেছিল কোনটা তার জন্য সঠিক হবে। কোন চাকরি করলে নোহারা মাথা তুলে বুক ফুলিয়ে গর্বিত ভাবে নিজের হাসবেন্ড সম্পর্কে দুই একটা কথা বলতে পারবে। একবার তো নিক ভেবেছিল পড়াশোনাও শুরু করবে কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে হয়েছিল এই অবস্থায় পড়াশোনা করা সময় নষ্ট ব্যতীত কিছুই না। তাছাড়া টাকা পয়সার ও ব্যাপার আছে। এতো দিন কৌশিক টাকার ব্যাপারগুলো ম্যানেজ করতো। তাকে কিছুই করতে হতো না। কিন্তু এখন তো আর সেই আগেকার কৌশিক নেই। আর না সে ভ্যাম্পায়ার যে রক্ত পান করলেই শরীর সুস্থ, সুন্দর এবং সবল থাকবে। সে এখন মানুষ। মানুষদের নির্দিষ্ট আয়ু আছে, জীবনসীমা আছে যা পূর্ব থেকেই স্থির করা থাকে তাই এখন আর অন্যের উপর নির্ভর করলে চলবে না। নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে।
নিক মৃদু হেসে বললো,
"ভেবেছিলাম সব ঠিকঠাক হলে জানাবো। কিন্তু তার আগেই তুমি জেনে গেছো। "
"তোমার ঠিকঠাক তোমার কাছেই রাখো। আমি তোমাকে অনন্যার দরকারে ফোন করেছিলাম। কিন্তু তুমি তো আমার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছো। সত্যি তুমি অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছো।"
নোহারা রাগী দৃষ্টি নিয়ে অনন্যার মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। রাত পেরিয়ে যাচ্ছে। এখন আর বাসায় গিয়ে লাভ নেই। আর বের হলেও সন্ধ্যা ব্রো এর সাথে ফিরতে হবে যেটা একদমই চায় না নোহারা। ছেলেটার স্বভাব ইদানিং ভালোও ঠেকছে না নোহারার কাছে। কিন্তু তাও নোহারা এই ছেলেটাকে পছন্দ না করতে নিজেকে আটকাতে পারছে না। যাওয়ার আগে আরো একবার পিছনে তাকাতে ইচ্ছে করলো ওর। বেশি কি বলে ফেলেছে সে? সন্ধ্যা ভাইয়া কি কষ্ট পেলো? নোহারা নিজের মাথায় থাপ্পড় মেরে রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। নিক নোহারার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটা চলে যেতেই ফ্লোরে খুব জোরে পা ঝাড়লো সে। বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
*******
কৌশিক নোটখাতায় আঁকিবুঁকি করছিল। আজকে ক্লাস শেষেই বাসায় এসে পড়েছে সে। অথচ পরিকল্পনা ছিল বেশি সময় থেকে সামনের পরীক্ষার প্রশ্নগুলো রেডি করবে। কিন্তু মনটা অবুঝ হয়ে পড়েছিল। কৌশিকের কথা শোনেনি সে মন। মাথার মধ্যে ভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনা ভরে দিয়ে কৌশিককে অতীষ্ঠ করে ফেলেছিল। খাতায় আঁকিবুঁকি করতে করতে কৌশিকের স্মৃতির পাতায় দোলা দিয়ে গেলো সেদিনের অনন্যার আঁকাটা। যেখানে ছিল কারো ছোট ছোট চোখ সেটা দেখে এবং প্রিন্স শব্দটা উচ্চারণ করে কৌশিকের কানে বেজে উঠেছিল নিজেরই কিছু কথা যেসব কথা কখনো সে উচ্চারণ করেছিল কিনা সন্দেহ।
নুহাশ আসলো কৌশিকের রুমে। কৌশিকের পিঠে চাপড় মেরে শুধালো,
"কৌশিক ভাই! ভার্সিটি কেমন যাচ্ছে?"
কৌশিক চোখ ঘুরিয়ে নুহাশের দিকে তাকালো। নুহাশ দাঁত কেলিয়ে হেসে বিছানায় পা তুলে বসলো। উপরে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর নিচে ঢিলেঢালা প্যান্ট পরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কৌশিক শ্বাস ফেলে নোট খাতায় তাকালো। তার অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছে না। গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো,
"আমার আবার কেমন যাবে? যেটা করতে ভালো লাগে সেটাই করছি। আমি তো আর স্টুডেন্ট না!"
নুহাশ হাত ভাঁজ করে চিন্তিত ভঙ্গি ধরলো,
"আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি কোনো ভার্সিটির শিক্ষক। মাঝেমধ্যে ভাবি কি কপাল নিয়ে জন্মেছ যে যেটা চাইছো সেটাই পেয়ে যাচ্ছো। সিরিয়াসলি ম্যান! ইউ আর লাকি! আমাকে দেখো এখনো ভার্সিটির ক্লাস করতে করতে দিন যাচ্ছে। সময় আর পেরোচ্ছে না।"
কৌশিক মুখ খুলে অল্প আওয়াজ করে হাসলো। খানিক ব্যঙ্গ করেই বললো,
"তুই আবার ক্লাস ও করিস? আমি তো ভাবি টাইম পাস করতে যাস!"
রাগ হলো নুহাশের। হ্যাঁ প্রথম প্রথম ভাইয়ের জ্ঞান আসার পরে সবকিছু খোলাসা করে বলেছিল কৌশিককে। বলেছিল তার ভার্সিটির কার্যক্রম। তার যে পড়ালেখা ভালো লাগে না তাও বলেছিল কিন্তু তাই বলে এভাবে খোঁটা মারবে ভাই? সে তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে উত্তর দিলো,
"ওগুলো তো আগের কথা ছিল। এখন আমি খুব সিরিয়াস! মাকে জিজ্ঞেস করো আজ আমি পড়াশোনা করেছি।"
কৌশিক বোঝার ভান করে মাথা নাড়ালো। নুহাশ ভ্রু কুঞ্চিত করে কৌশিকের মুখখানা দেখলো। ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে আসার পর তার মনটা খুশিতে নেচে উঠেছিল। এই পাগল ছেলেটার জন্য কত যে কান্না করেছে নুহাশ! খুব আফসোস হয়েছিল, মনটা ভার হয়েছিল প্রায় এক বছর ধরে। বাবা, ভাই লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় সেদিন কেনো সে এয়ার পোর্টে দাঁড়িয়ে থাকেনি এই কষ্ট নিয়ে সে অনেক রাত ঘুমাতে পারেনি। মেহজাবিন বেগম সেদিন নুহাশকে বলেছিল গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকতে, বাবা ভাইকে নিজ তাগিদে বাসায় নিয়ে আসতে। কিন্তু নুহাশ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার বাহানায় বিষয়টা উড়িয়ে দিয়েছিল। নিজে না গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল এয়ারপোর্টে। তারপরই খবর পাওয়া যায় ড্রাইভাররসহ ওদের বাবা ক্রিস্টোফার রেইন মৃত্যুর পথযাত্রী হয়ে গেছেন। বেঁচে আছে শুধু কৌশিক ভাই তাও আধমরা অবস্থায়। তাইতো নুহাশ বেশ দুঃখ কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলো। এরপর থেকে মেহজাবিন বেগম যেন ওকে একটু কম ই খেয়াল করেন। সব খেয়াল তার কৌশিকের দিকেই থাকতো। সারাক্ষণ হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি তিনিই বেশি করতেন।
মাঝেমধ্যে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে, হুট করেই পুরোনো কথা ভাবতে গিয়ে কেঁদে ফেলে নুহাশ। মেহজাবিন বেগমের মতো সবার সামনে তো কাঁদতে পারে না। সে কাঁদে আড়ালে আবডালে, যখন কেউ না থাকে, যখন কেউ না দেখে। নুহাশের মনে হয় যত ভুল সব তার ই ছিল। যদি নুহাশ সেদিন এয়ারপোর্টে থাকতো তাহলে হয়তো আজ এই দিন দেখতে হতো না! ফোঁস করে শ্বাস ছাড়তে সে। বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেলো বড় ভাইয়ের দিকে। আনমনেই অক্ষিপট নিয়ে কৌশিকের খাতার দিকে তাকায়।
বেশ খানিক এলোমেলো আঁকিবুঁকির মাঝে নুহাশ দেখতে পায় সুন্দর এক চোখজোড়া। বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় না এ সুন্দর টানা টানা কাজল কালো চোখজোড়া কোনো রমণীর। এক পার্শ্বে ছোট্ট করেই অগোছালো হাতের তবে মিষ্টি একটা শব্দ, Princess! চমকায় নুহাশ! আঁখিপল্লব তুলে চক্ষুদ্বয় ঘোরায় সে। স্থির রাখে কৌশিকের দিকে। সূচালো কণ্ঠেই শুধায়,
"এটা কোন মেয়ের চোখজোড়া?"
কৌশিক ও মুখ তুলে ছোট চক্ষু যুগল নিয়ে নুহাশের দিকে তাকায়। ধীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
"জানি না!"
"অসম্ভব! এতো সুন্দর, নিখুঁত করে আঁকার পর ও তুমি বলছো জানো না এই চোখ জোড়া কার?"
কৌশিক দুই দিকে মস্তিষ্ক হেলায়। সত্যিই সে জানে না এই চোখ জোড়া কার। শুধু চোখ বন্ধ করলেই মাথায় জেঁকে বসছে এই চোখজোড়া। কানে বাজতে থাকে নিজেরই কণ্ঠস্বর। তারপর সময় নিয়ে চিন্তা করে কল্পনার চিত্র মিলিত করার পর ফলাফল এমনটাই দাঁড়ায়।
নুহাশ তীক্ষ্ণ, টানা টানা সেই চোখজোড়া পর্যবেক্ষণ করে ধরা গলায় বলে ওঠে,
"ম্যান! ইউ আর ইন লাভ উইথ দিস আইস! "
"নুহাশ!"
কৌশিক নুহাশকে পাশের চেয়ারে টেনে বসায়। চোখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায় একবার। পরমূহুর্তে নুহাশের দিকে আঁখি ঘুরিয়ে বলে,
"আমি জানি না আমার সাথে কি হচ্ছে! আই থিংক আমি অন্য কেউ। যেটা সবাই দেখছে সেটা আমি নই।"
"মানে?"
নুহাশ বিস্মিত হয়ে ভ্রুগুলো উঁচিয়ে ফেলে।
"মনে আছে জ্ঞান ফেরার পর আমি কি বলেছিলাম?"
নুহাশ মনে করার চেষ্টা করলো। ভাই বলেছিলো, ওর জন্ম এখানে হয়নি, এই বর্তমান সময়ের সাথে ওর স্মৃতিকে থাকা সময়টা মিলছে না।
নুহাশ মাথা নাড়লো। কৌশিক নুহাশের দুই বাহু শক্ত হাতে চেপে ধরলো। তবু আঘাত করলো না ছেলেটাকে। বোঝানোর চেষ্টা করলো,
"সেদিন আমি ঠিকই ছিলাম, নুহাশ! আমার চিন্তাধারা মিলছে না। আমার কোনো অতীত আছে যা আমার মনে নেই।"
নুহাশ হতবিহ্বলের মতো কিছুক্ষণ স্থির বসে রইল। মস্তিষ্কের অলিগলিতে এখন আরেক ভয় ঢুকে গেছে। তারপর ও নুহাশ নিজেকে শান্ত করে বললো,
"ভাই! যা অতীতে ছিল তা ভুলে যাও। কারণ বর্তমান সময়টাই আসল। তোমার যেহেতু মনে পড়ছে না তাহলে অতীতের কথা চিন্তা করে বর্তমান সময়টাকে হারিয়ে ফেলা বেকুবের মত আচরণ হবে। তাই যা পেয়েছো তাই নিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা করো। এতো ভেবো না। আমি, মা তোমার সাথে আছি। তুমি ভাবো তুমি আমাদেরকে পেয়েছো, তুমি একটা ফ্যামিলি পেয়েছো। আর নিজের ইচ্ছেমত কাজ করতে পারছো! একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এইসব ই যথেষ্ট নয়? দেখো তুমি যদি আগের কথা এত চিন্তা করতে থাকো তাহলে এই সময়টা ভালোমতো যাপিত করতে পারবে না। তারপর সামনে গিয়ে পস্তাবে আর বলবে যে কি করছিলাম তখন আমি! তাই বলছি ভুলে যাও। আর তোমার পছন্দের কোনো মেয়ে থাকলে বলতে পারো আমি নিজে মায়ের সাথে কথা বলবো।"
পছন্দের মেয়ে কথাটা কানে আসতেই কৌশিকের মাথায় আসলো অনন্যার কথা। পরক্ষণেই নিজের মাথা গরম হয়ে গেল তার। কৌশিক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। তপ্ত মস্তিষ্ক এবং অগোছালো চিন্তাভাবনা নিয়ে সে নিজের রুমের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। এই খারাপ সময়ে সে কি করে অনন্যার কথা ভাবতে পারে? অনন্যা কি ওর পছন্দ? কিন্তু মেয়েটা ওকে হাসবেন্ড বলছে আবার ও নাকি কৌশিকের জন্য প্রেগন্যান্ট! এই বিষয়টাই আবারো সবকিছু গুলিয়ে দিচ্ছে। কৌশিকের অস্তিত্বকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এর সামনে দাঁড়াতে বাধ্য করছে এই কথাগুলো।
********
সময়ের পাল্লা ভারী হয়ে বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে। কৌশিক আর খোলাসাভাবে তেমন খেয়াল করে না অনন্যাকে। অনন্যাও নিজে থেকে আর এগিয়ে যায়নি। কারণ ওর প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি। যেহেতু এই জগতে কৌশিকের মতো রহস্যময় মানবের উপস্থিতি ছিল তাহলে কৌশিকের মতো দেখতে আরেকজন ব্যক্তি এই জগতে আছে এটাও অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। তবে কষ্ট লাগে, প্রতিদিন অনন্যা প্রচুর মানসিক অশান্তিতে ভোগে। ওই রহস্যময় লোকটার যত্ন, ভালোবাসা, পাগলপনা সবকিছু অনন্যার স্মৃতিপটে বারবার ধরা দেয় আর দুর্বল বানিয়ে দেয় ছোট্ট এই মনকে। লোকটার নাম কৌশিক হোক, অথবা কায়েরীথ অথবা কিয়ান! ছিল তো সে অনন্যার ভালোবাসা, অনন্যার জন্য জান দিয়ে দেওয়া একজন পাগল প্রেমিক। এই লোকটাকে ভুলে যাওয়া এই জীবনে তো সম্ভব হবে না।
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আজকের জন্য ক্লাস এদিকেই সমাপ্ত। কৌশিক স্যারের ক্লাস ছিল দ্বিতীয় নাম্বারে। অনন্যা করেনি। ইচ্ছে করেনি। এই লোকটাকে দেখলে বুক চিঁড়ে যায়। হৃৎপিণ্ডটা অগোছালো আচরণ করে। অনন্যা চায় না হৃৎপিণ্ডটা ভুল পথে দৌড়াক। তাই বলে দিয়েছে বেশ অসুস্থ অনুভব করায় রেস্ট রুমে চলে গিয়েছে সে। নোহারার সাথে হাঁটছে এখন। নোহারাও ইদানিং বেশ চুপচাপ। অনন্যা জিজ্ঞেস করেনি কেনো এমন হয়ে আছে ওর মুখটা! অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন মেয়েটা নিজে থেকেই মুখ খুলবে।
অবশ্য কপাল আজ এতোই খারাপ ছিল যে হাঁটতে হাঁটতে করিডোরে দেখা হয়ে গেল কৌশিক স্যারের সাথে। অন্য ব্যাচের ক্লাস করাতে যাচ্ছিলো লোকটা।
অনন্যাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো সে। অনন্যা দাঁড়ালো না। না দেখার ভান করে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু দাঁড়াতে হলো।
কৌশিক স্যার পিছন থেকেই ডাক দিয়ে উঠলো,
"এক্সকিউজ মি, মিসেস?"
·
·
·
চলবে.................................................................................