ফানুস - পর্ব ০৮ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          ঘুম থেকে উঠেই বালিশের পাশে একটা র‍্যাপিং বক্স আর অনেকগুলো চকলেট পেয়ে পেট্রার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বাবা চলে যাওয়ার পর একজনই ছিল ভরসা করার মতো কিছু কাজে এখনো ভুল হয় না মানুষটার। বাইরে যতটা কঠোর সে, ভেতরটা ততটাই কোমল।

ফ্রেশও হতে গেল না। র‍্যাপিং বক্সটা খুলতেই কালো পাড়ের সাদা রঙের একটা শিফনের শাড়ি পেল। সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ। ব্লাউজটায় তার টেইলার্সের ট্যাগ দেখে হেসে ফেলল। চাঁদনী চকের দোতলায় এই টেইলার্সটা। ভিড় আর গরমের কারণে প্রিয়কে ধরেবেঁধেও ওখানে নেওয়া যেত না। পেট্রা বলত, ‘চিনে রাখ, যখন তোর ছেলেমেয়ে পেটে নিয়ে হাতি হয়ে যাব, তখন আমি তো আসতে পারব না। তুই এখানে এসে আমার ব্লাউজ বানিয়ে নিয়ে যাবি। এখান থেকে না বানালে আমি পরতে পারি না।

শাড়ির সঙ্গে একটা চিরকুট। চিরকুটে লেখা,

‘শাড়িটা পরলে তোকে কতটা সুন্দর লাগবে, ভেবেই আমি খুন হয়ে যাচ্ছি! একটু কাছে এসে খুন করবি, প্লিজ? শুদ্ধকে নিয়ে আসব ভাবছি। ও আগের চেয়ে একটু শক্ত হয়েছে এখন আর তোর কথা বলার সময় তেমন কাঁদে না। আমাদের সেই ছোট্ট ছেলেটা সাত বছরে পা দিয়েছে। এখন অনেক কিছু বোঝে।
কোথা থেকে তোকে পিক করব, সব চিরকুট পাওয়ামাত্রই জানিয়ে দিস। আর না এলে সেটাও জানাবি।

টেনশনে সম্ভবত সারা রাত আমার ঘুম হবে না।’ চিরকুট পড়ে পেট্রা হেসে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল প্রিয়কে। ফোন পেয়েই প্রিয়র ঘুম ভাঙল। তাড়াতাড়ি রিসিভ করে বলল, হ্যাপি ক্রিসমাস।’

‘হ্যাপি ক্রিসমাস। টেনশনে ঘুমাতে পারবি না লিখেছিস? এখন তো দেখছি নাক ডাকছিস।’

প্রিয় হেসে বলল, ‘কোথায় আসব?

‘আমার বাসার নিচে, সাতটার মধ্যে।

‘এখন কয়টা বাজে?

পেট্রা কিছু বলার আগেই প্রিয় ঘড়ি দেখে বলল, ‘ছয়টা বাজে, তুই এত ভোরে উঠিস কবে থেকে?

পেট্রা উত্তর না দিয়ে বলল, ‘ছেলেকে ঘুম থেকে ওঠা, রেডি কর এবং দ্রুত চলে আয়।”

প্রিয় ফোন রেখেই শুদ্ধকে ডাকল। শুদ্ধ নড়েচড়ে বলল, ‘আরেকটু। ঘুমাই, বাবা।’

প্রিয় কানে কানে বলল, ‘মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। একাই যাব তাহলে?

শুদ্ধ একলাফে উঠে বসল। বলল, ‘সিরিয়াসলি, বাবা?

‘হুম।

শুদ্ধ দৌড়ে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে শুরু করে দিল। দুই বাপ-ছেলে রেডি হতে লাগল।

ওদিকে পেট্রাও এত দ্রুত বোধ হয় শাড়ি পরে নি কখনো।

সাতটা বাজার দশ মিনিট আগেই প্রিয় চলে এল। পেট্রা গেট থেকে বেরুতেই দেখতে পেল জিনসের প্যান্ট আর সাদা পাঞ্জাবি পরা প্রিয় রাস্তায় পায়চারি করছে। গায়ে একটা কালো শাল। প্রিয় ছাড়া রাস্তায় একটা কাকও নেই। চোখে চোখ পড়তে দুজনই হাসল। শুদ্ধ কোথায়? ও কি গাড়িতে? নাকি আনে নি! পেট্রাকে দেখেই প্রিয় এগিয়ে আসছিল। কাছাকাছি আসতেই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয় জড়িয়ে ধরার সময় মাথা নামিয়ে পেট্রার গালে চুমু দিল। পেট্রা হেসে বলল, ‘আমার ছেলে কোথায়?

প্রিয় চুপ। পেট্রা চিন্তিত মুখে জানতে চাইল, ‘আনিস নি?’

প্রিয় কিছু বলার আগেই পেট্রা নিজেই গাড়ির কাছে চলে গিয়ে জানালা দিয়ে তাকাল। শুদ্ধ হাঁ করে তাকিয়ে আছে। পেট্রা দ্রুত হাতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই শুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ল পেট্রার কোলে। পেট্রা বুকে চেপে ধরে বলল, ‘জান আমার। কেমন আছিস, মা?

শুদ্ধ একটা কথাও বলতে পারল না। দুবছর পর দেখছে মাকে। তার সারা শরীর কাঁপছে। কাঁকড়ার মতো চার হাত-পায়ে মাকে আঁকড়ে ধরেছে, যেন মেরে ফেললেও মায়ের কোল থেকে কেউ তাকে আর সরাতে পারবে। প্রিয় এগিয়ে এসে দেখল–ছেলে দুজনই হাউমাউ করে কাঁদছে।

সকালে নাশতার টেবিলে প্রিয় ও শুদ্ধকে না দেখতে পেয়ে বাবর খান নিকিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাপ-ছেলে কি এখনো ওঠে নি নাকি?

নিকিতা খাবার সার্ভ করতে করতে বলল, ‘ওরা বাসায় নেই, বাবা।

‘এত সকালে কোথায় গেছে? প্রিয়র অফিস নেই?

‘বাবা, আজ তো অফিস নেই, আজ বড়দিন।’

বাবর খান কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, কোথায় গেছে, বলে গেছে?

‘না বাবা। আমি ঘুম থেকে উঠেই দেখি ওরা বাসায় নেই।

‘কোথায় গেছে, বুঝতে পারছ?

‘আমি কীভাবে জানব বাবা, আপনার ছেলে কি আমাকে বলে কোথাও যায়?

‘ওরা পেট্রার সাথে দেখা করতে গেছে, আজ বড়দিন যে!’

‘আপনাকে বলে গেছে?

‘না, অনুমান করছি। এত সকাল সকাল আর কোথায় যাবে এই দিনে!’

‘ওরা এখনো দেখা করে, বাবা?

‘জানতাম তো করে না। কী যে করি! কীভাবে আমি ছেলেটাকে ফেরাব ওই পথ থেকে!

নিকিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার আর সহ্য হয় না, বাবা। এমন কী ছিল ওই মেয়েটার মধ্যে? ডিভোর্সের পর, এমনকি আমাকে বিয়ে করার পরও ও সেই সম্পর্ক থেকে বের হতে পারছে না!

ওদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। প্রিয়র পেছনে সব সময় নজর রাখার জন্য লোক রাখা আছে। সেই সূত্রেই জানি। কিন্তু ওরা আসলে দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তাই সম্পর্ক না থাকলেও টানটা রয়েই গেছে। সেই টানেই বোধ হয় মাঝেমধ্যে দেখা করে।

নিকিতার গা জ্বলে গেল এসব কথা শুনে। কিন্তু মাথা নিচু করে বলল, ‘ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি বাবা, বেয়াদবি নেবেন না। এতই যখন বোঝন ওদের ভালোবাসার ব্যাপারে, তখন ওদের আলাদা না করলেই পারতেন। আমার জীবনটা অন্তত নষ্ট হতো না।

‘বুড়ো বাপটাকে মাফ করো, মা। কীই-বা করার ছিল আমার? পেট্রাকে নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। ছোটবেলা থেকে চিনি ওকে, খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু ও যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে রাজি হয়। নি! বিধর্মী মেয়েটাকে নিয়ে একসাথে সংসার করতে পারতাম না। বড় ছেলেটা মারা যাওয়ার পর থেকে প্রিয়ই তো আমাদের সব। একমাত্র ছেলেটা বিপথে চলে যাচ্ছিল, এই পাপের ভার তো আমাদেরও বইতে হতো। আমরা ছেলেটাকে যে-কোনো মূল্যে ফেরাতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ঘরে বউ এলে শুদ্ধ মা পাবে। প্রিয়র জীবনেও আস্তে আস্তে পেট্রার অভাবটা পূরণ হবে। প্রিয় সুখী হবে।

‘হয় নি তো, বাবা।’

‘হবে, আমি এখনো এটা বিশ্বাস করি। একটু সময় লাগবে। ধৈর্য ধরো, মা।’

নিকিতার অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করছে কিন্তু কিছুই বলল না। কপালে ছিল এসব তার। বাবর খান বললেন, ‘দেখা করতে গিয়েছে, একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।’

নিকিতা অধৈর্য গলায় বলল, এটা কেমন ভালো বাবা?

‘আজ দেখো প্রিয়র ব্যবহার কেমন হয়। খুব খুশি থাকবে সে। সেই সুযোগে তুমি ফায়দা নেবে। গল্পের ছলে তার কাছে তুমি পেট্রার কথা জিজ্ঞেস করবে।

‘আমি কেন ওই মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করব? আমার কোনো আগ্রহ নেই।

‘বোকা মেয়ে। আমি জানি নিজের স্বামীকে অন্য কারও সাথে ভাগ করা যায় না। কিন্তু সেইসব অনুভূতি তুমি আপাতত তোমার ভেতরে রাখো। প্রিয়কে বুঝতে দিয়ো না। পেট্রার কথা জিজ্ঞেস করলেই সে বলবে তোমাকে। বলতে বলতে সে ফ্রি হয়ে যাবে তোমার সাথে। তোমার ওপর ভরসা করবে সে। তখন সে শুধু তার ভেতরে থাকবে না, একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাবে। সেই সুযোগে তুমি তার মনের ভেতর ঢুকে পড়বে, কিন্তু সে টেরও পাবে না। প্রথমে বন্ধু হও, ভালোবাসা তো তার পর আসতে বাধ্য। একটা কথা সব সময় মনে রাখবে, তোমার সবচেয়ে বড় জোর তুমি তার স্ত্রী।

শ্বশুরের শেষ কথাটায় নিকিতা মনে জোর পেল। তবু বলল, কিন্তু বাবা, আমার সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে আমি মাথা ঠান্ডা রাখতে পারি না। হুট করে রেগে কী বলতে কী বলে বসি! দেখেছেন তো বেয়াদবের মতো আপনাকেও অনেক সময় উল্টোপাল্টা বলে ফেলি, যা আমার বলা উচিৎ নয়। কিছুক্ষণ আগেও বলেছি।

‘আমি কিছু মনে করি না মা। তুমি আমার মেয়ের মতো। তুমি বলতেই পারো।

‘কিন্তু বাবা আমি পেট্রাকে সহ্যই করতে পারি না, তার কাহিনি শুনব কী করে?

‘পারতে হবে। সংসারে সুখ আনতে হলে পারতে হবে।’

নিকিতার চোখে প্রিয়র মুখটা ভেসে উঠল। শুধু সংসারে সুখ বা স্ত্রীর অধিকার নয়, ভালোবাসা চাই তার। নিজেও যে প্রিয়কে ভালোবেসে ফেলেছে!

—————

কাঁদতে কাঁদতে শুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়েছে। পেট্রা তাকে বুকে নিয়ে বসে আছে প্রিয়র পাশের সিটেই। প্রিয় গাড়ি চালাচ্ছে, গন্তব্য অজানা। পেট্রা শুদ্ধর গালে হাত বুলিয়ে বলল, এই গালে একদিন দাড়ি গজাবে, বাচ্চা ছেলেটা পুরুষ হয়ে উঠবে। আমার কি দেখার সৌভাগ্য হবে! ঈশ্বরই ভালো জানেন।

‘কেন হবে না? তোর ছেলে বড় হলে নিজেই তোর কাছে আসতে পারবে। তখন কি আর আমার অনুমতির অপেক্ষা করবে!

পেট্রা চুপ। সে জানে না ভবিষ্যতে কী ঘটবে! একটা অজানা ভয়, অজানা আশঙ্কা। মুক্তি নেই এর থেকে। বলল, ‘ইশ, ছেলেটা ঘুমিয়েই পড়ল। একটু কথাও বলতে পারলাম না।

প্রিয় বলল, ‘ঘুম থেকে উঠলে বলিস। আসলে রাতে অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছিল। খুব সকালে উঠেছে। কান্নাকাটি করেছে। তার ওপর মায়ের কোল পেয়েছে। আর কী চাই বল?

পেট্রা হেসে বলল, কিন্তু আজ ক্রিসমাস। সারা দিন তো থাকতে পারব না। দুপুরের আগে ফিরতে হবে।

‘লাঞ্চ করে যা।’

‘সম্ভব না, সরি।

প্রিয় গাড়িটা রাস্তার পাশে থামাল। তারপর পেট্রার দিকে তাকাল। বড় বড় চোখে টেনে কাজল পরেছে সে। ঠোঁটে ভুবনভোলানো হাসি। এই হাসির জন্য প্রিয় পেট্রাকে বলত সূচিস্মিতা। যার হাসিতে কোনো ভান নেই। অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে যাচ্ছে! প্রিয় বেশ কিছুক্ষণ পেট্রার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। পেট্রাও তাকিয়ে রইল। প্রিয়র দুটো চোখ পেট্রার চোখ দিয়েই কোনো এক গহিন অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এক হাতে সে পেট্রার মুখটা ধরে চোখের নিচে আঙুল বুলিয়ে বলল, সেই চোখ, সেই ঠোঁট, সেই মুখ অথচ কত অযত্নে আছে সব। এই অবস্থা হয়েছে কেন?

পেট্রা হেসে বলল, বয়স হচ্ছে তো।’

‘বয়সের জন্য না। আমি জানি কেন হচ্ছে এসব। একটু যত্ন নিতে পারিস না, পেট্রা? দেখ, নিজের কত যত্ন নিই আমি।’

পেট্রা প্রিয়র পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে নিল। চোখগুলো আগের মতোই যেন হাজারটা নেশাদ্রব্য মেশানো, একবার তাকালেই ঘোর লেগে যায়। চুল-দাড়ি সব স্টাইল করে কাটা। মুখটা তরতাজা। কোথাও কোনো অযত্নের চিহ্ন নেই। পেট্রা বলল, তুই তো হিরো, এভারগ্রিন।’

‘তোর চোখ দেখলে মনে হয় কত বছর যেন তুই ঘুমাস না। কত সুন্দর সিল্কি চুল ছিল তোর! এত রাফ হলো কী করে? প্রতিটা চুলের আগা ফেটে দুভাগ হয়ে গেছে, কাটিস না কেন? কত স্মথ স্কিন ছিল তোর, ধরলে মনে হতো মাখন ধরেছি। সেই স্কিন এত খসখসে কী করে হলো?

‘তুই কি গার্লস বিউটি পারলার দিয়েছিস?

‘মজা নিস না, মার খেয়ে মরে যাবি।

পেট্রা মিটিমিটি হাসছিল। প্রিয় বলল, এভাবে থাকিস না, পেট্রা। নিজের যত্ন নিবি আর ভাববিনিজের জন্য অন্তত এটুকু তো করতে পেরেছি! দেখবি শান্তি লাগবে। তোর এই অবস্থা দেখে আমার নিজেকে অপরাধী লাগছে। শেষমেশ কথা রাখতে পারি নি আমি। অথচ সম্পর্ক হওয়ার আগে-পরে কত সময় কতভাবে কতবার তুই আমাকে সাবধান করেছিলি, আমাদের একসাথে থাকা কখনো সম্ভব না। অথচ আমি শুনি নি। পাগলের মতো যখন যা ইচ্ছা হয়েছে, করেছি।’

‘আমি তোকে কোনো দোষ দিচ্ছি না। তুই কেন নিজেকে অপরাধী মনে করবি?’

প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ, তাড়াতাড়ি বিয়ে কর তুই। একটু হলেও শান্তি পাব।

পেট্রা মাথা নেড়ে হাসিমুখে বলল, ‘করব। প্রিপারেশন চলছে।’

‘আমাকে মিথ্যে বলিস না।’

‘সত্যি বলছি।

প্রিয় আবার পেট্রার দিকে তাকাল। পেট্রার ঠোঁটে চোখটা আটকে যাচ্ছে বারবার। নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। পেট্রা প্রিয়র দৃষ্টি দেখেই বুঝে গেল। বহু চেনা ওই দুটি চোখ, ওই দৃষ্টি। প্রিয় কাছে আসতেই পেট্রা বলল, তোর কি ভয় নেই?

প্রিয় থেমে গিয়ে বলল, ‘কিসের ভয়?

‘এটা পাপ। পরকীয়াকে আমরা দুজনই ঘৃণা করতাম।’

‘এটা কীভাবে পরকীয়া হলো? আমার বিয়ে, বউ কীভাবে হয়েছে আর কীভাবে আছে, তুই তো জানিস সব। তা ছাড়া তুইও তো আমার বউ ছিলি।

‘ছিলাম, এখন তো আর নেই।’

‘তো? বিয়ের আগে যেন আমরা এসব করি নি?

তখনকার ব্যাপার অন্যরকম ছিল। তখন আমাদের দুজনের মাঝে আর কেউ ছিল না।’

‘এখনো কেউ নেই।

‘আছে, তুই অস্বীকার করলেই সব সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবে না।’

‘আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না, পেট্রা।

‘শোন প্রিয়…’

পেট্রা এটুকু বলতেই প্রিয় তার মুখটা ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। যদিও শুদ্ধ ঘুমিয়ে আছে, তবু পেট্রা একটা হাতে আলগাভাবে শুদ্ধর চোখ ঢেকে রাখল।

—————

শুদ্ধর যখন ঘুম ভাঙল, মায়ের কোলে বসে দুহাতে সে মায়ের মুখটা ধরে তাকিয়ে ছিল। পেট্রা বলল, ‘মাকে দেখা হয় নি?

শুদ্ধ হেসে বলল, ‘মুখস্থ করে রাখছি, পরে মন চাইলেই দেখতে পারব।’

পেট্রা ও প্রিয় হেসে দিল। শুদ্ধ বলল, ‘মা, তুমি অনেক সুন্দর।

পেট্রা শুদ্ধর গালে চুমু দিয়ে বলল, তোমার মা যে আমি।’

‘আমি তোমার কাছে থাকব, মা।’

প্রিয় বলল, বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারবি?

শুদ্ধ চুপ করে রইল। পেট্রা হেসে ফেলল। তারপর শুদ্ধ বলল, আমি তোমাদের দুজনের সাথে থাকতে চাই।’

প্রিয় ও পেট্রা দুজন দুজনের দিকে তাকাল। কারও মুখে কোনো কথা নেই। পেট্রা শুদ্ধর দিকে ফিরে বলল, ‘সেটা যে কখনো কোনোভাবে সম্ভব না, মা।

শুদ্ধ বলল, ‘মা, আমি মুসলিম, সে জন্য কি আমি বাবার সাথে থাকি?

‘ঠিক সে জন্য না। যেহেতু এটা মুসলিম কান্ট্রি, তাই তোমাকে বাবার ধর্ম দেওয়া হয়েছে। যদি খ্রিষ্টান কান্ট্রি হতো, তাহলে হয়তো মায়ের ধর্ম দেওয়া হতো।

‘কে দিয়েছে?

‘আমি আর তোমার বাবা মিলে ঠিক করেছিলাম যে তুমি মুসলিম হবে।’

‘ও। আমি মুসলিম, তাই বাবার কাছে থাকি। আচ্ছা, আমি যদি খ্রিষ্টানও হই, তাহলে আমি তোমাদের দুজনের কাছেই থাকতে পারব?

‘না বাবা, একই সাথে দুটো ধর্মে বিলং করা যায় না।

‘কেন যায় না মা?

প্রিয় বলল, ‘নে, এবার ঠেলা সামলা। আমাকে সারাক্ষণ এমন কঠিন কঠিন প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়। আমি বলি, বড় হলে বুঝবি। পাত্তা দেয় না তোর ছেলে।

পেট্রা বলল, এটা কেন বলবি? বুঝিয়ে বললেই বোঝে আমার ছেলে।’

তারপর শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে পেট্রা বলল, ‘প্রত্যেকটা মানুষকে যে কোনো একটা ধর্মে বিলং করতে হয়, বাবা। সেই ধর্মকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হয়। এটাই নিয়ম, সে জন্যই একসাথে দুটো ধর্ম মানা যায় না। যদি তুমি চাও, তাহলে তোমার একটা ধর্মও ঠিকভাবে মানা হবে না। পাপ হবে।’

‘আর মায়ের কাছে না থাকলে পাপ হবে না?

পেট্রা হেসে বলল, ‘না।’

শুদ্ধ চিন্তিত মুখে বলল, তাহলে দাদা যে বাবাকে বলেছিল বাবা যদি দাদার কাছে না থাকে, তাহলে বাবার পাপ হবে?

পেট্রা প্রিয়র দিকে তাকাল। পেট্রা জানে না কবে এসব কথা বলেছেন তিনি। প্রিয় না শোনার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। শুদ্ধ আবার বলল, ‘দাদা আরও বলেছে, বাবা-মায়ের সব দায়িত্ব নাকি ছেলেকে নিতে হয়? আমিও তোমার সব দায়িত্ব নেব।’

পেট্রা হেসে বলল, ‘দায়িত্ব মানে কী, জানো তুমি?

‘হ্যাঁ, দায়িত্ব মানে রেসপনসিবিলিটি।

পেট্রা, প্রিয় দুজনেই হেসে দিল। পেট্রা শুদ্ধর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘বড় হ আগে বাবা, তারপর তোর যা ইচ্ছা তা-ই করিস।

প্রিয় নাশতা করার জন্য একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাল। পেট্রার শুদ্ধকে কোলে নিয়ে নামতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রিয় কোলে নিতে চাইছিল, শুদ্ধ যাবে না। প্রিয় বলল, তাহলে হেঁটে চল।

শুদ্ধ মায়ের গলাটা আরও ভালোভাবে জড়িয়ে বলল, ‘নাহ, আমি মায়ের কোল থেকে নামব না।’

‘এখনো মনে হয় ছোট আছিস?

পেট্রা বলল, ‘অসুবিধা নেই, আমি পারব।’

শুদ্ধ প্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের কথাবার্তা বুঝি না, একটু আগেই তো বললে বড় হলে করবি, বড় হলে বুঝবি। তার মানে তো আমি ছোটই এখন।

প্রিয় একটা ধমক দিতে যাচ্ছিল। তার আগেই পেট্রা শুদ্ধকে নিয়ে নেমে গেল। পেট্রা যখন ওকে কোলে নিয়ে হাঁটছিল, প্রিয় গাড়ি পার্ক করতে গেল। তখন শুদ্ধ বলল, ‘মা, সত্যি কি তোমার কষ্ট হচ্ছে? তাহলে বলো আমি হেঁটেই যাচ্ছি।’

পেট্রা শুদ্ধর নাকে নাক ঘষে বলল, ‘একটুও কষ্ট হচ্ছে না, বাবা।

‘আচ্ছা মা, আমাকে তোমার ফোন নম্বরটা দেবে? বাবার মোবাইলে আগে ছিল, এখন খুঁজে পাই না। তাই তো আমি তোমাকে একবারও ফোন করতে পারি না। নম্বর দিলে বুঝবে আমি তোমাকে কত ফোন করি।’

‘তোমার বাবার মোবাইলে আমার ফোন নম্বর নেই! ঠিক বলছো?

‘হ্যাঁ মা!

পেট্রার মনটা হঠাৎ খারাপ হলো। ওর নম্বরটা মোবাইলে না রাখার মতো কী হলো! তারপর বলল, আমার নম্বর কোথায় লিখে দেব, বলো তো? তোমার সাথে কোনো কাগজ-কলম আছে? আমার কাছে তো কিছু নেই।’

‘না না, লিখে নিলে বাবা দেখে ফেলবে, তারপর যদি রাগ করে? তুমি বলো। আমি মখস্থ করে ফেলি।

পেট্রা নম্বর বলল এবং শুদ্ধ মুখস্থ করে ফেলল। বলল, ‘বাহ মা, তোমার নম্বর মনে রাখা তো অনেক সোজা।

পেট্রা হাসল। এত সুখ কেন এই ছোট্ট মুখটাতে? পেট্রা লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রিয় এসে লিফট কল করে তার কোমরে হাত রেখে দাঁড়াল। পেট্রা তাকিয়ে বলল, ‘এটা পাবলিক প্লেস।

প্রিয় বলল, ‘সে জন্যই তো এটুকু।’

শুদ্ধ বলল, ‘কী মা?’

‘কিছু না, মা।

প্রিয় দুষ্টু ছেলেদের মতো হাসতে লাগল। শুদ্ধ বলল, ‘বাবা, তুমি হাসছ কেন?

‘এমনি বাপ। তুইও হাস।

শুদ্ধও হাসল। বাপ-ছেলের বোকা বোকা হাসি দেখে পেট্রাও হাসল। এর মধ্যে লিফট চলে এল। ওরা লিফটে উঠল। ফাঁকা লিফটে প্রিয় পেট্রার কাছে গিয়ে কোমরে হাত বোলাতে লাগল। পেট্রা বলল, ‘তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?

প্রিয় হাসতে হাসতে বলল, ‘আগে ছিলাম না?

বলতে বলতেই প্রিয় এবার হাতটাকে আস্তে আস্তে ওপরে ওঠাতে লাগল। পেট্রা বলল, ‘মেরে ফেলতে চাস তুই আমাকে?

‘অবশ্যই।’

শুদ্ধ বলল, ‘বাবা, তুমি মাকে কেন মেরে ফেলতে চাও? তুমি কি কিলার? মাকে মেরে ফেললে তোমাকে খুব হেট করব আমি।’

লিফট চলে এল গন্তব্যে। পেট্রা হাসতে হাসতে নামল। তারপর শুদ্ধর গাল ধরে বলল, এই মারা সেই মারা না, বাবু।

‘তাহলে কোন মারা, মা? এটাও কি বড় হলে বুঝব?

‘হ্যাঁ।

‘ও! আচ্ছা মা, তুমি যে এত পাতলা একটা শাড়ি পরেছ তোমার শীত করছে না?

‘কই, না তো? শাড়ি পরলে শীত লাগে না অত।

প্রিয় নিজের শাল খুলতে খুলতে বলল, ‘শীত করলে আমার শাল নিতে পারিস।

পেট্রা বলল, ‘দরকার নেই, লাগলে বলব।

প্রিয় রেস্টুরেন্টে ঢুকতে ঢুকতে বলল, দরকার না থাকলেই ভালো, চোখটা জুড়াবে আমার।’

পেট্রা হাসতে লাগল।

পেট্রা শুদ্ধকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল, ‘স্বপ্নের মতো লাগছে দিনটা।’

শুদ্ধ খেতে খেতে বলল, হ্যাঁ, আমারও।

প্রিয় চুপচাপ খেতে লাগল। পেট্রা বলল, ‘দেখেছিস, তুই চাইলে আমরা সবাই ভালো থাকতে পারি।’

প্রিয় না তাকিয়েই বলল, ‘উইদাউট মি।’

‘কেন?

‘দুটো কারণ। প্রথমত, আমি ছেলের কান্না দেখতে পারি না। অথচ তোর সাথে দেখা করলে প্রত্যেকবার সেটা আমাকে দেখতে হয়। এবং দ্বিতীয়ত, তোকে একটু পেয়ে আমার মন ভরে না, পেট্রা। একটু পেলে তোকে আরও বেশি করে পেতে ইচ্ছা করে। একদিন দেখা হলে পরের দিনও দেখা করতে ইচ্ছা করে, প্রতিদিন দেখা করতে ইচ্ছা করে। ফোন করতে থাকি আমি। কথা হলে অস্থির লাগে, কথা না হলে আরও অস্থির লাগে। তোর সাথে দেখা হলে…’

থেমে গেল প্রিয়। পেট্রা তাকিয়ে রইল। প্রিয় আবার বলতে শুরু করল, আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। সামলাতে পারি না নিজের চোখকে, হাতকে, ঠোঁটকে…। আমি যখন হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা নিয়ে তোকে ছুঁতে যাই তখন তুই বিশেষভাবে আমাকে মনে করাস যে, আমরা কেউ কারও নই।’

শুদ্ধ চুপচাপ শুনছে, কিছু বলছে না। কেমন একটা থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হলো। পেট্রা সেটা দূর করার জন্য সরাসরি প্রিয়র চোখের দিকে তাকাল। তারপর হেসে বলল, ‘তাহলে আজ দেখা করলি কেন?

প্রিয় হেসে বলল, ‘কী করব? দেখা না করেও যে থাকতে পারছিলাম না আর। কতগুলো দিন হয়ে গেছিল তোকে দেখি নি।

শুদ্ধ বলল, ‘মা, আমিও অনেক দিন দেখি নি তোমাকে। একদম দুই বছর।

পেট্রা শুদ্ধকে বুকে টেনে নিল। প্রিয় তাকিয়ে রইল। পেট্রা প্রিয়কে বলল, আমি কী করব, সেটা বলে দে। এভাবে নিয়মিত দেখা করব? তুই যা চাইবি, তা-ই করব? নিয়মিত ফোনে কথা বলব? সেটা কীভাবে সম্ভব? আমরা ডিভোর্সি, তুই ইতিমধ্যে বিবাহিত। তোর বিয়ের আগপর্যন্ত তো সেপারেটেড হওয়া সত্ত্বেও কমবেশি সম্পর্ক রেখেছি। এখন বিয়েটা যখন হয়ে গেছে, সবকিছু মেনে নেওয়াটাই শ্রেয়।

‘কীভাবে তুই পারিস এসব বলতে? কষ্ট তো তুইও কিছু কম পাস না। তাহলে?

‘আমি বাস্তবকে মেনে নিতে জানি।

এ কথা বলতে বলতে পেট্রার চোখ জলে ভরে উঠল। ব্যাপারটা খেয়াল করে প্রিয়র খুব খারাপ লাগল। পেট্রার একটা হাত ধরে বলল, ‘সরি।’

শুদ্ধ পেট্রার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে, মা? বাবা সরি কেন বলছে? বাবা কি তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?

পেট্রা হেসে বলল, ‘নাহ মা, তোমার বাবা দুষ্টুমি করেছিল, তাই সরি বলেছে।

তারপর শুদ্ধর কপালে একটা চুমু দিল। সেই সময় পেট্রা তাকিয়ে ছিল। প্রিয়র দিকে। প্রিয় হাসল।
·
·
·
চলবে.....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp