আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া, আমি একটা কাজ পেয়েছি। সাভারে একটা কম্পিউটারের দোকানে কাজ। তুই তো জানিস বকুল, আমি কম্পিউটারের কত কাজ জানি? সেইজন্যই কাজটা পেতে সুবিধা হলো। কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে রাহির এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। যেদিন ওর পরীক্ষা থাকে না সেদিন তো কোনো সমস্যাই নেই। কিন্তু যেদিন ওর পরীক্ষা থাকে সেদিন রূপকে কোথায় রেখে যাব-এটা নিয়ে একটা ঝামেলা লাগে। রাহি পাশের বাসায় রাখতে চায় যেটা আমার পছন্দ না। তবু একদিন উপায় না পেয়ে ওখানে রেখে যেতে হয়েছে। একদিন ধামরাইতে দাদার বাসায় রেখে গিয়েছি কিন্তু ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য কারণ ধামরাই এখান থেকে বেশ দূর। রূপকে রেখে এসে আমার কাজে যেতে যেতে দেরি হয়ে যায়। এরপর থেকে আমাদের কোনো কাজিন এসে রূপের কাছে থেকেছে। একবার এলো মীরা। সরি মীরা বললে তুই কনফিউজড হবি। শান্তনার কথা বলছি। একবার শান্তনা এলো। রাহির সঙ্গে যোগাযোগ করে এসেছে হয়তো। রূপ ওকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। আমি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। শান্তনা আমাকে ডেকে বলল,
আমাকে দেখে বিরক্ত হলি রাফি? একদিন কি আমি রূপের কাছে থাকতে পারি না? সবাই পারলে আমি কেন পারব না?
আমি বললাম,
যদি আমাকে বিরক্ত হতে দেখিস সেটা তোর দৃষ্টিভ্রম। রূপ তোর কাজিন। ও তোর কাছে থাকতেই পারে। আমি কেন বাধা দিতে যাব?
সত্যি বলছিস?
আমার দেরি হয় যাচ্ছে। রূপের খেয়াল রাখিস।
এ কথা বলে আমি বেরিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমার সব অনুভূতির মতই ঘৃণার অনুভূতিও কি কমে গেছে? নাহলে আজ কেন ওকে দেখে খুন করতে ইচ্ছে হলো না। আজ কেন ওর কাছে আমার বোনকে রেখে বেরিয়ে এলাম? ভাবতে ভাবতে একসময় আবিষ্কার করলাম, ঘৃণা কমেনি তবে কাউকে খুন করার চেয়ে নিজে সারভাইভ করাটা এই মুহূর্তে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
রাফসান শিকদার
০৫ মে, ২০১১
বকুল,
চাকরি পেয়েছি। মাস প্রায় গড়িয়ে গেল। কিছুদিন পর বেতনও পাব। খাওয়া পরার চিন্তা কমেছে। কিন্তু নতুন এক চিন্তা এসে মস্তিষ্কের ভেতর সংসার বাঁধতে শুরু করেছে। আমার ভবিষ্যৎ চিন্তা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার মীরা। আমার ভবিষ্যণ্টা যেমন হবার কথা ছিল তেমন হবে না এখন আর। বাবা-মা নেই, পড়াশোনা নেই, আয়-রোজগারও নিতান্তই সামান্য। ভবিষ্যতে বাড়তে পারে। আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হলেও বাকিসব একই থাকবে। তার ওপর দুই ভাইবোনের দায়িত্ব। এই অবস্থায় এটা স্পষ্ট যে আমাদের সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে বলে এতদিন ভয় পেয়ে এসেছি, অথচ আজ উপলব্ধি করতে পারলাম এই সম্পর্ক আমার নিজেরই ভেঙে দেয়া উচিত। মীরা আমার জন্য বদ্ধপাগল-এ কথা যেমন সত্য, ও যখন বড় হবে এই পাগলামি থাকবে না-এ কথাও সত্য। তখন হয়তো ও আফসোস করবে। না করলেও ওকে আমি ভালো রাখতে পারব না। সব থেকে বড় কথা ওর ফ্যামিলি আমাকে মানবে না। মানার মতো অবস্থা আর নেই আমার। কিন্তু…আমি কি পারব ওকে ছাড়া থাকতে? নিশ্চয়ই পারব। বাবা-মাকে ছাড়া আছি না? ওকে। ছাড়া থাকা আরেকটু সহজ। পারতে হবে। যার তিনবেলা ঠিকমতো ভাত জোটে না, তার সবকিছু পারার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়।
রাফসান শিকদার
২২ মে, ২০১১
আবার একটা ভয়াবহ সময় এসে গেল। রাহি কাল জানিয়েছিল, চাল শেষের দিকে। এখন আমি কাজে চলে যাই। রাহি রান্না করে। কিন্তু বাজারের ব্যবস্থা তো আমাকেই করতে হবে। মাস শেষ হলে টাকা পাব। এ কদিন চলবে কীভাবে বুঝতে পারছিলাম না। আজ বাসায় ফিরে দেখি রূপ ক্ষুধায় কাঁদছে। দুই ভাইবোন সারাদিন শুধু শসা খেয়ে রয়েছে। পুরো বাগান ঘুরে দেখলাম কোনো ফল বা সবজি নেই। নদীর পাড়ে শাকও নেই এখন। আমি আর কোনো উপায় না দেখে বড় চাচাকে ফোন করে কিছু টাকা ধার চাইলাম। কিন্তু তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন আগের টাকা শোধ না করা পর্যন্ত তিনি ধার দিতে পারবেন না। ১০ হাজার টাকা পান উনি। সেই টাকা না দিয়ে আমারও আবার চাওয়াটা উচিত হয়নি। ছোট চাচাকে ফোন করলাম। সে জানাল, মাসের শেষ এখন হাতে টাকা নেই। একশ টাকা দিতে পারবেন। গিয়ে নিয়ে আসতে। আমার কাছে ধামরাই যাওয়ার ভাড়া নেই তাই যাওয়া হলো না। ধামরাই তো দূরের কথা সাভার যাওয়ার ৫ টাকা বাসভাড়াই থাকে না। ব্যাংক টাউন থেকে প্রতিদিন সাভার হেঁটে গিয়ে চাকরি করি। তা ছাড়া একশ টাকা দিয়ে একদিনের বাজারও ঠিকমতো হবে না। আমি পুরো বাসায় আরেকটা চক্কর মারলাম। যদি কিছু পাওয়া যায়। ছাদে টব আর ড্রামের গাছ ছাড়া কিছুই আসলে নেই, যা বিক্রি করা যায়। তা ছাড়া গাছইবা কে কিনবে। তবুও আমি এলাকার যেসব বাড়িতে ছাদবাগান নেই তাদের দারোয়ান বা বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বললাম ছাদবাগান করতে চাইলে আমার গাছগুলো যাতে নেন। নার্সারির চেয়ে কম দামে দিয়ে দেব। তৎক্ষণাৎ কেউ কিছু জানাল না। বলল, পরে জানাবে। কিন্তু আমার তো তখনই টাকা দরকার!
বাসায় ফিরে দেখি রূপ পানি ওঠানোর মোটরের দিকে ইটের টুকরো ছুঁড়ে মারছে। এটা তার খেলা। তখন মনে পড়ল একবার আমাদের মোটর চুরি হয়ে গিয়েছিল সে কারণেই পরবর্তীতে বাবা মোটরটা ভেতরের দিকে লাগায়। এটা তো কোনো কাজে লাগছে না এখন। এটা বিক্রি করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে খুলে নিয়ে বিক্রি করলাম। অনেকদিন পর কিছু বিক্রি করে তিন হাজার টাকা পেলাম।
রাফসান শিকদার
২৪ মে, ২০১১
ফোনে বেশি করে টাকা ভরে মীরাকে ফোন করলাম। সবকিছু ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। কতদিন পর ওকে আমি ফোন করেছি নিজেও বলতে পারব না। এটুকুতেই মেয়েটা কত খুশি! ওর খুশি দেখে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করার কথাটা বলতে পারলাম না। অনেক রাত পর্যন্ত কথা বললাম। শুধু তাই না আমি আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম আসলে আমার কি করা উচিত? আমি কি একবার ওর সঙ্গে দেখা করব?
রাফসান শিকদার
০৩ জুন, ২০১১
আজ মীরার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা গিয়েছিলাম। অনেক শান্তি এই একটা মানুষের মাঝে। আমি যদি সপ্তাহে অন্তত একবার ওর সঙ্গে দেখা করতে পারতাম তাহলে আমার অনেক যন্ত্রণা কমে যেত। আমি অপলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ও জিজ্ঞেস করল,
এভাবে তাকিয়ে আছো যে?
তৃষ্ণা মেটাই। অনেক মাস পর দেখছি তো তোমাকে।
ভীষণ খুশি হলো মেয়েটা! কিন্তু আমার মনে ছিল, হয়তো এটাই তোমার সঙ্গে শেষ দেখা। মীরা যেহেতু আমার মনের কথাটা শুনল না তাই সে পুলকিত হলো।
দিনশেষে দুটি উপলব্ধি নিয়ে বাড়ি ফিরলামঃ—
১। মীরাকে ছাড়া বাঁচা বড় কঠিন হবে।
২। মীরাকে পাওয়ার যোগ্যতা আমি হারিয়েছি।
রাফসান শিকদার
১২ জুন, ২০১১
রাহি এইচএসসি পরীক্ষায় দারুণ রেজাল্ট করেছে। ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া কত কষ্ট করে ছেলেটা পড়াশোনা করেছে। সেকেন্ড ইয়ারের পুরোটা সময় মা ছিলেন না। শেষদিকে তো বাবাও চলে গেলেন। আমিও তেমনভাবে গাইড করতে পারিনি। কিন্তু ওর রেজাল্ট রীতিমতো চমকে দিল। পড়াশোনার তল্লাতল্পি একেবারেই গুটিয়ে রেখেছে বলে আজ বললাম,
এবার পড়াশোনা শুরু কর আবার। কোচিং তো করাতে পারব না। নিজে নিজে পড়তে হবে।
রাহি সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
আমি আর পড়াশোনা করব না ভাইয়া।
আমি চমকে বললাম,
কেন?
কাজ খুঁজছি।
আমি ওকে বোঝালাম,
তোর কাজ করতে হবে না। আমি যা বেতন পাচ্ছি তাতে তো আমাদের চলে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে একে একে গ্যাস ও ইলেক্ট্রিসিটি আনার ব্যবস্থাও করতে পারব। তোর আয় করার দরকার হবে না।
কিন্তু আমার পড়াশোনা করার মতো মন-মানসিকতা নেই ভাইয়া। এইচএসসি আমি কীভাবে দিয়েছি নিজেও জানি না। হয়তো একটা মিরাকলের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু এতদিনে বুঝে গেছি আমাদের জীবনে আচমকা বাবা মাকে হারানোই মিরাকল ছিল। এর চেয়ে বড় মিরাকল আর আসবে না।
এত ভেঙে পড়ছিস কেন? আমি তো আছি।
আমি আসলে প্রচণ্ড ডিপ্রেসড ভাইয়া। আমাকে দিয়ে পড়াশোনা কেন, কিছুই হবে না।
আচ্ছা না হলে নাই। তোকে কাজ খুঁজতে হবে না। তুই বাসায় থেকে রূপকে রাখবি, রান্না করবি। দুজন মিলে কাজ করলে রূপকে কে দেখবে।
রাহি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল,
ভাইয়া মা কি আর কোনোদিন ফিরবে না?
রাফসান শিকদার
২৭ জুলাই, ২০১১
·
·
·
চলবে....................................................................................