ফানুস - অন্তিম পর্ব ৪৫ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          পেট্রা রান্না করছিল। এর মধ্যেই দুবার কলিং বেল বাজল। পেট্রা রায়ানকে বলল দরজা খুলতে কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। উফ, রায়ানটা কি এখনো ঘুমাচ্ছে! পেট্রা চুলা বন্ধ করে দরজাটা খুলল। দরজা খুলে যা দেখল, তাতে তার নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার জোগাড়। শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে, একা। মুহূর্তের মধ্যে শুদ্ধ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। পেট্রা শুদ্ধকে কোলে নিয়ে ভেতরে চলে এল। খুশি সামাল দিতে না পেরে কেঁদে ফেলল সে। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, শুদ্ধ কাঁদল না। উল্টো হাসছে। শুদ্ধ বলল, ‘মা, আমি এত বড় হয়ে গেছি। দশ বছর বয়স আমার। তুমি এখনো আমাকে কোলে নিচ্ছ!’

‘মায়ের কাছে বাচ্চারা কখনো বড় হয় না, বাবু।

শুদ্ধ মায়ের গালে চুমু দিল। পেট্রা শুদ্ধর কপালে চুমু দিল। তারপর শুদ্ধ কোল থেকে নেমে জড়িয়ে ধরে রাখল। পেট্রা বলল, কার সাথে এসেছিস, বাবা? কীভাবে এলি? আমার মাথায় কিছু আসছে না।

ঠিক এমন সময় প্রিয় বলল, আমরা নিয়ে এসেছি।’

পেট্রা তাকিয়ে দেখে প্রিয়, নিকিতা ও আনিসা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। তিনজনের মুখেই হাসি। পেট্রা হেসে এগিয়ে গেল। নিকিতার কোল থেকে প্রসন্নকে কোলে নিল। কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘কী সৌভাগ্য আমার, বাবা, তোকে কোলে নিতে পারব, কখনো ভাবি নি!

প্রিয়র বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো পেট্রার। চোখ বেয়ে তখনো খুশির অশ্রু ঝরে চলেছে। মুখে হাসি, কণ্ঠে উত্তেজনা। আনন্দে দিশেহারা সে। প্রিয় মুগ্ধ চোখে দেখছে পেট্রার এই আনন্দ। তার বুকের চাপা আর্তনাদ ও অজস্র চোখের জলের বিনিময়ে সে কিনেছে এই আনন্দ। পেট্রা বলল, আমার মাথায় ঢুকছে না। তোমরা কী করে এলে! আর আসার আগে একবার জানালে না?

প্রিয় চুপ।

নিকিতা বলল, তাহলে কি এ রকম সারপ্রাইজ দিতে পারতাম, বলো?’

শুদ্ধ বলল, ‘মা, জানো, বাবা, নিকিমা, প্রসন্ন আর আমি মিলে এই সারপ্রাইজ প্ল্যানটা বানিয়েছি।

পেট্রা হেসেই চলেছে। বলল, ‘এই, তোমরা সবাই ভেতরে এসে বসো।

আনিসা আমতা আমতা করে বলল, ‘দি, রায়ান বাসায় নেই?

পেট্রা হেসে বলল, ‘আছে তো, ঘুমাচ্ছে। ওই ঘরটা ওর, যাও না, ডেকে তোলো।’

আনিসা শুধু এইটুকুর অপেক্ষায় ছিল। এবার সে দ্রুত রায়ানের ঘরে গিয়ে ঢুকতেই দেখল রায়ান ঘুমাচ্ছে। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে সে রায়ানকে ডেকে তুলল। রায়ান চোখ মেলে তাকাতেই তার পিলে চমকে গেল। উঠে বসে বলল, তুমি!

আনিসা ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে গাইতে লাগল,

‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি,

ইরান-তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি।’ রায়ান হা করে তাকিয়ে আছে। তার কাছে এখনো সবকিছু অবিশাস্য লাগছে। স্বপ্ন দেখছে না তো সে? আনিসা নিজের পাগলামিতে নিজেই হেসে কুটিকুটি হলো। রায়ানের তখনো ঘোর কাটে নি।

নিকিতাই মূলত তার ফ্যামিলিকে রাজি করিয়েছে রায়ান-আনিসার বিয়ের ব্যাপারে। প্রিয় সাপোর্ট দিয়েছে। নিকিতার কথা একটাই, সে আরেক জোড়া প্রিয়-পেট্রাকে চায় না। হয়তো কোনো নিকিতা রায়ানের জীবনে আসবে। রায়ান হয়ে যাবে প্রিয় আর আনিসা সারা জীবন পেট্রার মতো কষ্ট পাবে। এটা সে হতে দেবে না। রাজি হলে হবে, না হলে আনিসাকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবে, এমনটাই বলছিল নিকিতা। মেয়ে বিয়ে দিয়ে তার শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা খাওয়ার অপরাধে নিকিতার বাবা তেমন কিছু বলতে পারল না। যা-ও বলল, নিকিতা সে কথাকে দাঁড়াতে দিল না। উল্টো বলল, ‘আনিসাকে বিক্রি করার ব্যবস্থাও করে ফেলেছ। নাকি?’ পরে প্রিয় ধমকে থামিয়েছে তাকে।

আনিসা-রায়ানের বিয়ে দিয়ে প্রিয়-নিকিতা দেশে ফিরবে। তাই চা খেতে খেতে এ ব্যাপারে পেট্রার সঙ্গে কথা বলে নিল তারা। এক সপ্তাহ তারা থাকবে, এর মধ্যেই বিয়ের ব্যবস্থা করবে। ভিডিও কলে নিকিতার বাবা-মা উপস্থিত থাকবেন। কথাবার্তা শেষ করে প্রিয় উঠে যেতেই পেট্রা বলল, ‘আরে, এখনই যাবি কেন? লাঞ্চ করে যাবি।’

প্রিয় বলল, লাঞ্চ করব রায়ান-আনিসার বিয়ের দিন। আজকে যেতে হবে। বাবা এসেছে। হোটেলে আছে।

পেট্রা অবাক।

‘উনি কেন এসেছেন?

‘আমাকে পাহারা দিতে।

এ কথা বলে প্রিয় হেসে দিল। প্রিয়র দেখাদেখি সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল পেট্রা আর নিকিতার মাঝেও। যাওয়ার আগমুহর্তে প্রিয় বলল, ‘তোর জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ আছে। সেটা কী, জানিস?

পেট্রা হেসে বলল, ‘আরও সারপ্রাইজ! বদহজম না হয়!

প্রিয় বলল, ‘শুদ্ধ আজ থেকে তোর কাছে থাকবে। বাবার অনুমতি নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

পেট্রা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। প্রিয়র পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল নিকিতা। বলল, ‘আরে, শ্বশুরসাহেবকে রাজি করাতে গিয়ে কত যে কসরত করতে হলো! প্রিয় কত যে শর্ত মেনেছে! অবশ্য আমারও একটু ক্রেডিট আছে।

ওদের অবাক করে দিয়ে পেট্রা প্রিয়-নিকিতা দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। ওরাও ধরল। প্রিয় পেট্রার চুলের ঘ্রাণ নিল, হয়তো শেষবার।

—————

রায়ান-আনিসার বিয়ের পর যেদিন প্রিয়-নিকিতা চলে যাচ্ছিল, সেদিন রায়ান, আনিসা, শুদ্ধ ও পেট্রা এসেছিল তাদের সি-অফ করতে। চলে যাওয়ার আগমুহূর্তে পেট্রা-প্রিয় দুজন একসঙ্গে বলে উঠল, একটা কথা বলার ছিল।’

তারপর দুজনই হেসে দিল। পেট্রা বলল, ‘তুই আগে বল।

‘উঁহু, তুই আগে বল।

পেট্রা হেসে বলল, ‘বিশ্বাস কর প্রিয়, সেবার রেজাল্ট যদি পজেটিভ হতো এবং তোর-আমার নিজেদের একটা বাচ্চা হতো, তবু এত খুশি হতাম না, যতটা শুদ্ধকে ফিরে পেয়ে হয়েছি।’

‘আমি জানি, পেট্রা।’

পেট্রা জিজ্ঞেস করল, এবার বল তুই কী বলতে চেয়েছিলি?’

প্রিয় হেসে বলল, ‘দূরে গেলেই আসলে ভালোবাসাটা সবচেয়ে বেশি করে টের পাওয়া যায়। তোর থেকে দূরে থেকে বুঝেছি তোকে কতটা ভালোবাসি। আজও।

—————

কিছু কিছু প্রেমিক-প্রেমিকা থাকে, যারা ভালোবাসা কী, তা বুঝতে শেখার আগেই পরস্পরকে ভালোবাসে। তারা ভালোবাসে পাগলের মতো। সমাজ, পরিবারের কথা চিন্তা করার মতো বয়স হওয়ার আগেই তারা ভালোবেসে ফেলে। তাদের ভালোবাসাটা হয়ে যায় রক্তের সম্পর্কের মতো। মাতাল করা ভালোবাসা তাদের উড়িয়ে, ভাসিয়ে, ডুবিয়ে দিয়ে যায়। জাগতিক নিয়ম হয়তো তাদের আলাদা করে দেয়, জড়িয়ে দেয় অন্যের সঙ্গে। তবু তারা দূর থেকে দুজন দুজনকে ভালোবাসে, যে ভালোবাসায় কোনো চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার নেই। কে কী করছে, কীভাবে আছে, কেমন আছে, তা তারা জানে না হয়তো, কিন্তু তারা একে অপরকে ভালোবাসে। হ্যাঁ, আগের মতোই পাগলের মতো ভালোবাসে। তাদের সম্পর্কটা ফানুসের মতো। ফানুস ওড়ানোর সময় সবাই যেমন ভীষণ আনন্দিত থাকে। তারা জানে ফানুস আজীবন আলো জ্বেলে আকাশে উড়তে পারে না। মোম ফুরোলেই নিভে কোথাও পড়ে যাবে। তবু লোকে ফানুস ওড়ায়, আনন্দ নিয়েই ওড়ায়। ঠিক তেমনি, তারাও প্রেমে পড়ে।
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp