কৌশিক অনন্যার কোনো কথা শুনলো না। ওর নিজের ভেতরেই শব্দহীন, তবে তীব্র লড়াই চলছিল। অনন্যাকে পাঁচ মিনিট সময় দিলো কৌশিক। পাঁচ মিনিটের মধ্যে যা যা দরকার অনন্যাকে গুছিয়ে নিতে হলো। ততক্ষণে কৌশিকের সারা ফ্ল্যাটে ঘোরাঘুরি শেষ। ফ্ল্যাটটা গোছানোই। হাতে গোনা কয়েকটা ছবি লিভিং রুমে চোখে পড়লো কৌশিকের। তাই মনোযোগ দিয়ে চোখের অক্ষিপটে ঢুকিয়ে নিলো সে। অনন্যার রুমটা অতো ভালো করে খেয়াল করা হয়নি। এর আগেই মেয়েটা গুছিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কৌশিক হাত ভাঁজ করে একবার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত অনন্যাকে পরখ করে নিলো। অনন্যা সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে ফেললো। লোকটার দৃষ্টিপট থেকে সরে এলো সে।
অনন্যা যাওয়ার সময়েও বলছিলো সে যেতে চায় না। কিন্তু কৌশিক মুখ দিয়ে টু শব্দটি করলো না। এই বাড়িতে দুজনের দরকারি কাজ শেষ হলে সজোরে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিলো কৌশিক। অনন্যাকে নিয়ে নিচে নেমে আসলো সে। অনন্যা প্রথমেও বিষয়টা অমান্য করতে চেয়েছিল। উনার সাথে আসতে চাইছিল না। প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল সে কিন্তু কৌশিক স্যারের কঠোরতা দেখে সে আর কথা বাড়াতে পারলো না।
নিচে নেমে গাড়ির দরজা খুলে অনন্যাকে পেছনের সিটে বসিয়ে দিলো কৌশিক। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই গাড়ির দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলো নুহাশ। ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে তাকিয়েই আকাশ থেকে পড়লো। ভাই আবারও মেয়েটাকে নিয়ে ফিরে এসেছে!
কৌশিক এসে সামনের সিটে বসলো। চোখ ঘুরিয়ে এক ঝলক তাকালো নুহাশের দিকে। নির্দেশের সুরে বলে উঠলো,
"বাড়ি চল।"
নুহাশ কিছুক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। কিন্তু তারপর ও ভাইয়ের চাহনির তাড়ায় স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো সে। চারপাশে গভীর রাত নেমে এসেছে। কিন্তু গাড়ির ভেতরে আরও ঘন অন্ধকার জমে আছে। কৌশিকের ফোনে মেহজাবিন বেগম ফোন করছে। কৌশিক ফোন তুলে জানালো বাসায় আসছে। কৌশিকের সোজাসুজি উত্তরে এবার মেহজাবিন বেগম ও চমকে উঠলেন।
অনন্যা হাত ভাঁজ করে বসে আছে। চোখ তার স্থির হয়ে আছে কেবল কৌশিক স্যারের দিকেই। যদিও সামনের সিটে বসা মানুষটাকে সরাসরি দেখা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু স্যারের প্রতিচ্ছবিটা ঠিকই ধরা পড়ছে সামনের আয়নায়। সেই প্রতিচ্ছবিতেই আটকে গেছে অনন্যার দৃষ্টি। আর মনে মনে একশোটা প্রশ্ন ভিড় করছে।
এই মাঝরাতের গাড়ি যাত্রায়, নীরব পথে আচমকাই গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে উঠলো। কৌশিক উপরের সানগ্লাস হোল্ডারের দিকে তাকিয়ে নিঃসাড় গলায় বললো,
"স্ট্রেস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।"
শব্দগুলো এতটা গভীর ছিল কিন্তু অনায়াসে উচ্চারিত যে অনন্যা পিলে চমকে উঠলো।বুকে ধ্বক করে আওয়াজ হলো। তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নিল সে।
নুহাশ ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
"কে স্ট্রেস নিচ্ছে?"
কৌশিক কোনো উত্তর করলো না। জানালার বাইরে চোখ ফেরাল। অনন্যাও ততক্ষণে ডান পাশের জানালার দিকে সরে বসছে। কেউ না বুঝুক সে তো বুঝেছে এই কথা কার জন্য ছিল। অনন্যা শ্বাস ফেলে বাইরের অন্ধকার রাস্তাগুলোর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো ।
রাস্তায় তাকিয়ে থেকেই স্বল্প স্বরে বিরবির করে বললো,
"লোকটা মারাত্মক ভয়ংকর।"
বিরবির করে বললেও কেবল বাতাসই তা শুনলো। উঁহু না! কৌশিকের ঠোঁটে একপাশে টেনে ওঠা হালকা হাসিটা প্রমাণ করে দিলো সেও শুনেছে ঠিকই।
গাড়ি থামতেই কৌশিক চুপচাপ দরজা খুলে বাইরে নেমে এল। চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো অভিজাত এক আবাসিক এলাকার দৃশ্য। সাজানো গোছানো ছিমছাম পথ, গেটের ভেতর উঁচু পাঁচিল ঘেরা বিল্ডিং, আর সামনে সারি সারি ফুলের টব। সবকিছুই দেখে বোঝা যাচ্ছে এবারেও ভালোই প্রভাবশালী ব্যক্তি উনি। অনন্যা চুপচাপ চারপাশটা নিরীক্ষণ করছিল। মনোযোগ দিয়ে দেখলো বিল্ডিংটা। দূর থেকেও দেখা গেলো বিল্ডিংয়ের দুই তলার বেলকনিতে একজনের উপস্থিতি। বেলকনিতে প্রজ্বলিত হলুদ আলো মানুষের উপস্থিতিটা আরো ভালোমতোই বুঝিয়ে দিচ্ছে। অনন্যার ধ্যান ভাঙল কৌশিক স্যার এগিয়ে এসে গাড়ির পেছনের দরজা খোলার ফলে। আবারো অনন্যার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। এবার ও অনন্যাকে নামতে সাহায্য করলো।
অনন্যা কৌশিকের পাশে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বললো,
"আমি নিজেই নামতে পারতাম।"
"বিশ্বাস নেই।"
অনন্যা বিস্মিত হয়ে বললো,
"হ্যাঁ? তো সারাক্ষণ কী এভাবে পাশে পাশে ঘুরবেন? আর ধরে ধরে নিয়ে যাবেন?"
কৌশিক দাঁড়িয়ে গেলো। অনন্যার দিকে ঘুরে একবার দৃষ্টি স্থির করলো। অতঃপর কিছু না বলেই ভিতরে চলে গেল। অনন্যা ভেংচি কেটে তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। নুহাশ ও এসে পড়েছে ইতিমধ্যে।
নুহাশ অনন্যার পাশে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো,
"নামটাই জিজ্ঞেস করা হলো না। "
অনন্যা মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
"অনন্যা। আপনার নাম কি?"
"নুহাশ ইফতেখার।"
"ওহ! স্যারের ছোট ভাইও যে আছে আজ জানতে পারলাম।"
নুহাশ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো,
"আর তোমার স্যারের যে এতো মিষ্টি স্টুডেন্ট আছে সেটাও আমি আজ জানতে পারলাম।"
অনন্যা জোরে হেসে উঠলো। নুহাশের কথাবার্তা ওর কাছে বাচ্চামো মনে হলো। অনন্যার হাসি দেখে নুহাশ ও হেসে ফেললো। আরেকটু হাসাতেই বললো,
"আগে জানলে তোমাদের ভার্সিটিতেই এডমিশন নিতাম। তাহলে আগেই আমাদের দেখা হতো! "
অনন্যা নুহাশের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বললো,
"অনেক তেল মারা হয়ে যাচ্ছে।"
নুহাশ, অনন্যা ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো কৌশিক হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। নুহাশ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো। কৌশিক ওর কান টেনে ধরে বললো,
"কোথায় পালাচ্ছিস , ছাগল? তোর সাথে আমার কথা আছে।"
নুহাশ তুতলিয়ে বললো,
"কককিইই কথা?"
"তুই কি করেছিস তা তো শুনলামই।"
মেহজাবিন বেগম সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে দাঁড়ালেন।চোখ পড়ে গেলো অনন্যার দিকে। বাড়িতে একটা অচেনা মেয়ের আগমন দেখে বেশ অবাকই হলেন তিনি। কৌশিককে এই বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করার আগেই ছেলেটা ভাইয়ের পূর্বের করা আচরণ নিয়ে মেতে উঠেছে। তাই আপাতত তিনি বিষয়টি নিয়ে কিছু বললেন না।
নুহাশ কান থেকে ভাইয়ের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। মুখে বললো,
"লাগছে , ভাই। ছাড়ো। আচ্ছা আমি শুধু এটাই বলেছিলাম যে তোমাকে গাড়ি করে নিয়ে আসতে হলে আমাকে কিছু টাকা দিতে হবে।"
"হু,হু! তোর ফাতরামির শেষ নেই। এর জন্যই বলছিলি চলো ঘুরে আসি? "
কৌশিক মেহজাবিন বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
"মা! আমি নিজেই আসতে পারতাম। তুমি শুধু শুধুই ফাজিলটাকে পাঠিয়েছ।"
মেহজাবিন বেগম হেসে উত্তর দিলেন,
"কি আর করবো বল! তোকে নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তায় থাকি যে।"
কৌশিক এগিয়ে এসে বললো,
"ডোন্ট ওরি। আমি নিজের খেয়াল রাখার জন্য যথেষ্ট বড় হয়েছি। তাই কোনো চিন্তা করবে না, প্লিজ।"
মেহজাবিন বেগম নরম গলায় মাথা নাড়লেন। ঠোঁটে ঠান্ডা সৌজন্যের রেখা টেনে রাখলেন তিনি। ধীরে ধীরে চোখ ঘুরিয়ে অনন্যার দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টির ওজনে অনন্যা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কৌশিক ও মায়ের চোখ অনুসরণ করে সেদিকে দৃষ্টিপাত করলো। অনন্যা লজ্জায় পড়ে গেছে। মাথা নামিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করলো সে। হুট করে অন্য কারো বাড়ি বিনা ডাকে চলে এসেছে। অচেনা বাড়ি, অচেনা পরিবেশ এবং স্যারের মায়ের সামনে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে সে ঠিক কীভাবে আচরণ করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।
কৌশিক মায়ের দৃষ্টিভঙ্গি আঁচ করতে পেরে নিজেই ব্যাখ্যা দিলো,
"আমার স্টুডেন্ট। শরীরটা খুব খারাপ ছিল বলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ওর বাড়ির লোকজন বাইরে থাকে বুঝলে? খেয়াল রাখার জন্য কেউ ছিল না। তাই নিয়ে এলাম আমাদের বাড়িতে।"
মেহজাবিন বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখে-মুখে একরাশ বিস্ময় ছাপিয়ে একটা অপার শান্ত থাকার অভিনয় ফুটিয়ে তুললেন তিনি। কিছু বলার ছিল তবে বলতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করলেন। ছেলের সামনে কখনো নিজের মনের বিরক্তি প্রকাশ করতে শেখেননি তিনি।
হালকা হাসি এনে বললেন,
"হুম, ঠিক আছে। আজকের রাতটাই তো। গেস্ট রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিবো আমি।"
কৌশিক ঠান্ডা গলায় স্পষ্টভাবে বলল,
"আজকের রাত না, মা। অনন্যার ফ্যামিলি যতদিন না ফিরছে, ও ততদিন এখানেই থাকবে।"
এইবার মেহজাবিন বেগমের মুখের হাসি নড়বড় হলো।তার চোখে অস্থিরতা ফুটে উঠলো। কপালে গভীর ভাঁজ পড়লো।
কৌশিক মাকে আলতো করে ধরে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। নীরব ঘরের আবহে মায়ের মুখের দুই পাশে হাত রাখল সে।
চোখে একরাশ দায়িত্ববোধ নিয়ে বলল,
"মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা, মা। একা একা থাকা ওর পক্ষে এখন অসম্ভব। কী কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তুমি একজন মেয়ে হয়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারো? তাই বলছি, যতদিন না ওর পরিবার ফিরে আসে প্লিজ এখানে থাকুক। আমি নিজে ওর বিষয়টা দেখবো। "
মেহজাবিন বেগম ছেলের চোখে চোখ রাখলেন। কোনো প্রশ্ন করলেন না। অন্তরে সন্দেহ খেলে গেলেও উপরে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করলেন না। শুধু চুপচাপ সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। কৌশিক বেশ খুশি হলো। মাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে আসলো। কিন্তু মেহজাবিন বেগম শকে রয়েছেন। অপরিচিত একটা মেয়েকে হুট করেই কৌশিক বাসায় নিয়ে এসেছে এটাই তাকে ঘাটাচ্ছে বেশি। ওনার জানামতে পূর্বের কৌশিক কখনো নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে কোনো চিন্তা করতো না। যতোই কষ্টে থাক না কেউ মায়ের অনুমতি ছাড়া কৌশিক একটা কাজ ও করতো না। আর এদিকে একটা মেয়েকে নিজের ইচ্ছেতেই বাড়িতে নিয়ে এসেছে। একবার ওনাকে জিজ্ঞেস করার ও প্রয়োজন বোধ করলো না? সত্যি বিষয়টা মনে দাগ কেটে গেলো মেহজাবিন বেগমের। নুহাশ নিজের ইচ্ছেমতো যা মন চায় করে বেড়াতো। কিন্তু কৌশিক ছিল ভিন্ন। একদম মায়ের আদর্শ পুত্র ছিল সে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই কথাটার বিরুদ্ধে কাজ করে ফেলছে কৌশিক। প্রথমে অনাকাঙ্ক্ষিত চাকরি, তারপর এই মেয়ে।
নুহাশ অনন্যাকে সোফায় বসতে দিয়েছে। কাজের মেয়েটাকে চা আনতে বলে দিয়েছে। অনন্যা নিজের ব্যাগটা পাশে রেখে শান্ত হয়ে বসে আছে। কৌশিক স্যারের মা দেখতে বেশ সুন্দর, পরিপাটি এবং আধুনিক ধাঁচের মহিলা। শরীরে দামী শাড়ি। মুখমন্ডলে হালকা মেকআপের ছোঁয়া। কিন্তু অনন্যা বুঝতে পারছে মেহজাবিন বেগম অনন্যাকে পছন্দ করেনি।এই বাসায় অনন্যার থাকা উনার পছন্দ হয়নি। এটা স্বাভাবিক ই।কার ভালো লাগবে একটা অপরিচিত মেয়েকে নিজের বাড়িতে থাকতে দিতে আর নিজেদের প্রাইভেসি নষ্ট করতে? এটাই হয়েছে ওনার সাথে অনন্যা বুঝতে পারছে। কিন্তু ওর এখন কি করা উচিত এটাই বুঝে উঠতে পারছে না। এখান থেকে কি চলে যাওয়া উচিত নাকি কৌশিক স্যারের কথায় উনাদের সাথে এখানে থাকা উচিত? দেখতে দেখতে কাজের মেয়ে রুম্পা চা নিয়ে আসলো। ততক্ষণে কৌশিক স্যার ও ফিরে এসেছেন।
অনন্যার পাশে বসে নরম গলায়ই শুধালেন,
"তোমার ফ্যামিলি কোথায় থাকে?"
"কানাডা!"
অনন্যা আস্তে করে উত্তর দিলো।
কৌশিক চায়ের কাপ হাতে তুলে জিজ্ঞেস করলো,
"তোমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে ওনাদের আইডিয়া আছে?"
অনন্যা মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হ্যাঁ! এই বিষয়টা আমার ফ্যামিলির মধ্যে মা, বাবা, ভাই ওরা সবাই জানে।"
"আর তোমার বেস্টিও জানে নিশ্চয়ই!'
অনন্যা চোখ ঘুরিয়ে তাকালো কৌশিকের দিকে। মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হু জানে।"
নুহাশ দুজনের কথা শুনছিলো। আচমকাই বলে উঠলো,
"সবকিছুই বুঝলাম কিন্তু তোমার হাসবেন্ড! সে কোথায়?"
অনন্যা চমকে উঠলো। কৌশিকের দিকে তাকালো সে। কৌশিক ও অনন্যার দিকে তাকিয়ে ফেললো। দুজনের চোখের পলক বেশ অনেকক্ষণ পড়লো না। নুহাশ ও দু'জনের এমন তাকিয়ে থাকাতে সন্দেহের ঘেরাটোপে বেঁধে গেল। তখনই মেহজাবিন বেগম লিভিং রুমে আসলেন। জোর গলায় বললেন,
"নুহাশ! কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে এভাবে প্রশ্ন করে? হতেই পারে মেয়েটার স্বামী ওকে ছেড়ে চলে গেছে অথবা অন্য কিছু! এগুলো কি মেয়েরা মুখ খুলে সবাইকে বলতে পারে?"
ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো নুহাশ।
অনন্যা মেহজাবিন বেগমের গলা শুনেই কৌশিক স্যারের তীক্ষ্ণ বাদামী মণি হতে চোখ সরিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু মেহজাবিন বেগমের কথাগুলো সবচেয়ে বেশি হৃদয়ে লাগলো ওর। অনন্যার বুকের গভীরে কিছু একটা তছনছ হয়ে ভেঙে পড়লো। সত্যিই তো অনন্যার প্রিন্স ওকে ছেড়ে চলে গেছে। আর কখনোই আসবেন তিনি। এই সত্যিটা মেনেই ওকে বাকিটা জীবন বেঁচে থাকতে হবে। এ বিষয়টি ভুলে অনন্যা বাস্তবতাকে মেনে নিতে চাইছে, পাশের মানুষটিকে ওর প্রিয় মানুষ ভাবতে চাইছে। কিন্তু কেনো দুনিয়া বারবার ওর সাথে খেলা খেলছে? কেনো বারবার মনে হয় আগের সেই মানুষটা কাছেই আছে? আবার মনে হয় সে নেই। কেনো বারবার মনে হয় ও আবারো সেই প্রিয় মানুষটিকে ফিরে পেতে চলেছে? কিন্তু বারবার ধোঁকা খেয়ে যাচ্ছে।
অনন্যার চোখ দুটো ছলছলিয়ে উঠলো। কিন্তু চোখ দুটো হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার পূর্বেই কৌশিক মুখ খুললো।
"মা! কি বলছো এগুলো? এভাবে বলা কি উচিত হলো?"
মেহজাবিন বেগম কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলেন,
"আমি আবার কী বললাম? যাই হোক, চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, মেয়ে। নাহলে ফেলে দিতে হবে। আমরা আবার ঠান্ডা চাকে বিষ মনে করি। তাই অপচয় করো না।"
অনন্যা কাঁপা কাঁপা হাতে দ্রুত সৌখিন ডিজাইনের চায়ের কাপটা হাতে নিলো। মাথা নুইয়ে চায়ে চুমুক দিলো সে। মেহজাবিন বেগম কৌশিককে কথা বাড়াতে দিলেন না। ছেলেটা মুখ খোলার পূর্বেই তিনি বলে উঠলেন,
"ইশু! রুমে যা! সারাদিন কাজ করে এসেছিস। নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড? যা রুমে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে আয়। ডিনার করবি।"
কৌশিক মাথা হেলিয়ে বাধ্য ছেলের মতো উঠে দাঁড়ালো। সিঁড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
"রুম্পাকে বোলো উপরের তলার গেস্ট রুমে অনন্যাকে পৌঁছে দিতে।"
মেহজাবিন বেগম নীরবে এসে নুহাশের পাশে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হালকা ধমক দিয়ে ছোট ছেলেকে উপরে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। নুহাশ বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে ভাইয়ের পিছু ধরলো। বিরবির করে উচ্চারণ করলো,
"সবাই শুধু আমার পিছেই কেনো পড়ে থাকে?"
ঘরে এখন শুধুই নীরবতা। মেহজাবিন বেগম হাত ভাঁজ করে অনন্যার ঠিক বিপরীতে বসে আছেন। ওনার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে অনন্যার চোখে-মুখে। অনন্যা কাপ হাতে নিয়ে বসে আছে, চায়ে ধোঁয়া উঠছে এখনও। ঠোঁটে তুলতে পারছে না। প্রথমবার মুখে দিয়ে জিভ পুড়িয়ে ফেলেছে সে। ফুঁ দিতে দিতে মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। আর ঠিক তখনই চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে স্যারের মায়ের সঙ্গে।মনে হচ্ছে, চা যত গরম, তার পরিস্থিতিটাও ঠিক ততটাই অস্বস্তিকর।
মেহজাবিন বেগমের চোখের চাহনি অতোটা কোমল নয় আবার কঠোরও নয়। কিন্তু প্রচন্ড তীক্ষ্ণ, শরীরে ভয় জাগিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে ওনার। অনন্যার ভেতরে কোথাও একটা কাঁপন ধরে যাচ্ছে। যদি পরিচিত কেউ বা অচেনা কেউও এরকমটা করতো অনন্যা মুখ খুলে উচিত জবাব দিয়ে দিতো। কিন্তু এই মহিলার চাল-চলন আর হাবভাব দেখে অনন্যা মুখটাও খুলতে পারছে না।
কথা শুরু মেহজাবিন বেগমই করলেন। একদম সরাসরি আসল কথায় আসলেন তিনি।
"আমার ছেলের থেকে দূরে থাকবে।"
অনন্যা চমকে উঠলো। চায়ের কাপ টেবিলে রাখলো। বড় করে শ্বাস নিয়ে বাইরে ছাড়লো।
নিজেকে শান্ত করে জবাব দিলো,
"ম্যাম! আমি নিজ ইচ্ছায় এখানে আসেনি। আপনার ছেলে আমাকে নিয়ে এসেছে। আর ওনার থেকে দূরে থাকা ওইটা তো আমি আপনি কেউই নির্ধারণ করতে পারবো না। আমাদের ভাগ্য কথা বলবে।"
মেহজাবিন বেগম তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন। তার প্রসাধনী যুক্ত মুখে হালকা দাগ ফেললো সেই হাসি। অনন্যা যেন বোকা বনে গেলো। মেহজাবিন বেগম মাথা নাড়িয়ে বললেন,
"জানতাম আমি। তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম তুমি আমার ছেলেকে নিজের জালে আটকে ফেলতে চাইছো। শোনো এই অবস্থায় নিজের দিকে বেশি খেয়াল রাখা উচিত। আমার ছেলের দিকে চোখ ঘুরিয়েও তাকাবে না। থাকতে এসেছো আমি থাকতে দিলাম। কালকের মধ্যেই চলে যাওয়ার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে এই বাড়িতে বেশি দিন সহ্য করবো না। আর আমার পাওয়ার সম্পর্কে তোমার নিশ্চয়ই কোনো জ্ঞান নেই? আমি চাইনা তোমার মতো ক্ষুদ্র কীটের উপর আমার শক্তি অপচয় করতে। তাই যা করবে বুঝেশুনে করো।"
"ক্ষুদ্র কীট কাকে বলছেন? বুঝেশুনে বলছেন তো ম্যাম?আপনি যার থেকে দূরে থাকার কথা বলছেন সে আমার বিশেষ প্রিয় মানুষ। দেখবেন এই ক্ষুদ্র কীট ই একদিন আপনার চোখের সামনে থেকে আপনার ছেলেকে দূরে নিয়ে যাবে আর আপনি কিছুই করতে পারবেন না।"
অনন্যা মুচকি হেসে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালো। তখনই রুম্পা এদিকটায় এগিয়ে আসছিল। অনন্যার হঠাৎই মনে হলো বলে সে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ঠান্ডা চা পুরোটা পান করলো। মেহজাবিন বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
"ঠান্ডা চা খেতে যদিও ভালো লাগে না কিন্তু এতে কারো মরণও হয় না। তাই আপনার ধারণা পাল্টান। একে বিষ বলা বন্ধ করুন। হতেও পারে এটা বিষ ছিল না। কিন্তু ছিল সুখ পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম।"
রুম্পাকে ইশারা করলে সে এগিয়ে এসে অনন্যাকে উপরে নিয়ে গেলো। এদিকে মেহজাবিন বেগম বুঝতে পারলেন অনন্যা শেষ কথা দিয়ে নিজেকেই বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে সে কোনো বিষ নয়, কৌশিকের জীবনের সুখ। কিন্তু এমনটা হতে পারে না। তার ছেলে এমন একটা মেয়ের সাথে কখনোই জড়িত হতে পারে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা।
******
নোহারার বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। কি যেন হয়েছে বাড়িতে! কিছুই বুঝতে পারছে না নোহারা।
মা শুধু ব্যথিত স্বরে বলেছে,
"তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়, মাইয়া। আমরা মরলে পরে কান্দিস ভালোমতো।"
নোহারার মাথা কাজ করছে না। সে মালকিনকে বলে কাজ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই রাতের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে সড়ক ধরে এক দৌড়ে ছুটে এসেছে সে। এই অবস্থাতেই নোহারা বাসে চেপে বসেছে। কাউকে ফোন দেওয়ার কথা মনেই ছিলনা ওর।
রাতের দিকে শহরে হালকা বাতাস নামে। গরমটা একটু কমই লাগে বলা যায়। কিন্তু নোহারা চিন্তায় প্রচন্ড ঘেমে উঠেছে। যতোই যাই বলুক, যতোই ঝগড়া করুক বাড়ির মানুষ ছাড়া আপন কে আর হয়। ওদের কিছু হলে নোহারা কি করে বাঁচবে? এই রাত করে বাসে উঠেছে, বাসে লোক ও বেশ কম। ভয় তো খুব করছে কিন্তু কিছু করার নেই ওর। ওকে তো যেতেই হবে।
ফোনের দিকে তাকিয়ে একবার ভাবলো অনন্যাকে কল করবে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ১১ টার দিকে। এমনিই মেয়েটা টেনশনে ঘুমাতে পারে না ঠিকমত। আলাদা টেনশন দিতে চাইছে না নোহারা। তাই ইতিমধ্যে এই চিন্তা নোহারাকে বাদ দিতে হলো। আরেক আছে নিক। একে কি বলা উচিত সে গ্রামে যাচ্ছে?
·
·
·
চলবে.................................................................................