!!১০!!
সূর্য মাথার উপর স্থির। রোদের তাপ বেশি না। হালকা শীতল হাওয়া বইছে। এখন দুপুরবেলা। কলেজের পাশেই কফিশপের এক কোণায় আশবিন বসে আছে। হালকা নীল রঙের শার্ট পরে আছে সে। শার্টের হাতা সুন্দর করে ভাজ করে কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রেখেছে। চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ানও। বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছে সে। বসে আছে কারো জন্য। বিশেষ মানুষের অপেক্ষায়। কফিশপে সে ছাড়াও অনেকে এসেছে আড্ডা দিতে। পুরুষের তুলনায় আজ মেয়েই বেশি। অদ্ভুত স্বভাবের মেয়েগুলো। তারা আড়চোখে আশবিনকে দেখছে লুকিয়ে লুকিয়ে। আবার মিটিমিটি করে হাসছে। কী আশ্চর্য! আবার কথাও বলা হচ্ছে ফিসফিস করে।
দক্ষিণ দিকে একটা টেবিলে চারজন মেয়ে বসে আছে। অনেকক্ষণ যাবৎ আশবিনকে চোখ দিয়ে গিলছে তারা। তাদের মধ্যে প্রথমজন তানজিলা বলল, ‘ছেলেটা দারুণ। উফফ! ও যদি আমার বয়ফ্রেন্ড হত। তাহলে তো আমি পাগলই হয়ে যেতাম।’
দ্বিতীয়জন তিথি ঈষৎ রাগী গলায় বলে ওঠল, ‘ওতো হ্যান্ডসাম ছেলে। তোকে পাত্তা দিবে কেন? তুই তো ওর নখের যোগ্যও না।’
তানজিলা কর্কশ গলায় হিসহিসিয়ে বলল, ‘বেশি বেশি বলছিস।’ তিথি তার কথার ধার ধরে না। তিথি তখন মাওরার হাতটা চেপে ধরে বলল, ‘মাওরা, তুই একবার চেষ্টা কর। এখানে সবার চেয়ে তুই বেশি সুন্দরী। ছেলেটা তোকে কিছুতেই মানা করতে পারবে না। তাছাড়া ছেলেটা লম্বা, সুঠামদেহ, সুদর্শন আর কী চাই? তোর সাথে দারুণ মানাবে।’
মাওরা লজ্জিত ভাবে হাসল। ঘাড় ঘুরিয়ে আরও একবার আশবিনকে দেখল সে। তারপর নরম গলায় বলল, ‘আমি ওর কাছে যাব। একটা চিরকুটে আমার নম্বর লিখে দে। তাকে দেবো।’
তন্বী চটপট একটা কাগজে মাওরার নম্বর লিখে দেয়। মাওরা চিরকুটটা দুভাজ করে উঠে দাঁড়ায়। মাওরা ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে আছে। সে দ্রুত জামাটা ঠিক করে। তারপর গলার দিক থেকে কাপড় কাঁধ পর্যন্ত নামিয়ে। হাই হিলের ঠুকঠুক শব্দ তুলে এগিয়ে গেল। মাওরা, আশবিনের ঠিক পাশে দাঁড়ায়। মনে হল সম্ভব হলে, সে গিয়ে তার কোলে বসত। মাওরা হাসিমুখে মিষ্টি কণ্ঠে বলল, ‘হাই, হ্যান্ডসাম। আই’ম্ মলি। এন্ড ইউ?’’
আশবিন জবাব দিলো না। সে গম্ভীর। মাওরা লম্বা শ্বাস টেনে তারপর ফেলল। কণ্ঠস্বর কোমল করে বলল, ‘আমার দেখা সকল পুরুষের মধ্যে তুমি সবচেয়ে সুন্দর। দিস ইজ ফর ইউ।’
মাওরা চিরকুটটা টেবিলের ওপর রেখে চলে গেল। মাওরা ওর বন্ধুদের পাশে গিয়ে বসল। টেবিলের ওপর খানিকটা ঝুঁকে মৃদুস্বরে বলল, ‘চিরকুট দিয়েছি। এইবার শুধু কল আসার অপেক্ষা। উফফ! আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। অনেক এক্সাইটেড লাগছে।’
তিথি হঠাৎ মাওরার হাতটা চেপে ধরে। বলল, ‘আজকেই কল করবে। ধৈর্য ধর। সবুরে কিন্তু মেওয়া ফলে।’
মাওরা মুচকি হেসে মাথা নাড়ল।
আশবিন কাগজটার দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাত দিয়ে কাগজটা ছুড়ে ফেলল নিচে। আশবিন গভীর শ্বাস ছাড়ে। টেবিলের ওপরে থাকা কফি কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে তখনও। আশবিন ওয়েটারকে ডেকে বলল, ‘এক্সকিউজ মি! আমি যখন বলব তখন একটা কোল্ড কফি আরেকটা ব্ল্যাক কফি দিবে। এখন এই কাপটি নিয়ে যাও।’
ওয়েটার মাথা কাত করে। আশবিন বিষণ্ণ চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে। তার চোখে কেবল অপেক্ষা।
ক্লাস শেষে ইভা ছুটে গেল চারুর কাছে। চারু ব্যাগ গোছাচ্ছে। ইভা তার সামনের বেঞ্চে বসে। ধীরে ধীরে বলল, ‘চারু।’
‘হু।’
‘আশবিন ভাইয়া খবর পাঠিয়েছেন। উনি তোর জন্য কফিশপে বসে অপেক্ষা করবেন।’
চারু ঝাঁঝাল গলায় বলল, ‘বসে বসে অপেক্ষা করতে কে বলেছে? শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করুক। কারো কোনো সমস্যা নেই।’
‘উঃ চারু, আশবিন ভাইয়া তোকে ওইখানে যেতে বলেছেন।’
চারু অকপটে জবাব দিলো, ‘আমি যাবো না।’
‘তুই এমন করছিস কেন? আমরা সবাই জানি, আশবিন ভাইয়া তোকে অসম্ভব ভালোবাসে। তারপরও তুই সব সময় উনাকে ইগনোর করিস।’
ইভা হঠাৎ ইলমার হাতে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘তুই চুপ করে আছিস কেন? তুইও কিছু বল।’
ইলমা দ্রুত মাথা নাড়ল। হড়বড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে। চারু ডেফিনিটলি তোর যাওয়া উচিত। প্লিজ চলে যা। তুই না গেলে ভাইয়া আমাদের গলা টিপে ধরবে।’
তাদের মুখে একপ্রকার চাপা ভয়। চারু ঠোঁট টিপে হাসল। ইভা ফের বলল, ‘ভাইয়া বলেছেন, তোর সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’
‘কি কথা?’
‘আমরা জানি না।’
চারু মৃদুস্বরে বলল, ‘ঠিক আছে। যাচ্ছি।’
চারু এল। আশবিনকে দেখে সে হেঁটে তার দিকে এগিয়ে গেল। আশবিনের সামনের চেয়ারটায় বসল চারু। আশবিন মুচকি হাসল। হাতের ইশারায় ওয়েটারকে কফি আনতে বলল। চারু ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, ‘আমাকে ডেকেছেন কেন?’
‘কথা আছে।’
‘কী কথা? তাড়াতাড়ি বলুন।’
‘সময় হলেই জানতে পারবা।’
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে এল। টেবিলের ওপর রেখে সে চলে গেল। চারু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে। হুট করে বলে ওঠল, ‘আপনি কী ওইসব ছেলেদের মত যারা মেয়েদের ইমপ্রেস করার জন্য ব্ল্যাক কফি খায়?’
আশবিন ভ্রু কুঞ্চিত করলো। একপলক তাকালো। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। শক্ত গলায় বলল, ‘তুমি ইমপ্রেস হচ্ছ? তাতেই হবে।’
চারু বিশাল বড় ধাক্কা খেল যেন। তার প্রশ্নে তাকেই পেচিয়ে দিয়েছে আশবিন। বেশ চালাক৷ চারু আশবিনের দিকে তাকিয়ে। চেয়ার ঠেলে উঠতে নিলো। আশবিন গম্ভীর গলায় বলল, ‘বোসো। কথা আছে।’
‘আমার কোনো কথা নেই।’
‘আমার আছে। আমার অনুমতি ছাড়া তুমি এখান থেকে একপা ও কোথাও যেতে পারবে না।’ গম্ভীর গলায় বলল সে।
আশবিনের কথায় কিছুটা দমল চারু। সে আড়চোখে চারদিক লক্ষ করে। আশেপাশের মেয়েগুলো কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকেই দেখছে। চারু এবার আশবিনের দিকে তাকায়। মেয়েগুলোর অদ্ভুত চাহনির কারণ এখন বুঝতে পারে সে। চারু কিঞ্চিৎ রাগী গলায় বলল, ‘আপনি এত সেজেগুজে আসছেন কেন?’
‘কেন? হিংসে হচ্ছে?’
চারু রাগে দাঁত কটমট করছে। এই লোকটা কোনো প্রশ্নের উত্তর সোজাসাপটা দিতেই জানে না। প্রশ্নের জবাবে আরেকটা প্রশ্ন করতেই যেন মজা পান। এই সময় মাওরার বন্ধু তন্বী এল। চারু তার দিকে তাকিয়ে। তন্বী একবার চারু আরেকবার আশবিনকে দেখে। সে বলল, ‘উনি কে? আপনার সঙ্গে কী করছে?’
আশবিনের রাগ হল। সে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। এইগুলোর কী আত্মসম্মান নেই? এদের বুদ্ধি কি হাঁটুতে? এদের ভেতর থেকে লাজলজ্জা যেন উঠে গেছে। আশবিন তাকালো। উচ্চ গলায় বলল, ‘মাই ওয়াইফ মিসেস চারুলতা শিকদার।’
তন্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে আশবিনকে দেখে, চারুর দিকে তাকায়। আশবিন বিরক্ত গলায় বলল, ‘ক্যান ইউ গো নাউ?’
তন্বী মন খারাপ করে। মাথা নিচু করে চলে গেল। চারু রাগে ফোঁস ফোঁস করে উঠল। ‘আমি আপনার ওয়াইফ?’
‘হু।’
‘হইনি।’
‘হবা।’
‘কখনও না। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’
আশবিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘তোমার বিয়ে যতই ঠিক হোক; বিয়ে তোমার আমার সাথেই হবে।’
চারু রাগ করেছে। আশবিন নরম গলায় বলল, ‘আমার বাবা যে বিয়ে এনেছে, তাতে তুমি রাজি?’
চারু ভ্রু কুঁচকাল। বিস্মিত গলায় বলল, ‘আপনার বাবা?’
আশবিন মাথা নাড়ল। ‘গাজীপুর জেলা মন্ত্রী শাজান শিকদার। আমার বাবা। যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সে আমার বড় এবং সৎভাই আফনান শিকদার।’
চারু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল। কি হচ্ছে এসব? কি বলছে আশবিন? কিছুই বুঝতে পারছে না সে। আশবিন লম্বা শ্বাস টেনে তারপর সব তাকে বলে দিলো। তার জীবন কাহিনি শুনাল, আফনান তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছে। তার পেছনের কারণ বলল। চারু নির্বাক তাকিয়ে আছে।
আশবিন জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার সাথে আফনানের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল?’
‘কলেজের বাইরে।’
‘কিভাবে?’
‘ওইদিন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রায় এক সপ্তাহ আগের কথা। আমি আর আমার বন্ধুরা রাস্তার পাশে দোকানের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন একটা গাড়ি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ির ভেতরে আফনান ছিলেন। উনি আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিবেন বলেন। আমি প্রথমে রাজি হইনি৷ কারণ তাকে আমরা কেউই চিনি না। বৃষ্টিতে ভিজতে ঠান্ডা লাগবে, জ্বর আসবে। এসব বলে তারা। তাই। ওদের জোরাজুরিতে রাজি হই। তারপর উনি আমাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। তারপরেই বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। আর বাবাও রাজি হয়ে যায়।’
আশবিন চারুর চোখে চোখ রেখে। শুধাল, ‘তুমি রাজি?’
চারু ভারী নিঃশ্বাস ফেললো। ডানে বামে মাথা নেড়ে না বুঝাল। আশবিন ফের জিজ্ঞেস করলো, ‘বিয়ে করবে আমায়?’ কথাটুকু বলে চারুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল আশবিন। সে কী চায়? সেটা আগে বুঝতে হবে।
চারু বলল, ‘আমার বাবার কথার বিরুদ্ধে আমি যেতে পারব না। আমার বাবা রাজি হলে আমিও রাজি।’
আশবিন রাগান্বিত গলায় বলল, ‘তোমার ওই বাপ যদি বলে পানিতে ঝাপ দিতে। তুমি দিবে?’
চারু মাথা নাড়ল।
আশবিন রাগ চেপে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর বলল, ‘বাসায় যাও। আজই তোমার হিটলার বাপের সাথে কথা বলব।’
চারু চুপচাপ উঠে চলে গেল।
আশবিন কফিশপ থেকে বের হবার আগ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। আশবিন হেঁটে হেঁটে তার বাইকের সামনে দাঁড়াল। সে মূহুর্তে গাড়ি থেকে নামে আফনান। দুজনেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আফনানের সাথে আরও তিনজন পুরুষ লোক দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে ফরেনারের মতো লাগছে। আশবিন চোয়াল শক্ত করলো। চোখে রাগ, দাঁত কটমট করে উঠল নিজের অজান্তেই। আফনান তাকে দেখে মৃদু হাসল। দুহাত প্যান্টের পকেটে গুজে রেখেই এগিয়ে এল। চোখের সানগ্লাসটির জন্য চোখে চোখ পড়ল না। আফনান বলল, ‘ইশশ, তোকে দেখলে আমার খুব মায়া হয়। কেমন সব হারিয়ে পথের ফকির হয়ে গেছিস।’
আশবিন রাগান্বিত গলায় বলল, ‘তোর মায়ার ধারধারি না আমি।’
আফনান ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। ‘রাস্তায় থেকেও তেজ কমেনি’
‘আমি তো এমনই থাকব। তেজওয়ালা।’
আফনান বলল, ’আমি আসবো তাই এখানে আগেই চলে আসছিস?’
আশবিন হাসল। ‘নাহ। তোর জন্য না। আমার বউয়ের জন্য এসেছিলাম। দেখাও করেছি।’
‘তোর বউ এখানে থাকে বুঝি?’
‘মেম্বারের বাড়িতে জায়গার কম পড়ছে নাকি যে এখানে থাকবে?
আফনান রাগান্বিত গলায় বলে ওঠল, ‘চারু আমার হবু বউ।’
‘চারু শুধু আমার। আমার বউ সে। ছোট ভাইয়ের বউকে হবু বউ বলতে লজ্জা করে না? মানুষ শুনলে ছিহঃ ছিহঃ করবে তো।’
আফনান রাগের মাথায় হুট করে আশবিনের শার্টের কলার চেপে ধরলো। আশবিন খুব শান্ত ভাবে তার হাতটা সরিয়ে ফেললো। তারপর বলল, ‘আমি এখন আর ছোট নই। আমি কি করতে পারি? তোর ধারণাও নাই। আর শোন, তোর শরীরে যে রক্ত বইছে, আমার শরীরেও সেই একই রক্ত বইছে। রক্ত গরম আমারও হয়। তখন সব একসাথে এলেও সামাল দিতে পারবি না।’
আশবিন বাইকে উঠে চলে গেল।
·
·
·
চলবে.........................................................................