ফানুস - পর্ব ৩৩ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। আশপাশে কিছুই ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না। তাই অফিস থেকে বের হতে পারছে না পেট্রা। অবশ্য অত তাড়াও নেই। সমস্যা একটাই, ফোনটার যেন কী হয়েছে। দুপুরে হুট করেই বন্ধ হয়ে গেছে, আর স্টার্ট হচ্ছে না। ফোনেরই-বা কী দোষ, অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছে। একটা নতুন ফোন কিনতে হবে।

অফিসে আজই তার শেষ দিন। মায়া পড়ে গিয়েছিল এই অফিসে। কয়েকদিন পরেই তার ফ্লাইট। নতুন চাকরি, নতুন জায়গা। জীবনে একটা পরিবর্তন দরকার ছিল খুব। চলে যাচ্ছে বলে খুশি কিন্তু নিশ্চিন্তে নেই সে। রায়ান-আনিসার ব্যাপারটা তাকে এখনো ভাবাচ্ছে। কত দিনের সম্পর্ক ওদের? এইটুকু ছেলেমেয়ে, যদি ম্যাচিওরড হওয়ার পর দুজনের দুজনকে আর ভালো না লাগে? নিজের পরিবার ছেড়ে এভাবে গিয়ে আনিসা কি ভালো থাকতে পারবে? তা ছাড়া আনিসা বাসায় কেন বলতে চায় না? মানুক না মানুক, অন্তত বাসায় জানানোটা তো জরুরি। তা না করেই পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ভাবনার মাঝেই স্মরণ ডাক দিল, ‘পেট্রা।’

পেট্রা স্মরণের দিকে তাকাল। স্মরণ বলল, ‘কোথায় যাবে এখন?

‘সরাসরি বাসায়।

‘চলো আমি নামিয়ে দিই।’

‘না না, বৃষ্টি একটু থামলেই আমি চলে যাব।’

‘আজই তো শেষ। আজকের পর থেকে তো এই স্মরণ চাইলেও আর তোমাকে জ্বালাতে পারবে না। প্লিজ পেট্রা। আর আজকে তোমার হাতের এক কাপ চা খাব। শেষ আবদার।

পেট্রা হেসে বলল, ‘আচ্ছা, চলো।’

বাইরে তুফান হচ্ছে। অফিসের গেট থেকে বের হয়ে পেট্রার চোখ শুধু একজনকেই খুঁজছিল। সে প্রিয় ছাড়া আর কেউ না। নয় বছর আগের এই দিনে ওরা বিয়ে করেছিল। সেদিনও ঠিক একই রকম বৃষ্টি হচ্ছিল। আজ কি প্রিয় এসেছে? সে যোগাযোগ করতে নিষেধ করেছে, তাও প্রিয়। আসে মাঝেমধ্যে। আজও নিশ্চয়ই আসবে। আবার না-ও আসতে পারে। ডিভোর্সের পর এই দিনটিকে ঘটা করে পালন করার কোনো মানে হয় না। বিগত বছরগুলোতেও করেও নি অবশ্য। কিন্তু স্মৃতি! স্মৃতি তো প্রতারণা করে না। প্রিয়কে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না পেট্রা। আসে নি তাহলে? অবশ্য পরিস্থিতি এখন যেমন, এটাই তো স্বাভাবিক। তবু তার কেন খারাপ লাগছে?

—————

দশ দিন আগে ছিল শুদ্ধর জন্মদিন। পেট্রা নিকিতার মাধ্যমে শুদ্ধর সঙ্গে দেখা করেছে, উপহার দিয়েছে কিন্তু প্রিয়র সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করে নি। এমনকি একটা ফোনকলও না। তাই প্রিয় বুঝেই গেছে পেট্রা আজও যোগাযোগ করবে না। কিন্তু আজকের দিনটায় প্রিয় মনকে কিছুই বোঝাতে পারল না। আজ সে পেট্রাকে পেয়েছিল। জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ঠিক করল আজ পেট্রার কাছে কিছু সময়ের সঙ্গ আবদার করবে সে, পেট্রা মানলে মানল, না মানলে না মানল, চাইতে তো কোনো দোষ নেই। এসব হাবিজাবি ভেবে শেষমেশ প্রিয় ফোনটা করেই ফেলল। নম্বরটা নিকিতার কাছ থেকেই চেয়ে নিয়েছে। কিন্তু পেট্রার ফোন বন্ধ। না বলে সামনে যেতে না করেছে, গেলে হয়তো রাগ করবে। তাই প্রিয় সেসব ইচ্ছেকে বিসর্জন দিয়ে শুধু দূর থেকে দেখে আসার সিদ্ধান্ত নিল। তাই পেট্রার অফিসের সামনে চলে এল। ঠিক অফিসের সামনে না, রাস্তার মাথায়। যাতে বের হওয়ার সময় একটু দেখতে পায়। দূর থেকে দেখে চলে আসবে।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর খেয়াল করল পেট্রা স্মরণের গাড়িতে। পেট্রা-স্মরণ একসঙ্গে কীভাবে? তারা কীভাবে একজন আরেকজনকে চেনে? প্রিয় দূর থেকে তাদের অনুসরণ করল। যখন গাড়িটা পেট্রাদের বাসার দিকে যাচ্ছিল, প্রিয়র বুকের ভেতর কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছিল। সে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো পেট্রা স্মরণকে নিয়ে ওদের বাসায় ঢুকল দেখে। দুজনের কী সম্পর্ক? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল কিন্তু স্মরণ বের হলো না। তার মানে, বাসায় পৌঁছে দিতে আসে নি। অন্য কোনো কারণে? কী সেই কারণ?

প্রিয় পেট্রাদের এলাকা থেকে বেরিয়ে এল। কোথাও যাবে না, আন্দাজে এদিক-ওদিক ঘুরছে। একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে। সবকিছু অসহ্য লাগছে ওর। রাত দশটার দিকে আবার ফোন করল পেট্রাকে। পেট্রা ফোন ধরল না। এবার ফোন করল স্মরণকে।

স্ক্রিনে প্রিয়র নম্বর দেখে অবাক হলো স্মরণ। সচরাচর ফোন করে না সে। আজ হঠাৎ? ফোন ধরে বলল, ‘হ্যালো প্রিয় ভাইয়া।

‘হ্যালো স্মরণ, কেমন আছ?

‘ভালো আছি, ভাইয়া। হঠাৎ কী মনে করে?

‘কিছু মনে কোরো না, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?

‘বলুন।

‘পেট্রাকে তুমি কীভাবে চেনো?

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?

‘আমি আজ সন্ধ্যায় তোমাদের ওর বাসায় যেতে দেখলাম। আসলে আমি ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম, দূর থেকে দেখলাম।

‘ও আচ্ছা। পেট্রা আমার কলিগ।’

‘কলিগ, তাহলে ওর বাসায় গেলে যে!’

‘কলিগের বাইরেও আমাদের বাড়তি একটা সম্পর্ক আছে। ভালোবাসার সম্পর্ক, তাই আমি যেতেই পারি ওর বাসায়। কিন্তু আপনি ওকে কীভাবে চেনেন?’

ও আচ্ছা। পেট্রা আমার বন্ধু।

‘ও হ্যাঁ, আপনিও তো বুয়েটে পড়তেন। বুয়েটের বন্ধু?

‘হ্যাঁ, আচ্ছা স্মরণ, রাখি তাহলে, ভালো থেকো।

লাইন কেটে প্রিয় ফোনটা আছাড় দিল। নিজেকেই নিজের খুন করতে ইচ্ছা করছে এখন তার। মাথাটা পুরো খারাপ হয়ে গেল। পেট্রা তাহলে স্মরণের সাথে প্রেম করছে! ও কি মুসলিম কাউকে বিয়ে করে এটাই প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে প্রিয় যেটা পারে নি, সেটা চাইলেই অনেকে পারে? পরমুহূর্তেই মনে হলো, ধুর পেট্রাকে কেন ভুল বুঝছে সে। পেট্রাকে তো সে নিজেই বলেছে বিয়ে করতে। পেট্রার একটা ভালো বিয়ে হলেই তো সে নিজের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাবে। তাহলে এসব দেখে কষ্ট পাচ্ছে কেন? সে নিজে তো একটা ইউজলেস, ভালোবাসাকে তাই আজ অন্য কারও সঙ্গে এভাবে সহ্য করতে হচ্ছে।

গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে গেছে। গাড়িটা গ্যারেজে দিয়ে রিকশা নিল প্রিয়। শিলাবৃষ্টি হচ্ছে, ঠান্ডায় রীতিমতো কাঁপছে সে, তবু পর্দা নিল না, হুডও তুলল না। শরীরে আগুন জ্বলছে, বৃষ্টির পানিতে নিভুক একটু। কিন্তু এ দাবানল নিভবে বলে মনে হচ্ছে না। কত দিন ধরে চলছে ওই সম্পর্ক কে জানে! তাকে জানালও না পেট্রা! এভাবে জানতে হলো নিজের ভালোবাসা হারানোর গল্প! পেট্রা তাহলে এখন আর তার নেই। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা, রাগ, অভিমান, নিজের অপারগতা, নিজের প্রতি ঘৃণা– সব মিলেমিশে একাকার হয়ে প্রিয়কে গ্রাস করেছে।

—————

বেল বাজাতেই নিকিতা দরজা খুলে বলল, ‘ইশ, একদম ভিজে গেছ। এত ভিজলে কী করে?

প্রিয় কিছু না বলে সোজা ঘরে চলে গেল। নিকিতাও পেছন পেছন গিয়ে তোয়ালে বের করতে করতে বলল, কোথায় ছিলে তুমি?

প্রিয় কোনো কথা বলছিল না। ভেজা শার্টের বোতাম খুলছিল। শার্টটা খুলে রাখতেই নিকিতা সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে দিতে দিতে বলল, ‘শুদ্ধ তোমাকে কী যেন আনতে বলবে, এতবার ফোন দিল। তোমার ফোন বন্ধ। শেষমেশ বাচ্চাটা দাদার কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেল। আমরা দুশ্চিন্তা করছিলাম খুব।

প্রিয় ভাবছিল, শুধু পেট্রার জন্য, পেট্রাকে ভালোবেসে, তার প্রতি সম্মান রেখে, গত ছয় বছর ধরে কোনো নারী শরীর স্পর্শ করে নি। নিকিতাও চার বছর ধরে দিনরাত তার সঙ্গেই থাকছে, সে না মানলেও বিয়ে করা বউ! কতভাবে গলাতে চেয়েছে, তবু তো এক মুহূর্তের জন্যও গলে নি প্রিয়। অথচ পেট্রা কিনা…মনে হচ্ছিল সারা শরীরে কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে খোঁচাচ্ছে।

নিকিতা বলল, ‘ইশ, একদম বরফ হয়ে গেছ। তুমি কাপড় বদলে নাও, আমি তাড়াতাড়ি এক মগ কফি বানিয়ে দিই।

কথাটা কেবল শেষ করল নিকিতা। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রিয় আচমকা এক হাতে তাকে কাছে টেনে ঠোঁটে চুমু খাওয়া শুরু করল। নিকিতার হাত থেকে তোয়ালে পড়ে গেল। সে এত অবাক হলো যে কোনো সাড়া দিতে পারল না। প্রিয় চুমু খেতে খেতেই তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, সে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরতেও পারল না। প্রিয় এবার তাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেল। সে এত অবাক জীবনে কোনো দিন হয় নি। কী করতে যাচ্ছে প্রিয়? দরজাটা লক করাও হয় নি। অবশ্য এত রাতে কেউ জেগে নেই, থাকলেও নক না করে ঢুকবে না। ব্যস, এর বেশি আর কিছু ভাবতে পারল না নিকিতা। এরপর ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতাটাও অবশ হয়ে গেল।
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp