শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ০৯ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          বাসায় মা নেই এমনটা এর আগে কদাচিৎ হয়েছে। তবে সেটা কয়েক ঘণ্টার জন্য। এরকম একাধারে মাকে ছাড়া থাকা তো কখনো হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম মাকে ছাড়া আমাদের কোনো সমস্যাই হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ভীষণ সমস্যা হচ্ছে। রান্নাবান্না আমি আর রাহি মিলে করে নিচ্ছি। বাবাও কখনো সাহায্য করছে। নিজেদের অন্যান্য কোনো কাজেই সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা একটা জায়গায় সেটা হচ্ছে-মাকে দেখতে পাচ্ছি না। মা বলে ডাকতে পারছি না। বাবা হুটহাট মায়ের নাম ধরে ডেকে ফেলছেন। আমরা অবশ্য শুনেও না শোনার ভান করি।

এই প্রথম মা দূরে গিয়ে বুঝিয়ে দিলেন তিনি যতই আমাদের সব কাজ শেখান না কেন, আমরাও আসলে অন্য ছেলেমেয়েদের মতোই মাকে ছাড়া অচল!

রাফসান শিকদার
২৮ নভেম্বর, ২০০৯

আমি মীরাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না আবার আমার বন্ধুদেরকেও পুরোপুরি বিশ্বাস হয় না। বিশেষ করে শুভকে একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না। মীরার বক্তব্য শোনা দরকার। দাগি আসামিকেও কিছু বলার সুযোগ দেয়া হয় কিন্তু আমি ওকে কিছু বলার সুযোগ দিইনি। কাজটা ঠিক হয়নি। আবার আরেকদিক থেকে ভাবতে গেলে ঠিক আছে। প্রচণ্ড রাগের মাথায় কারো সঙ্গে সিরিয়াস ব্যাপারে কথা বলা উচিত না। বললে হয়তো বাজে কিছু বলে ফেলতাম! অন্য কারো মেয়েকে বাজে কথা বলার আমি কে? তারচেয়ে এই নীরব শাস্তি ভালো। ৭ দিন হয়ে গেছে আমার ফোন বন্ধ ছিল। আজ ফোন করেছিলাম। ফোন ধরেই মীরার কান্নাকাটি শুরু। মেয়েরা এই একটা কাজ খুব ভালো পারে। এটা তাদের মোক্ষম অস্ত্র। অস্ত্র কাজে লেগেছে। কান্না শুনেই মায়া লাগল! অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাপার। মায়া ভয়ানক এক জাল। এই জালে আটকালে জীবদ্দশায় বের হবার সুযোগ মেলে না। নিজের ওপর বিরক্তির শেষ রইল না আমার।

যাই হোক, বিরক্তি নিয়েই ওর বক্তব্য শুনলাম। ঘটনা হচ্ছে মীরা নতুন ফোন পাওয়ার পর হঠাৎ একদিন ত্রিশা একটা কাগজে আমাদের ৪ বন্ধুর ফোন নাম্বার লিখে নিয়ে এসেছিল। সবাইকে ফোন করে মজা করবে বলে। প্রথমে নাকি আমাকে কল করেছিল। আমি ফোন ধরলাম না। এরপর ফোন করেছে শুভকে। শুভর সঙ্গে সেই থেকে ত্রিশার কথা শুরু। ওর সঙ্গে কথা জমে ওঠায় প্রায়ই নাকি ত্রিশা মীরার কাছে এসে ওকে ফোন করত। প্রথমদিন আমি যখন মীরাকে কলব্যাক করেছিলাম ততক্ষণে ত্রিশা চলে গেছে। আর মীরাও প্রথমে। বুঝে উঠতে পারেনি আমি আসলে কে! যখন বুঝলো ততক্ষণে নাকি আমার কণ্ঠ শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। একবার কথা বলেই নাকি আবার কথা বলার লোভে পড়ে গিয়েছিল। ওদিকে ত্রিশা মীরার বেস্টফ্রেন্ড, সে বারবার বলছিল যেন ধরা না খায়। তাকে বাঁচাতে গিয়ে মীরা মিথ্যা বলেছিল। বক্তব্য অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। সত্যিই মনে হচ্ছে কিন্তু ভেজালটা হলো কণ্ঠস্বরের ব্যাপারটায়। এই একই কথা আমি মীরাকে বলেছিলাম। মীরাও এখন এই কথা আমাকে বলছে! এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। তাছাড়া আমার কণ্ঠস্বর এমন কোনো রসগোল্লাও না, আমি তা জানি।

এক পর্যায়ে আমি মীরাকে জিজ্ঞেস করলাম, ও যে ত্রিশাকে যখন-তখন ওর ফোন ব্যবহার করতে দিত, ওই মেয়ে যদি কোনোদিন আমাকেই ফোন দিয়ে বসত তাহলে তো আমাদের সম্পর্কের কথা টের পেয়ে যেত।

এ কথা জিজ্ঞেস করতেই মীরা ফুঁসে উঠল, কেন আমাদের সম্পর্কের কথা ত্রিশা জানলে কি তোমার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?

আচমকা আমি হাসি আটকাতে পারলাম না। তবে পরমুহূর্তেই সামলে নিলাম। যে মেয়ে আমাকে নিয়ে জেলাস ফিল করে সে নিশ্চয়ই আমাকে ভালোবাসে। এত সরল যে মেয়ে, সে মিথ্যা বললেও নাটক সাজাতে পারে না।

রাফসান শিকদার
২৯ নভেম্বর, ২০০৯

আসলেই আমি প্রেমে পড়ে ছাগল হয়ে গেছি। নাহলে এই ব্যাপারটা আমার মাথায় আরো আগে কেন এলো না! তপনদের বাসায় গেলেই ত্রিশা যে আমার পেছনে ছুক চুক করত-সেটা আমি কীভাবে ভুলে গেলাম? আজ হঠাৎ মনে পড়ল। আমি এখন নিশ্চিত মীরা যা বলেছে সত্যি বলেছে। দুজনের বয়স এক হলেও স্বভাব আলাদা। মীরাকে ত্রিশা হাটে নিয়ে ১৪ বার বেঁচে দিতে পারবে, মীরা টেরও পাবে না। যে মেয়ে চায়ের কাপ দেয়ার হুঁতোয় হাতে হাত লাগাতে পারে সে মেয়ে নির্দ্বিধায় এতগুলো ছেলের সঙ্গে কথা বলে যেতে পারে। আসল ঘটনা আমার বোঝা হয়ে গেল। একটা ক্ল যখন পেলাম তখন সত্যিটা প্রমাণ করতে আর সমস্যা হলো না। মীরার কিছু ভয়েস রেকর্ড করেছিলাম। দীপু আরিফকে শোনানোর পর ওরা বলল ওদের সঙ্গে যে কথা বলেছে তার গলা এটা নয়। কিন্তু শুভকে শোনানোর পর শুভ বলল, ওর সঙ্গে যার কথা হয়েছে এটা তারই গলা। সন্দেহটা তখনই হলো। কারণ দীপু আরিফ দুজনেই মিথ্যে বলবে তা হয় না। ওদেরকে একসঙ্গেও জিজ্ঞেস করিনি, আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করেছি। শুভকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, এখনো কথা হয় কি না, শুভ বলল হয়। তখন শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গেলাম ওর মীরার সঙ্গে কথা হয়নি। কারণ মীরার ফোন তো ওর বাবা নিয়ে নিয়েছে পরীক্ষার আগেই। তার মানে মীরা সত্যি বলেছে। শুভ ত্রিশার সঙ্গে কথা বলত। ওদের হয়তো প্রেম হয়েছে আর সেটা আড়াল করতেই শুভ মিথ্যে বলছিল।

আমাদের মাঝে আজ যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা মীরার এই সরলতার জন্য হয়েছে। ওর সরলতা কমাতে হবে। মানুষকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা যে ঠিক না তা ওকে বোঝাতে হবে। ও যে নরম মেয়ে কোনো সহজ পদ্ধতিতে বোঝালে হবে না। কঠিন পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

রাফসান শিকদার
০২ ডিসেম্বর, ২০০৯
·
·
·
চলবে.................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp