শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ০৮ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          শেষ। আমি শেষ। আবারও আমি ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলাম। সব মীরারাই কি অভিনয়ে পারদর্শী হয়? সব মীরারাই কি চরিত্রহীন হয়? এখনো ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে মীরা আমাকে সম্পূর্ণ মিথ্যে পরিচয় দিয়েছে! যে মীরার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মেলাবার জন্য আমি কলাবাগানের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি সে কলাবাগানে থাকেই না। সে থাকে নাখালপাড়া। এসব ছোটখাটো ব্যাপার না হয় ছেড়েই দিলাম। কারণ সে আরো অনেকগুলো বড় বড় মিথ্যে বলেছে। সে আমার নাম্বার কীভাবে পেয়েছে তা নিয়ে তো বিরাট এক মিথ্যে নাটক তৈরি করেছে। সে আমাকে বলেছিল তাদের বাসার কাজের মেয়ে নাকি বাড়িতে ফোন করতে গিয়ে একটা ডিজিট ভুল করে আমাকে ফোন করেছে!

অথচ আজ জানতে পারলাম সব মিথ্যে বলেছে। ও আসলে তপনদের বাসার বাড়িওয়ালার মেয়ে। তপনের বোন ত্রিশার বান্ধবী। ও তপনের ফোন থেকেই আমাদের সব বন্ধুদের নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দিয়েছে! শুভকে বানিয়েছে স্বামী, বাচ্চার বাবা। আর আমাকে বানিয়েছে প্রেমিক। দীপু আরিফের সঙ্গেও কথাবার্তা চলছে।

অথচ এই মীরাকে আমি ছাগলের মতো বিশ্বাস করে বসে আছি। যেখানে তাকে ভালোবেসে আমি দিন-রাত এক করে ফেলছি, সেখানে তার জন্য আমি শুধুই মজা? এও কি সম্ভব ওই ছোট্ট নিষ্পাপ দেখতে মেয়েটার দ্বারা? এত বড় ধোকার শিকার হলাম আমি? এত বোকা আমি? এত বোকা?

রাফসান শিকদার
২২ নভেম্বর, ২০০৯

মীরার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব না বলে ফোন বন্ধ করে রেখেছি। ও খুব কাঁদছিল। সবটা এক্সপ্লেইন করতে চেয়েছিল। কোনো সুযোগ দিইনি। আমার যে পরিমাণ রাগ উঠেছে তাতে ওর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে গেলে ভয়াবহ কিছু হতো। অনেক বাজে এবং কঠিন কথা বলে ফেলতাম যা হয়তো ও নিতেই পারত না। হায়রে রাফি এত বড় ছাগল তুই? এখনো ওই মেয়ে কী নিতে পারবে আর কী নিতে পারবে না সেই চিন্তা করিস? এখনো এত ভাবছিস? যে এত অভিনয় জানে, এত মিথ্যা জানে সে সবই নিতে পারবে।

রাফসান শিকদার
২২ নভেম্বর, ২০০৯

শুভ, আরিফ, দীপু তিনজনের ফোনেই মীরার নাম্বার থেকে কল গিয়েছিল। মীরার নাম্বার বলতে ওর নিজস্ব ফোন যেটা ছিল সেটা থেকে। আমি যেটা দিয়েছি সেটা না। তার মানে ঘটনা মাস দুয়েক আগের। কারণ মীরার ওই ফোন ওর বাবা দু মাস আগেই নিয়ে নিয়েছে। আমার বন্ধুরাও আমাকে দু মাস আগের কল হিস্ট্রিই দেখাল। তবে দীপু এবং আরিফের সঙ্গে খুব বেশি কথা হয়নি। বেশি কথা হয়েছে শুভর সঙ্গে। কেন যেন মনে হচ্ছে–এখানে বড় ধরনের কোনো ফাঁক রয়ে গেছে। যেটা আমি ধরতে পারছি না। আমার মন মস্তিষ্ক সবই বলে মীরা এমন হতেই পারে না। মিথ্যা বলতে পারে, তাই বলে একইসঙ্গে এতগুলো ছেলের সঙ্গে চক্কর চালাতে পারে না। নাকি এই ভাবনা আমার আরেক বোকামি?

রাফসান শিকদার
২৩ নভেম্বর, ২০০৯

নাহ পারছি না। শক্ত থাকতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে মীরাকে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। আমি জানি কোনো একজনের জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। কাউকে ছাড়া কেউ মরে না। কিন্তু তবুও প্রতিমুহূর্তে আমার এ এক অসহ্য রকমের দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু ওর কাছে ফিরে যেতে পারছি না। অসহ্য লাগছে ওকে। না পারছি ফেলতে, না পারছি গিলতে! ফেলতে গেলে মনে হয় ওকে তো ভালোবাসি। গিলতে গেলে মনে হয় ওকে তো ঘৃণা করি।

কেউ যখন কাউকে একইসঙ্গে ভালোবাসে এবং ঘৃণা করে তখন তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এবং এটা দুনিয়ার সবচেয়ে বিশ্রী অনুভূতি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি শান্তনার ক্ষেত্রেও সম্পর্কের শেষদিকে আমার এই একই অনুভূতি ছিল। অনেক কষ্টে সেই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। কেন বিশ্রী এই অনুভূতিগুলো পুনরায় আমাকে তাড়া করছে?

রাফসান শিকদার
২৫ নভেম্বর, ২০০৯

আজ মা বাপের বাড়ি গেছে। সবার মায়ের বাপের বাড়ি যাওয়া আর আমার মায়ের বাপের বাড়ি যাওয়া কিন্তু এক না। আমার মায়ের বাপের বাড়ি তুরস্ক। নানা নাকি অসুস্থ। মাকে একবার দেখতে চায়। এমতাবস্থায় না গিয়ে পারা যায় না। যাওয়ার আগে মায়ের মন খুব খারাপ ছিল দুটো কারণে। প্রথমত, বাড়ি করার পর বাবার যতটুকু সেভিংস ছিল সব খরচ হয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, বাবা বা আমাদের কাউকেই মায়ের সঙ্গে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার প্রাণপ্রিয় স্বামী, দু বছরের ছোট্ট কন্যা আর দুটো দামড়া ছেলেকে এখানেই রেখে যেতে হচ্ছে। হয়তো চিন্তা হচ্ছে আমরা ঠিকভাবে চলতে পারব কি না। মা আমাদের এমনভাবেই মানুষ করেছেন যে আমরা ঠিকঠাকই চলতে পারব। কোনো সমস্যাই হবে না। কিন্তু মায়ের চিন্তা দূর করতে পারব না।

আল্লাহর কাছে সারাদিন দুটি প্রার্থনা করে যাচ্ছি। এক, তিনি আমার মায়ের সব চিন্তা দূর করে দিক। নিরাপদে তিনি দেশে পৌঁছাক এবং নিরাপদে ফিরে আসুক।

দুই, আল্লাহ আমার বাবার মনটা ভালো করে দিক। হাসিখুশি মানুষটাকে জীবনে এই প্রথম মন খারাপ করতে দেখলাম। ২৩ বছরের সংসার জীবনে কখনোই একটি দিনের জন্যও আলাদা থাকেননি তাঁরা। আল্লাহ খুব দ্রুত দুজনকে দুজনার কাছে ফিরিয়ে দিক।

রাফসান শিকদার
২৬ নভেম্বর, ২০০৯
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp