শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ১৮ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          কীরে বকুল, খবর কী তোর? অনেকদিন কথা হয় না। মন-মেজাজ এত খারাপ থাকে যে তোর কথাও মনে পড়ে না। আজ হঠাৎ করেই মনে পড়ল প্রায় তিন মাস ধরে লিখি না তোকে! আমার অবস্থা আর কী? চলছে একরকম। কোনো আয়ের ব্যবস্থা করতে পারিনি এখনো। তবে চেষ্টা করছি।

মীরার সঙ্গে সম্পর্কের এখন আরো অবনতি হয়েছে। মাঝেমাঝে ভয় হয় সম্পর্কটা টিকবে তো? ও এখন আমার ভালোবাসায় অন্ধ। কিন্তু এই অন্ধত্বের পর্দা যদি কখনো সরে যায়? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যাওয়াটাও তো অস্বাভাবিক না। তার ওপর এখন আর সম্পর্কটার সুস্থতা বজায় রাখতে পারছি না। আমাদের জন্য একটু দোয়া করিস। মীরা এখন আর আমার প্রেমিকা নেই, তারচেয়ে বেশি কিছু হয়ে গেছে।

আমাদের বাসায় সম্ভবত খুব দামি কোনো জিনিস ছিল না। আর থাকলে ন্যায্য দাম পাইনি। জিনিসপত্র বিক্রি করতে করতে সব শেষ। এখন শুধু রান্নার জিনিসপত্র আর বিছানা বালিশ আছে।

মজার ব্যাপার কি জানিস? এখন আর রূপ মুরগির জন্য কাঁদে না। যা দেই তা দিয়েই খেয়ে নেয়। ক্ষুধার যন্ত্রণা চিনে গেছে মেয়ে! ভাত পেলেই খুশি! আলহামদুলিল্লাহ।

রাফসান শিকদার
০৬ মার্চ, ২০১১

আজ আমরা অনেক আনন্দ করলাম। গ্যাস বিল দিতে পারিনি কয়েকমাস। আজ দেখি গ্যাসলাইন কেটে দিয়েছে। কী আর করা যাবে। না খেয়ে তো আর থাকতে পারব না। আমি আর রাহি নদীর মাটি তুলে আনলাম। সেই মাটি দিয়ে চুলা বানালাম। এর আগে একবার গ্রামে পিকনিক করার জন্য কাজিনরা সবাই মিলে মাটির চুলা বানিয়েছিলাম। সেই কারণেই মাটির চুলা কীভাবে বানাতে হয় সেই ধারণা ছিল। লাকড়ির ব্যবস্থা আমার বাগান থেকেই হয়ে গেল। সবকিছুতেই রূপ এত আনন্দ পেল! ওর ধারণা হলো আমরা বুঝি পিকনিক করছি। তবে চুলা শুকাতে একটু সময় লাগল। ততক্ষণে রূপ ক্ষুধায় কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল। ওকে গাছের পেয়ারা খেতে দেয়া হয়েছিল, সেটা ছুঁড়ে মেরেছে। এক জিনিস আর কত খাওয়া যায়? যাই হোক চুলা শুকালে রান্না বসালাম। ততক্ষণে রূপ কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। রান্না হওয়ার পর যখন ওকে খেতে ডাকলাম, হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। মেনু মোটা চালের ভাত (মোটা চাল সস্তা বিধায়) আর গাছের মিষ্টি কুমড়ার নিরামিষ। তাতেই রূপ মহাখুশি, নিজ হাতেই ভাত খেল। রূপের এই পরিবর্তন, এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাওয়া… বাবা-মা থাকলে হয়তো কখনোই হতো না। সবকিছুরই ভালো খারাপ দুটো দিক থাকে। আমাদের অভাব দিনের ভালো দিক বোধহয় এটা।

রাফসান শিকদার
১৩ মার্চ, ২০১১

রোজ একটু একটু করে ডুবে যেতে থাকি অন্ধকারের অতল গহ্বরে…

জানি না এর শেষ কোথায় কিংবা
আদৌ কোনো শেষ আছে কি না!

রাফসান শিকদার
২২ মার্চ, ২০১১

বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। গ্যাসের মতোই বিল জমে গিয়েছিল অনেক। বিল দিতে গেলে না খেয়ে থাকতে হতো। শেষমেশ লাইন কেটে দিয়েছে। এটা ঢাকা শহর আর ওয়াসার পানি হলে হয়তো সেই লাইনও এতদিন কেটে দিত। যদিও ইলেক্ট্রিসিটি না থাকার কারণে মোটর চালিয়ে পানি তোলা সম্ভব হয় না। টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে সব কাজ করি। নতুন নতুন বাড়ি করার পর প্রায়ই এখানে দীর্ঘসময় ধরে ইলেক্ট্রিসিটি থাকত না। তখন পানির সমস্যা হয়েছিল বলেই বাবা এই টিউবওয়েল টা বসিয়েছিল। সমস্যা একটাই, প্রচণ্ড গরম। দিনের বেলা রূপ মাঝেমাঝে কান্নাকাটি করে। কিন্তু আমি বিচলিত হই না। এটাও একসময় তার অভ্যাস হয়ে যাবে। তবে রাতের বেলা সারারাত ওকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করি। এখন এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি ঘুমিয়ে থাকি আমার হাতে পাখা নড়তে থাকে।

রাফসান শিকদার
২৯ মার্চ, ২০১১

বেশকিছু গরমের সবজি বুনেছিলাম। করলা আর মিষ্টি কুমড়া ছাড়া তেমন কিছুই দু-একটার বেশি হয়নি। তবে কুমড়ার ফলন বেশ ভালো হয়েছে। প্রতিদিন কুমড়ার নিরামিষ খেয়েও আমাদের কুমড়া শেষ হচ্ছে না। মিষ্টি কুমড়া খেতে খেতে রূপ অবশ্যি বিরক্ত। মাঝেমাঝে ডিম ভুনা করলে ওর আনন্দ দেখার মতো হয়। আজ ডিম ভুনা করেছি। আজ আমার রূপের আনন্দ দেখার দিন।

রাফসান শিকদার
০৭ এপ্রিল, ২০১১

হে আল্লাহ, আমার জীবনের সব সুখের বিনিময়েও কি আমার মাকে ফেরত দেয়া যায় না?

রাফসান শিকদার
১১ এপ্রিল, ২০১১

রাহির এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। ইলেক্ট্রিসিটি না থাকায় ওর কষ্ট হচ্ছে। রাত জেগে পড়ার অভ্যাস ছিল। সেই অভ্যাস বদলাতে হয়েছে। যে ছেলেকে কখনো বেলা ১০/১১ টার আগে ঘুম থেকে তোলা যেত না। সে এখন অনায়াসে ভোরবেলা উঠে পড়তে বসে। যতক্ষণ আলো থাকবে ততক্ষণের মধ্যে পড়াশোনা শেষ করতে হবে কি না। অভাবে আমার ভাইবোন দুটো যে শিক্ষাগুলো পেয়েছে তা হয়তো আমি ওদেরকে আরাম-আয়েশে রেখে সারাজীবনেও দিতে পারতাম না।

রাফসান শিকদার
১৮ এপ্রিল, ২০১১

পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি ঘরে আর কিছু বিক্রি করার মতো আছে কি না। কিন্তু পাচ্ছি না। গাছেও কোনো ফল নেই। দুদিন ধরে ভাত খাই না। শুধু মিষ্টি কুমড়ার নিরামিষ আর গাছের শসা খেয়ে বেঁচে আছি। চাল শেষের দিকে কিন্তু একটা টাকাও নেই আমার কাছে। তাই কম করে রান্না করেছিলাম। যাতে অন্তত একদিনের চালে দুদিন চলে আর এরমধ্যে কোনোমতে কিছু টাকা ম্যানেজ করতে পারি। রাহি যাতে টের না পায় তাই ও পরীক্ষা দিয়ে ফেরার আগেই রূপকে খাইয়ে দিয়েছি আর বলেছি আমি রূপের সঙ্গে খেয়ে নিয়েছি। বেচারা খেতে বসে বলল,

ভাইয়া কাল থেকে চাল আরেকটু বাড়িয়ে নিস। এত অল্প ভাতে ক্ষুধা মেটে না।

আমি রাহিকে বলতে পারি না কাল হয়তো ভাত খাওয়াতেই পারব না।

আমার শরীরে শক্তি নেই। মাথা কাজ করে না। শরীর কাঁপতে থাকে। পেট গুলিয়ে বমি আসে। একমুঠো ভাতের জন্য আমার ড্রাগ এডিক্টের মতো অবস্থা হয়েছে। ২৩ বছর বয়সে আমি প্রথমবার উপলব্ধি করলাম ভাতের চেয়ে বড় নেশা আমার আর নেই।

রাফসান শিকদার
২২ এপ্রিল, ২০১১

গত তিনদিন ধরে তুমি একবারও আমাকে ফোন করোনি রাফি।

কথা তো প্রতিদিনই হচ্ছে।

হ্যাঁ হচ্ছে। আমি ফোন দিচ্ছি বলে হচ্ছে। তুমি নিজ থেকে একবারও ফোন দাওনি।

আমাকে ফোন দেয়ার সুযোগ তো দাও না। তার আগেই তুমি ফোন করো।

বাহানা দিও না।

আচ্ছা এখন কী করতে হবে?

তোমার যা মন চায় তাই করো। তোমার আর ফিলিংস নেই আমার জন্য। আমি বলে বলে তো সেই ফিলিংস আনাতে পারব না।

ফিলিংসে ভরপুর কাউকে পেলে চলে যেতে পারো। আমি তোমাকে বেঁধে রাখিনি।

কী বললে তুমি?

ফিলিংসে ভরপুর কাউকে পেলে চলে যেতে পারো।

কনভার্সেশনের এই পর্যায়ে মীরা ফোন রেখে দিল। সম্ভবত কাঁদছে। আমাদের সম্পর্কটা দিন দিন খারাপ হচ্ছে এই নিয়ে সারাক্ষণ ভয়ে থাকি আমি অথচ আজ নিজেই কি বাজে একটা কথা বলে ফেললাম। যদিও আমার এভাবে বলা ঠিক হয়নি, তবে কথাটা বাজে হলেও সত্যি। আমার ওকে আটকে রাখা উচিত না। আমার সঙ্গে ও ভালো নেই।

রাফসান শিকদার
২৩ এপ্রিল, ২০১১

আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিনটি সম্ভবত আজ গেল। এমন দিন যেন আমার শত্রুরও না আসে। চাল শেষ এটা রাহিকে জানানো হয়েছে তাই সে চুপ ছিল। কিন্তু রূপকে এসব বোঝানো যাচ্ছে না। সে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদছিল। সকাল থেকে না খাওয়া, দুপুরও পেরিয়ে গেছে। রূপ বারবার বলছিল, আমাকে ভাত দাও রাফি ভাইয়া, আমাকে ভাত দাও। আম্মু আমাকে প্রতিদিন ভাত দিত। আমি ওর এসব কথা সহ্য করতে পারছিলাম না। বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। যদি কিছু জোগাড় করতে না পারি তাহলে হাইওয়েতে গাড়ির তলায় মাথা দেব আজ। টাকা-পয়সা ধার করার মতোও কেউ নেই। দাদা-দাদি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের একটা গতি হত। কিন্তু চাচারা তো ফিরেও তাকায় না। একটা খোঁজও নেয় না পাছে টাকা চেয়ে বসি! হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবকিছু অসহ্য লাগছে। ঠিক তখন চোখে পড়ল নদীর পাড়ঘেঁষে খুব সুন্দর কলমি শাক গজিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি গিয়ে কাঁচি আনলাম। শাক কেটে আঁটি বেঁধে বাজারে নিয়ে গেলাম। কেউ কিনল না। বিকেলবেলা কেউ তেমন একটা বাজারে ঢোকে না। তাই রাস্তার ধারে বসলাম, অফিস থেকে ফেরার পথে কেউ যদি কেনে! ভাগ্য ভালো, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে শাকগুলো বিক্রি হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা চাল কিনে বাসায় ফেরার পথে আমাদের জন্যও কিছু শাক কেটে আনলাম। আজ মিষ্টি কুমড়ার নিরামিষের সঙ্গে নতুন আইটেম পেয়ে রূপ খুশি হলো। চার দিন পর ভাত খেয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, এই বুদ্ধিটা আমার মাথায় আগে এলে আমার ভাইবোনগুলোকে দুইবেলা না খাইয়ে রাখতে হতো না। বুদ্ধি করে চলতে পারলে সব সমস্যারই সমাধান আছে। সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিতেই আমাদের জীবনধারণের জন্য সবকিছু সুনিপুণ হাতে গুছিয়ে রেখেছেন। আমরা মানুষেরা বুঝতে পারি না। একখণ্ড জমি থাকলে আমি ধানচাষ করতাম। পুকুর থাকলে মাছ চাষ করতাম। কোনোকিছুর অভাব থাকত না।

আরে তোকে লিখতে লিখতেই মাথায় একটা আইডিয়া এলো। জমি, পুকুর না থাকলেও তো আমার একটা উঠান আছে। আমি এতে মুরগি তো পালতে পারি। আমার বোনের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য যা অনেক মাস ধরে তাকে আমি খেতে দিতে পারি না। মুরগি পালা শুরু করতে মুরগির বাচ্চা কেনা এবং খাবার কেনা বাবদ কিছু টাকা লাগবে। এই টাকাটা জোগাড় করতে পারলেই আমি শুরু করে দেব ইনশাআল্লাহ।

শুরুতে লিখেছি আজকের দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিন গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খারাপের সঙ্গে সঙ্গে দিনটি বিশেষ শিক্ষণীয়ও ছিল বটে। অভাব আর পেটের ক্ষুধা মানুষকে যে শিক্ষা আর জেদের জোগান দেয় তা আর কেউ দিতে পারে না বলে আমার মনে হল।

রাফসান শিকদার
২৪ এপ্রিল, ২০১১

এই পর্যায়ে মীরা ডায়েরিটা বন্ধ করে মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেলল । নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছল। এরপর ড্রয়িংরুমে গেল। কিন্তু রূপ সেখানে নেই। সে রূপের ঘরে গেল। রূপ আগামীকাল স্কুলের জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছিল। মীরাকে দেখে বলল,

ভাবি ভাল হয়েছে এসেছো, আমার পড়া শেষ। এসো গল্প করি।

মীরা রূপের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, মাথায় হাত বোলাল। তারপর আচমকাই রূপকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। হতভম্ব রূপ জিজ্ঞেস করল,

কী হয়েছে ভাবি?

মীরা রূপের কপালে চুমু খেল। তারপর বলল,

ভাইয়া ভাবি তোমাকে অনেক ভালোবাসে রূপ।

রূপ বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক কী হচ্ছে। তবে মীরার কথার উত্তর দিল,

আমিও তোমাদেরকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু কী হয়েছে ভাবি? তুমি কাঁদছো কেন?

তেমন কিছু না। হঠাৎ ইমোশনাল হয়ে পড়লাম।

সেটা বুঝতে পারছি কিন্তু কেন?

মীরা চোখের পানি মুছে হেসে বলল,

এমনি।

রূপ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। মীরা আবার নিজের ঘরে গিয়ে ডায়েরি পড়া শুরু করল।
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp