মৌনচন্দ্রা - পর্ব ০৫ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প

“Life Is Too Short To Be Bored & Die!” 

আমি তাকে ফিরতি চিঠি লেখা না অবধি স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তার একটিমাত্র বাক্যে আমি এতখানি শান্তি পেলাম যে, ঘুমের ওষুধ নিয়েও যেই চোখ দুটোয় বিন্দুমাত্র ঘুম ছিল না, তা আস্তে-ধীরে বুঁজে গেল, শরীর নিস্তেজ ও আরাম পেল।

দুপুরে ঘুম থেকে উঠেই তাকে আমি ফিরতি চিঠি লিখতে লাগলাম। কী নিয়ে লেখা যায়, বুঝতে পারছিলাম না। ঠুনকো একটা টপিক নিয়েই শুরু করে দিলাম...

—————

“মেজবাহ, 
আপনি যেমনটা আমার নাম দেখে চিঠি লিখতে প্রফুল্লিত হয়েছেন, আমিও কিঞ্চিৎ তা-ই। মেজবাহ নামটা আমার ভীষণ পছন্দের। ওয়াজিহ মেজবাহ রঙ্গন! একটা ফিকশনাল ক্যারেক্টারের নাম। আমার আগ্রহ, আকর্ষণসহ আরও কিছু ব্যাপার সংযুক্ত আছে এই নামের সাথে। সে বেশ ভালো গান গায়। হৈচৈ উল্লাসে মেতে থাকে। চিঠির রিপ্লাই দিলাম ঠিক এ কারণেই।
আমি আরাধ্যা, আপাতত থাকি পৃথিবীর এক ছোট্ট কোণায়। নিজেকে ভালোবাসি, নিজের মধ্যে বাঁচি৷ আমার বেশ উদ্ভট কিছু অভ্যেস আছে। একটি হচ্ছে দিনে মরার মতো ঘুমানো আর রাতে নিশীথিনী সেজে ছাদে বসে চাঁদের সবচেয়ে প্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বী সাজা। 

ভোরের সূর্য আমি দেখি না। আমার দেখতে ভালো লাগে না। প্রকৃতির নিয়মানুসারে নাকি অন্ধকারের পর পুরো ধরা আলোকিত হয় এবং হবেই। অথচ কেন যে তারা মাঝে মাঝে অনিয়ম করে! তারা রাতকে বড়ো বানিয়ে দিনকে ছোট করে ফেলে। বাস্তবার্থে দিনকে অত্যাধিক ছোট করে ফেলে। বুঝতে পারছেন তো আমার কথা? এজন্য আমার অভিমান হয়। সেই অভিমান থেকেই আমি সূর্যোদয় দেখি না। যে নিয়ম ব্যতিক্রম ঘটাতে এত পছন্দ করে, সে নিয়ম কেন আশার সঞ্চার করবে? জঘন্য নিয়ম!

আমি সূর্যের আলো গায়ে লাগানোর আগেই ছাদ থেকে রুমে চলে আসি। একটা ভীষণ ল-ম্বা ঘুম দরকার তখন। সারারাত এটা-সেটা খেতে থাকি, ঘুমানোর আগে তাই আর খিদে পায় না। এরপর ঘুম থেকে উঠি উমম.... দুপুর বা বিকেলের দিকে! ফ্রেশ হয়ে রান্না করি অথবা তৈরি হয়ে শহরের রাস্তায় এলোমেলোভাবে হাঁটার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাই। 

মেজবাহ, জানেন? আমার শহরের প্রতিটি অলিতে গলিতে অসংখ্য অসুখ কাহিনি আছে। আমি সেসবের চাক্ষুষ সাক্ষী হওয়ার উদ্দেশ্যে এক উদ্দেশ্যহীন জীবন পার করছি। আপনাকে তা অন্য এক চিঠিতে জানাব। 

এবার আপনি বলুন, জীবন কেমন চলছে? চলার মতোই চলছে না-কি বেশ ভালোভাবে চালানোর জন্য সর্বোচ্চ এফোর্ট আপনি দিচ্ছেন? আমি অলস প্রজাতির মানুষ, এফোর্ট জিনিসটা আসে না। আপনার আসে? সারাদিন কী কী করেন? 

একটা প্রশ্ন, আপনার কল্প-জগৎ আছে? আমার আছে কিন্তু...

পুনশ্চ: সিস্টেম আপনাকে বলেছে আমি বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা বুঝব না। সিস্টেম আপনাকে যেটা বলেনি, সেটা হচ্ছে—আমার বড়ো বড়ো চিঠিতে বিশাল অনুরাগ। 
পুনশ্চ ২: চিঠির শেষাংশে এসে মুচকি হাসা বাধ্যতামূলক। হাসি ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র। জীবন সুন্দর।”

_aradhya_
May 22, 2017 2:39 PM
Somewhere in Bangladesh

—————

আমি চিঠিটা পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একঘন্টা বিভিন্ন কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোন হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম, পৌঁছেছে কি না। নিজস্ব নোটিফিকেশনে আমাকে সঠিক সময়েই জানান দেওয়া হলো, চিঠিটি পৌঁছেছে।

আমি তখন অবসরে বসে কাজ হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম। এই যেমন, ধোয়া কাপড়গুলো ফের ধুয়ে রোদে শুকাতে দিলাম। সেই সাথে আমিও রোদে গা পুড়িয়ে নিজের গলে পড়া মনকে খানিক শুকিয়ে নিলাম। নোটিফিকেশনটা যখন এলো, তখন আমি গা ঝলসানো রোদে বসে গুনগুন করে গান গাইছিলাম,

আমার সারাটাদিন,
মেঘলা আকাশ,
বৃষ্টি, তোমাকে দিলাম....

চিঠিটা পৌঁছানোমাত্র আমি গান থামিয়ে ফোনের ব্রাইটনেস পুরোটা বাড়িয়ে দিয়ে দেখতে লাগলাম, দুটো টিকচিহ্ন কখন সম্পূর্ণ নীল হয়ে আমাকে জানান দেবে যে, সে পড়েছে!

একমিনিট, দুইমিনিট, তিনমিনিট... পঞ্চম মিনিটে আমি মুচকি হাসলাম। দুটো টিকচিহ্নই নীল হয়েছে। সে পড়ছে! 

আমি বেতের এই দোলনাটিতে পা তুলে বসলাম। হাঁটুতে গাল এলিয়ে দিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলাম। নিষ্ঠুর সূর্যের সাথে নিষ্ঠুরতায় মেতে উঠলাম। সে মনে করে, এত তাপদহনে আমি চোখ বুজে নেব? ক-খ-নো নয়। আমি সেভাবে তাকিয়ে থেকেই গান গাইতে লাগলাম—
আমার সারাটাদিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি, তোমাকে দিলাম...

সম্বোধনবিহীন তার পরবর্তী চিঠিটা এলো ঘন্টা দুয়েক পরেই।

—————

“আমি নিজেকে কতটুকু ভালোবাসি তা আসলে বলতে পারছি না। পারিপার্শ্বিক চাপে কিংবা সময় হয়নি বলে এটুকুর উপলব্ধি এখনো হয়ে ওঠেনি। তবে আমি নিজেকে গুরুত্ব দেই, ছোটছোট শখ পূরণের চেষ্টা করি।
আমার গ্রাজুয়েশন একদম শেষের দিকে। ফাইনাল সেমিস্টার এর এক্সাম চলছে। ঈদের আগেই গ্রাজুয়েট হয়ে যাব, অফিশিয়াল বেকার আরকি। 
পুনশ্চ: ক্লাসের ফাঁকে বসে এটা লিখলাম। এটাকে আবাহনী চিঠি ধরতে পারেন। মূল চিঠির অপেক্ষা করুন, রাতে আসবে। এর ফাঁকে আপনি কিছু বলুন, আপনাকে শুনতে মন্দ লাগছে না। প্রশ্নের বিপরীতে পালটা প্রশ্ন— আপনার জীবনটা কেমন চলছে?”

Mezbaah.
May 22, 2017 4:47 PM
Dhaka, Bangladesh

—————

মানুষ বড়ো আজীব প্রাণী। অভ্যেসের দাস। আমি নিজেকে কখনো কোনোকিছুতে অভ্যস্ত করিনি। কোনো কিছুর প্রতি মায়া বা টান সৃষ্টি করিনি। তবে কীভাবে কী যে করে ফেলল এই দুই দিনের অতিথি! আমার জানা নেই। আমি তার অপেক্ষায় ছাদে পায়চারি করতে লাগলাম। হাতে ফোন। মাঝেমধ্যে নেটওয়ার্ক সমস্যা হচ্ছে, বাট ইটস ফাইন! আমি তো কিশোরী। প্রজাপতির মতো দুই ডানা ছড়িয়ে নেটওয়ার্ক পেতে যুদ্ধ করছি। অথচ তার চিঠি আসে না। সে কি আমাকে আর চিঠি লিখবে না? নাকি ব্যস্ত আছে সে? এসব ভাবতে ভাবতে আমি তাকে লিখতে লাগলাম, 

“জীবন কীভাবে চলছে এর ব্যাখ্যায় এলে খরচ করতে হবে এত এত সব শব্দ! আপাতত অলস মস্তিষ্ক তা করতে নারাজ। সংক্ষেপে বলি—

জীবন চলছে না, চালাচ্ছি। একটু একটু করে সাজিয়ে গুছিয়ে, তৈরি করছি, উপভোগ করছি। রোজ রাতে তারাদের সঙ্গী করে চন্দ্রের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়ি। ছাদে হাঁটাহাঁটি করি, গুনগুন করে ধরি কোনো পুরোনো গানের সুর। গানটা ঠিক মনে করতে পারি না। সুরে তাল মেলাতে থাকি যতক্ষণ না মন হালকা হয়। তারপর হঠাৎ কেমন যেন অন্ধকার কেটে যায়, আলোকিত হয়। তার সঙ্গে ভেসে আসে পাখির কলতান, মিষ্টি ফুলের সুবাস, গা শিউড়ানো বাতাস আর অনুভবে উপলব্ধি....

সব শেষে বাসায় চলে এসে ঘুম। উঠি দুইটা নাগাদ, উঠে রান্না-বান্না করি। তারপর যাবতীয় সব কাজ সেরে সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে থাকি চায়ের কাপ নিয়ে। অসংখ্য কাপ খালি করি উপন্যাসের পাতা ওলটাতে ওলটাতে। পড়াশোনা কীসে করছি, ইচ্ছাকৃত স্কিপ করলাম। বয়সের আন্দাজে এলে অনুভূতিরা তুচ্ছ কিংবা অহেতুক লাগতে পারে।

এ-ই তো, জীবন আমার এভাবেই চলছে। সুন্দরমতো, নিজের সাথে। সবচেয়ে মজার বিষয়, গোটা একটা জীবন স্রষ্টা শুধু আমাকেই দিয়েছেন। এই জীবনে অন্য কারো অস্তিত্ব নেই, অন্য কারো ভাবনা নেই। ওরা নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিবর্গের জন্য বাঁচে, তাদের দেওয়া ব্যথাতেই মরে যায়। আমি আরাধ্যা বাঁচি শুধু নিজের জন্য, মরবও কখনও নিজেকে দেওয়া সীমাহীন ব্যথায়। অসম্ভব সুন্দর একটা জীবন পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ।

_aradhya_
May 22, 2017 10:48 PM
Somewhere in Bangladesh
·
·
·
চলবে…………………………………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp