কিছু মুরগির বাচ্চা কিনে এনেছিলাম। রূপের খুশি আর দেখে কে! এখন বাচ্চাগুলো বেশ বড় হয়েছে। রাহির গাছের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ না থাকলেও মুরগির ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখা গেল। রূপ-রাহি দুজনেই মুরগির আদর যত্ন করে। চাইলে এখন এদেরকে খাওয়া যায় কিন্তু রূপ তাদের খেতে নারাজ। রাহি আবার খেতে আগ্রহী। সে নাকি খাওয়ার উদ্দেশ্যেই এতদিন লালনপালন করেছে। এই নিয়ে দুই ভাইবোনের নিত্য কলহ। তবে সেই কলহ আবার আমি বাড়িতে না থাকলে হয় না। আমাকে দেখলেই রাহি একটু ছোট হয়ে যায়, রূপ একটু বড় হয়ে যায়। আহারে মায়া!
রাফসান শিকদার
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১
মাঝেমাঝে আমি একটা কাজ করি। রাহির কাছ থেকে ওর মোবাইলটা ধার এনে আমার মেমোরি কার্ড ভরে মীরার সঙ্গে কল রেকর্ডিংগুলো শুনি। ওর কণ্ঠস্বর শুনলে পরম শান্তি মেলে। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই মনে হলো এটাও এক ধরনের স্বার্থপরতা। আমি জানি মীরার কাছে আমাদের কোনো কল রেকর্ডিং নেই। কারণ কলরেকর্ড করার অপশন ওর ফোনে নেই। ও মন চাইলেই আমাকে শুনতে পাচ্ছে না, অথচ আমি শুনছি। স্বার্থপর আমি। সঙ্গে সঙ্গে মেমোরি কার্ড খুলে যত্ন করে তুলে রাখলাম। আর কখনো শুনব না। ওকে যতটা কষ্ট দিয়েছি। তা আমাকেও ভোগ করতে হবে।
রাফসান শিকদার
০৪ অক্টোবর, ২০১১
আরে বকুল? অনেকদিন পর তোকে লিখছি। তোর দিনকালের খবর কী? এতদিন একা একা বোর হচ্ছিলি? আমি ব্যস্ততার কারণে এতদিন তোকে লিখতে পারিনি। দোকানে ওভারটাইমের কাজ করে ফিরতে দেরি হয়ে যেত। কোনোরকমে দুটো ভাত গিলে ঘুমিয়ে পড়তাম। রূপকেও সেভাবে সময় দিতে পারিনি। কিছু টাকা বাড়তি এসেছে অবশ্য। তবে ইচ্ছে করে যে করেছি তাও না। উপায় ছিল না বলেই করেছি। কিন্তু ব্যাপারটা ভালো। ব্যস্ততা যত বেশি মীরার স্মৃতির জ্বালাতন তত কম। আচ্ছা কেমন আছে মীরা? ওর কোনো খবর জানিস?
রাফসান শিকদার
০৯ এপ্রিল, ২০১২
টগর আমাকে প্রপোজ করেছে। ব্যাপারটা আগেই বুঝেছিলাম আর তাই সবসময় তাকে এভয়েড করে গেছি। অবশেষে বলেই ফেলল। একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। এই সুযোগে আমিও তাকে বোঝাতে পারলাম আমার পক্ষে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব না। সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল ঠিক তখন আমি তাকে মীরার কথাও বললাম। মীরাকে তীব্রভাবে ভালোবাসা সত্বেও দূরে সরে গেছি এ কথা শুনে সে কিছুটা আঁতকে উঠল বটে। আশা করছি এরপর থেকে সে আমাকে আর বিরক্ত করবে না।
রাফসান শিকদার
১৩ মে, ২০১২
সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ শুকরিয়া, তিনি আমার মাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। মায়ের কাছে জানতে পারলাম, তিনি অ্যাক্সিডেন্ট করে এতদিন কোমায় ছিলেন। যেহেতু বাবা-মায়ের বিয়ে নানাবাড়িতে মেনে নেয়নি তাই আমাদের কারো ফোন নাম্বার তাদের কাছে ছিল না। অ্যাক্সিডেন্ট স্পটে মায়ের ফোনও পাওয়া যায়নি তাও তারা কেউ যোগাযোগ করতে পারেনি। মা সুস্থ হয়ে বাবার এবং আমার নাম্বার বন্ধ পেয়ে রাহির নাম্বারে ফোন করলেন। আজ অনেকদিন পর এই প্রথম আমার মনে হলো আমি বেঁচে আছি। কিন্তু সেই অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হলো না যখন মা বাবার কথা জানতে চাইলেন। বাবার ফোন বন্ধ কেন জিজ্ঞেস করলেন। আমি কথা বলতে পারছিলাম না। মা আবার জিজ্ঞেস করলেন,
কথা বলছিস না কেন? তোর বাবার ফোন বন্ধ, তোর ফোন বন্ধ। একমাত্র রাহিকে পেলাম। সবাই মিলে ফোন বন্ধ করে রেখেছিস কেন?
আমি কোনোমতে বললাম,
মা তুমি ফিরে এসো। এরপর সব বলছি।
মা কিছু বুঝতে পারলেন কি না জানি না। সে হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন,
রাফি তোর বাবা কোথায়? কী হয়েছে তার? সুস্থ আছে তো?
রাহি বারবার ইশারা করছে যেন না বলি। ওদিকে মা বারবার জিজ্ঞেস করছে। সত্যিটা যত কষ্টেরই হোক না কেন বলতে তো হবেই। আমি নিঃশ্বাস আটকে বলে ফেললাম,
বাবা আর বেঁচে নেই মা।
মা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। পাগলের মতো নানা প্রলাপ বকতে শুরু করলেন। আমার কঠিন মা এই প্রথম আমার সামনে কাঁদছে-অথচ কি অভাগা আমি কোনো সান্ত্বনাবাণী আমার জানা নেই। আমি আর কোনো কথাই বলতে পারলাম না। চুপচাপ মায়ের কান্না শুনতে লাগলাম। নিজেকে বড় অসহায় লাগল। এরচেয়ে কঠিন সময় সম্ভবত আমার জীবনে এর আগে আসেনি।
রাফসান শিকদার
৩০ জুন, ২০১২।
মায়ের কাছে বাংলাদেশে আসার মতো টাকা নেই। মামাদের টাকা-পয়সাতে মায়ের চিকিৎসা হয়েছে। তাদের পক্ষেও মায়ের আসার খরচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। মা পাগল হয়ে গেছেন দেশে ছুটে আসবার জন্য। বাবা মাকে ছাড়া আমরা তিন ভাই-বোন কীভাবে বেঁচে আছি সেই চিন্তায় মা অস্থির। আরো বেশি অস্থির হয়েছেন রূপের জন্যে। রূপ মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় প্রথম কথাটাই বলেছে,
মা তুমি মরে যাওনি? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি মরে গেছে। আর যে আসো না তাই। জানো মা? বাবা মরে গেছে। আমাদের কাছে আর আসে না। আমি কত কাঁদি তবুও আসে না। তোমার জন্যও কাদি। তুমি তো মরে যাওনি। তুমি চলে আসো না প্লিজ?
এমন কথা শুনলে কোনো মায়ের পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব না। আমার মাও ছিল না। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি বিক্রি করে মাকে দেশে আসার জন্য টাকা পাঠাব। এছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। বাবার অনেক শখের বাড়ি আমি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারই ভালোবাসার স্ত্রী-সন্তানদের এক করার জন্য। কেন নিয়েছি সেটাও নিশ্চয়ই তিনি জানেন। নিশ্চয়ই তিনি মনে কষ্ট পাবেন না।
রাফসান শিকদার
০২ জুলাই, ২০১২
খুব ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছি। বাড়ি বিক্রি করে মাকে টাকা পাঠিয়েছি। বাকি টাকা ব্যাংকে রেখেছি। আমরা আপাতত ধামরাইতে একটা বাসা ভাড়া করে সেখানে উঠেছি। প্রথমে ব্যাংক টাউনে বা সাভারে বাসা নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু খুঁজে দেখলাম ওসব এলাকায় বাসাভাড়া অনেক বেশি। তাই ধামরাইতে বাসা নিলাম। এখানে বাসাভাড়াও কম আবার আমার প্রতিদিন সাভারে কাজে যেতেও খুব একটা সুবিধা হবে না। মাত্র ঘণ্টাখানেকের রাস্তা।
ব্যাংক টাউনের বাড়ির উঠানে আমার কত বছর ধরে লালনপালন করে বড় করা গাছগুলো ফেলে আসতে হলো। রাহি-রূপের পালা মুরগিগুলো বিক্রি করে দিতে হলো। কিন্তু কোনো কিছুতেই আমাদের এখন কষ্ট হচ্ছে না। এখন আমাদের হৃদয়ভরা আনন্দ। আমরা আমাদের মাকে ফিরে পেয়েছি যে!
রাফসান শিকদার
২৭ জুলাই, ২০১২
·
·
·
চলবে...................................................................................