স্মরণ পেট্রাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় পৌঁছে দিল। সঙ্গে রায়ানও ছিল। এরপর বিদায় নিতে চাইলে পেট্রা বলল, ‘অফিস তো নেই আজ। এত তাড়া কিসের? চা খেয়ে যাও।’
স্মরণ সুযোগ হাতছাড়া করল না। চা খাওয়া মানে কিছুক্ষণ গল্প করা। স্মরণ বলল, তা ঠিক। কিন্তু তুমি তো অসুস্থ। চা আমি বানাই?
‘আরে না, এমন কিছুই হয় নি আমার। তুমি বসো। আমি চা বানাচ্ছি।’
স্মরণ বসল। পেট্রা শুধু ফরমালিটি করেই চায়ের কথা বলেছিল। স্মরণ সত্যিই বসে যাবে তা বোঝে নি। তিন কাপ চা আর টোস্ট বানিয়ে রায়ানের ঘরে এক কাপ দিয়ে স্মরণের সঙ্গে ড্রইংরুমে বসল পেট্রা। স্মরণ বলল, নিজের কোনো খেয়াল রাখো না তুমি। সেদিন আমি ওখানে না পৌঁছালে কী হতো?’
কিছুই হতো না। অন্য কেউ দেখত। আর আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো কিছুই হয় নি। তাও তোমার জন্য হাসপাতাল ঘুরে এলাম। কারণ সুস্থ রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে নিলেও অসুস্থ হওয়ার দায়িত্বটা তারা নিয়ে নেয়।
‘হাসপাতালে নিয়েছি বলে রাগ করেছ? শুনলে তো ডক্টর বলেছে অতিরিক্ত স্ট্রেস যাচ্ছে তোমার ওপর দিয়ে?
‘না, রাগ করি নি। শুধু বললাম যে দরকার ছিল না। আর তোমার এভাবে রাত জেগে থাকারও কোনো দরকার ছিল না। শুধু শুধু ঋণী করলে।
‘ঋণ শোধ করে দাও।’
পেট্রা হাসল। তারপর বলল, ‘স্মরণ, পাগলামি কোরো না। আর কতবার বলব তোমাকে আমি ভালোবাসি না।
‘ভালোবাসতে কে বলেছে? শুধু বিয়ে করো।’
‘সম্ভব না।’
‘কেন? এখন তো বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই।
‘স্মরণ, আমার মা মারা গেছে দুই মাসও হয় নি। এখন তুমি আমাকে বিয়ের কথা বলছ?
‘সরি পেট্রা। কথায় কথা উঠল। আমি এক্ষুনি বিয়ে করার কথাও বলছি না। আসলে তোমার এমন অবস্থা দেখতে পারছি না আমি। তুমি নিজের প্রতি এতটাই কেয়ারলেস যে দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছ। তোমার দিকে খেয়াল রাখার, তোমাকে একটু শাসন করারও কেউ নেই। তাই তোমাকে আগলে রাখার দায়িত্বটা নিতে চাচ্ছিলাম।’
‘তুমি কি আমাকে অসহায় ভাবো স্মরণ?
‘তা কেন ভাবব?
পেট্রা দৃঢ় গলায় বলল, আমার মায়ের জন্য, তাকে খুশি করার জন্য, আমি আবার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এখন মা নেই, তাই আমি আর বিয়েও করব না।’
‘সারা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবে তুমি?
‘এটা আমার জীবন। আমি কীভাবে কাটাব সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার। এ ব্যাপারে কথা বলার অধিকার আমি কাউকে দিই নি।’
‘একজনের জন্য কষ্ট পেয়ে নিজের জীবন নষ্ট করবে কেন? নতুন করে সাজানো উচিত সবকিছু।
পেট্রা শীতল গলায় বলল, আমার জীবন সাজানোই আছে। বিয়ে করে সংসার করলে জীবন সাজানো হয়, আর না করলে বুঝি জীবন নষ্ট হয়, স্মরণ? বিয়ে আর সংসারই কি একটা মেয়ের জীবনের সব? একটা মেয়ে কি অন্যভাবে সুখী হতে পারে না? তোমার মতো আধুনিক একটা ছেলেও এমন টিপিক্যাল চিন্তা করে তাহলে?
‘পেট্রা, তুমি যার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছ, সে কিন্তু বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে আছে।
‘কতটুকু জানো তুমি প্রিয় সম্পর্কে?
‘তোমাকে তো বলেছি আমরা একই এলাকাতে থাকি, একই সাথে জিম করি। অনেকটাই জানি তাকে। অনেক সুখী সে।
পেট্রার মেজাজ খারাপ হলো। সে এবার একটু কঠিন স্বরেই বলল, ‘প্রিয় সম্পর্কে কিছুই জানো না তুমি। আর যা জানো না তা নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে এসো না প্লিজ। যে বাচ্চা নিয়ে ওর সুখে থাকার গল্প শোনাচ্ছ আমাকে, সে আমারই বাচ্চা।
স্মরণ চুপ করে রইল। পেট্রা বলল, একটা অনুরোধ রাখবে স্মরণ?
‘বলো।’
‘ভালোবাসা, বিয়েশাদি এসব নিয়ে আমার সাথে আর কথা বোলোনা প্লিজ। এই চাকরিটা ছাড়লে এই মুহূর্তেই আরেকটা চাকরি পাওয়া আমার
জন্য মুশকিল হবে।’
বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। স্মরণ বলল, ‘ঠিকাছে পেট্রা। চা-টা ভালো ছিল। আজ উঠি?
পেট্রা হেসে বলল, ‘আচ্ছা।’
দরজার বাইরে গিয়ে স্মরণ বলল, আজকের পর থেকে আমি কি তোমার সাথে সাধারণ কথাবার্তাও বলতে পারব না? অন্যকোনো বিষয়ে?
পেট্রা হেসে বলল, ‘অবশ্যই বলবে।
—————
বাজারের একটা দোকানে টিভিতে খবর চলছিল। প্রিয় বাজার করছিল। টিভির দিকে চোখ পড়তেই দেখল, চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে কয়েকশত অবৈধ অস্ত্র ধরা পড়েছে। অস্ত্রের সঙ্গে যারা ধরা পড়েছে তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারল সে। বাবর খানের কাছে প্রায়ই আসত সে। কর্মচারী বলেই জানত। ছেলেটা তাদের সাভারেরই। তার মানে এই অস্ত্রগুলো বাবর খান পাঠাচ্ছিলেন কোথাও। তার অবৈধ কিছু ব্যবসা আছে তা প্রিয় জানে। অনেকবার ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মন্ত্রীসাহেবের সঙ্গে পারবে এমন সাধ্য কোথায় তার? হয়তো এবারও তিনি ধরা খাবেন না। কিন্তু বিশাল লসে পড়ে যাবেন। এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাকে খোঁজার দিকে সেভাবে মনোযোগ দিতে পারবেন না। আর ধরা খেলে তো আলহামদুলিল্লাহ।
রাতে স্টিমারের ডেকের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল প্রিয়। শুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। ওকে অবশ্য ভেতরের কেবিনে শুইয়ে দিয়েছে। আকাশে আধ ফালি চাঁদ, ঝিরিঝিরি বাতাস শরীরে শীতল অনুভূতি এনে দিচ্ছে। খুব আরাম লাগছে। ঘুম আসি আসি করছে। ঠিক এই মুহূর্তে পেট্রা যদি পাশে থাকত! বুকে জড়িয়ে ধরে থাকত শুধু, একটা কথাও বলত না। পেট্রার কথা ভাবতে ভাবতে ওখানেই খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে পড়ল প্রিয়।
ঠিক সেই মুহূর্তে নিকিতা প্রিয়র ঘরে বসে কাঁদছিল। এতদিন হয়ে গেল প্রিয় চলে গেছে। শ্বশুর সাহেব বলেছেন খুঁজে আনবেন, কিন্তু তিনি তো কিছুই করতে পারছেন না। প্রিয় কি আর কখনো ফিরে আসবে না? আর কখনো দেখা হবে না তার সঙ্গে? ইশ, কেন সে এমন পাগলের মতো করল? কিছু না পাক, প্রিয় চোখের সামনে তো ছিল। প্রতিদিন দেখতে তো পেত! নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়তে মন চাইছে। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। কেন এমন করতে গেল? এত বোকা কেন সে? আল্লাহ কি একটু বুদ্ধি দিতে পারল না তাকে?
মাঝরাতে প্রিয় ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠল। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে, ঘেমে একাকার অবস্থা। হাঁপাতে হাঁপাতে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করতে লাগল যে এটা সত্যি নয়, স্বপ্ন ছিল। এত বাজে স্বপ্ন সে দেখল কী করে? পেট্রার কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়েছিল, আর স্বপ্নে কিনা নিকিতার সঙ্গে…ছি ছি। এমনটা হওয়ার আগে যেন তার মরণ হয়। সে জানে পেট্রা যা বলেছে ঠিকই বলেছে। অযৌক্তিক কিছুই বলে নি। কিন্তু তার পক্ষে নিকিতার সঙ্গে এসব করা অসম্ভব। পেট্রা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে আজও ভাবতে পারে না সে। দোয়া পড়ে নিজের বুকে ফুঁ দিল প্রিয়। শয়তান দেখাচ্ছে এসব স্বপ্ন। নিজেকে বড় অশুচি লাগছে।
—————
নিকিতা জানে না পেট্রা কেন তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। কিন্তু দেখা করতে চাওয়ায় সে এককথায় রাজি হয়েছে। কফিশপে দুজন মুখোমুখি বসে আছে। আজ নিকিতা মনস্থির করেই এসেছে মাথা ঠান্ডা রাখবে বলে। পেট্রার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করবে না। পেট্রাকে দেখে তার মনে হচ্ছে সে বেশ হাসিখুশি মিশুক একটা মেয়ে। আসার পর থেকে খুব স্বাভাবিকভাবে এটা-সেটা অনেক কথাই বলছে। যেন নিকিতা তার অনেক দিনের চেনা। নিকিতা অবশ্য কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু একবার বলেছে, আপনি আমাকে আপনি আপনি কেন বলছেন? তুমি করে বলুন, আমি আপনার চেয়ে অনেক ছোট। পেট্রা তারপর থেকে ‘তুমি’ করেই বলছে। একসময় বলল, ‘নিকিতা, আমি আসলে তোমাকে যে কথা বলার জন্য ডেকেছি তা এখনো বলি নি। আসলে ভাবছি কথাগুলো তুমি কীভাবে নেবে বা বিশ্বাস করবে কি না। কিন্তু এটা বললে তোমার কাছে একটা জিনিস অন্তত ক্লিয়ার হবে।’
‘আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন আপু।
‘আমার বাবা হরতালের দিন অফিসে গিয়েছিলেন। ফিরেছিলেন লাশ হয়ে। সবাই জানে ক্রসফায়ারে পড়ে মারা গেছেন। শুধু আমি জানি বাবাকে খুন করিয়েছেন তোমার শ্বশুর। তিনি নিজেই আমাকে জানিয়েছেন। আমার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন। কিছুই করতে পারি নি আমি।
নিকিতা বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে পড়েছে। পেট্রা বলতে লাগল, উনি আমাকে আগেও থ্রেট দিয়েছিলেন প্রিয়র সাথে সম্পর্ক রাখলে উনি আমার পরিবারের ক্ষতি করবেন। যদিও তখন আমি বা প্রিয় কেউ গায়ে মাখি নি। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেলেও সম্পর্ক ছিল। আসলে বুঝতে পারি নি উনি সত্যিই এতটা নির্দয় হবেন।
নিকিতা চুপ। পেট্রা আবার বলল, ওই ঘটনার পর আমার আর প্রিয়র আসল বিচ্ছেদটা হয়। প্রিয় চাচ্ছিল সম্পর্ক রাখতে, আমি রাখি নি। হ্যাঁ, আমি প্রিয়কে ভালোবাসি। ভালোবাসা বোঝার আগে থেকে আমি এই ছেলেটাকে ভালোবাসি। তাই এখন অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা ভাবতে পারি না। কিন্তু নিজের বাবার খুনির ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ভুলের জন্য আমার বাবা মারা গেছেন। আমার মাও পরোক্ষভাবে আমার ভুলের জন্যই চলে গেছেন। এই অপরাধবোধ থেকে আমি কখনো বের হতে পারব না। এরপর যদি সবকিছু ঠিকও হয়ে যায়, প্রিয়র বাবা যদি কখনো নিজে এসে আমার কাছে অনুরোধও করে প্রিয়র সাথে সংসার করতে, তবুও আমি তা পারব না। প্রিয় নিজেও জানে সেটা। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমাকে নিয়ে জেলাস হওয়ার কোনো কারণ নেই?
পেট্রার চোখ ভিজে আসছে। মুখটা লাল হয়ে গেছে। কেন জানি পেট্রার মুখ দেখে নিকিতার কান্না পাচ্ছে। নিকিতা পেট্রার একটা হাত ধরে বলল, ‘সরি আপু।’
পেট্রার চোখে জল কিন্তু সে হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘শুদ্ধর মা মারা যাওয়ায়, জন্মের দিন থেকেই শুদ্ধকে আমি নিজের ছেলের মতো পেলেছি। জন্ম না দিয়েও ওর মা হয়েছি। মা যেমন সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, আমিও ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। প্রিয়কে হারিয়েও শুদ্ধকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যেদিন তোমার শ্বশুর জানতে পারলেন শুদ্ধ ভাইজানের ছেলে, সেদিনই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেছেন ওকে। এই লোকটাকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি।
নিকিতা চুপ করে রইল। পেট্রা আবার বলল, তোমার কাছে আমি অনুরোধ করছি, আমার শুদ্ধকে তুমি কখনো জানতে দিয়ো না আমরা ওর বাবা-মা নই। ও খুব অভিমানী ছেলে। কী থেকে কী করে বসবে ঠিক নেই। তুমি ওকে মায়ের আদর দিয়ো প্লিজ।
‘আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপু, শুদ্ধ কখনো জানবে না। আমি আর পাগলামি করব না।’
পেট্রা দুহাতে নিকিতার দুই হাত ধরে বলল, ‘আর প্রিয়কে কষ্ট দিয়ে। ও খুব অসহায়। ওকে একটু বোঝো, ভরসা দিয়ে আর অনেকটুকু ভালোবেসো। ভালোবেসে তুমি ওর ভেতর জমে থাকা সব কষ্ট, অভিমান আর অপরাগতাগুলোকে মুছে দিয়ো।
·
·
·
চলবে....................................................................................