জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতি আসে, যখন নিজেকে বড় অসহায় লাগে। পেট্রা বহুদিন আগে থেকেই বারবার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু আজকের মতো বোধ হয় কখনো না। এতটাই শাস্তি পাওয়া বাকি আছে তার এখনো? তা নয়তো কী? না হলে দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে নিকিতার বোনের সঙ্গেই কেন সম্পর্ক হবে রায়ানের? আর ওদের কী হবে, সেই সিদ্ধান্তটা পেট্রাকেই কেন নিতে হবে? মা-বাবা থাকলে সে শুধু সাপোর্ট দিত তাদের কিন্তু এভাবে পুরোটা নিজের ওপর পড়ত না। এখন কী করবে সে? তার নিজের ক্ষেত্রে যেমন হৃদয়ের চেয়ে মস্তিষ্কের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভাইয়ের বেলায় তো সেটা সে কখনো পারবে না। এমনিতেই সে বলেছিল একদিন আনিসাকে বাসায় নিয়ে আসতে, কথা বলবে। কিন্তু আজ রায়ান বলল, কাল নাকি রিদিমার বিয়েতে কেউ আনিসাকে দেখে তাদের ছেলের জন্য পছন্দ করেছে। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে দিয়েছে। এখন দুশ্চিন্তায় ওদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই আবার আজই ওকে নিয়ে আসতে বলেছে। ওদিকে প্রিয়াঙ্কাকেও আসতে বলেছে।
পেট্রা-প্রিয়াঙ্কা দুজনের সঙ্গেই আনিসার আগেও বহুবার দেখা হয়েছে, কোনো জড়তা থাকার কথা না, তবু আজ জড়তা কাজ করছে আনিসার। ভাগ্যিস, তারা অনেক স্বাভাবিক আছে। না হলে আনিসা এতক্ষণে টেনশনেই মরে যেত। রায়ান অবশ্য আছে পাশে কিন্তু চুপ করে আছে, সে এমনিতেও কথা একটু কম বলে। নানান কথার মাঝে এই বিষয়টা পেট্রাই তুলল, ‘আমি যে শুদ্ধর মা, এটা কি তুমি জানতে?
আনিসা বলল, ‘না আপু, কালই জানলাম।
‘আচ্ছা। তোমার কি মনে হয় রায়ানের সাথে তোমার সম্পর্কের কথা তোমার পরিবার জানলে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে?
‘মানবে না, উল্টো মেরেও ফেলতে পারে আমাকে। রিদিমা আপুর বয়ফ্রেন্ডের তো সবই ঠিক ছিল, তাও মানে নি। জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল। ওর বয়ফ্রেন্ডের অপরাধ ছিল সে এখনো স্টুডেন্ট। দুই বছর সময় চেয়েছিল। বাবা সময় দিল না। এরপর তো আমার সিরিয়াল আপু। অলরেডি বিয়ের কথা চলছে।’
‘হ্যাঁ, রায়ানের কাছে শুনলাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি!
‘বাবা বলে যে বয়স হয়ে গেলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যায় না। নিকিতা আপুকে ১৮ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছিল। রিদিমা আপুকেও তো ১৮-তেই দিয়ে দিল। কিন্তু আমার মাত্র ১৭। আমাকে কেন এত তাড়াতাড়ি দিতে চাচ্ছে, বুঝলাম না।’
প্রিয়াঙ্কা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এখন জিজ্ঞেস করল, তোমার যে অ্যাফেয়ার আছে, এটা কি কোনোভাবে জানতে পেরেছে?
‘না আপু, জানে না কিছু, আমি খুব সাবধানে থাকি।
পেট্রা বলল, তুমি এখন কী করতে চাও?
‘আমি পালাব। তাদের বললেও তারা মানবে না, তাহলে বলব কেন বলো?
‘একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য বলবে।’
‘জানি তো আপু, কিছুতেই মানবে না। যদি শোনে ধর্ম আলাদা, সাথে সাথে আমাকে কেটে ভাসিয়ে দেবে।
এসব কথার মাঝে হঠাৎ প্রিয়াঙ্কা বলে উঠল, ‘আমি ভাবছি নিকিতা কী রিঅ্যাক্ট করবে!
আনিসা বলল, ‘বড়াপু সবচেয়ে বেশি ঝামেলা করবে। শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে। ওর ভয়ংকর রাগ। বড়লোক বাড়ির বউ হওয়ার পর তো আমাদের বাসায় তার পাওয়ার আরও বেড়ে গেছে। মা বাবাও ওর কথা শোনে। মা-বাবার বাধ্য মেয়ে যে ও। শুধু দুলাভাইয়ের সামনে মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।’
পেট্রা কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবল, আনিসার কথা বলার ধরনই কি এমন? নাকি রায়ানের জন্য ডেসপারেট হওয়ায় উত্তেজনার বশে এভাবে বলছে! যাক, যেমনই হোক, যার পার্টনার হবে, সে সুখী থাকলেই হলো। পেট্রাকে চিন্তিত দেখে আনিসা কিছু বলবে কি না ভাবছে, কিন্তু আর কী বলবে, বুঝতে পারছে না। তাই চুপ করে আছে। রায়ান ও প্রিয়াঙ্কাও চুপচাপ মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছে। পেট্রাই আবার আলোচনায় ফিরে এল, ‘আমি সামনের মাসেই মালয়েশিয়া যাচ্ছি। রায়ান তিন মাস পর যাবে। এটুকু সময়ের মধ্যে কী করব বুঝতে পারছি না। আর তোমাদের দুজনেরই বয়স খুব কম, এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। তা না হলে অনেক কিছুই করা যেত।
রায়ান-আনিসা চুপ। পেট্রা বলল, ‘রায়ান, তুই কী করতে চাস?
‘বুঝতে পারছি না, দি। তুই বল কী করা উচিত।
পেট্রা আনিসার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে সেই স্কুল লাইফ থেকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল, বুঝেছ? আমি নানান বাহানা দিয়ে ঠেকিয়েছি। তুমিও একটা বছর ঠেকিয়ে রাখো। এইচএসসি পরীক্ষাটা শেষ করো। ততদিনে আমরা ওদিকে সব গুছিয়ে নিতে পারব। তারপর আমরা তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব। তখন আমরা তোমার পরিবারের সাথে কথা বলব। প্রিয়াঙ্কা তোমাকে এখান থেকে সাহায্য করবে। এর মধ্যে কোনো সমস্যায় পড়লে ওর কাছে আসবে।
প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘হ্যাঁ, ফোন নম্বর নিয়ে নাও। আর রায়ান, তুই একদিন ওকে আমার বাসায় নিয়ে যাবি। বাসাটা চেনা থাকলে ভালো হবে।
রায়ান বলল, ‘আচ্ছা।’
আনিসা বলল, কিন্তু আপু, বিয়ে যদি ঠিকই করে ফেলে, সেটা ঠেকাব কীভাবে?
পেট্রা বলল, ‘বিয়েতে আপত্তি করবে না। শুধু বলবে যে এইচএসসির পর বিয়ে করবে। তাহলে আশা করি তোমার পরিবার আর জোর করবে না। প্রথমেই যদি আপত্তি করো, তাহলেই বরং জোর করবে।
‘ঠিকাছে আপু, তা-ই করব। কিন্তু আমার খুব ভয় করছে।’
পেট্রা-প্রিয়াঙ্কা একসঙ্গেই বলে উঠল, ‘ভয়ের কিছু নেই।’
তারপর দুজনেই হেসে দিল। তারপর পেট্রা বলল, আমরা আছি তো।’
রায়ান বলল, ‘দি, তোরা কেউ এটা কেন জিজ্ঞেস করলি না যে পেট্রাদিকে দেখেও আমার শিক্ষা হয় নি, মুসলিম একটা মেয়েকে কেন ভালোবেসেছি! কেন করলাম?
প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘যা করার তা তো করেই ফেলেছিস। এখন আর এসব বলে কী হবে?
পেট্রা বলল, এমন বোকা প্রশ্ন আমি কেন করব, রায়ান? ভালোবাসা এত কিছু চিন্তা করে হয় না। হলে আমারটাও হতো না।
আনিসা চুপ করে আছে। সে বুঝতে পারছে না তার কী বলা উচিত। তবে এটুকু বুঝতে পারছে, দুনিয়ার সেরা বোনদের কাছে এসে পড়েছে সে।
—————
রিদিমার বউভাতের অনুষ্ঠানে নিকিতা শুদ্ধকে খাইয়ে শ্বশুরের কাছে রেখে কাজিনদের কাছে যাচ্ছিল। এমন সময় তার বড় মামি ডেকে বলল, এই নিকিতা, এদিকে শোন।
নিকিতা এগিয়ে গেল, ‘হা মামি, বলো। তোমরা খেয়েছ?
‘আরে না, পরে খাব, শোন এদিকে। তোর ওই সতিনটা আজও এসেছে নাকি? কোন পক্ষের ও?’
এ কথা শুনে নিকিতার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে বলল, ‘আজ আসে নি। আর কিছু বলবে?
‘কী আর বলব বল, তোর বাবা তোর জীবনটা একেবারে নষ্ট করে দিল। ছেলেটা দেখতে-শুনতে তো ভালোই কিন্তু কেমন অহংকারী। কারও সাথে কথাই বলে না। খুব দুঃখ হয় তোর জন্য, মা।
নিকিতা রাগ ঝাড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, এর মধ্যেই মামি আবার বলল, এমন চাঁদের মতো মুখ তোর। তোর জন্য আরও ভালো পাত্র পাওয়া যেত। জীবিত বউকে মৃত বলে বিয়ে করল। আল্লাহই জানে আরও বিয়েশাদি করেছে কি না! বড়লোকের ছেলেদের বিশ্বাস নেই, বাবা। তার উপর মন্ত্রীর ছেলে। এখন তার জীবনটা ওই বাচ্চা পালতে পালতেই যাবে।
এবার আর নিকিতা নিজেকে সামলাতে পারল না। মামিকে একটা ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের ওপর ফেলে দিল। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘আমার স্বামী এক শটা বিয়ে করবে আর ওর হাজারটা বাচ্চা আমি পালব। তোমার বাপের কী?
দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভদ্রমহিলা প্রচণ্ড ব্যথা পেল। ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে চুপসে গেল। নিকিতা এমন কেন করল?
বিয়েবাড়ির সবার দৃষ্টি এখন নিকিতার দিকে। চিৎকার শুনে নিকিতার মা-বাবা এবং প্রিয়ও ছুটে এসেছে। এমনকি বাবর খানও এসে অবাক হয়ে সব দেখছেন। নিকিতা এবার মামির কাছে গিয়ে বলল, ‘তোমাকে কি বলেছি আমার বাচ্চা পালায় সাহায্য করো? নাকি বলেছি আমি সুখে নেই? আমার স্বামীকে নিয়ে, ওর বিয়ে নিয়ে তোমার এত চুলকানি কেন? তোমাকে বিয়ে করেছে? নাকি তোমার মেয়েকে বিয়ে করেছে? আসল কথা হলো, তোমরা মানুষের সুখ দেখে ঠিক থাকতে পারো না, তোমাদের জলে।
অবস্থা বেগতিক দেখে প্রিয় এগিয়ে গিয়ে নিকিতাকে ধরে আনতে চাইল, ‘নিকিতা, ছি, কী বলছ তুমি এসব? চলো আমার সাথে।
প্রিয় যাওয়ায় নিকিতার মা-বাবা আর এগোলেন না। এদিকে নিকিতার গায়ের জোর দেখে এবার অবাক হওয়ার পালা প্রিয়র। তাকে কিছুতেই সরানো যাচ্ছে না। সে আবার মামিকে মারতে যাচ্ছে। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, তুমি জানো সে কী বলেছে? সে বলেছে…’
প্রিয় এবার উপায় না দেখে পেছন থেকেই এক হাতে নিকিতার মুখ চেপে ধরল। আরেক হাতে তার কোমর জাপটে ধরে বাচ্চাদের মতো উঁচু করে নিয়ে বের হয়ে গেল ওখান থেকে। পেছন পেছন শুদ্ধ দৌড় দিল।
প্রিয় একেবারে গাড়িতে নিয়ে বসাল নিকিতাকে। ততক্ষণে শুদ্ধও পেছনের দরজা খুলে উঠে গেছে। নিকিতার এত রাগ উঠেছে এবং এত জোরে চিৎকার করেছে যে গলা শুকিয়ে গেছে, এখন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শুদ্ধ বলল, ‘বাবা, কী হয়েছে নিকিতা মার?
প্রিয় ততক্ষণে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। নিকিতা রাগে ফোঁস ফোঁস করছে, চোখে জল। প্রিয় একটু দূরে গিয়ে একটা দোকানে গাড়ি থামিয়ে পানি কিনল। তারপর আবার গাড়িতে ফিরে পানিটা নিকিতার হাতে দিতেই নিকিতা বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। প্রিয়র কেন যেন পুরো ঘটনাটায় প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে। প্রিয় হেসেই বলল, ‘এক শটা বিয়ে করব?
নিকিতা আবার চিৎকার দিল, ‘করবে, প্রয়োজনে হাজারটা করবে, ওই বেটি বলার কে?’
শুদ্ধ বলল, ‘বেটি কী জিনিস, মা? আর বাবা এক শ বিয়ে কেন করবে?
নিকিতা চুপ। প্রিয় বলল, ‘দেখেছ ছেলে কী সব শিখছে? ওর সামনে ভুলেও এসব বলবে না আর।
শুদ্ধ নিকিতার চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘কান্না কোরো না, মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিকিতা শুদ্ধকে কাছে টেনে কোলে নিল। প্রিয় হাসছে। প্রিয়র এই হাসি নিকিতার সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু প্রিয়র খুব মজা লাগছে, আরও হাসতে ইচ্ছা করছে। হঠাৎ প্রিয় সজোরে হেসে দিল।
·
·
·
চলবে...................................................................................