অভিমানিনী - পর্ব ১৮ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          পরেরদিন সকালে বাবার ডাকে ঘুম ভাঙল। আমি উঠে বসে বললাম,

“বাবা.. কখন এলে?”

“কাল রাতের ট্রেনে উঠেছিলাম। আজ সকালেই বাসায় আসলাম।”

“ওহ!”

“তুই এক কাজ কর, উঠে তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে নে। তোর সাথে কথা আছে।”

“হুম, এখনই বলো। ব্রেকফাস্ট পরে করা যাবে। ক্ষিদে পায়নি এখনো।”

“ওকে, কাল শ্যামা এসেছিল শুনলাম।”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। বাবা বলল,

“একদিকের কথা শুনেছিস। তোর মা তো নার্ভাস হয়ে কিছুই বলতে পারেনি শুনলাম। সব যখন জেনেই ফেলেছিস তখন দুই দিকের কথাই তো জানা উচিত।”

“আমার কিছুই জানার নেই বাবা। আমি কালকের দিনটা ভুলে যেতে চাই।”

“হুম, তবু তো কিছু কথা জানাটা জরুরি।

আমি চুপ করে রইলাম। বাবা বলল,

“একদিন শ্যামা ইউনিভার্সিটি গিয়ে আর ফিরল না। আমরা তো চিন্তায় পড়ে গেলাম, তোর বয়স তখন ২ মাস মাত্র। তোর মা ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে জানতে পারল শ্যামাকে ওর বাবা নিয়ে গেছে। আর তখন তোর মা তোকে নিজের ছেলের মতোই পালতে শুরু করল। তারপর যখন আমরা জানলাম শ্যামার বিয়ে হয়ে গেছে, তখন তোর মা বলল আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছে। কারণ তখন আমরা জানতাম ও কখনো মা হতে পারবে না। এই একটাই দুঃখ ছিল ওর। তোকে পেয়ে সব ভুলে গেল। একদিন হঠাৎ কী হলো যখন তোর ১ বছর প্রায় তখন ও আমাকে বলল বাড়ি বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য। তোর প্রতি এত মায়া জন্মে গিয়েছিল যে ভয় পাচ্ছিল যদি শ্যামা এসে কখনো তোকে ফেরত চায়, মরে গেলেও তো তোকে ফেরত দিতে পারবে না। তারপর আমার মধ্যেও কীভাবে যেন এই ভয়টা ঢুকে গেল। আমি সত্যি সত্যি বাড়ি বিক্রি করে এখানে চলে এলাম। এই বাড়িটা কিনলাম। তারপরই তো মিরাকলের মতো সৌরভ হলো। অনেক বছর পর আবার মোনাও। কিন্তু তোর প্রতি তোর মায়ের একচোখা ভালোবাসা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছিস সবসময়। সবাই খেয়াল করেছে আর ভেবেছে প্রথম সন্তান তাই তার জন্য সবকিছুই বেশি বেশি।”

“বাবা, কোনোদিন আমি কল্পনাও করিনি এমনটা।

“আমরা তো একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম।”

আমি চুপ করে রইলাম। বাবাও কিছুক্ষণ চুপ। তারপর বলল,

“তোর মা খুব ভেঙে পড়েছে।”

“কেন?”

একে তো তোকে ওভাবে জোর করে বিয়ে দিয়েছে, তার ওপর কাল জানলি ও তোর নিজের মা না। দিতিয়ার সাথে তোর বিয়ের পরই তোর সাথে তোর মায়ের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এখন যদি দূরত্বটা আরো বেড়ে যায় সেই ভয়েই সে অস্থির হয়ে আছে।”

“তা কেন হবে বাবা? মায়ের ওপর একটা অভিমান ছিল ঠিকই তবে মায়ের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়ার মতো কিছু হয়নি।”

তারপর হঠাৎ মনে পড়ায় জিজ্ঞেস করলাম,

“বাবা আমার আর দিতিয়ার বিয়ের সাথে কি ওই মহিলার কোনো সম্পর্ক আছে? ওনাকে মা বলছিল…তুই যা বলেছিস আমি করেছি। এখন তুই তোর কথা রাখ, এই ধরনের কিছু কথা। আমি পেছন থেকে শুনে ফেলেছিলাম।”

“হ্যাঁ, মূলত এই কথাটা বলতেই আমি তোর কাছে এসেছি।”

“কী?”

“কিছুদিন আগে হঠাৎ মার্কেটে শ্যামা তোকে আর তোর মাকে দেখতে পেয়েছিল। তোর মাও তোকে নাম ধরে ডেকেছিল সেটা শুনেই ও বুঝে গিয়েছিল তুই ওর ছেলে। কারণ নীরব নামটা ওরই দেয়া ছিল। যাই হোক, সেদিন শ্যামা তোদের সামনে আসেনি। ফলো করে এসে বাসা চিনে গিয়েছিল। তারপর তোর মায়ের সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ করে তোকে ফেরত চায়। তোর মা তো দেবে না। উল্টো জিজ্ঞেস করল এতদিন পর কেন তোকে চাচ্ছে! ছোটবেলায় তো তোকে একেবারেই দিয়েছিল। সেই চিঠিটা তোর মা অনেক যত্নে রেখে দিয়েছিল। সেটাও দেখাল। তারপর শ্যামা ওর সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বলল। কীভাবে ওর বাবা ওকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। কীভাবে সেই বিয়ে ভাঙলো, কীভাবে আবার সিফাতকে ফিরে পেল সব বলল। সব শুনেও তোর মা তোকে দিতে রাজি হয়নি। তারপর সিফাতও তোর মায়ের সাথে দেখা করে অনেক অনুরোধ করল। আসলে ওদের আর কোনো সন্তান নেই তো। কিন্তু তোর মা কিছুতেই রাজি হলো না। উল্টো বোকামি করে বলল, তোকে ছাড়া আর যা চাবে তাই দেবে। আজীবনের বোকা তোর মা। ওরাও বলল, যদি তোকে দিতিয়ার সাথে বিয়ে দেয় তাহলে আর তোকে চাইবে না।”

“মানে কী? এটা কেমন কথা! এটার সাথে ওটার কী সম্পর্ক? আর দিতিয়া ওদের কে হয়?”

“আরে বাবা, বলছি তো…সবটা ধৈর্য ধরে শোন।”

“আচ্ছা বলো।”

“এসব কথা বলার পর তোর মা বলল তুই মানসীকে বিয়ে করেছিস।”

“বাবা তুমি আমার আর মানসীর বিয়ের কথা জানতে?”

“নাহ, আজই জানলাম।”

আমি কিছু বললাম না আর। বাবা আবার বলতে শুরু করল,

“ওরা তখন বলল…বিয়ের কথা তো কেউ জানে না। আর এটাকে বিয়েও বলা যায় না, এটা আসলে ছোটকালের ভুল। ডিভোর্স করে নিলেই মিটে গেল।”

আমি অবাক হয়ে সব শুনতে লাগলাম। বাবা বলল,

“তোর মা যে একটা ইমোশনাল ফুল তা আমি আগে থেকে জানতাম। তবে এতটাও জানতাম না। এইসব ঘটনা ওদের তালে পড়ে ওদের শর্ত মেটাতে করেছে, অথচ একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি! কারণ ওরা মানা করেছে আমাকে জানাতে। আমি আন্দাজ করছিলাম কিছু হয়েছে তবে এত বড় ধরনের একটা গণ্ডগোল তা টেরই পাইনি। আমি যদি টের পেতাম তাহলে এটা হতে দিতাম না।”

“বাবা, কী বলছ এসব? মা ওদের কথায় এসব করেছে? একবার ভাবলো না আমার কথা? মা কী করে ভাবলো এত বছরের সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে আমি চলে যাব? অতটা অমানুষ কি বানিয়েছো তোমরা আমাকে?”

“আমি জানলে এটা হতে দিতাম না। আর সেটা ওরা খুব ভালোভাবে জানে বলেই তোর মাকে ভয় দেখিয়েছে ওদের কথা না শুনলে কিংবা আমাকে কিছু জানালেই ওরা তোকে সব জানিয়ে দেবে। সেই ভয়েই তোর মা মরতে বসেছিল কিন্তু মুখ খোলেনি।”

“আমি জানলে কী হতো বাবা? এখন তো জেনেছি! কই মাকে ছেড়ে, তোমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছি ওদের পিছু পিছু?”

“না চলে যাসনি ঠিকই, কিন্তু অনেক দূরে সরে গিয়েছিস। কাল সবকিছু জানার পর একবারও গিয়েছিস মার কাছে?”

এবার আমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগল। সত্যি তো যাইনি মায়ের কাছে। যাইনি কারণ খুব অস্বস্তি লাগছিল কাল সব জানার পর থেকে। সেটাই বললাম বাবাকে। বাবা বলল,

“হুম, আর তোর মাও তো সেই কারণেই তোর কাছে আসতে পারেনি। ঠিক এই কারণেই তোর মা চায়নি কোনোভাবে তুই জানতে পারিস যে তুই আমাদের ছেলে না। যেকোনো মূল্যেই হোক সে এই কথাটা গোপন রেখেছে। ও বোকা ঠিকই…না বুঝে অনেক ভুল করে ফেলে। কিন্তু ওর ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই।”

“বাবা, আমি জানি। এসব কথা কি তোমার বলতে হবে? আমার মাকে আমি চিনি না? কিন্তু ওরাই বা কেন এমনটা করতে গেল?”

“কারণ ওরা ভেবেছিল এসব করে তোর আর তোর মায়ের সম্পর্কটা খারাপ করে দেবে। তারপর একদিন না একদিন সব জেনে তুই ওদের কাছে ফিরে গেলেও যেতে পারিস। আর আলটিমেটলি ওরা কিছুটা সাকসেসফুল হয়েছে। তোর আর তোর মায়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। ইভেন তুই ইদানীং তোর মাকে দেখানোর জন্য ড্রিংকও করছিস।”

“সরি বাবা। আমি এক্ষুনি মায়ের কাছে গিয়ে সব ঠিক করে দিচ্ছি, তুমি জাস্ট দেখো।”

“দাঁড়া, আমি কথা শেষ করে নিই। তারপর যা।”

“আচ্ছা বলো।”

“তখন জিজ্ঞেস করলি না, দিতিয়া ওদের কে হয়?”

“ও…হ্যাঁ।”

“দিতিয়া ওদের কেউই হয় না। ও একটা অসহায় মেয়ে যাকে শুধুমাত্র ইউজ করেছে শ্যামা-সিফাত। আর দিতিয়ার চাচাও নাকি অনেক টাকা খেয়েছে ওদের কাছ থেকে।”

“সেকি!”

“হ্যাঁ। নীরব একটা অনুরোধ করছি। যা হয়েছে তাতে দিতিয়ার কোনো দোষ নেই। ওকে কষ্ট দিস না, খুব লক্ষ্মী একটা মেয়ে। জানি তোর মানতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু তুই কেন, আমিই তো এখনো ভাবতে পারি না মানসী আর বউ হয়ে আসবে না এ বাড়িতে। কিন্তু যেভাবেই হোক, কপালে যা ছিল তা হয়ে গেছে। এবার তো আমাদের সবকিছু মেনে নেয়া উচিৎ।”

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,

“মেনে তো নিয়েছি বাবা।”

“নাহ, তুই মেনে নিতে পারিসনি। মেনে নিলে তোর আর দিতিয়ার সম্পর্কটা স্বাভাবিক হতো।”

“আমাদের সম্পর্ক তো স্বাভাবিকই বাবা।”

“তাহলে মেয়েটার মুখে হাসি নেই কেন?”

“সেটা আমি কী করে বলব? ও বোধহয় হাসে কম।”

আমার এ কথায় বাবা হো হো করে হেসে দিল। বলল,

“ভালো বলেছিস। কিন্তু বাবা, বিয়ে যখন করেই ফেলেছিস তখন বউয়ের প্রতি কিছু দায়িত্বও তো পালন করতে হবে।”

“বিয়ে তো মানসীকেও করেছিলাম বাবা। কিন্তু কোনো দায়িত্বই পালন করতে পারিনি।”

“সেটা তো তোর মায়ের জন্য।”

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,

“বাবা, বাদ দাও না। চলো মায়ের কাছে যাই।”

বাবাও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“হ্যাঁ, চল।”

বাবা-মায়ের ঘরের সামনে যেতেই বাবা বলল,

“আমি যাব না…তুই যা।”

আমি ঘরে ঢুকে দেখি মা জানালায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ডাকলাম,

“মা।”

মা বোধহয় কাঁদছিল। লুকিয়ে চোখ মুছে পেছনে ফিরলো। আমি মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের একটা হাত ধরে বললাম,

“মা আমাকে মাফ করে দাও। আমি সব না জেনে না বুঝে এতদিন তোমার সাথে অভিমান করেছিলাম। প্লিজ মা আমাকে মাফ করো। আমি তোমাকে ছেড়ে কোনোদিনও কোথাও যাব না। আমার একটাই মা। আমি এতদিন জেনে এসেছি তুমিই আমাকে জন্ম দিয়েছ, তুমিই আমাকে মানুষ করেছ। তুমিই আমার সব। আজীবন তাই জানব। তাই বিশ্বাস করব।”

মা কিছুই বলতে পারল না। কেঁদে বুক ভাসাতে লাগল। আমি মাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রইলাম। কাঁদুক একটু। এই কান্নার সাথে সাথে সব কষ্ট ধুয়ে যাক।

নীরব ইশতিয়াক
২৩ এপ্রিল, ২০১৬
·
·
·
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp