ফানুস - পর্ব ৩৬ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          অফিস থেকে ফিরে পেট্রার এত ক্লান্ত লাগছিল যে সে রান্নাবান্নার ধারেও গেল না। কিছু ফাস্টফুড কিনে এনেছিল, গোসল করে তা-ই খেয়ে নিল। গোসল করে খুব ফ্রেশ লাগছিল। চুল মুছে তোয়ালে মেলে দিচ্ছিল। তখনই ফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরতেই প্রিয়র গলা ওকে অবাক করে দিল, ‘পেট্রা, ফোন রাখবি না, শুদ্ধর কসম।

পেট্রা নম্বরটা ভালো করে দেখল, মালয়েশিয়ান নম্বর। বলল, ‘তুই মালয়েশিয়াতে কীভাবে? কবে এসেছিস?’

‘অনেক কাহিনি করে এসেছি শুধু তোর সাথে দেখা করার জন্য। মাত্র ল্যান্ড করলাম। বাসার অ্যাড্রেস দে।’

‘বাসার অ্যাড্রেস!’

‘ও! সমস্যা আছে? ঠিকাছে, বাইরেই দেখা করি। কখন কোথায় আসতে পারবি, বল।

‘বাসার অ্যাড্রেস মেসেজ করে দিচ্ছি। ট্যাক্সি নিয়ে চলে আয়।

‘আচ্ছা।’

পেট্রার হাত-পা সব কাঁপছে। প্রিয় এল কেন? প্রিয়র কাছ থেকে দূরে থাকার জন্য দেশ ছেড়েছে। অথচ সেই প্রিয় এখানে এসে হাজির। প্রিয় সামনে এলে কী করবে সে? ঠিক থাকতে পারবে তো? এখন দেখা না করেই-বা কী উপায়? এত দূর এসেছে! জেনেও দেখা না করে থাকবে কী করে সে? দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে ঢুকল। বাসায় যা ছিল, তা দিয়েই ঝটপট রান্নাটা সেরে ফেলল।

দরজা খুলতেই প্রিয় হড়হড় করে ভেতরে ঢুকে এল। কোনো কুশল বিনিময় না, কোনো ফর্মালিটি না। প্রিয়কে দেখে পেট্রার হার্টবিট বেড়ে গেল। পেট্রা কিছু বলার আগেই প্রিয় ধমকে উঠল, ‘তুই আমাকে না বলে এলি কী করে, পেট্রা? এত দূর আসার আগে একবার আমাকে বলে আসার প্রয়োজন মনে করলি না? এতটাই ফেলনা আমি তোর কাছে?

পেট্রা কাছে এগিয়ে এল। হাত ধরে বলল, ‘মাথা ঠান্ডা কর, বলছি। সব।

‘ফাক ইওর ঠান্ডা মাথা।

‘মুখ খারাপ করবি না প্রিয়।’

‘এক শ বার করব।’

পেট্রা হেসে বলল, ‘বলে এলে তুই দেখা করতে চাইতি, শুধু চাইতিই না, দেখা করেই ছাড়তি। আমাকে ফেরাতে চাইতি। কে জানে কখন পটে যেতাম, সেই ভয়ে বলি নি। সেজন্য সরি।

‘এভাবে আমার কলিজাটা ছিঁড়ে নিলি, পেট্রা। দেখা না হলেও, যোগাযোগ না থাকলেও, কাছেই ছিলি। কিছু একটা হলে আমি দৌড়ে যেতে পারতাম। আমাকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে চাস তোর জীবন থেকে?

পেট্রা প্রিয়র পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘সরি দোস্ত, মাথাটা একটু ঠান্ডা কর। এত দূর থেকে আমার কাছে এসেছিস কি ঝগড়া করতে?

প্রিয় পেট্রাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘খুন করতে এসেছি তোকে।

পেট্রা আবারও হেসে ফেলল। প্রিয় বলল, হাসবি না, দাঁত ভেঙে দেব।’

পেট্রা মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা সরি। আগে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নে।

প্রিয়র রাগ মিটছিল না। এবার হুট করেই বলল, তুই আমাদের অ্যানিভার্সারির দিন স্মরণকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলি কেন?

‘স্মরণকে তুই কীভাবে চিনিস?

‘একই জিমে জিম করতাম।

‘ও। স্মরণ আমার কলিগ। চলে আসব বলে আমার হাতে চা খেতে চেয়েছিল, সে জন্যই বাসায় নিয়ে যাওয়া।

‘কেন, বাপের বয়সে চা খায় নি? চা খেতে চাইলেই ঝড়বৃষ্টির রাতে তুই একটা ছেলেকে খালি বাসায় নিয়ে যাবি?

‘খালি বাসা কই? রায়ান ছিল তো বাসায়।

প্রিয় চুপ। পেট্রা বলল, ‘বাব্বা, এত জেলাস! তুই কীভাবে জানলি আমি ওকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম?

‘আমি দেখেছি।’

‘ফলো করছিলি আমাকে?

‘করছিলাম। সেদিন আমাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি ছিল।

পেট্রা চুপ। প্রিয় চুপ। কিছুক্ষণ পর পেট্রা উঠে গিয়ে প্রিয়র জন্য বানিয়ে রাখা অরেঞ্জ জুস নিয়ে এল। গ্লাসটা প্রিয়র হাতে দিয়ে বলল, ‘তুই কয় দিনের জন্য এসেছিস?

প্রিয় একটানে জুসটা শেষ করল। তারপর বলল, ‘ভিসার মেয়াদ শেষ প্রায়। দুদিন পর চলে যেতে হবে।’

‘আচ্ছা, তুই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে। তারপর কথা বলছি। তোয়ালে দিচ্ছি দাঁড়া।’

পেট্রা ভোয়ালে দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই প্রিয় পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল। পেট্রা সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠল। যেন প্রথম প্রেমের প্রথম স্পর্শ! ওদিকে পেট্রাকে অবাক করে দিয়ে প্রিয় বলল, আমাকে মাফ করে দে পেট্রা। আমি তোক ভুল বুঝেছিলাম।’

পেট্রা ঘুরে দাঁড়াল। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কী ভুল বুঝেছিলি?

‘আমি ভেবেছিলাম স্মরণের সাথে তোর অ্যাফেয়ার চলছে। তোরা বিয়ে করবি!’

পেট্রা হেসে বলল, ‘কী দেখে এমন মনে হলো?

প্রিয় বিছানায় বসল। পেট্রা তার সামনেই একটা চেয়ারে বসল। তারপর প্রিয় পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। স্মরণের সঙ্গে ফোনের কনভারসেশনগুলো রেকর্ড করা ছিল, সেগুলো শোনাল। পেট্রা অবাক হলো এবং রেগে গেল স্মরণের ওই কথাটা শুনে, আপনার ভাগ্য ভালো পেট্রা আমাকে বিয়ে করে নি, করলে আপনাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতাম কত ধানে কত চাল।’

প্রিয় আবার মাফ চাইল, ‘তুই আমাকে মাফ করেছিস তো?

পেট্রা বলল, ‘মাফ চাওয়ার কী আছে? সন্দেহ হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল।’

‘তবু আমার তোর ওপর বিশ্বাস রাখা উচিত ছিল।’

‘দূরত্ব বাড়লে বিশ্বাসটা আস্তে আস্তে কমে যায়। কারণ, মানুষ প্রতিনিয়ত বদলায়। মানুষকে দিয়ে সব সম্ভব।’

এ কথা বলে পেট্রা প্রিয়র দিকে তাকাতেই দেখল প্রিয়র চোখে পানি। পেট্রা দেখে ফেলার আগেই মুছে নিতে চাইল। কিন্তু পেট্রা দেখেই ফেলল। পেট্রা উঠে প্রিয়র সামনে দাঁড়াল। প্রিয়র মুখটা ধরে বলল, কী হয়েছে? চোখে পানি কেন?

প্রিয় এবার কেঁদে ফেলল। সে নিজেকে সামলাতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। কারও সামনে কাঁদতে পারে না, একমাত্র পেট্রার কাছে এসে সে সব পারে। তার কাছে কোনো লজ্জা নেই। প্রিয়কে এমন অবস্থায় দেখে পেট্রার বুকের ভেতরটায় একটা চাপা কষ্ট অনুভূত হচ্ছিল। সিরিয়াস কিছু কি হয়েছে? না হলে সে এভাবে কেন কাঁদছে? পেট্রা প্রিয়র মাথাটা তার বুকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়ও কোমর জড়িয়ে ধরল। পেট্রা প্রিয়র মাথায় চুমু খেয়ে বলল, ‘ইশ প্রিয়, তুই কি কখনো বড় হবি না রে?

এ কথা শুনে প্রিয় হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। পেট্রা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই প্রিয় বলল, ‘আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছি পেট্রা। তাও নিরপরাধ তোর ওপর রাগ করে, তোকে ভুল বুঝে।

‘কী করেছিস?

‘নিকিতার সাথে ইন্টিমেট হয়েছি আমি।’

‘এত দিনে!’

পেট্রার এমন প্রতিক্রিয়া আশা করে নি প্রিয়। সে পেট্রাকে ছেড়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘মানে কী বলতে চাস তুই?

পেট্রা প্রিয়র চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম আরও আগে সেসব হয়েছে। নিকিতা পুরোপুরি বদলে গেছে, ওর আচরণ অনেক ভালো হয়ে গেছে। এ জন্যই আমি এমনটা ভেবেছিলাম। তোর বিয়ে করা বউ, তুই ইন্টিমেট হবি না কেন? এ জন্য আমাকে কেন সরি বলছিস? পাগল নাকি তুই?

রাগে, দুঃখে, অভিমানে প্রিয়র মনে চাইছিল নিজের চুল ছিঁড়তে। পেট্রা আচমকা প্রিয়র কোলে বসে ঠোঁটে চুমু খাওয়া শুরু করল। পেট্রা জানে পাগল কীভাবে থামাতে হয়।
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp