ধরিত্রীর বুকে অন্ধকার নেমেছে। দিনের আলো ফুরিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ তুলে নিজের স্থান পরিবর্তন করেছে। অবস্থান সাতটার ঘরে। প্রকৃতি ঘোর তমসায় নিমজ্জিত। অম্বরে কালো নীরদের ঘনঘটা। ক্ষণে ক্ষণে আকাশের গা চিরে বজ্ররেখা দৃশ্যমান হচ্ছে। গির্জার চারপাশ মুখরিত খুশির আমেজে। বেষ্টিত শত গার্ডের দ্বারা।ঘরোয়াভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হচ্ছে। ডুবইস আর্থার খুব কাছের ব্যবসায়িক পার্টনার গুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন অপরদিকে শেখ সাদমান ও কয়েকজন সহকর্মী ডক্টরকে আমন্ত্রণ করেছেন। ওনাদের একমাত্র ছেলে এবং মেয়ের বিয়ে বলে কথা। একদম হেলায় ফেলায় তো সম্পন্ন হতে পারে না। তাছাড়া ডুবইস আর্থার, বিলিওনিয়ার এর ছেলের বিয়ে। যেন তেন মানুষের ছেলের বিয়ে নয়।রৌহিশের নিষেধাজ্ঞা না থাকলে ডুবইস আর্থার সেভাবেই সব কিছুর আয়োজন করতেন। কিন্তু ছেলের কথা অমান্য করার সাহস ওনার নেই। তবুও একটু অবাধ্য হয়েছেন। এই যে ইনভাইটেড সকলের কথা রৌহিশের নিকট অজানা। রৌহিশের আদেশ ছিল কেবল দুই পরিবারের উপস্থিতিতে বিয়েটা সম্পন্ন হবে। সেখানে উনি একটু পাকনামি করেছেন। নিজের অজান্তেই হয়তো বোকামো করে বসেছেন।
গির্জার ভেতরে মানুষের উপস্থিতিতে গমগমে পরিবেশ। কিন্তু এখনো বর এবং কনের পরিবার এসে পৌঁছায়নি। খবর নেওয়া হয়েছে রওনা দিয়েছেন। পথিমধ্যে আছেন ওনারা।
কিয়ৎসময়ের ব্যবধানে পরপর বিশটা মার্সিডিজ বেঞ্জ এসে থামল গির্জার সামনে। প্রথম গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল ব্ল্যাক ফর্মাল ড্রেস পরিহিত একজন যুবক। নিজেকে আজ সম্পূর্ণ ব্ল্যাক কালারে মুড়িয়েছে ডুবইস রৌহিশ রৌনক। ব্ল্যাক শ্যুটের মাঝে থেকে উঁকি দিচ্ছে পরিহিত সফেদ রঙা শার্টটা। হাতে প্যাটেক ফিলিপ ব্র্যান্ডের সাদা, কালোর কম্বিনেশনে তৈরি ঘড়িটা জ্বলজ্বল করছে। ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুলগুলো জেল দিয়ে খাড়া করে রাখা। গৌরবর্ণের শরীরে রঙটা ভীষণ মানিয়েছে, আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। অবশ্য ব্ল্যাক তার নিজস্ব রঙ, নিজস্ব শক্তি। পিছনের গাড়ি গুলো থেকে নেমে এলো এলিয়ানা, ডুবইস আর্থার, রিদাহ, তিয়াশ, রোজ, রাইমা হান্টস সহ আরও কয়েকজন এবং গার্ডস। রাইমা হান্টস এলিয়ানার বন্ধু কম বোন বেশি। তাই তো মেয়েকে সাথে নিয়ে ওনাকে আসতে হয়েছে। জ্যাইন ও আসবে সম্ভবত। তবে কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আসেনি রবিন হান্টস। আসবেন না তিনি। কী একটা কাজে যেন ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন! এলিয়ানা নিজে যেয়ে রাইমা হান্টস এবং রোজকে সঙ্গে করে এনেছেন। একমাত্র ছেলের বিয়ে আর ওনার বোন থাকবে না তাই কখনো হয় নাকি! কখনো শত্রুতা, কখনো বন্ধুত্ব এভাবেই ঝুলে আছে সম্পর্কগুলো। কার মনে কী আছে বোঝা বড্ড দুষ্কর!
রৌহিশকে দেখতেই গির্জার ভেতর থেকে ভেসে আসা কোলাহল থেমে গেল। নিস্তব্ধতা বিরাজ করল সবটা জুড়ে। ওদের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে আসলেন যাজক। ভালো মন্দ কথা বললেন সকলের সাথে। অথচ কারোর কোনো পরোয়া না করেই গটগট পায়ে হেঁটে ভেতরে চলে গেল রৌহিশ। ওর পিছু পিছু সবাই সেদিকে অগ্রসর হলেন। যাজক এতে একটু অসন্তুষ্ট হলেন বৈকি। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার দুঃসাহস করলেন না। সবাই যেতেই ওখানে উপস্থিত হলো আরও একটা বিএমডব্লিউ গাড়ি এবং বাইক। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন শেখ সাদমান, আরাধ্যা শেখ, জারা স্মিথ এবং তন্ময়। জারা স্মিথকে বলা হয়েছে মিরা পার্লারে গেছে। যথাসময়ে উপস্থিত থাকবে। উনি বিশ্বাস ও করেছেন। কারণ মানুষগুলো যে বড্ড বিশ্বস্ত।
বাইকের উপর বসেই আলগোছে হেলমেটটা খুলল তন্ময়ী। নেমে দাঁড়াল। বেঁধে রাখা ড্রেসটা মেলে দিলো। ছড়িয়ে পড়ল পাথর খচিত রাস্তায়। রাইডিং এ যেন সমস্যা না হয় তাই এই পথ অবলম্বন করেছে। ওর পাশে এসে দাঁড়ালেন শেখ সাদমান। চোখ তুলে তাকাতে পারলেন না মেয়ের দিকে। কেবল হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। তন্ময়ী কিছুক্ষণ একদৃষ্টে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আস্তে করে হাতটা রাখল বাবার হাতের উপর। ছোট্ট করে বলল,
"এই হাতটা আজ থেকে পর হয়ে যাবে বাবা? তুমি আমার আশ্রয়স্থল রবে না? ভুলে যাবে আমাকে? আমার সবটুকু ভালো থাকা হারিয়ে যাবে?"
দৃষ্টি নত রেখেই থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন শেখ সাদমান। মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলতে পারলেন না। মুখ খুললেই যে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে। বুকে পাহাড়সম কষ্ট দমিয়ে রেখে কোনোরকমে ভাঙা গলায় বললেন,
"সন্তান কখনো তার আম্মাকে ভোলে না। আজ থেকে আপনার ভালো থাকার স্থান পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু ভালো থাকা নয়। আপনাকে ভালো রাখার ঊর্ধ্বে আপনার বাবার জীবনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয় আম্মা। আমি আপনার আশ্রয়স্থল আমৃত্যু রবো। আপনার বাবার বুক সবসময় আপনার অপেক্ষায় রবে। বিশ্বাস রাখুন এই হতভাগার উপর।"
তন্ময়ীর মনে হলো বুকটা কেউ ছুরিকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। ভীষণ বুকব্যথা হচ্ছে সাথে কান্না পাচ্ছে। হয়তো বাবার অসহায়ত্ব বুঝছে বলেই এমনটা অনুভব হচ্ছে। ওদের কথার মাঝেই ওখানে উপস্থিত হলো যাজক। শেখ সাদমানের সাথে প্রয়োজনীয় কথা সারলেন। অতঃপর তন্ময়ীকে ভেতরে নিয়ে যেতে বলেই উনি প্রস্থান করলেন। ওনার হাতে এখন অনেক কাজ। শেখ সাদমান সেভাবেই মেয়ের হাত ধরে রেখেই বললেন,
"চলুন আম্মা।"
তন্ময়ী বাধ্যর মতো হেঁটে বাবার সাথে ভেতরে চলে গেল। পিছু পিছু গেলেন বাকিরা।
রৌহিশ কথা বলছিল তিয়াশের সাথে। এতো মানুষ দেখে ক্ষেপে আছে ভীষণ। পাপাকে এর জবাবদিহি করতে হবে। তিয়াশ ওকে সবটা বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করছে। বুঝছে আঙ্কেলের কপালে শনি ঘুরছে। কথার মাঝেই এক ফাঁকে রৌহিশের চোখ গেল দরজার দিকে। আর নজর সরল না। স্থির হয়ে রইল। তিয়াশ আরও কিছু বলতে নিলেই হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে থামিয়ে দিলো। শুভ্র রঙা একটা ব্রাইডাল গাউন শরীরে জড়ানো তন্ময়ীর। যা পিছনে ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়েছে। মাথায় আটকানো ব্রাইডাল ভেইল। গলায় ড্রেসের সাথে ম্যাচিং সিম্পল ডিজাইনের একটা ডায়মন্ডের পেন্ডেন্ট। কান দুটোতে পেন্ডেন্ট এর সাথেই ম্যাচিং করা একজোড়া সিম্পল ছোট্ট দুল। সুদীর্ঘ কৃশলা পিঠজুড়ে ছড়িয়েছে। এমন সাজে সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়েছে। শরীর থেকে যেন নিঃসৃত হচ্ছে একটা অদৃশ্য আলো। যা আলোকিত করে রেখেছে সম্পূর্ণ তন্ময়ীকে। সবার আগ্রহ কেবল তন্ময়ীকে ঘিরেই। মুহুর্তেই সকলের দৃষ্টি ঘুরে নিবদ্ধ হয়েছে ওর দিকে। গ্রিসের দেবীর থেকে কোনো অংশে কম নয় এই রুপ। দ্বিতীয় বারের মতো তন্ময়ীর সম্পূর্ণ আনন দেখল রৌহিশ। হিংস্র নেত্র যুগল শীতল হয়ে এসেছে। ছড়িয়েছে আকাশসম মুগ্ধতা।
হঠাৎ রৌহিশের এমন ব্যবহারে তিয়াশের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। পরক্ষণেই রৌহিশের দৃষ্টি লক্ষ্য করে সেদিকে তাকাল। এতক্ষণে বুঝল ইম্পর্ট্যান্ট আলোচনায় বন্ধুর ধ্যান হারানোর কারণ। মুচকি হাসল। তন্ময়ীকে নিয়ে স্টেজের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন শেখ সাদমান। রৌহিশ এগিয়ে গেল সামনে। কোনো কথা ছাড়াই হাতটা তন্ময়ীর দিকে এগিয়ে দিলো। তন্ময়ী ওর দিকে তাকাতেই ভ্রু তুলে ইশারায় সেখানে হাতটা রাখতে বলল। শেখ সাদমান মেয়ের হাতটা রৌহিশের হাতের উপর তুলে দিতে ব্যর্থ হলেন। পরক্ষণেই ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললেন। তন্ময়ীর হাতটা দুহাতে আকড়ে ধরে অস্ফুট স্বরে ডাকলেন, "আমার আম্মা।"
তন্ময়ীর চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। মৃত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। এতো কষ্ট বুকে চেপে ওকে অন্যের হাতে তুলে দিতে কেন হবে? ও কী খুব ভারী হয়ে গেছিল বাবার নিকট? হঠাৎ কেন নিলো এমন সিদ্ধান্ত? মনের এককোণে সুপ্ত অভিমান জমল। তবুও কিছুই বলল না। আর না একফোঁটা চোখের পানি ফেলল। নির্লিপ্ত মুখে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। উপস্থিত সকলের আঁখি জোড়া ভিজে হয়ে এসেছে ততক্ষণে। বাবা, মেয়ের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রইল গির্জার হলঘরটা সাথে প্রায় অর্ধশত মানুষ। আরাধ্যা শেখ ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। ছোট্ট তন্ময় মুখটা ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দুহাতে জড়িয়ে রেখেছেন জারা স্মিথ। ওনার চোখেও পানি। কিছু সময় পেরোতেই নিজেকে সামলিয়ে নিলেন শেখ সাদমান। বুকে পাথর চেপে কাঁপা কাঁপা হস্তে রৌহিশের হাতে তন্ময়ীর হাত তুলে দিলেন। ওনার বলার অনেক কিছুই ছিল কিন্তু কণ্ঠস্বর বার বার রোধ হয়ে আসছে। এতক্ষণে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন পরপরই দৃষ্টি ঘুরিয়ে রৌহিশের দিকে তাকিয়ে বললেন,
"আমার মেয়ে নয় প্রাণ তুলে দিচ্ছি তোমার হাতে বাবা। মনে রেখো ওই শরীরে একটা আঁচড় ও পড়লে ব্যথিত হবে দু'টো অন্তর। যন্ত্রণা সহ্য করবে দুটো শরীর।"
"আমার উপর ভরসা রাখুন পাপা। আমি আমার দেওয়া কথা রাখব।"
রৌহিশের কথায় একটুখানি আশ্বস্ত হলেন শেখ সাদমান। মলিন মুখাবয়বে মুচকি হেসে মেয়েকে স্টেজে উঠতে সাহায্য করলেন। তন্ময়ী যন্ত্রের ন্যায় স্টেজে উঠে চুপচাপ রৌহিশের একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। যাজক দেরী না করে বাইবেল পাঠ করতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পাঠ করে তন্ময়ী এবং রৌহিশকেও ওনার সঙ্গে বলতে বললেন। রৌহিশ বললেও তন্ময়ী নিশ্চুপ। মুখ এঁটে রয়েছে। রৌহিশের ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল। তীক্ষ্ণ চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাল। তক্ষুনি তন্ময়ীও তাকিয়েছিল। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলল কয়েক সেকেন্ডের জন্য।
গত দুইদিন থেকে ক্লারা নিখোঁজ। সেই যে হসপিটাল থেকে গেছে আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ফোন বন্ধ। সম্ভবত সিম চেঞ্জ করেছে। তাই তন্ময়ী চাইলেও কিছুই করতে পারেনি। তার উপর বাবার অসুস্থতা ছিল যার দরুন তেমন খোঁজ করা হয়ে ওঠেনি। তবে ক্লারা যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকত সেটা সহ আশপাশের সবগুলো অ্যাপার্টমেন্টে খোঁজ নিয়েছে। বরাবরের মতোই হতাশ হতে হয়েছে। তার উপর মিরাও উধাও হয়ে গেছে। হসপিটালের পাশের রাস্তাতে মিরার হাতে থাকা ঘড়িটা কুড়িয়ে পেয়েছে ও। আঁচ করতে পেরেছে ঘটনা অনেকটাই। মিরাকেও খুঁজেছে অনেক জায়গায় কিন্তু সন্ধান মেলেনি। আজ সারাটা দিন এই করেই কেটেছে ওর। ক্লারার বাবা, মা কেউ নেই। মামার কাছে থেকে বড়ো হয়েছে। একা একটা অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলায় ভাড়া থাকত। কিন্তু হঠাৎ করেই নিরুদ্দেশ। এতটুকুই সম্পর্কেই অবগত তন্ময়ী। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা মেয়েটার। মন চাইছে এখান থেকে এক ছুটে পালিয়ে যেতে দূরে, বহুদূরে। যেখানে গেলে কেউ ওকে খুঁজে পাবে না, যেখানে থাকবে না কোনো মন বিষিয়ে তোলা মানসিক অশান্তি। কিন্তু সেই সুযোগ কোথায়? বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কে বাস্তব জীবন থেকে হারিয়েছে বহু দূরে। বুদ হয়ে আছে ভাবনার জগতে। সবাই যে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে তন্ময়ীর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। ভাবনার মাঝেই শুনতে পেলো হাড়হিম করা শীতল মৃদু আওয়াজ,
"বিয়ে করার ইচ্ছা না থাকলে গেট আউট মিস তন্ময়ী।"
তন্ময়ীর ঘোর ভাঙল। দৃষ্টি ভাসমান হলো গির্জার কক্ষজুড়ে। বুঝল সবটা। নিজের বোকামোতে নিজেই কিঞ্চিত লজ্জা পেল। পরক্ষণেই তীক্ষ্ণ চোখে রৌহিশের দিকে তাকাল। হিসহিসিয়ে উঠল,
"আমি তন্ময়ীর পা ধরে বিয়ে করছেন আবার মুড? হাহ্! রিডিকিউলাস!"
রৌহিশের অধরপল্লব বাম পাশে ঈষৎ উচু হলো। একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। কানের কাছে অধর এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
"মিথ্যা বলতে নেই মিসেস ডুবইস রৌনক। আজ রাতে ধরব কেমন?"
"মিসেস ডুবইস রৌনক" সম্বোধনে আটকাল তন্ময়ী। শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল। পরক্ষণেই কথাটার অর্থ মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতেই রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করল রৌহিশের দিকে।
চোখে, চোখ রেখেই হাসল রোহিশ, "বেশি বোঝা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মাত্রই তো বললে পা ধরার কথা। ওটা তো এখনো ধরিনি আমি। মিথ্যা অপবাদ আমার হজম করতে সমস্যা হয় হার্ট।"
'হার্ট' আবারও নতুন সম্বোধন। আজ এই নিত্যনতুন সম্বোধন বার বার অবাক করে দিচ্ছে তন্ময়ীকে।ওদের কথার মাঝেই গির্জার দরজার নিকট এসে দাঁড়াল দুটো মানব। তন্ময়ী আরও কিছু বলতে নিচ্ছিল কিন্তু রৌহিশ সেই সুযোগ দিলো না। ভ্রু তুলে ইশারায় দরজার নিকট দেখাল। ও সেদিকে তাকাতেই নেত্র যুগল খুশির পানিতে টইটম্বুর হয়ে উঠল। মিরা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কালো পোশাকে পুরো শরীর ঢাকা। মেয়েটা ঠিক আছে তো? বুকের ভেতরটা কেপে উঠল। মিরার পাশেই রায়ান দাঁড়ানো। তন্ময়ীকে মিরার সাথে কথা বলার ফুরসৎ দেওয়া হলো না। রৌহিশ যাজকের উদ্দেশ্যে বলল,
"আপনি কন্টিনিউ করুন।" পরপরই তন্ময়ীর দিকে তাকাল। শাণিত কুটিল চাহনিতেই বুঝিয়ে দিলো ও নিজের কথা রেখেছে। এখন যেন সবটা ঠিকমতো হয়। তন্ময়ীর বুক চিরে ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আরও একবার তাকাল মিরার দিকে। মেয়েটা ততক্ষণে পিছনের একটা চেয়ারে বসেছে। তন্ময়ীকে দূর থেকেই কনগ্রেটস জানাল। বিয়ের রিচুয়াল পালনে মনোযোগী হতে বলল। তন্ময়ী ম্লান হেসে এবার মনোযোগ দিলো বাইবেল পাঠে।
বাইবেল পাঠ শেষ হয়েছে। এবার আংটি বদলের পালা। তিয়াশ এসে দু'টো আংটি দু'জনের হাতে দিয়ে গেল। অদূরে দুই জোড়া নেত্র যুগল দিয়ে বারিধারা নেমেছে। নিজের থেকে কাউকে বেশি ভালোবাসলে বুঝি এভাবেই এক বুক বিষব্যথা মেলে? স্বচক্ষে নিজের মানুষটাকে অন্যের হতে দেখতে হয়? নিজের ভালোবাসা বিসর্জনের সাক্ষী নিজেকেই হতে হয়? রায়ান পাশে বসা রমনীর একবুক হাহাকার দিব্যি অনুভব করতে পারছে। প্রকৃত ভালোবাসা হারানোর কষ্ট জন্মজন্মান্তরের। মিরা মলিন চোখে স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে। ওখানে ওর থাকার কথা ছিল। স্বপ্ন দেখেছিল তো মেয়েটা। তাহলে? আজ সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে কী? ওর তনু তো ভালো থাকবে। তনু ভালো থাকলেই ও নিজেও ভালো থাকতে পারবে। যা রৌহিশকে পেলেও সম্ভব হতো না। স্বল্প সময়ের জীবন কোনো না কোনোভাবে ঠিক কেটে যাবে। নিজের ভাবনার মাঝেই চোখের পর্দায় ভাসমান হলো টিস্যু ধরে রাখা একটা হাত। পাশে চাইল। রায়ান ইশারায় ওকে ওটা নিতে বলল। মিরা মুচকি হেসে নিলো। চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। ছোট্ট করে বলল, "থ্যাংকস।"
"মাই প্লেজার।" কথাটা বলে হাসল রায়ান। পরিপ্রেক্ষিতে মিরাও মুচকি হাসল।
রোজের নাক মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে। নয়ন জোড়া রক্তিম। দেখে মনে হচ্ছে রক্ত জমে লাল হয়ে গেছে। এক্ষুনি চোখের শ্বেত মন্ডল ফেটে র ক্ত বেরিয়ে আসবে। ফর্সা মুখটা বেজায় ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। রাইমা হান্টস ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন। মেয়েটা এই যন্ত্রনা স্বেচ্ছায় মাথা পেতে নিতে আসত না। এলিয়ানা এক প্রকার জোর করেই নিয়ে এসেছে। আন্টির বড্ড আদুরে রোজ। তাই তো 'না' বলে অপমান করতে পারেনি। দৃষ্টি নিবিষ্ট সামনের স্টেজের দিকে।
রৌহিশ তন্ময়ীকে আংটি পড়াতে নিবে তৎক্ষণাৎ আশেপাশের কোথাও বজ্রপাতে গির্জায় আলোর অস্তিত্ব হারিয়ে গেল। মিনিট কয়েকের ব্যবধানেই জ্বলে উঠল ক্যান্ডেল। সকলের হাতে একটা করে ক্যান্ডেল জ্বলছে। মৃদু নিয়ন আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল চারপাশ। খিড়কি, দরজা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল এক খন্ড শীতল হাওয়া। উপস্থিত সকলের শরীর শিরশির করে উঠল। গির্জার সদর দরজায় একজনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেল। একটা মানব ছায়া ক্রমশ স্টেজের দিকেই এগিয়ে আসছে। সামনে আসতেই আবছা আলোয় মুখটা জ্বলে উঠল। পরিচিত একটা মুখ ডুরান্ড জ্যাইন রোনিত। কোনো কথা ছাড়াই নিজস্ব ভঙ্গিতে হেঁটে এসে রাইমা হান্টসের পাশের চেয়ারে বসল। যেটা ওর জন্য বরাদ্দ রেখেছিলেন রাহিমা হান্টস নিজেই। নিজের বরাবর সামনের সারিতে বসা ডুবইস আর্থারের দিকে নজর আটকাল। উনি ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। ওষ্ঠপুটে উঁকি দিলো অবজ্ঞার এক চিলতে হাসি। অথচ অপরপক্ষ স্নেহের চোখে তাকিয়ে রইল জ্যাইনের দিকে। এতক্ষণে রৌহিশের দিকে দৃষ্টিপাত করল জ্যাইন। রৌহিশ ও তাকাল তৎক্ষণাৎ। দু'জনের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে এক অব্যক্ত ভাষা, নীরব হিংস্রতা। দুই পক্ষের অধরপল্লবে খেলা করছে কপট হাসি। ভীষণ পরিচিত একটা আনন অকস্মাৎ রিদাহ এর বুকব্যথা বাড়িয়ে দিলো। দুহাতে চুল খামচে, মাথা নিচু করে বসে রইল। এইসব তিয়াশের নজর এড়াল না। তাচ্ছিল্য হাসল। হাহ্! জীবনের সূত্র মেলানো আর দিক হারিয়ে মাঝ সাগরে ডুবে ম রা একই।
প্রথমে রৌহিশ আংটি পরিয়ে দিলো তন্ময়ীর অনামিকা আঙ্গুলে, তারপর একইভাবে তন্ময়ী পরিয়ে দিলো রৌহিশের আঙ্গুলে। রৌহিশের মধ্যমা আঙ্গুলে থাকা আরও একটা আংটি নজরে এলো। বেশ পুরোনো। অনেকটা আগের যুগের মতো। বিষয়টা ভাবুক করে তুলল তন্ময়ীকে। আপাতত সব নিয়ম কানুন শেষ। যাজক রৌহিশের হাতের উপর তন্ময়ীর হাতটা তুলে দিয়ে দুজনকে জিজ্ঞাসা করল,
"এই বিয়েতে আপনাদের মত আছে?"
"জি।" একসাথে প্রত্যুত্তর করল দুজন।
"আজ থেকে ইসমাত মাহমুদা তন্ময়ীর ভালো, খারাপ সবটুকুর দায়িত্ব আপনার ডুবইস রৌহিশ রৌনক। আপনি রাজি?"
"রাজি।"
"একই শর্ত আপনার জন্য প্রযোজ্য মিসেস রৌনক।আপনি রাজি?"
"রাজি।" কম্পনরত গলার আওয়াজ তন্ময়ীর।
দুজনের সম্মতিতে যাজক হাসলেন। রেজিস্ট্রি পেপারটা দুজনের দিকে এগিয়ে দিলেন। রৌহিশ কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেই সাইন করে দিলো। এবার তন্ময়ীর পালা। হাত কাঁপছে, বুক কাঁপছে, মস্তিষ্ক শূন্য অনুভূত হচ্ছে। ভীষণ অসহায় লাগছে নিজেকে নিজের কাছেই। ঘাড় ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকাল। শেখ সাদমান অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মানসপটে সোনালী অতীত স্মরণ হতেই আঁখি যুগল বন্ধ করে নিলো মেয়েটা। বড়ো একটা শ্বাস ফেলে কলম তুলে নিলো হাতে। এক পলক তাকাল মিরার দিকে। ও ইশারায় সাইন করে দিতে বলল। তন্ময়ীর চোখের কার্নিশ বেয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। টপ টপ শব্দ তুলে ঝরে পড়ল রেজিস্ট্রি পেপারের উপর। কম্পিত হাতে সাইন করে দিলো তন্ময়ী। এক জীবনে জুড়ে গেল ঘৃণিত একজন মানুষের সাথে। যাকে নিজের অজান্তেই মনের সবটুকু ঘৃনা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু কেন? কারণ অজানা।
যাজক হাত তুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল। সবাই সামিল হলো সেই প্রার্থনাতে। অতঃপর বিয়ে সম্পন্ন হলো। এবার ভালোবাসা আদান প্রদানের মাধ্যম হিসেবে ছোট্ট একটা আদর দেওয়ার পালা। মুলত কিসিং সিন এটা। তন্ময়ীর বুকটা শব্দ তুলে লাফাচ্ছে। রৌহিশের দিকে তাকাতেই হৃৎস্পন্দন বাড়ল। ছেলেটা কীভাবে দুষ্টু হেসে তাকিয়ে আছে। তন্ময়ীর ভয় বাড়ল। এই নিয়ম ও পালন করতে হবে নাকি?
রোজ সেই দৃশ্য একবার মানসপটে কল্পনা করতেই হাত পা থরথর করে কেঁপে উঠল। রৌহিশকে তন্ময়ীর দিকে এগোতে দেখেই চারপাশের সবকিছু ধোঁয়াশা হয়ে এলো। পৃথিবীর সকল আলো হারিয়ে গেল অন্ধকারের অতল সায়রে। ঢলে পড়ল মায়ের বুকে। মেয়েকে অবচেতন অনুভব করতেই চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন রাইমা হান্টস। মুহুর্তেই হৈচৈ পড়ে গেল আবছা আলোয় রাঙানো হল ঘরটাতে। একজন মায়ের আর্তনাদে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম প্রকৃতি। অদ্ভুতভাবে প্রকৃতির তান্ডব বাড়ল কয়েকগুণ। ঝড়ো হাওয়ার সাথে তুমুল বর্ষণ এবং বজ্রপাত চারপাশের পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠল। বোনের এই দশায় ও নিশ্চুপ জ্যাইন। চুপচাপ নীরব দৃষ্টিতে তন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে কী চলছে কে জানে? রৌহিশের চোখে চোখ পড়তেই হাসল। পাত্তা দিলো না রৌহিশ। তাচ্ছিল্য হাসল ।যাজককে বলল,
"লিভ দিস আউট।"
যাজক পরিস্থিতি বুঝল। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝাল। তন্ময়ী এতক্ষণে আটকে রাখা শ্বাস টুকু ফেলল। যাক বাবা বাঁচা গেল। ও যা ভেবেছিল সেটা হলে এক্ষুনি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত। ওই মানুষটা সহ তার স্পর্শ তন্ময়ী ঘৃণা করে। দীর্ঘ একটা নিয়মের শেষে দুই রাস্তার দুই পথিক বাঁধা পড়ল একসাথে। এর পরিণাম কী হবে? ঘৃণা থেকে কি ভালোবাসা জন্মাবে? হয়তো! হয়তো না। কেবল একটা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো দুজন। যেখানে কোথাও নেই কোনো ভালোবাসার ছিটেফোঁটা। আছে শুধু গুটিকয়েক মানুষের মন ভাঙার গল্প। কেউ হয়তো ভালোবেসে ধ্বংস হবে আবার কেউ হয়তো আমৃত্যু আফসোস নিয়ে বাঁচবে। কেউ ভালোবেসে নিজেকে ত্যাগ করবে, কেউ হয়তোবা একপাক্ষিক ভালোবাসায় জর্জরিত অন্তর বয়ে বেড়াবে আজীবন। কে জানে অদূর ভবিষ্যতে কী আছে?
·
·
·
চলবে...................................................................................