হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো নিহিনের, গলার ভেতর কথা সব আটকে যাচ্ছে যেন। এতদিন পর একবার একটা হ্যালো শুনেই কণ্ঠ চিনে ফেলল কলরব! কোনরকমে বলল,
“হ্যাঁ”
“হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! কেমন আছ তুমি?”
“ভালো, তুমি কেমন আছ?”
“আমিও ভালো আছি।”
“ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”
“আমার কণ্ঠ শুনে তাই মনে হচ্ছে? উলটো তোমার কণ্ঠটা ঘুমে জড়ানো।”
লজ্জা পেয়ে নিহিন বলল,
“আসলে এত রাতে ফোন করেছি তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“তুমি তো দেখি এখনো আগের মতই অকারণে লজ্জা পাও।”
একথায় নিহিন আরো লজ্জা পেল, মনে পড়ে গেল আগের কথা, তখন নিহিনের লজ্জা পাওয়াটা রীতিমতো উপভোগ করত কলরব। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর আবার কলরবই শুরু করল,
“ভাবিনি তোমার সাথে আবার কখনো কথা হবে। কিন্তু, আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেলে?”
“ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।”
“ও, তা ম্যাডামের এ ইচ্ছাটা আরো আগে হলো না কেন?”
“কারণ সে জানতো আপনি পালিয়ে গেছেন। পালিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে লাভ কী?”
“সেটাও ঠিক, তা আজ হঠাৎ কী মনে করে এই পালিয়ে যাওয়া মানুষটাকে খুঁজে বের করা হলো?”
“কারণ কিছুদিন আগেই আমি সত্যিটা জানতে পেরেছি।”
“কোন সত্যিটা?”
“১০ বছর আগে বাবা আর তোমার মধ্যে যা কথা হয়েছিল তা। ৬ বছর আগে যা কথা হয়েছিল তাও।”
“ও, কীভাবে জানলে?”
“বাবা নিজেই বলেছে।”
অবাক হলো কলরব।
“আংকেল নিজে বলেছে?”
“হ্যাঁ।”
“কী মনে করে?”
“জানি না।”
“ও”
আবারও দুজনই চুপ। কিছুক্ষণ পর নিহিন বলল, “তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করনি কেন?”
“কখন?”
“১০ বছর আগে, বাবার সাথে কথা হওয়ার পর। একবারের জন্য যোগাযোগ করনি, উলটো বারান্দার দরজাটাও খোলনি যে কয়দিন ছিলে ওই বাসায়।”
“হুম, ওই রকমই ডিল হয়েছিল তোমার বাবার সাথে।”
বলেই হেসে ফেলল কলরব। নিহিন বলল,
“ডিল! আমি সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি।”
“আমিও সিরিয়াসলি বলছি। এক রকম ডিলই ছিল। তোমার বাবা আমাকে কোনো স্পেস না দিয়ে সরাসরি বলেছিল তোমাকে ভুলে যেতে, উনি প্রেমে বিশ্বাসী না। তখন আমিও তাকে বলেছিলাম, আমি প্রেম করব না, বিয়ে করব। ব্যস একগাদা শর্ত জুড়ে দিয়েছিল, বলেছিল সব মানতে পারলেই তোমাকে পাব। সে সব শর্তের মাঝে এটাও ছিল যে তোমার সাথে লুকিয়ে চুরিয়েও কোন যোগাযোগ করা যাবে না।
“কিন্তু একবার জানাতে পারতে যে বাবার সাথে তোমার এসব কথা হয়েছে এবং তুমি অপেক্ষা করবে।”
“তাতে তো শর্ত মানা হতো না। হয়তো তোমার বাবা জানতে পারত না, হয়তো পারত। কিন্তু আমি তো জানতাম, আল্লাহ তো জানত। শান্তি পেতাম না তাতে।”
“শর্ত মেনেই বা কী হয়েছে?”
কলরব হাসল।
“তোমার বাবা কি রিটায়ার করেছে?”
“হ্যাঁ, গতবছর।”
“এইবার বুঝলাম, কেন তোমাকে সব বলে দিয়েছে।”
“কেন?”
“ওই তো, আর্মি পোশাক যতদিন গায়ে থাকে ততদিন মানুষের মধ্যে মায়া-দয়া কাজ করে না।”
“তুমি আগের মতো দুষ্টুই রয়ে গেছ।”
একটু হেসে বলল নিহিন। কলরব বলল,
“আর তুমিও আগের মত লজ্জাবতী রয়ে গেছ। আচ্ছা এখনও কি আগের মত লাফালাফি কর ধুমধাম?”
“আমি কি চঞ্চল ছিলাম নাকি? লাফালাফি করে চঞ্চলরা।”
“এটাই একটা আজব ব্যাপার ছিল, তুমি কম কথা বলতে, লজ্জা পেতে, কখনো ধমক দাওনি, ঝগড়া করনি। কিন্তু হাঁটার বদলে দৌড়াতে, লাফাতে, উলটো চরিত্র। সোজাভাবে হাঁটতেই দেখিনি কখনো, তবে তোমাকে ওটাতেই মানাতো।”
কলরবের কথা শেষ হতেই একটা বাচ্চা ছেলের কন্ঠ পাওয়া গেল। বাচ্চাটা আহ্লাদি গলায় বলছিল, “পাপ্পা দেখ না, দাদাভাই বলছে আজকেও আমাকে ব্রাশ করতে হবে।”
কলরব নিহিনকে বলল,
“জাস্ট হোল্ড আ মিনিট।”
এরপর ওপাশে শুনতে পাওয়া গেল কলরব বাচ্চাটাকে বলছে, “প্রতিদিন ব্রাশ না করলে তোর মুখে গন্ধ হবে, দাঁতে পোকা ধরবে তারপর আফরা আর তোর পাশে বসবে না, দেখিস তুই।” বাচ্চাটা রেগে বলল, “পাপ্পা, শি ইজ মাই ফ্রেন্ড, আই টোল্ড ইউ বিফোর।”
“নিহিন, সরি।”
“ইটস ওকে, বাচ্চাটা কে?”
“ও কল্প, আমার ছেলে।”
বুকের ভিতরটা কুঁকড়ে গেল নিহিনের, পরক্ষণেই ভাবল এটাই তো স্বাভাবিক, মন খারাপ করার মত কোনো কারণই নেই। নিজেকে আরো স্বাভাবিক বোঝানোর জন্য নিহিন বলল,
“কত কিউট! কল্পর বয়স কত?”
“৫ বছর।”
“স্কুলে যায় বুঝি?”
“হুম, ওকে সাড়ে তিন বছর বয়সেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম।”
“কোন ক্লাসে পড়ছে এখন?”
“কেজি ওয়ান।”
“এইটুকুন একটা বাচ্চা এত রাত পর্যন্ত জেগে থকতে পারে?”
“না, ও ১০ টা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ে। আজকে জেগে আছে কারণ, একটু আগেই আমরা গ্রাম থেকে ফিরলাম।”
“ও তাহলে তো তুমি অনেক ক্লান্ত, ঘুমাও তাহলে।”
“হ্যাঁ, ঘুমাব। আসলে কাল সকালেই অফিস আছে, তা নাহলে আরো জেগে থাকা যেত।”
“কী চাকরি করছ?”
“ব্যাংকে।”
“ফিউচার ব্যাংক?”
“না, এখন এবিসি ব্যাংকে। দেড় দুই বছর আগে ছিলাম ফিউচারে।”
“ও।”
“তুমি? আর্মিতে?”
“ধ্যাত!”
হাসল কলরব। বলল, “তাহলে কী করছ?”
“ইউনিভারসিটিতে আগডুম বাগডুম পড়াই আর কী!”
“ওয়াও লেকচারার, গ্রেট। হাউ লাকি দে আর।”
“কাদের কথা বলছ?”
“তোমার ভার্সিটির ছেলে স্টুডেন্টগুলোর কথা বলছি।”
“তুমি আগের মতই মারাত্মক দুষ্টু আছ।”
“কই না তো।”
“ঘুমাও, তোমার না অফিস আছে?”
“হ্যাঁ, ঘুমাবো। রাখো তাহলে।”
“তুমি রাখো।”
“না তুমি রাখো।”
“একজন রাখলেই হয়।”
“লেডিস ফার্স্ট।”
“আচ্ছা রাখছি, গুড নাইট।”
“শোনো…”
“বল।”
“তোমার ফোন পেয়ে অনেক ভালো লাগল। আসলে অসম্ভব যখন সম্ভব হয় তখন বোধহয় এরকমই লাগে।”
নিহিনেরও কেমন যেন অদ্ভুত লাগতে লাগল!
·
·
·
চলবে.....................................................................................