বিরহ বীণার সুর - ইলমা বেহরোজ - অনু গল্প

বিরহ বীণার সুর
          খুব অল্প বয়সে প্রেম নামক সমুদ্র তার পূর্ণাঙ্গ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার নিরীহ হৃদয়ের উপর। অনুভূতির প্রবাহ এতটাই তীক্ষ্ণ ছিল যে মনে হতো আমার সমস্ত চেতনা, সমস্ত আবেগ একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দিনকে দিন যেন অতল সাগরে ডুবে যাচ্ছিলাম। নিঃশ্বাসের জন্য হাহাকার, বুকের কাছে পানির চাপ, আর মধুর দমবন্ধ অনুভূতি; একইসাথে যন্ত্রণাদায়ক এবং পরমসুখের।

আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল নাটকীয়ভাবে, সেদিন পাড়ার মাঠে আমরা বাচ্চারা 'জামাই-বউ' খেলায় মেতে উঠেছিলাম। এই খেলায় একজন 'জামাই' হয়, আর বাকি মেয়েরা 'বউ' সাজে। জামাই তার পছন্দের বউ বেছে নেয়। সেদিন তৈমুর নামে ছেলেটি 'জামাই' হয়েছিল। আমি ছিলাম প্রতিযোগী 'বউ'দের দলে। অনেকগুলো মেয়ের মাঝ থেকে যখন তৈমুর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকে বেছে নিয়েছিল, তখন অবুঝ মনেই আনন্দে হাততালি দিয়েছিলাম।

তারপর থেকে শুরু হলো আমাদের একসঙ্গে পথ চলার অভিযান। কৈশোরে আমরা বন্ধু থেকে প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে উঠলাম। তৈমুর ছিল আমার দুই বছরের সিনিয়র। আমরা একই স্কুলে, একই কলেজে, একই ভার্সিটিতে পড়েছি। প্রতিবার ও আমার দুই ক্লাস উপরে থাকত। তবুও আমাদের জীবনধারা এমনভাবে সংযুক্ত ছিল যে মনে হতো আমরা একই তালে, একই ছন্দে জীবন যাপন করছি। একসঙ্গে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে যাওয়া, একসঙ্গে বাড়ি ফেরা, পরীক্ষার আগে রাত জেগে ফোনে পড়া রিভিশন করা, ক্যান্টিনের চা ভাগাভাগি করে খাওয়া; সবকিছুতেই আমরা ছায়ার মতো জড়িয়ে থাকতাম। সকলের কাছে তৈমুর-আমি মানেই ছিলাম চিরকালের আদর্শ জুটি।

যতদিন গেছে, আমাদের সম্পর্কের শিকড় আরও গভীরে গেঁথে গেছে। প্রেম একটা অনুভূতি থেকে রূপান্তরিত হয়েছে জীবনের অপরিহার্য অংশে। আমরা একে অপরের অস্তিত্বের এমন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলাম যে আলাদা থাকাটা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। তাই আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিয়েতে কোনো জমকালো আয়োজন ছিল না, কিন্তু আকাশের রং সেদিন একটু বেশিই নীল ছিল। বাতাসে একটা মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল।

তারপর একদিন, আমাদের নির্ভার প্রেমের গল্পটা হঠাৎ করে ছিঁড়ে গেল একটা থাপ্পড়ে। বিয়ের ঠিক এক বছর পর, একেবারে সামান্য কারণে তৈমুর আমার গায়ে হাত তুলল। থাপ্পড়ের আওয়াজে আমার প্রিয় বিড়ালটা পর্যন্ত লাফিয়ে উঠেছিল। আমি ছিলাম নির্বাক। শরীরটা কাঁপছিল না, অথচ ভেতরে কোথাও একটা ফাটল ধরছিল। যেন একটা শক্ত কাঁচের দেয়াল চুরমার হয়ে গেছে। এ কি আমার সেই তৈমুর? যে মানুষটার চোখে আমি মায়া খুঁজে পেতাম, যার স্পর্শে সারা পৃথিবী কোমল হয়ে যেত, যে মাঝরাতে সোহাগ করে কপালে চুমু দিয়ে বলত, 'তুমি আমার পৃথিবী'। সে কীভাবে এমন করতে পারল? প্রশ্নটা আমার মনে হাজার বার করে বাজছিল।

আমি সেদিন যন্ত্রণায় কাঁদিনি, থাপ্পড়টা খুব একটা ব্যথা দেয়নি। আমি কেঁদেছিলাম চেনা মানুষকে হঠাৎ অচেনা হয়ে যেতে দেখে। মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে সারারাত কেঁদেছি, মাথার ভেতর শুধু ঘুরছিল, ' কেন এই পরিবর্তন? কী এমন করেছি আমি?'

পরদিন তৈমুর ক্ষমা চেয়েছিল। নরম গলায়, মায়াভরা চোখে। ওর মুখটা আমার দুর্বলতা ছিল, একবার তাকালে সব অভিমান ভুলে যেতাম। বড্ড ভালোবাসতাম যে। তাই ওর ক্ষমার অভিনয়ে আমি নরম হয়ে গেলাম। ভাবলাম, হয়তো ওর খারাপ দিন ছিল। হয়তো কোনো চাপে ছিল। প্রেমের অন্ধত্ব এমনই, যেখানে কালো রঙটাও সাদা দেখায়। আমি নিজেকে বোঝালাম, এটা একটা দুর্ঘটনা। আর হবে না।

কয়েক সপ্তাহ পর আবারও একই দৃশ্যপট। এবার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ঠিক পরেই হঠাৎ করেই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই গলা চেপে ধরল। সঙ্গে ঝরে পড়ল বৃষ্টির মতো কটু কথা, যেন শব্দ নয়, তীক্ষ্ণ বিষের তীর। প্রতিটি শব্দ আমার কানে না লেগে, গিয়েছিল ঠিক বুকে, চেপে বসেছিল শ্বাসের ওপর। 

শরীরে তখন আমার একচিলতে কাপড় মাত্র। সেই অবস্থায় ওর মুখ থেকে ঝরে পড়া নোংরা গালিগুলো মনে গেঁথে রইল ট্রমার মতো। আমি কিছু বলার সাহস পেলাম না, শুধু স্তব্ধ, কাঁপা চোখে তাকিয়ে ছিলাম। যার চোখে একদিন ছিল উপচানো মায়া, আজ সে আমাকে এমন চোখে দেখছে, যেন আমি কিছুই না, এক পশলা ধুলোর চেয়েও হালকা। কুকুরের চেয়েও অধম।

আমি আবারও গলা ছেড়ে কাঁদলাম, পাগলের মতো কাঁদলাম। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কেঁদে জ্বর বাঁধালাম। 

আমি ছিলাম বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। আদরে গড়ে ওঠা, সোনার খাঁচায় রাখা পাখি। বাবা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। জীবনে অভাব কী, সেটা কল্পনাতেও আসেনি কখনো। কোনো কষ্ট ছুঁয়ে দেখেনি আমায়। এমনকি রাগ করে কেউ কখনো গায়ে হাত তোলার সাহসও করেনি। যদি অসুস্থ হতাম, বাবা নিজের অফিস বন্ধ করে পাশে বসে থাকতেন। জ্বর হলে মাথা ছুঁয়ে তার চোখ ভিজে যেত। আর এখন সেই আমি... বড্ড হাসি পাচ্ছে নিজের ভাগ্যের উপর। কী বিচিত্র জীবন! যে মেয়েকে পৃথিবীর সব সুখ দিতে চেয়েছিল বাবা-মা, সেই মেয়ে আজ স্বামীর হাতে মার খাচ্ছে।

শেষরাতে নিজেকে জড়ো করে বাবার বাড়ি চলে গেলাম। চোখ লাল, মুখ বিবর্ণ। আমাকে দেখে বাবা প্রথমে কিছু না বুঝলেও যখন কারণ বললাম, রেগেমেগে আগুন হয়ে উঠলেন।
'কি! তোর গায়ে হাত তুলেছে? আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে? ওই কুত্তার বাচ্চার একদিন কি আমার একদিন।'

বাবার চোখ রাগে ঝলসে যাচ্ছিল। হাত কাঁপছিল রাগে। মুখ দিয়ে গলগল করে বের হচ্ছিল ঝাঁঝালো গালাগাল। মা তখন কাছে এসে বাবাকে থামালেন, 'চুপ করো তো। দু'জন মানুষ একসঙ্গে থাকলে একটু-আধটু কথা-কাটাকাটি, ঠোকাঠুকি হবেই। সব সংসারেই তো হয়।'

আমি স্তব্ধ হয়ে তাকালাম মায়ের মুখের দিকে। যে মা আদরে, যত্নে, লাজুক চোখে আমাকে মানুষ করেছেন, তিনি আজ এতটা নিরাসক্ত কণ্ঠে শারিরীক নির্যাতনকে স্বাভাবিক বলছেন?

বাবা বললেন, 'সব ঘরে হওয়া আর আমার ঘরে হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমি অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতে শিখিনি।'

মা একটু হাসলেন। বললেন, 'রাগ হলে পুরুষ মানুষ একটু-আধটু হাত তো তোলে-ই। তুমি কি তোলেনি কখনো?'

বাবা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। আমি চোখ বড় করে তাকালাম বাবার দিকে। তারপর মাকে বললাম, 'বাবা! বাবা তোমার গায়ে হাত তুলেছে?'

বাবা দাঁড়ালেন না, ধীর পায়ে চলে গেলেন বারান্দার দিকে।

মা বললেন, 'তুলেছে। বিয়ের পর পর তো খুব রাগী ছিল। সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে গেছে। মেয়ে হয়ে জন্মালে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়।'

আমি তীব্র বিস্ময়ে কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
'তুমি সহ্য করেছো, মানে আমাকেও করতে হবে?'

'এইটুকু কারণে সংসার ছেড়ে আসা যায় না। পুরুষ মানুষ সারাদিন বাইরে কাজ করে, কত চাপ, কত টেনশন নিয়ে বাড়ি ফেরে। ঘরে এসে যদি শান্তি না পায়, রাগ তো করবেই। কখনো কখনো না চাইলেও, হাত উঠে যা।'

'আমি কি শান্তি দিইনি? ওর শান্তির জন্য তো সবই করতাম আমি।'

'তুই হয়তো এমন কিছু বলেছিস, যেটা ওর ভালো লাগেনি। পুরুষ মানুষ সব পারে, কিন্তু নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।'

'কথা ভালো না লাগলেই কেউ কাউকে মারবে? তাহলে তো আমিও রাগে অনেককে মেরে ফেলতে পারতাম!'

'মেয়েদের আর ছেলেদের রাগ কি এক? মেয়েরা সবসময় ধৈর্যশীল, সহনশীল। এইটাই তো আমাদের শক্তি।'

'এই সহনশীলতা দিয়ে কী করব আমি, মা? এই ধৈর্য দিয়ে কী হবে যদি সেটা শুধু মার খাওয়ার অনুমতি হয়ে দাঁড়ায়?'

মা ধীরে ধীরে বললেন, 'বিয়ে মানেই কেবল ভালোবাসা না, মানিয়ে নেওয়ারও নাম। যতটা পারা যায় বোঝে চলতে হয়।'

আমি চিৎকার করে বললাম, 'মানে আমি মার খাবো, আর তুমিই বলবে এটা মানিয়ে নেওয়া?'

মা একটু অস্বস্তিতে বললেন, 'দেখ মা, তৈমুর ছেলে হিসেবে খারাপ না। ভালো পরিবারের ছেলে, চাকরি আছে, তোকে ভালোবাসেও। একটু রাগী হতে পারে, কিন্তু সেটা তো পুরুষ মানুষের স্বভাব।'

'যে ভালোবাসে সে গায়ে হাত তোলে কীভাবে?'

'রাগের মাথায় সব মানুষই কিছু না কিছু করে বসে। তুই নিজেও তো কখনো কখনো খুব রেগে যাস।'

'আমি রাগ করলে কি তৈমুরকে মারি? গালাগাল করি?'

'তুই তো আর পুরুষ মানুষ নোস। মেয়েদের রাগ আর ছেলেদের রাগ এক হয় না।'

'কেন হয় না? আমিও তো মানুষ, আমারও তো রাগ আছে। কিন্তু আমি তো কাউকে মারি না!'

মা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, 'তুই এতো বিশ্লেষণ করিস না। সংসার এমনই হয়।'

'এমনই মানে? ধরো, তুমি যদি বাবাকে মারতে, তাহলে কি বাবাও বলতেন সংসার এমনই? মানিয়ে চলি?'

মা একটু রেগে গিয়ে বললেন, 'আমি তোর বাবাকে মারবো কেন? কী বাজে কথা বলছিস!'

'ঠিক! তুমি বাবাকে মারবে না, কারণ তুমি জানো এটা ভুল। তাহলে তৈমুর কেন আমাকে মারবে?'

মা চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, 'তুই এখনো ছোট, সংসারের খুঁটিনাটি বুঝিস না। তৈমুর তোর স্বামী, তোর সাথে একটু রাগারাগি করতেই পারে।'

'একটু রাগারাগি আর মারপিট কি এক জিনিস?'

'এত তর্ক করিস না। আমিও সংসার করেছি। যখন বিয়ে করেছি, তখন অনেক কিছু সহ্য করেছি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে গেছে। তোর বাবাও এখন আমার গায়ে হাত তোলে না।'

'বাবা এখন তোমার গায়ে হাত তোলে না! কিন্তু আগে তুলতো! তোমার কী তখন কষ্ট হতো না? বুক ফেটে আসতো না?'

মা একটু অস্বস্তিতে বললেন, 'ওসব পুরানো কথা তুলিস না এখন।'

'কেন তুলবো না? এই পুরানো কথা থেকেই তো আমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হচ্ছে। তুমি সহ্য করেছো বলে আমাকেও সহ্য করতে হবে?'

আমি চুপ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম উত্তরের আশায়। মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি অন্য একটা গ্রহে চলে এসেছি। এখানে ভুলটা মেয়েদেরই, আর সহ্য করাটাই প্রেম, সংসার, আর নারীত্বের সেরা গুণ। আমার চোখে জল আসছিল, কিন্তু কাঁদছিলাম না। কারণ এবার কষ্টের সাথে সাথে ভেতরে একরাশ রাগ জমছিল। নিজের জন্য, মা'র জন্য, সমস্ত নারীর জন্য, যাদের শিখিয়ে দেয়া হয়, 'পুরুষ মানুষ রেগে গেলে মারতেই পারে। সেটা মাফ করে দাও, সেটাই ভালোবাসা।' আমি বুঝতে পারলাম, এই সমস্যা শুধু আমার নয়। এই সমস্যা আমার মায়ের, আমার মায়ের মায়ের, এবং এমন হাজার হাজার নারীর যারা মনে করে পুরুষের হিংস্রতা সহ্য করাই নারীত্বের পরিচয়।

কিন্তু আমি সহ্য করব না। নিজের আত্মসম্মান খোয়াব না৷ মায়ের মতো 'সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে'- এই মিথ্যার ছায়ায় জীবন কাটাব না।

কিন্তু আমার আত্মসম্মানও ছিল কাগজের তৈরি দুর্গের মতোই। একটু বৃষ্টিতেই ভেসে যাওয়ার মতো ভঙ্গুর। তৈমুর যখন আমার বাবার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, সরি বলল, আমার সংকল্প বরফের মতো গলে গেল। না চাইতেও নিজের অজান্তে সেই তথাকথিত আদর্শ স্ত্রী হয়ে উঠলাম। যাকে যতবার ভাঙা হোক, সে ঠিক জোড়া লাগিয়ে ফিরে যায়। 

তারপর থেকে যতবারই সংসারে ঝড় উঠত, আমি ভাঙা মন নিয়ে বাবার বাড়ি যেতাম। এক বুক যন্ত্রণায়, অপমানের ভারে নুয়ে পড়া আমি যখন মায়ের সামনে দাঁড়াতাম, তিনি সেই একই পুরনো উপদেশের বাক্স খুলে বসতেন।

-'মেয়েরা সংসার করে, ভাঙে না।,
-'একটু সহ্য করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।,
-তোর বাবাও তো রাগ করত, আমি সহ্য করেছি।' 

প্রতিটি বাক্য আমাকে আরো একবার ভেঙে দিত। মনে হতো, আমি ভিক্টিম হয়েও অপরাধী বনে গেছি। মায়ের চোখে আমি একজন ব্যর্থ নারী, যে সংসার রক্ষা করতে পারেনি। তার প্রতিটি বাক্য আমার বুকে এসে বিঁধত, ঠিক তৈমুরের আরেকটি থাপ্পড়ের মতো। 

এই অসহায়, বোবা লড়াইয়ের মাঝেই একদিন আমার জীবনের একমাত্র আশ্রয়, আমার বাবা স্ট্রোক করে চিরতরে চলে গেলেন। হাসপাতালের বারান্দায় দৌড়াতে দৌড়াতে, ডাক্তারদের কাছে অনুরোধ করতে করতে হারিয়ে ফেললাম আমার একমাত্র সত্যিকারের রক্ষাকর্তাকে। যিনি কখনো আমাকে দোষ দেননি, যিনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তার চলে যাওয়ার পর আমার পুরো দুনিয়া টলে উঠল। বুকের ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলো। সব আশা, সব ভরসা একসাথে ধ্বসে পড়ল। তৈমুর সেই সময়টাতে অদ্ভুত রকমের শান্ত ছিল। দেড় মাসের মতো কোনো ঝগড়া হলো না। এর কারণ ছিল আমার নিরবতা, আমার শোক। এমন না যে ও বদলে গিয়েছিল বা আমার দুঃখ বুঝেছিল।

ঠিক দেড় মাস পর, একদিন, মানুষের কোলাহলে ভরা এক রাস্তায় ও হঠাৎ করে আমার গালে আবারও সজোরে থাপ্পড় মারল। কী কারণে, কী অপরাধে ঠিক মনে নেই। শুধু মনে আছে চারপাশের মানুষদের অবাক, কৌতূহলী, অবজ্ঞাময় দৃষ্টি। কারও মুখে মৃদু হাসি, কারও চোখে বিরক্তি। কেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল না, 'কী হয়েছে এখানে?'

আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। সেখানেই, জনসমক্ষে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। অঝোর কান্নায় বুক ভাসিয়ে দিলাম। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। শুধু সেখান থেকে না...মা, তৈমুর, এই শহর, এই সংসার, এই অপমান সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে গেলাম। চিরতরে। ব্যাংক থেকে তুলে নিলাম আমার নামে থাকা সব টাকা। সেই টাকা নিয়েই পাড়ি জমালাম ভারতে। 

একটা অচেনা, মেঘলা শহরে শুরু করলাম নতুন জীবন। না, সেটাও খুব রঙিন ছিল না। প্রথম দিকে একটা ছোট্ট রুমে একা একা অনেক কেঁদেছি। হতাশা, অপরাধবোধ, একাকীত্ব সব মিলিয়ে অনেক কষ্টের দিন কেটেছে। কিন্তু স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, সেই জীবনে ছিল না থাপ্পড়, গালি, অভিযোগ কিংবা বোঝানোর নামে অপমান। 

নতুন শহরের প্রতিটি দিন কাটত তৈমুরকে ভোলার চেষ্টা করতে করতে। কিন্তু মানুষের মন বোধহয় এমনই যে, যাকে ভুলতে চাই, সেই আরও বেশি করে মনে পড়ে। সারাক্ষণ মনে পড়ত ভালোবাসার দিনগুলো, কপালে ওর চুমু, পিঠে হাত বুলিয়ে বলা, 'তুমি আমার পৃথিবী।' সন্ধ্যায় একা একা বসে থাকতে থাকতে ইচ্ছে করত, সব ভুলে ফিরে যাই। ক্ষমা করে দেই। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। মনে হতো, হয়তো এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো ও বদলে গেছে। হয়তো আমি অতিরিক্ত সেনসিটিভ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেই মনে পড়ে যেত সেই রাস্তার থাপ্পড়, সবার সামনে অপমান আর গালিগালাজ; নিজেকে শক্ত করে আটকে রাখতাম। 

সমস্ত যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দিয়েছিলাম, মুহূর্তের দুর্বলতাও যাতে আমাকে আরেকটা ভুলে না নিয়ে যায়। বাংলাদেশ নামটাই হয়ে উঠেছিল আমার কাছে ব্যথার আরেক নাম। ওই দেশের কোনো খবর, কোনো মুখ, কোনো স্মৃতি আর ফিরত না আমার কাছে। আমি শুধু জানতাম, সেখানে আমার একটি অতীত রয়ে গেছে। একটা দগদগে ক্ষত, যার সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।

আর এখন, আমি সেই অতীতকে পেছনে ফেলে, খুব ধীরে ধীরে, নিজের মতো করে একটা নতুন আমি গড়ার চেষ্টা করছি। যে আর কাউকে ভালোবাসার নামে সহ্য করবে না। যে আর চড়-গালি-পশুতা মেনে নেবে না ভালোবাসা বা সংসার টিকিয়ে রাখার অজুহাতে। 

কিন্তু আমি জানতাম না, ফেলে আসা গল্পটা তখনও এক অজানা মোড়ে অপেক্ষা করছিল তীব্র আকুলতায়। 
          নতুন শহরের অচেনা পরিবেশে যখন আমি একাকিত্বের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম, তখন পাশের এপার্টমেন্ট থেকে ভেসে আসা গিটারের ছন্দ, গানের সুর আমার নিঃসঙ্গতার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ফালাক নামের তরুণটি প্রতিদিন সকালের কোমল সূর্যকিরণের স্পর্শে বারান্দায় বসে গান গাইত, সেই সুর আমার ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে আমার হৃদয়ে প্রশান্তির ঢেউ তুলত। মনের বিষণ্নতা মুহূর্তেই উবে যেত, হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়ত। শুনেছি ফালাকের স্বপ্ন, একদিন সে বিখ্যাত গায়ক হবে।

সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মায়াবী মুহূর্তে ছাদে জমায়েত হতো তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আড্ডা। বিল্ডিংয়ের ছোট্ট ছেলেমেয়েরা চারপাশে বৃত্ত তৈরি করে বসত, আর ফালাক গান গেয়ে মুগ্ধ করত সবাইকে। কখনো রবীন্দ্রনাথের সুরের মাধ্যমে, কখনো বাংলা ব্যান্ডের উত্তাল ছন্দে, আবার কখনো নিজের অন্তর থেকে উৎসারিত কোনো সুরের মাধ্যমে। সবার মুখে হাসি ফোটানোর এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। এমন প্রাণবন্ত, এমন আনন্দময় একটা মানুষ! হাসিটা ছিল সংক্রামক - যে একবার দেখত, সেই অনিবার্যভাবে হাসতে বাধ্য হতো। এমন সংক্রামক হাসি তৈমুরেরও ছিল!

মাস দুয়েক পর একটা অদ্ভুত, অস্বস্তিকর ব্যাপার আমার নজরে আসতে শুরু করল। ফালাক আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। আমি যখন বাজার থেকে ফিরি, তখন দেখি রাস্তার ওপাশে সে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। করিডরে হাঁটার সময় পেছন থেকে আসা পায়ের আওয়াজ আমার কানে বাজে। আমি যখন হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাই, সে চট করে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে, চোখ এড়িয়ে যায় আমার দৃষ্টি থেকে।

মেয়েদের সহজাত একটা বুদ্ধি থাকে, একটা অন্তর্দৃষ্টি থাকে। আমরা বুঝতে পারি কোনো পুরুষ আমাদের দিকে কীভাবে তাকায়। সেই দৃষ্টিতে কী লুকিয়ে আছে। প্রশংসা, নিছক কৌতূহল, নাকি আরো গভীর কিছু। ফালাকের চোখে থাকা তীব্র আগ্রহ, প্রেমময় আকর্ষণ আমি স্পষ্ট টের পেতে শুরু করলাম। 

সবচেয়ে বেশি দেখা হতো লিফটের সংকীর্ণ পরিসরে। আমি উঠতে গেলেই দেখতাম সে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি একা থাকলে সে লিফটে উঠত, অন্য কেউ থাকলে পরের লিফটের জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করত। আমার দিকে তাকাতো চুপিসারে, লুকিয়ে লুকিয়ে, আমি টের পেয়ে তাকাতেই লিফটের বাটনের দিকে তাকানোর ভান করত।

কিছুদিন পর শুরু হলো তার অজুহাতের নাটক। একদিন দরজায় মৃদু শব্দে নক দিয়ে বলল বিনয়ী স্বরে, 'মিস ডিম্পল, আপনার কাছে একটু লবণ আছে? আমার শেষ হয়ে গেছে, কাল বাজার করব।'

হাতে একটা ছোট বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সহজ সরল ভাবে, এমন নিরীহ অসহায়ত্বের সাথে বলল যে, না করার কোনো উপায়ই ছিল না। 

কিছুদিন পর এলো চিনি চাইতে। তারপর একদিন এলো আরও জরুরি অজুহাত নিয়ে, 'আমার ফ্ল্যাটের কারেন্ট চলে গেছে। আপনার কাছে একটা মোমবাতি হবে?' আমি যখন মোমবাতি দিতে গেলাম, দেখলাম কারেন্ট ঠিকঠাকই আছে। 

দিন দিন তার অজুহাতগুলো আরো সৃজনশীল, আরো কৌশলী হতে থাকল। কখনো বলত গলা খাঁদে নামিয়ে, 'গলা খুসখুস করছে, আপনার কাছে কোন ওষুধ আছে? প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে সাহায্য করা তো সওয়াবের কাজ।'

কখনো বলত সংকুচিত ভাবে, 'সরি বিরক্ত করার জন্য৷ মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু আমার ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। আপনার ফোনটা একটু...'এই সব অজুহাতের মাঝে আমি আরও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, সে আমার সাথে কথা বলার কোন না কোন সুযোগ খুঁজছে। আমার সাথে কিছু সময় কাটানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। আমি যখন হাসতাম, তখন তার মুখও আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, যেন সে জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছে।

একদিন দেখলাম সে তার প্রিয় গিটার নিয়ে আমার দরজার কাছে বসে আছে। আমাকে দেখে নিরীহ ভাবে বলল, 'হ্যালো মিস ডিম্পল, আমার ফ্ল্যাটের পানির লাইন ফেটে গেছে। এখানে বসে একটু অপেক্ষা করি, প্লাম্বার আসবে।'

তারপরই শুরু হলো তার মিষ্টি গলার গান। আমি ঘরের ভেতরে বসে সেই সুরেলা গান শুনতে শুনতে মন হারিয়ে ফেললাম তৈমুরের স্মৃতিতে। ফালাকের এই সব আচরণ আমার হৃদয়ে তার প্রতি কোনো টান সৃষ্টি করার বদলে, বরং তৈমুরের অনুপস্থিতিকে আরও বেশি করে অনুভব করাত। তার প্রতিটি ভঙ্গিতে, প্রতিটি কথায় আমি খুঁজে পেতাম তৈমুরের প্রতিবিম্ব।

আমাদের ভালোবাসার গল্পে প্রথম হৃদয় হারিয়েছিল তৈমুর। বিভিন্ন ছুতোয় আমাকে দেখতে আসত, কথা বলার সুযোগ খুঁজত। সেই একই লজ্জাভরা চোখ, সেই একই সকাল-সন্ধ্যা নানা অজুহাতে দেখা হয়ে যাওয়া। সেই একই উৎকণ্ঠিত মুখ, সেই একই প্রত্যাশায় ভরা দৃষ্টি।

তৈমুর মিথ্যা করে বলত, 'মা তোকে ডাকছে।'

আমি তাড়াহুড়ো করে ছুটে গিয়ে দেখতাম কাকিমা কিছুই বলেননি। পেছনে ফিরে তাকালেই চোখে পড়ত, তৈমুর দাঁড়িয়ে আছে মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে। ওর আনন্দ দেখে আমার রাগ হতো না। বরং মনে মনে খুশি হতাম।

পরদিন এসে বলত, 'আমার খাতার পাতা শেষ। তোর কাছে খাতা আছে?'

তারও পরের দিন এসে বলত, 'কলমের কালি শেষ। একটা কলম দিবি?'

এরপর পেন্সিল, তারপর রাবার। এভাবে প্রতিদিন কোনো না কোনো অজুহাতে আসত। আমি পরিষ্কার বুঝতাম সবই বাহানা। কিন্তু সেই বাহানাই আমার কাছে ভালো লাগত। লজ্জায়, অনুভবে গালদুটো রক্তিম হয়ে থাকত। ভীষণ উপভোগ করতাম। চুপিচুপি মিটিমিটি হাসতাম। আর অপেক্ষা করতাম, আবার কোন অজুহাতে আসবে।

ফালাকের এই একই ধরনের অজুহাত দেখে আমার মনে হচ্ছিল, সময় যেন স্থির হয়ে গেছে। যেন তৈমুরই আবার ফিরে এসেছে, ভিন্ন রূপে, ভিন্ন নামে।
আমি কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেললাম। হাতড়ে খুঁজলাম ওর উপস্থিতি। বুঝতে পারলাম, প্রেম একবারই হয়। বাকি সব শুধু অভ্যাস, সময় পার করার উপায়।

সকালে হাঁটতে বের হওয়ার তোড়জোড় করছিলাম। লিফটের দরজা খুলতেই নাকে এসে লাগল মাদকতা ভরা সুগন্ধ। চোখ পড়ল কর্নারে রাখা বেলি ফুলের মালা। আমার প্রিয় ফুল! পুরো লিফটটা ভরে গেছে তার মিষ্টি ঘ্রাণে।

সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিপটে ভেসে উঠল তৈমুরের মুখ। কত মালা দিয়েছিল ও! হিসেব রাখতে গেলে শেষ হবে না। কখনো লাল জবার মালা, কখনো গোলাপের কোমল পাপড়ি দিয়ে, কখনো রজনীগন্ধার উদাস সুগন্ধ নিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশি দিত এই বেলি ফুলের মালা। সম্পর্কে জড়ানোর পর 'তুই' থেকে 'তুমি' হয়ে বলত, 'এই ফুলটা ঠিক তোমার মতো। দেখতে যেমন সুন্দর, গন্ধেও তেমনি মাতাল করা।' বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে আসত, যেন আমার সুগন্ধ নিতে চায়। আমি লজ্জায় গুটিয়ে যেতাম কচ্ছপের মতো।

রাতের আঁধারে চুপিসারে আমাদের বাগানের বেলি গাছ থেকে ফুল পেড়ে আনত। সারারাত জেগে থেকে একটা একটা করে গেঁথে তৈরি করত মালা। সকালে কলেজ যাওয়ার পথে দিয়ে দিত আমার হাতে। বলত, 'ফুলের জন্য ফুলের মালা।' সহপাঠীরা আশেপাশে থাকত বলে আমি লজ্জা পেতাম। কিন্তু লুকিয়ে ঠিকই মালাটা নাকের কাছে নিয়ে প্রাণভরে তার ঘ্রাণ নিতাম। 

পরপর তিনদিন একই দৃশ্য ঘটল। প্রতিদিন লিফটে সুগন্ধি বেলি ফুলের মালা। তৃতীয় দিনে মালার সাথে পেলাম একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো। হস্তাক্ষরে লেখা ছিল, 'আপনার জন্য।' লিখনশৈলী দেখেই বুঝলাম, ফালাকের কাজ। চতুর্থ দিন লিফটে ঢুকতেই দেখি ফালাক দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে আজকের বেলি ফুলের মালা। আমাকে দেখে একটু এগিয়ে এলো। বারকয়েক ঢোক গিলে বলল, 'এতো কষ্ট করে ফুলের মালা বানাই আপনার জন্য। নিয়ে যান না কেন? এমন অবহেলা করবেন না। বুকে লাগে।'

ফালাককে কাছে এসে দাঁড়াতে দেখে মনে পড়ে গেল বহু বছর আগের স্মৃতি। তৈমুর স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক নীরব গলিতে। খুব কাছে এসে আকুল হয়ে বলেছিল, 'তুই কি কিছু বুঝিস না? কেন তোর পিছু ঘুরি? কেন তোকে একটু দেখার জন্য বাহানা খুঁজি। এবার তো সাড়া দে। আর কত পাগল করবি আমায়?'

ওর কথা শুনে, নিঃশ্বাসের উষ্ণতা অনুভব করে আমার বুকের ভেতরটা দুলে উঠেছিল। অনুভূতির জোয়ারে মাথা ঘুরে যাচ্ছিল। কোনোমতে তৈমুরকে ঠেলে সরিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম।

ফালাককে কোনো উত্তর না দিয়ে লিফট থামতেই দ্রুত পায়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে চলে গেলাম। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসে রইলাম হতবাক হয়ে। কীভাবে বুঝাব ফালাককে , সে যতো যত্ন ও ভালোবাসা দেখাচ্ছে, তার সবই আমি আগে অন্য কারো কাছে পেয়েছি। তৈমুরও তো একই রকম যত্ন করত। একই রকম ভালোবাসা দিত। পৃথিবীর সব ভালোবাসা একাই বুকে পুষে রাখত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেও পাল্টে গিয়েছিল।

ফালাকের আগ্রহ, আকুলতা দেখে মনে হচ্ছিল, আমি যেন সময়ের চক্রে আটকে পড়েছি। যেন একই গল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কেন এই অবিরাম পুনরাবৃত্তি? এই হৃদয় আর কোনো পুরুষের প্রেমে পড়তে চায় না। প্রেমের সব রূপ সে দেখে ফেলেছে। আর কীসে মুগ্ধ হবে? শরীর থেকে তো তৈমুরের ভালোবাসার স্পর্শ কিংবা আঘাত, কোনোটাই মুছে যায়নি। 

ফালাকের জন্য শুধু সহানুভূতিই জাগছিল। সে এমন একজনকে ভালোবেসেছে যে তার প্রাপ্য ভালোবাসা দিতে পারবে না। আমি একটা ভাঙা পাত্রের মতো, যেখানে জল রাখলেও তা গড়িয়ে পড়ে যায়। আর ফালাক সেই পাত্রে ভালোবাসার জল ঢালতে চাইছিল।

পরদিন যখন ফালাক আবারও আমার পেছনে পেছনে হেঁটে আসছিল, আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। থেমে গিয়ে তাকে ডেকে স্পষ্ট করে বললাম, 'আমি ম্যারিড। সেপারেশনে আছি।'

ফালাকের মুখটা সঙ্গে সঙ্গে যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল। চোখ দুটো বিস্ময়ে বিস্তৃত হয়ে উঠল। মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোল না বেশ কিছুক্ষণ। আমি ভাবলাম, হয়তো এবার সে সরে যাবে। হয়তো এই সত্যটুকু জানার পর তার মনে আমার জন্য যে কোমল অনুভূতি ছিল, তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমি পেছন ফিরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। ফালাকের কণ্ঠস্বর আমাকে থামিয়ে দিল, 'ডিভোর্স তো হয়েই যাবে। আমার কোনো অসুবিধা নেই।'

আমি স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ডিভোর্স! শব্দটা প্রবল ঝাক্কি দিয়ে কানে বিঁধল। এক মুহূর্তের জন্য চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল। যেন কেউ আমার মাথার ওপরে বাজ ফেলেছে।

সেদিন সন্ধ্যায় অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে হিসেব করে দেখলাম। পুরো পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে তৈমুরকে ছাড়া। পাঁচটা মাস! এত দীর্ঘ একটা সময় পার করে দিয়েছি একা। কিন্তু তবুও কেন মনে হয় যেন গতকালও ও আমার পাশে ছিল? কেন ওর স্মৃতিগুলো এখনো এত প্রখর, এত জীবন্ত?

রাতের পর রাত জেগে থেকে ভাবতাম, এর কারণ কী? বিবাহের বন্ধনটা এত শক্তিশালী যে সেটা আমাকে এখনো বেঁধে রেখেছে? নাকি আইনত এখনো তার স্ত্রী হয়ে থাকায় আমার অবচেতন মন মুক্ত হতে পারছে না? হয়তো ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত এই যন্ত্রণা, এই টানাপোড়েন শেষ হবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশে ফিরে যাব। ডিভোর্সের কাগজপত্র সম্পন্ন করে আসব।

এত দিনে নিশ্চয়ই তৈমুরও এগিয়ে গেছে জীবনে। নতুন কাউকে খুঁজে পেয়েছে। আমাদের বিবাহিত জীবনের শেষ দিনগুলোতে ও দানবের মতো আচরণ করেছিল। ওর পক্ষে নতুন কাউকে গ্রহণ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এবার গিয়ে সব কিছু পরিষ্কার করে আসব। ডিভোর্স নিয়ে এসে অদৃশ্য শিকলগুলো ভেঙে ফেলব। অতীতের সব পিছুটান মুছে দিয়ে নতুন করে শুরু করব জীবন। তবেই আমি সত্যিকারের মুক্তি পাব।

মাত্র চার দিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা সেরে আমি ঢাকায় পৌঁছে গেলাম। সোজা চলে এলাম তৈমুরের ফ্ল্যাটে। গেটে পৌঁছাতেই দারোয়ান কাজি মিয়া আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তার চোখে অবিশ্বাস, বিস্ময়! কতদিন পর দেখলেন আমাকে!

মুখ খুলে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই আমি সেই দৃষ্টি এড়িয়ে দ্রুত পা বাড়ালাম। লিফটে উঠে তৃতীয় তলায় পৌঁছলাম।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতে গিয়ে দেখি দরজাটা খোলা। অর্ধেক খোলা। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো মনে। পরে শুনেছিলাম, আমি চলে যাওয়ার পর থেকে তৈমুর নাকি আর কখনো দরজা বন্ধ করেনি। বিশ্বাস করত, আমি যেকোনো মুহূর্তে ফিরে আসব। আর তখন যেন দরজা খুলতে দেরি না হয়।

ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। আমার নিজের হাতে সাজানো সংসার দেখে বুকটা কাঁপতে লাগল। পাঁচ মাস ধরে জমাট বাঁধা বরফের মতো শক্ত হয়ে থাকা আমার হৃদয়ে যেন কেউ ভারী হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করল। ফাটল ধরে গেল সেই বরফে।

আমি নিঃশব্দে আমার থাকার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। ঘরে ঢুকে দেখি, সবকিছু ঠিক যেখানে রেখে গিয়েছিলাম, সেখানেই আছে। আমার বইগুলো, আমার পুতুল, এমনকি আমার চুলের ক্লিপটাও ড্রেসিং টেবিলে সেই জায়গাতেই পড়ে আছে। কী অবিশ্বাস্য! যেন সময় থেমে গেছে এই ঘরে।

পরক্ষণেই আমার চোখ পড়ল মেঝেতে। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে তৈমুর। গভীর ঘুমে বিভোর। তার চেহারা দেখে চমকে উঠলাম। দাড়ি-গোঁফ অনেক লম্বা হয়েছে। কাপড়চোপড় এলোমেলো। যেন অনেক দিন ধরে নিজের যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমার বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। এক অদ্ভুত যন্ত্রণা আর করুণায় ভরে উঠল মন। আমি অনুভব করতে লাগলাম, আমার হৃদয়ের বরফ গলতে শুরু করেছে। গলে গলে পানি হয়ে ঝরে পড়ছে।

না, আমি গলে যেতে পারি না! আমি আবার এই ভুলে ফিরতে পারি না। আমি তো এসেছি সব শেষ করে দিতে, নতুন করে শুরু করতে। তবে কেন আমি এভাবে গলে যাচ্ছি? কেন আমার মন চাইছে তৈমুরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে?কতদিন পর দেখলাম ওকে! কতদিন ওর বুকের উষ্ণতা আমাকে স্পর্শ করেনি। কতদিন ওর নিঃশ্বাসের ছোঁয়া আমি পাইনি। আমার হাত কাঁপতে লাগল। পা দুটো যেন অবশ হয়ে গেল। আমি দাঁত কামড়ে নিজেকে আটকালাম। গলে যাওয়ার ভয়ে পালাতে শুরু করলাম। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে পা লেগে গেল ড্রেসিং টেবিলের কোণায়। কিছু একটা পড়ে গেল। আওয়াজ শুনে জেগে উঠল তৈমুর।

আমি থাকতে পারলাম না। দৌড়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। পিছন থেকে তৈমুরের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল, 'অলকা! অলকা দাঁড়াও, অলকানন্দা...'

আমি থামলাম না। থামতে পারলাম না। 
থামলেই হেরে যাব। আমি হেরে যেতে চাই না।  
          বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সাহস হয় না। জানি, মায়ের সামনে দাঁড়ালে প্রশ্নের পাহাড় নিয়ে বসবে,
-'কোথায় ছিলি তুই?'
-'এভাবে কেউ বাড়ি ছেড়ে যায়?'
-'সংসারে তো ঠোকাঠুকি হয়ই, তাই বলে চলে যাবি।'

যেগুলো আমার মনখোঁড়ানো ক্ষতের ওপর নুনের ছিটার মতো জ্বালা ধরাবে।

তিনি এখন নিজের বড় দুই ভাইয়ের অকৃত্রিম স্নেহের ছায়ায় বেশ নিরাপদেই আছেন। তাকে নিয়ে চিন্তা করার কোনো অবকাশ নেই। বয়স হয়েছে, তবুও তাদের আদরে কোনো ঘাটতি নেই। একমাত্র বোন বলেই হয়তো এই অটল মমতা। জন্মানোর পর থেকেই মামাদের ভালোবাসার বলয় প্রতিরক্ষার আবরণ হয়ে ঘিরে রেখেছে মায়ের সমগ্র অস্তিত্ব। এতো আদরের বোন হয়েও সংসারের নামে নীরবে সহ্য করে গেছেন স্বামীর নির্যাতন। মুখ বুজে, নিঃশব্দে অশ্রু গিলে গিলে কাটিয়েছেন যৌবনের স্বর্ণালী দিনগুলো। নারীর জীবন এতটা সহনশীল কেন? কেন এই অসীম সহ্যক্ষমতা, কেন এই আত্মহুতি? আদর, স্নেহ, ভালোবাসা প্রাচুর্য থাকার পরেও কেন একজন নারী দিনের পর দিন মুখ বুজে মেনে নেয় অন্যায়? কী রহস্যময় নারীর জীবন! সংসারই তাদের কাছে পরম সত্য। আমিও কি এই সংসারের টানে গত পাঁচটি মাস পুড়িনি?

ক্লান্ত, ঝিমিয়ে পড়া হৃদয়টা নিয়ে পৌঁছে গেলাম শহরের সীমানা ঘেঁষে থাকা এক বিলাসবহুল রিসোর্টে। যেখানে কেউ নেই, নেই চিনে ফেলার ভয়, নেই কোনো চেনা মুখের উপচানো প্রশ্ন। শরীর তখন নিজেরই ভার সইতে পারছিল না। একরকম নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ঢুকলাম নির্দিষ্ট ভিলায়। ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়াতেই থমকে গেলাম। ভীষণ চমকে উঠলাম নিজেকে দেখে। কেমন বিবর্ণ, ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখের নিচে লম্বা জলের দাগ। আমি কাঁদছিলাম? কখন? কেন? তৈমুরকে ছেড়ে দ্বিতীয়বারের মতো চলে আসার কষ্টে? এ কী করে হয়! 

বাইরে তখন গোধূলির আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। জানালার পর্দাটা একটু সরিয়ে তাকালাম। কাচের ওপারে দেখা গেল কৃত্রিম জলপ্রপাত, সাদা জলধারা গড়িয়ে পড়ছে পাথরের গায়ে। তার পাশেই ছোট ছোট নুড়ি পাথর, বুনো ঘাসের পাতায় লেগে থাকা হলদে আলো। সবুজে মোড়া বাগানে কিছু অচেনা ফুল মাথা নাড়িয়ে যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। বাতাসে মৃদু সৌরভ।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো জানালার ফাঁক গলে। সেইসাথে কোথাও থেকে ভেসে আসছিল মৃদু গানের সুর।দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। তৃষ্ণার্ত শরীর, ক্লান্ত মনের ভার ধুয়ে ফেলতে ঢুকে পড়লাম গোসলখানায়। জলের ছোঁয়ায় যদি কিছুটা হালকা হয় হৃদয়ের বিষাদ।

গোসল সেরে একরাশ জলভেজা ক্লান্তি নিয়ে বের হয়েছি মাত্র, এমন সময় দরজায় হালকা শব্দ হলো। কৌতূহলে দরজার ছিটকিনি খুলে দিলাম। পর মুহূর্তেই বুকের ভেতর কেমন ছ্যাৎ করে উঠল। তৈমুর! শরীর মুহূর্তেই শীতল হয়ে গেল, পেছনে ঘুরে ঘরের ভেতর পালানোর মতো সরে আসি অজান্তেই।
তৈমুর পেছন থেকে জাপটে ধরে ফেলল। নিঃশ্বাসটা আটকে এলো। স্নায়ুকোষগুলো যেন একসাথে থেমে গেল। বুকের ভেতর হঠাৎই যেন একের পর এক শব্দহীন গুলির শব্দ; তীব্র, কাঁপানো, বেপরোয়া। এতো মধুর কি কখনো লেগেছিল ওর স্পর্শ?
কতদিন ধরে এই স্পর্শ পাইনি! পাঁচ মাস- আক্ষরিকভাবে প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত আমি বয়ে বেড়িয়েছি অভিমান, রাগ আর ক্ষোভের বিস্ফোরণ। তবু যখন ওর হাত আমার গায়ে এলো, মনে হলো পুরো পৃথিবী কেঁপে উঠল। মাথা ঝিমঝিম করছিল। এই সেই মানুষ, যে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, ভেঙে দিয়েছে, পুড়িয়ে দিয়েছে। তবু কেন এত তীব্র অনুভব? কেন?

ও আমার ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে বলছিল, 'আর পালাতে দেব না তোমায়… আর না...'

এই কণ্ঠটাই তো আমি গত পাঁচ মাস ধরে শুনতে চেয়েছি! প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত ওর গলা শুনব বলে কী ভয়াবহ রকমের হাঁসফাঁস করেছি! আমার ঘোর লেগে গেল। আমি নিজেকে সেই ঘোর থেকে বের করে আনতে চাই। প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করি সেই বিষাক্ত দিনগুলো, যেদিন আমি ভেঙে পড়েছিলাম। শরীরের সব শক্তি একত্র করে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম। কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, কিন্তু কথাগুলো ছুরির মতো বেরিয়ে এলো, 'দূরে থাকো, কাছে আসবে না।'

তৈমুর নাছোড়বান্দা। আবার এগিয়ে এলো। আমাকে জড়িয়ে ধরল। চোখে, গালে, কাঁধে, গলায় নামিয়ে আনল বৃষ্টির মতো চুম্বন। আর কানে কানে বলছিল, 'জানতাম তুমি আসবে…
আমাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারবে না…'

ওর স্পর্শ, ওর কথা শিমুল তুলার মতো নরম অথচ আমার দেহে জ্বলন্ত স্পর্শ হয়ে লাগছিল৷ আমি বোঝাতে পারব না, কী ভয়ানক দুর্বল করে দিচ্ছিল আমাকে ওর পাগলামি। কিন্তু আমি হেরে যেতে চাই না। শুধু স্পর্শের কাছে, অনুভূতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চাই না। আমি ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, 'গায়ের জোর দেখাবে না, প্লিজ! আল্লাহর দোহাই, দূরে থাকো! আমি কিছুই ভুলে যাইনি। কেন পিছু পিছু এলে? আমি এখুনি চলে যাব!'

রাগে, কষ্টে, অভিমানে আমার হাত-পা কাঁপছিল। আমি তড়িঘড়ি করে স্যুটকেস গুছাতে শুরু করলাম। মনে প্রশ্ন জাগল, রিসোর্টের মত প্রাইভেট জায়গায় ও কীভাবে ঢুকে পড়ল?
পরে জেনেছিলাম, ও আমার পিছু পিছু এসেছিল। রাস্তায় সিনক্রিয়েট হতে পারে সেই আশঙ্কায় দূর থেকে অনুসরণ করেছে। এই সিনক্রিয়েটই তো আমাকে ওর কাছ থেকে ছিটকে দিয়েছিল একদিন! তাই এবার রাস্তায় কিছু না বলে, সোজা পাশের ভিলায় উঠেছে।

চাইলেই আমি চেঁচাতে পারতাম। তাহলেই নিরাপত্তা কর্মীরা এসে ওকে এই ভিলা থেকে বের করে দিত।
কিন্তু আমি চেঁচালাম না। হয়তো অবচেতনে আমি চেয়েছিলাম ওর সম্মানটুকু বাঁচুক। অথবা হয়তো আমি এখনও ওর একটুখানি কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম, অস্বীকার করলেও সত্যটা এই! আমার মন, আমার আত্মরক্ষার দেয়ালের পেছনে কোনো এক অনুভব নিঃশব্দে ঢুকে ছিল। তৈমুর এগিয়ে এসে স্যুটকেসটা সরিয়ে অনুনয়-বিনয় করতে লাগল, 'তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আমি আর তোমাকে যেতে দেব না। প্লিজ থামো… আর না।'

আমি কঠিন গলায় বললাম,
'হাত ছাড়ো, নয়তো আমি চেঁচাব।'

ও থামল না। শুধু কণ্ঠটা আরও নরম করে বলল, 'এভাবে হারিয়ে যেও না। সরি বলছি আমি। আমাকে একবার… আরেকটিবার বলার সুযোগ দাও অন্তত…'

আমার ঠোঁটে তিক্ত হাসির রেখা ফুটে উঠল। ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম, 'সরি? তোমার সেই বিখ্যাত সরি? যার উঠতে-বসতে কোনো কমতি নেই! তুমি নিজেও জানো, তুমি আবারও একই ভুল করবে! তোমার সরি মানেই নতুন ভুলের ছাড়পত্র।' 
বুড়ো আঙুল তুলে, ওর চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডা গলায় বললাম, 'এই সরির এক বিন্দু মূল্য নেই তৈমুর। এক বিন্দুও না।'

তৈমুরের চোখে জল টলমল করছে, তবুও আমার কথায় দমে গেল না। আবার জড়িয়ে ধরল, আরও ব্যাকুল হয়ে ফিসফিস করে বলল,
'তুমি যা বলবে তাই করব…
যা করলে তুমি ফিরে আসবে, যা বললে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, আমি তাই করব… আমি বদলে যাব… শুধু আমাকে আর একটিবার সুযোগ দাও…'

ও এমনই! মাফ চাইবে এমনভাবে যে ক্ষমা না করে উপায় নেই। আমি সেই ফাঁদে বহুবার হেঁটেছি, ভেবেছি হয়তো এবার সত্যিই পাল্টে যাবে। কিন্তু না, এবার আর নয়। আমি ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বললাম, 'নাটক করবে না, প্লিজ। সরে যাও।'

তৈমুর মুখ তুলল। দুটো হাতে আমার গাল ছুঁয়ে চোখে চোখ রাখল। ওর চোখে জমে থাকা জলের ঝিলিক আমার সমস্ত প্রতিরোধকে নরম করে দিতে চাইল। আমি অনুভব করছিলাম, আমার বুকের বরফ গলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। শুধু গলেই যাচ্ছে না, মিষ্টি শরবতে পরিণত হচ্ছে৷ ওর স্পর্শ, ওর বাহুর জোর সবকিছুই আমার প্রতিদিনের অভ্যাস ছিল। চেনা উষ্ণতা আমাকে তীব্র গতিতে টানছে ওর দিকে। 

তৈমুর কাঁপা কণ্ঠে বলল, 'তুমি পারবে আমাকে ছেড়ে থাকতে?'

আমি এক পা পিছিয়ে গিয়ে আবারও হাসলাম। বললাম, 'থাকিনি? পাঁচটা মাস কম নয় তৈমুর।'

তৈমুর তখন থেমে গেল। আহত চোখে তাকিয়ে রইল, যেন ভেবেই উঠতে পারছে না, তার চেনা মানুষটা এমন বদলে গেল কীভাবে! আমি ওর সেই আহত চোখ দেখতে পারছিলাম না। চোখ ফিরিয়ে নিলাম। দ্রুত স্যুটকেস গোছাতে লাগলাম। এই জায়গায় আর নয়। এই সম্পর্কের গোলকধাঁধায় আর ফেরা নয়। 

পেছন থেকে তৈমুরের কণ্ঠ ভেসে এলো,
'তোমাকে সেদিন থেকে পাগলের মতো খুঁজেছি। মিসিং ডায়েরি করেছিলাম… পুলিশ খুঁজেছে, তোমার মামারাও চারদিকে খুঁজেছে। পাসপোর্ট ট্রেস করে জেনেছিলাম তুমি ইন্ডিয়ায় গিয়েছিলে। আমিও সেখানে গিয়েছিলাম... থেকেছি দুই মাস… রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি, একেকটা স্টেশনে, হোটেলে, টার্মিনালে খুঁজেছি। সব জায়গায় গেছি, যেখানে একটু হলেও সম্ভাবনা ছিল। তুমি ছিলে না কোথাও। তখন বুঝলাম, যে মানুষ নিজেই হারিয়ে যেতে চায়, তাকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়?'

ওর কণ্ঠটা নরম হয়ে এলো, 'তারপর থেকে অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত। আমার সেই অপেক্ষা আজ পূর্ণ হয়েছে…তুমি ফিরে এসেছো। প্লিজ, আর চলে যেও না। তোমাকে ছাড়া আমার কোনো মূল্য নেই, আমি থাকতে পারি না…'

আমি নিঃশব্দে শুনছিলাম ওর কথা। পিঠটা তখনও ওর দিকে, তাই ও দেখতে পেল না, আমার চোখ বেয়ে নেমে এসেছে দু'ফোঁটা জল। বলতে পারলাম না, আমিও ভালো ছিলাম না। তোমার অনুপস্থিতি আমায় প্রতিদিন একটু একটু করে গিলে খেয়েছে। বরং কাঠ কাঠ গলায় বললাম, 'আমাকে আঘাত করার আগে এসব ভাবা উচিত ছিল তোমার।'

ও ধীরে ধীরে এসে আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। বলল, 'আমি সরি, অলকা। আমাকে ক্ষমা করো। আমি ভুল করেছি, মহাভুল। আমি অন্যায় করেছি… অপরাধ করেছি। তুমি যা চাও শাস্তি দাও, তবুও প্লিজ দূরে যেও না…'

আমি তখন স্যুটকেস গুছিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, 'সরি বললেই সব অপরাধ মাফ হয়ে যায় না। ভালো থেকো।'

আমি ঘুরে দাঁড়াতেই, ও জড়িয়ে ধরল আমাকে। দুই হাতে পেট আঁকড়ে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল, কাঁধে নিঃশ্বাসভেজা চুমু দিয়ে বলল, 'আমি তোমাকে যেতে দেব না…'

আমি ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করলাম,
'ছাড়ো।'

'ছাড়ব না।'

'আমি চেঁচাব…'

'চেঁচাও।'

'তৈমুর, প্লিজ!'

'তুমি যাবে না…'

আমি গলার স্বর শক্ত করে বললাম, 'তোমার সঙ্গে থাকলে আমি তিলে তিলে মরব। আমার সুখ নষ্ট করো না, প্লিজ। আমি কেবল একটু ভালো থাকতে চাই…'

তৈমুর তবুও ছাড়ল না, কাঁধ থেকে মুখ তুলে বলল, 'আমি নিজেকে বদলেছি, অলকা…একবার অন্তত আমাকে সুযোগ দাও।'

আমি ওর বাঁধা হাত থেকে বেরিয়ে পালাতে চাইলাম। একটু আলগা হয়েও গেলাম৷ বললাম, 'বহুবার তোমায় সুযোগ দিয়েছি, আর নয়…'

ও আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, জলভেজা চোখে বলল, 'আর একবার… আর একবার অলকা…আমি সত্যিই অনুতপ্ত…'

আমি ওর বাহু থেকে নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিলাম। স্যুটকেস হাতে দরজার দিকে এগোতে এগোতে ঘৃণা মেশানো কণ্ঠে বলে উঠলাম, 'অন্য কাউকে সুযোগ দেব, তাও তোমায় না।'

পেছন থেকে সঙ্গে সঙ্গে জবাব এলো, 'ভুল কি কেবল আমারই ছিল? তোমার কোনো দায় ছিল না?'

আমি থমকে দাঁড়ালাম। চোখ বন্ধ করলাম এক মুহূর্ত, যেন নিজেকে সামলাতে পারি। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, 'এখন তুমি ভিক্টিম সাজবে? সত্যিই?'

তৈমুর এগিয়ে এসে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। বলল, 'ভিক্টিম সাজার মানসিকতা তোমার। আমার না।'

আমি স্যুটকেসটা শব্দ করে মেঝেতে ফেলে দিলাম। চোখ রাঙিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, 'আমি ভিক্টিম সাজি? তুমি আমাকে দুবার চড় মেরেছ, একবার সবার সামনে, পাব্লিক প্লেসে!
একবার গলা চেপে ধরেছিলে! আর রোজ রোজ তো ছিলই অপমান, অবহেলা, ছোট করা…তবুও বলবে আমি ভিক্টিম সাজছি? ভিক্টিম নই?'

তৈমুর তীব্র শ্বাস টানল, ওর গলার স্বর থরথর করছে, 'বলতো, শেষ কবে তুমি আমাকে সরি বলেছ?'

আমি চুপ হয়ে গেলাম। 

তৈমুর চোখে চোখ রেখে বলল, ' মনে করতে পারছো না, তাই তো? কারণ তুমি কখনোই সরি বলোনি। আর আজ বলছো, আমার সরির কোনো দাম নেই!
একটা সরি, অলকা…আমার কাছে এই একটা শব্দের অনেক মূল্য ছিল…'

আমি ঠোঁট কামড়ে বললাম, ' আমি কখনো অন্যায় করিনি তোমার সঙ্গে। তাই সরি বলার দরকার পড়েনি।'

তৈমুর মাথা নাড়ল, 'তুমি নিশ্চিত তো, কখনো অন্যায় করোনি?'

আমি থমকে গেলাম। চোখ কাঁপছিল। মনে মনে গুনে যাচ্ছিলাম, কোথাও কি আমি ভুল করেছিলাম? নির্ভর কণ্ঠে জবাব দিলাম, 'না। অন্তত ইচ্ছে করে কিছু করিনি।'

তৈমুর মৃদু হেসে বলল, 'মানুষ শুধু নিজের ব্যথা মনে রাখে। কার মনে কীভাবে ছুরি বসিয়েছিল সেটা খুব সহজে ভুলে যায়।'

আমার হৃদয়ে ঝাঁকুনি খেল। উত্তেজিত হয়ে বললাম, 'তুমি এখন আমাকে দোষারোপ করছো? প্লিজ, তোমার আসল রূপটা দেখিও না। যাওয়ার আগে অন্তত একটা ভালো স্মৃতি দাও। শেষটায় একটু শ্রদ্ধা রেখো।'

'আমিতো বিদায় চাই না।'

'কিন্তু আমি চাই, এটাই হোক আমাদের শেষ।'

তৈমুর এক পা এগিয়ে এলো, আমার দিকে ঝুঁকে বলল, 'আমার অপরাধের শাস্তি এত বড় কেন? তাহলে তোমার অপরাধের শাস্তিও তো তোমাকে পাওয়া উচিত। সেটা কি তুমি পেয়েছো? আমি যদি তোমাকে শারীরিকভাবে কষ্ট দিয়ে থাকি, তুমি মানসিকভাবে ধ্বংস করেছো আমাকে। তাই তোমাকেও শাস্তি পেতে হবে৷ তোমার শাস্তি হচ্ছে, আমি তোমাকে চাই। আমার সঙ্গে তোমাকে থাকতে হবে।'

আমি একপা পেছনে সরে এলাম। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললাম, 'আমি ধ্বংস করেছি?'

তৈমুর শান্ত কণ্ঠে বলল, 'করেছো…কিন্তু মনে রাখোনি। তুমি শুধু মনে রেখেছো, আমি তোমাকে কীভাবে কষ্ট দিয়েছি।'

ওর অভিযোগ আমি নিতে পারছিলাম না। আমার ভেতরটা জ্বলে উঠল। চেঁচিয়ে উঠলাম, 'আমি কী করেছি হ্যাঁ? কী করেছি? বলো, কী করেছি? কেন মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছো?'

'তোমার কিছুই মনে নেই?'

আমি রাগে-দুঃখে থরথর করে কাঁপছিলাম, 'না, মনে নেই। কী করেছি আমি?'

'বিয়ের পর থেকে তুমি আমাকে একটা রিমোট কন্ট্রোল খেলনার মতো চালাতে চেয়েছ। যেকোনো সিদ্ধান্তে তোমার মতটাই চলেছে৷ আমার কোনো কথা তুমি শোনোনি, যেন আমি আছি শুধু তোমার সিদ্ধান্তে সায় দেওয়ার জন্য।

আমি সবসময় ব্যবসা করতে চেয়েছি, নিজের একটা কিছু দাঁড় করাতে চেয়েছি। হ্যাঁ, প্রথমদিকে লস হচ্ছিল, লাভ আসছিল না, তখন তুমি বলেছিলে, চাকরি করো, বলেছিলে তোমার বাসায় মিথ্যে বলতে, যেন আমি কোনো উঁচু পদে কর্পোরেট জব করি। আমি রাজি ছিলাম না মিথ্যে বলতে। জীবনে কখনো বলিনি, তবুও বলেছি, তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে। তোমার ভালোবাসার জন্য নিজের বিবেকে ফাটল ধরিয়েছি। 

তুমি খুব দ্রুত রেগে যাও। রেগে গিয়ে বহুবার আমার হাত চেপে ধরেছো, নখ দিয়ে খামচে দিয়েছো। আমি কি ব্যথা পাইনি, অলকা? পেয়েছি। কিন্তু কখনো সেটা নিয়ে প্রতিবাদ কিংবা অভিযোগ করিনি। কারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

তুমি সবসময় অস্থির থাকো, যা চাও সঙ্গে সঙ্গে চাও। কিন্তু জীবনটা তো মাইক্রোওয়েভ ওভেন নয় যে একটু তাপ দিলেই সব রেডি হয়ে যাবে! আমি প্রতিদিন ভয়ে থাকতাম কখন তুমি আবার রেগে যাবে।

বিয়ের প্রথম বছর- যেখানে সম্পর্কটা রোমান্টিক আর স্বপ্নের মতো হওয়া উচিত ছিল। সেটা হয়ে উঠেছিল টক্সিক, পেইনফুল।

এক বছর আমি সহ্য করেছি কোনোরকম প্রতিবাদ ছাড়া৷ তারপর তৃতীয়বার যখন আমি লস খেলাম তুমি রাগে বলেছিলে, 'তোমাকে দিয়ে ব্যবসা হবে না, চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকো, কাপুরুষ।'

এই কথা শুনে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। বলো তো, ব্যথা কি শুধুই শারীরিক হয়? হৃদয়ের হয় না? তোমার কথাগুলো আমায় গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ভেতরে ভেতরে। আমি চাইছিলাম তুমি আমার পাশে থাকো, জাজ না করো, সাহস দাও, সাপোর্ট করো। সেটা যখন হলো না, উল্টো এভাবে বললে না চাইতেও হাত উঠে গিয়েছিল। আমি মানছি, আমার উচিত ছিল অন্যভাবে রাগ কমানো, থাপ্পড় দেয়া উচিত হয়নি, আমি সেটা স্বীকার করি, সরিও বলেছি। মাফ চেয়েছি, বলো চাইনি? তুমি মাফ করেছো বটে, কিন্তু তারপর থেকে তুমি আর কখনো নর্মালি মেশোনি আমার সঙ্গে।

'রূপ, লাবণ্য, ক্যারিয়ার, টাকা সব কিছু থাকা সত্ত্বেও আমি কেন সহ্য করব ওর মতো ছেলের থাপ্পড়?'

এই ভাবনা তোমাকে ধীরে ধীরে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। কিছুদিন পর তুমি নরম হয়েছিলে, নিজে থেকে কাছে এসেছিলে, আমি ভেবেছিলাম, ফাইনালি তোমার ভেতরের গ্লানি কেটে গেছে। কিন্তু (ফিজিক্যাল) ইন্টিমেসির পরে তুমি হঠাৎ এমন একটা কথা বললে যে, আমার ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। 

একটা কল আসায় আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বের হব কি না। তুমি বলেছিলে, 'আমি কি তোমার প্রস্টিটিউট? কাজ শেষ আর টাকা দিয়ে চলে যাব?' আরও বলেছিলে, 'সেই টাকাটাও তো তোমার নাই।'

তখন আমি… আমি সহ্য করতে পারিনি। আমার ভেতরে রাগ, অপমান, অভিমান একসাথে ফেটে পড়েছিল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল, তোমার কণ্ঠটা চিরতরে থামিয়ে দিতে। আমি রাগ বশবর্তী হয়ে গলা চেপে ধরেছিলাম।

অলকা, আমি তো শুধুই বলেছিলাম, একটা জরুরি কল এসেছে, আমাকে বের হতে হবে। তোমার অনুমতি চেয়েছিলাম। দ্যাটস ইট! তুমি চাইলে যেতাম, না চাইলে না যেতাম। কিন্তু তোমার ইগো হার্ট হয়েছিল। তুমি ভুল বুঝেছিলে, ভেবেছিলে তুমি নিজে থেকে কাছে এলে, আর আমি বের হয়ে যাচ্ছি। তুমি আমাকে অপমান করতে চেয়েছিলে কথাটা বলে… অথচ নিজেকেই অপমান করেছিলে।

তুমি শুধু মনে রেখেছো, আমি তোমার গলা চেপে ধরেছিলাম, কিন্তু তার আগে তুমি কী বলেছিলে, তা কি মনে রেখেছো? তারপরও আমি সরি বলেছি, ফিরিয়ে এনেছি তোমাকে।

একজন ছেলে যখন বারবার ব্যর্থ হয়, সবাই তাকে লুজার ভাবে। আমি জানি, পুরুষ মানেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেই যুদ্ধে আমি একা ছিলাম না, তুমি ছিলে পাশে, অথচ সাহসের বদলে তুমি বারবার আমাকে ছোট করেছো। কারণ তুমি চাওনি আমি ব্যবসা করি। তুমি চেয়েছ হয় চাকরি করি অথবা বিদেশ স্যাটেল হই।

আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাসো। তুমি বিশ্বাস করো আমায়। আমার জ্বর হলে, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে এলে, তুমি দিশেহারা হয়ে পড়ো। তুমি আমাকে বিয়ে করতে নিজের বাবার সঙ্গে লড়াই করেছো। কখনো কোনো ছেলেকে বন্ধুও অবধি বানাওনি। আমাকে নিয়েই সারাজীবন থেকেছো। আমাকেই তোমার জীবন ভেবেছো, আমার সঙ্গে ভালো থাকতে চেয়েছো। শধু বুঝলে না, পুরুষ মানুষও ব্যথায় ভেঙে পড়ে, শুধু শরীর নয়, কথাও ব্যথা দেয়। 

যতবার তুমি বাবার বাড়ি চলে গিয়েছো, আমি তোমাকে অনুরোধ করে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। তারপর তোমার বাবার মৃত্যুর পর, তুমি চুপ হয়ে গেলে। তোমার হাসি হারিয়ে গেল, শরীর দূর্বল হচ্ছিল। আমি চিন্তায় ব্যবসায়ও সময় দিতে পারছিলাম না। ডাক্তার দেখাতে তোমাকে ঢাকা নিয়ে গেলাম জোর করে৷ কিন্তু তুমি ইচ্ছে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলে। যেন খুঁজে না পাই। তুমি একবারও ভাবোনি, আমি কেমন দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম! একটা একটা করে প্রতিটি বোরকা-নিকাবওয়ালা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। শেষমেশ যখন তোমার চোখ দেখে চিনেছিলাম, তুমি আমায় দেখেও পেছন ফিরে চলে যেতে লাগলে। শুধু এই কারণে যে, আমি তোমায় ডাক্তার দেখাতে এনেছি। তখনও আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। একটা থাপ্পড় মেরেছিলাম, আমি খুব বড় অন্যায় করেছি। পুরনো অভিমান, জমানো রাগ, তোমার প্রতি ক্রোধ, নিজের প্রতি হতাশা, সব মিলে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি পরক্ষণেই বুঝেছিলাম আমার ভুল। আমি প্রয়োজন হলে তোমার পায়ের নিচে পড়ে যেতাম। যদি তুমি থেকে যেতে। কিন্তু তুমি হারিয়ে গেলে। 

আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল কি জানো? এই দীর্ঘ সম্পর্কজুড়ে, আমি তোমাকে কখনো সরি বলার জায়গা দিইনি। দোষ যারই হোক, আমি সরি বলেছি। এজন্যই তুমি নিজের অজান্তে ভেবে নিয়েছিলে, তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি কখনো অন্যায় করোনি...করো না। আর সেই বিশ্বাস থেকেই, তুমি আমায় যত কষ্ট দিয়েছো, তা কখনো তোমার চোখে ধরাই পড়েনি।' 

তৈমুর থামল। প্রাণভরে শ্বাস নিল। ওর চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে৷ ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'আমাদের সম্পর্কটা এমন কেন হয়ে গেল, অলকা? ভালো তো কম বাসিনি। তুমিও তো কম বাসোনি।' 
          আমার চোখ দুটো বর্ষার দিনের প্রশান্ত পুকুরের মতো টলটলে জলে ভরে গেল। দুই চোখ ভর্তি অভিমান নিয়ে বললাম, 'তাহলে সব দোষ আমার? আমি কি কিছুই দিইনি তোমাকে? শুধু কষ্ট আর যন্ত্রণা দিয়েছি? এত নিষ্ঠুর ছিলাম আমি?'

বুকের গভীরে যেন কোনো অদৃশ্য হাত এক পাহাড়সম ভার চাপিয়ে দিয়েছিল। শ্বাস টানতে গিয়ে বারবার দম আটকে আসছিল, যেন ফুসফুস দুটো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। মস্তিষ্কের ভেতর সমস্ত চিন্তাভাবনা একসাথে তোলপাড় করতে করতে তৈমুর যা যা বলেছে সবই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল চেতনার পর্দায়। কোনো রকম বিকৃতি বা ভুল ব্যাখ্যা ছাড়াই। সবটুকুই ছিল নিরেট সত্য, কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেই। তাহলে এতদিন নিজেকে নির্দোষ ভেবে এসেছিলাম কীভাবে?

কেউই নিজের ভুল মুখের ওপর শুনতে চায় না, আমিও না। অন্তরে একটা গুমরে থাকা রাগ চিড়বিড় করে উঠছিল। একইসাথে তৈমুরের ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে মনটাও টাল খেয়ে যাচ্ছিল। অনুশোচনার কাঁটা হৃদয়ে খোঁচা দিয়ে যেন বলছিল, 'তুইও তো দোষী... তুইও অপরাধ করেছিস।'

তৈমুর আমার চোখের জল দেখে অস্থির হয়ে কাছে এসে চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, 'ভুল ভাবছো। যে ভালোবাসা তুমি আমাকে দিয়েছো, সেটা শুধু রেয়ার না, এক্সট্রা-অর্ডিনারি। এমন ভালোবাসা, এমন যত্ন হাজারে একজনও দিতে পারে না। তোমাকে পেয়ে আমি কতটা সৌভাগ্যবান, জানো তুমি? আমার জন্য রাঁধতে গিয়ে প্রথমবার রান্নাঘরে ঢুকে হাত পুড়িয়ে ফেলেছিলে। সেই দাগ এখনো রয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে একটু খারাপ কথা বলায় নিজের মামার বাড়িতে চার বছর পর্যন্ত যাওনি। শুধু আমাকে পাবার জন্য দিনের পর দিন নিজের বাবার সঙ্গে কথা বলোনি। এসব কী করে ভুলে থাকি? তারপর করোনা মহামারির সময়, আমি হাসপাতালে মৃত্যুর দোরগোড়ায়। যখন কেউ আমার পাশে দাঁড়াতে সাহস করেনি, তখন তুমি আমার পাশে দাঁড়ালে, আমার গায়ে হাত রাখলে, আমার সঙ্গে শুয়ে থাকলে...জানতে তুমি নিজেও ইনফেকটেড হতে পারো, তবুও আমাকে একা হতে দাওনি। হাসপাতাল জুড়ে তোমার আর্তনাদ, তোমার চিৎকার আজও কানে বাজে। তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমার ভেতরের যোদ্ধাটাকে জাগিয়ে তুলেছিলে। তাইতো বেঁচে গিয়েছিলাম।
তুমি রাগ করো, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নাও, কখনো কখনো দিনের পর দিন কথা বলো না। কিন্তু কখনো রান্না বন্ধ করোনি। প্রতিদিন আমার পছন্দের খাবার বানিয়ে রেখেছো। জানো তো, আমার ক্ষুধা সহ্য হয় না! রাগ থাকলেও আমার যত্ন নিতে ভুলে যাওনি কখনো। কতজন পারে এমন মমতায় জড়িয়ে রাখতে? মানুষ ভুল করে, অলকা। আমিও করেছি, তুমিও করো। কেউই নিখুঁত না। সেই ত্রুটিগুলোকে মেনে নিতে পারলেই সম্পর্ক গ্রো করে। প্রেম গভীর হয়। শুধু মাঝেমধ্যে নিজেদের আয়নায় তাকাতে হবে, একটু সংশোধন করে নিতে হবে। এইটুকুই তো।'

আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমার দায় ছিল, এই তিক্ত, কঠিন সত্যটা মানতে পারছিলাম না। মুছে ফেলতে পারছিলাম না থাপ্পড়গুলোর অপমানজনক স্মৃতি। দগদগে ঘায়ের মতো সেই দৃশ্যগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।

অন্যদিকে, এত অন্যায় করেছি তবুও তৈমুর আমার ভালোবাসার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ত্যাগের কথা স্মরণ রেখেছে! সেই ভাবনা থেকে একটা তীব্র ব্যর্থতাবোধ জন্মাল অন্তরে। একটা গভীর আত্মগ্লানি পেয়ে বসল। ও পেরেছে, আমি কেন পারিনি ওর ভালো দিকগুলো মনে রাখতে? ওর প্রতিটি স্নেহ, প্রতিটি যত্ন? তাহলে কি ও বেশি ভালোবেসেছে? বেশি সহনশীল ছিল এই সম্পর্কে? বেশি পরিণত ছিল আমার চেয়ে? আর আমি? আমি কেবল ঝড় বইয়ে দিয়েছি। আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি সবটুকু। ধ্বংস করেছি আমাদের সাজানো-গোছানো সংসার। অন্তরে একসাথে জেদ, রাগ, অভিমান, অহংকার আর অনুশোচনার তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গেল। মাথা ঝিমঝিম করছিল। চারপাশে সব ঘুরে যাচ্ছিল। আবেগের উত্তাল সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, কোনটা ধরে রাখব, কোনটা ছেড়ে দেব? কোনটাকে ক্ষমা করব, কোনটাকে প্রতিরোধ করব?

নিজের অজান্তেই পুরনো ক্ষতগুলো টেনে এনে বললাম, 'এতো ভালোবাসো তাহলে আমার গায়ে হাত তুললে কী করে? আর আমিই বা কীভাবে ওরকম ভাষায় অপমান করলাম তোমাকে? আমরা আসলে একজন আরেকজনের অভ্যাস ছিলাম। প্রকৃত ভালোবাসা হয়তো আমাদের মধ্যে ছিলই না। নইলে এভাবে আমাদের সম্পর্কে দাগ লাগত? লাগত না। আমাদের সম্পর্কে কালি লেগে গেছে, দাগ হয়ে গেছে।'

তৈমুর ধীরে ধীরে সামনে এলো। হাঁটুগেড়ে বসে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল। কেঁপে উঠলাম আমি। পেটের ভেতর তীব্র এক অনুভূতির স্রোত গড়িয়ে গেল। ও ভগ্ন কণ্ঠে বলল, 'প্রতিদিন নিজেকে এই প্রশ্ন করেছি- কী করে আমি তোমাকে আঘাত করতে পারলাম! কী করে আমার হাত উঠতে পারল তোমার গায়ে! সব অপরাধ আমার। তুমি যাই বলো, যাই করো আমার ধৈর্য ধরা উচিত ছিল। চেয়েছিলাম, তুমি আমার ব্যথা বুঝো। চুপ থেকে অভিমান আর কষ্ট পুষেছি। নিজের ভেতরকার অনুভূতি খোলাসা করে বলা উচিত ছিল। বলিনি। নীরবে সহ্য করেছি তারপর শেষদিনগুলোতে রাগে ফেটে পড়েছি। তুমি একা দোষী নও, বরং বেশি দোষটা আমারই। আমি অনুতপ্ত, অলকা। অনেক বড় শাস্তি পেয়েছি। এতো কঠিন শাস্তি দিয়েছো যে কল্পনাতেও আনতে পারব না আর এমন কিছু। প্লিজ, আমরা আবার নতুন করে শুরু করি।'

আমার কান্নার বেগ আরও তীব্র হয়ে উঠল। এভাবে কেন নিজের ভুল স্বীকার করে নিচ্ছে ও? কেন এতটা নিজেকে ছোট করছে? তর্ক করুক, প্রতিরোধ করুক। এতো মহৎ, এতো উদার কে হতে বলেছে? নিজের ঘাড়ে সব অপরাধ নিয়ে? তাহলে কেন আমার ভুলগুলো এতক্ষণ বলল? ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিলো দুই রকম পরস্পরবিরোধী চিন্তায়। দীর্ঘদিন যে গভীর অভিমান পুষে রেখেছি, যে ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছি তা কি এত সহজে হাল ছেড়ে দিবে?

নিজের অজান্তেই ওর থেকে একটু সরে গেলাম। ও আমার দিকে হতাশ, বিষণ্ণ চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। হয়তো ভাবছিল, এতকিছু বললাম, এত অনুনয়-বিনয় করলাম, এত কাতরভাবে ক্ষমা চাইলাম তবুও ওর হৃদয় গলল না! তবুও ওর মনে কোনো নরম ভাব এলো না!

সবকিছুই বুঝতে পারছিলাম। ওর প্রতিটি কথা, প্রতিটি অনুভূতি আমার কাছে স্পষ্ট ছিল। কিন্তু নিজের গড়ে তোলা অহংকারের দুর্গ ভেঙে ফেলতে পারছিলাম না। যে মানসিক প্রাচীর গড়ে উঠেছে আমাদের মধ্যে, যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেই প্রাচীর ভেঙে আগের মতো কাছে ফিরে যাওয়া এত সহজ নয়!

চোখের জল মুছে শান্ত সুরে বললাম, 'আগের মতো কিছু নেই, তৈমুর। পাঁচ মাসে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। পরিস্থিতি বদলেছে। আমিও বদলে গেছি। আমার মনও বদলেছে।'

ও অবাক চাহনি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, 'তুমি সত্যিই ভালো আছো… আমাকে ছাড়া?'

কে যেন জোর করে বলাল, 'আছি। তোমাকে ছাড়াই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।'

ওর চোখ মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল। কণ্ঠটা খানিক ঝাঁঝালো হয়ে উঠল, 'তবে কেন এলে? কেন গেলে আমার ঘরে?'

আমি জবাব দিতে পারিনি। মনে হচ্ছিল হাজারটা শব্দ গলায় গিঁট বেঁধে আটকে গেছে। 

তৈমুর তেড়ে এসে বলল, 'বলো, কেন এসেছো?' 

'ডিভোর্স নিতে।' কথাটা বলেই ওর চোখের দিকে তাকালাম। দেখতে পেলাম, বিস্ময় ভরা ছলছল চোখ দুটি। আমার বুকটা যন্ত্রণায় চিনচিন করে উঠল। তবুও হার মানলাম না। গর্বিত, অহংকারী মানুষেরা সহজে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করে না। আমিও পারলাম না। কোনো কারণ ছাড়াই আমার অহংবোধ আরও বেড়ে গেল।

স্বভাব পাল্টানোর মতো কঠিন আর কিছু নয়। বরফের পাহাড় গলানোর চেয়েও দুরূহ। ছোট থেকে বাবা-মা আর কৈশোর থেকে তৈমুর আমার রাগ, জেদ, অহংবোধকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। লতানো গাছের মতো মুড়ে দিয়েছে আমার অহংকারকে। যে মাথা কখনো কারো সামনে ঝুঁকেনি, সে কি হঠাৎ করে নতজানু হয়ে যায়? অহংকার একদিনে গলে যায় না, যেমন হিমালয়ের বরফ এক বিকেলে মরে না।

তৈমুর দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, 'এখনো চাও?' 

চোখ নামিয়ে স্যুটকেস তুলে নিয়ে বললাম, 'চাই।' 

বলেই চলে যাচ্ছিলাম। আমার ভেতরে তখন দুটি সত্তা মল্লযুদ্ধ করছিল। একটি চাইছিল ভেঙে গুড়িয়ে যেতে তৈমুরের বুকে, অন্যটি চাইছিল তৈমুর আরও আকুল হয়ে আমাকে চাক, তবেই আমার হৃদয় তৃপ্ত হবে। প্রকৃতপক্ষে, চলে যাবার বাসনা যখন তৈমুর প্রথম জড়িয়ে ধরেছিল তখনই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। আমি বরবরই ছিলাম মোমবাতির শিখা আর ও এক পশলা হাওয়া।

দরজার কাছাকাছি পৌঁছাতেই হঠাৎ তৈমুর বজ্রের মতো টেনে নিল আমাকে। ওর উন্মাদ বাহু জোড়া মুহূর্তেই আবদ্ধ করে ফেলল আমার সারা অস্তিত্ব। পিঠ, কাঁধ, গলা, চোখ, মুখ শরীরের প্রতিটি চৌখুপিতে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল ওর পাগলপারা চুমুগুলো। 

প্রথমে আমি ছুটে পালাতে চাইলাম। বন্দী পাখির মতো ছটফট করলাম। কিন্তু শরীর ধীরে ধীরে আত্মসমর্পণের দিকে গলে যেতে লাগল। মানসিক প্রতিরোধ যতই জোরালো হোক, শিরা-উপশিরায় যে আবেগের রক্ত বইছে, সে তো তৈমুরেরই জন্য। মস্তিষ্ক অদম্য প্রতিবাদে গর্জে উঠছিল, 'না!'

কিন্তু হৃদয় তীব্র প্রশান্তিতে ফিসফিস করে বলছিল 'থেমে যা, এটাই সত্যি।'

একটা দম্পতির মধ্যকার মনোমালিন্য যখন শেষ হওয়ার পথে থাকে, তখন তাদের অনুভূতি তীব্র বেগে ফেটে পড়ে। ঠিক তাই হচ্ছিল আমার সারা শরীরজুড়ে। রক্তের প্রতিটি কণা কাঁপছিল গভীর আবেগে। যখন প্রতিটি শিরা-উপশিরা আমাকে সমর্পণ করে দিচ্ছিল, যখন শরীরের প্রতিটি অংশ অজান্তেই সাড়া দিচ্ছিল ওর স্পর্শে, ঠিক তখনই ও হঠাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল। চোখ নামিয়ে, ফ্যাকাসে গলায় বলল, 'যাও, যেখানে যেতে চাও… চলে যাও।'

আমি দাঁড়িয়ে রইলাম হতবাক হয়ে। 
ওর বলা শব্দগুলো আমার হৃদয়ে ধ্বংসস্তূপের মতো ধসে পড়ল। বুকের ভেতরটা খালি হয়ে গেল। চোখে আঁধার নেমে এলো, মুখ থুবড়ে পড়ল ভেতরের সমস্ত প্রতিরোধ। তৈমুর মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, ও কাঁদছে। এক পা সামনে বাড়ালাম। মন চাইছিল ওর কাছে গিয়ে সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলতে। কিন্তু অহংকার আর সেই চিরচেনা প্রতিরোধের দেয়াল আমার পায়ে শিকল পরিয়ে দিল। নিজেকে ধরে রাখলাম। স্যুটকেসটা উঠিয়ে নিলাম হাতে। বেরিয়ে পড়লাম ভিলা থেকে। 
রিসোর্টের নির্জন এক কোণে গিয়ে বসে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলাম শিশুর মতো। বুকফাটা আর্তনাদে ফেটে পড়ল আমার কান্না।

আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি আবার ওর প্রেমে পড়েছি... প্রেমের আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল আমার হৃদয়। আমি ওর অপেক্ষার প্রেমে পড়েছি, আমি ওর ব্যাকুলতার প্রেমে পড়েছি, আমি ওর অজস্র চুমুর প্রেমে পড়েছি। প্রেমে, প্রেমে ভেতরে থইথই আগুন জ্বলছে। সেই আগুনে আমার মন, মস্তিষ্ক পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। এই আগুন একমাত্র তৈমুরই নেভাতে পারে। অথচ, তৈমুর, আমাকে চলে যেতে বলল! কীভাবে পারল? আমার হৃদয়ে আবার জন্ম নিল নতুন অভিমান। যার আঁচ পুরোনো সমস্ত যন্ত্রণাকেও ছাপিয়ে গেল।

নারী জাতি বড়ই রহস্যময়। আমরা অভিমানের উপরও আবার অভিমান করি। চাই কেউ আমাদের ভুল বুঝুক, শুধু যাতে অভিমান করার একটা সুযোগ পাই। আবার সেই মানুষটিই যেন ভুল ভেঙে অনুনয় করে বলে, 'থেমে যাও, প্লিজ... থেকে যাও।'

আমিও তাই চাচ্ছিলাম। তৈমুর আর একবার ছুটে আসুক। আমাকে জাপটে ধরুক। বলুক, 'তুমি কোথাও যাবে না।'
আমি থেকে যেতাম। ওর বুকেই ফিরে যেতাম। সহস্রবার সরি বলতাম। সব ভুলে গিয়ে সব ঠিক করে ফেলতাম।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তাকিয়ে থাকলাম পেছনের পথের দিকে। কিন্তু তৈমুর এলো না। এটাই ওর ভালোবাসা?
যে মানুষটা পাঁচ মাস ধরে অপেক্ষা করেছে, সে ত্রিশ মিনিটের কথায় সমস্ত অপেক্ষার মহত্ত্ব মুছে দিল?

কান্নায় বুক ভাসিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছালাম। দুই দিন পর ভারত ফিরে যাওয়ার আগাম টিকিট কাটা ছিল। এই দুই দিন কাটিয়ে দেওয়ার জন্য কক্সবাজারকে বেছে নিলাম। কিন্তু স্লিপার তো দূরের কথা, বিজনেস সিটও পেলাম না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা নন-এসি সিটের টিকিট কাটতে হলো।

বাস যখন চলতে শুরু করল, কষ্টটা বাসের গতি অনুসরণ করে আরও বেড়ে চলল। সম্পর্কটা সত্যিই শেষ হয়ে গেল? আমি কেন ছুটে যেতে পারছি না? কি এমন অহংকার আমাকে টেনে রাখছে? নিজের উপরই ঘৃণা হতে লাগল। রাগে, দুঃখে, নিজের প্রতি যন্ত্রণায় কেঁদে ফেললাম, হেঁচকি উঠে গেল।

পাশের সিটে বসা মহিলা একটু বয়স্ক, পরনে সাদা-কালো ছাপার শাড়ি, অনবরত পান চিবোচ্ছেন আর আড়চোখে আমাকে দেখছেন কৌতূহল নিয়ে। ঠোঁটের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল গাঢ় লাল পানির রেখা। গাল বেয়ে নামতে নামতে থেমে যাচ্ছিল থুতনির নিচে এসে। মাঝে মাঝে জিভের আগা দিয়ে সে পানি ঠেলে দিচ্ছিলেন ভেতরে, আবার নতুন করে চিবোতে শুরু করছিলেন। চিবোনোর শব্দটা মাথায় কেমন গুঁজি গুঁজি করে বিঁধে যাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি টিস্যু বের করে চোখের জল মুছলাম। জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম যেন কিছুই দেখতে না হয়।

ফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ বাজল।
অবচেতনভাবে ফোনটা হাতে তুলে চোখ রাখতেই দেখি, তৈমুরের নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে,

তুমি চলে যাওয়ার পর, সূর্য উঠেছে ঠিকই, কিন্তু তার আলো আমাকে আর স্পর্শ করেনি।
সকাল হয়েছে, কিন্তু আমার ভেতরটা রাতের মতো অন্ধকারই থেকে গেছে।
চাঁদ উঠেছে আকাশে, কিন্তু তার মায়া আমার চোখে আর রূপ ছড়ায়নি।
তুমি ছিলে না, তাই পাখির কূজন কানে গিয়ে ঠেকেনি, ফুল ফুটেছে কিন্তু তার সৌরভ মনে পৌঁছায়নি।
তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর, পৃথিবীর প্রতিটা ঋতু আমার জন্য নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছিল।
শীত এসেছিল হাড় কাঁপানো শূন্যতা নিয়ে, আর বসন্ত এসে বলেছিল, 'অলকা নেই, প্রেমও নেই।' —

পড়তে পড়তে বুকের ভেতর কেমন হুহু করে উঠল। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
এমন সময় জানালার পাশে একটা তীব্র হর্ন বেজে উঠল। চমকে গিয়ে জানালার ওপারে তাকালাম। তৈমুর! বাইক নিয়ে পিছু পিছু এসেছে! হেলমেট পরেনি, এলোমেলো চুল, চোখে অস্থিরতা।

আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, 'আমার থেকে তোমার মুক্তি নেই, অলকানন্দা!'

আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ঠোঁট কেঁপে উঠল। মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেললাম। অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠল বুক। হঠাৎ করেই মনে হলো, পৃথিবী সুন্দর, আকাশ সুন্দর, এমনকি সুন্দর পাশে বসে থাকা পান চিবোনো মহিলাটিও।

আমি অনুভব করলাম, আমি যতটা না বেহায়া হয়েছি, তৈমুর তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি নির্লজ্জ হয়েছিল এই সম্পর্কে। আমরা ভাবি, সম্পর্ক মানেই নিট অ্যান্ড ক্লিন হবে, কোনো দাগ থাকবে না, কোনো তিক্ততা আসবে না।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দাম্পত্য মানে শুধু ভালো সময় ভাগাভাগি করা নয়। বিয়ে মানে প্রতিশ্রুতি। জীবনের শেষ অবধি একসঙ্গে থাকার, ভালোবাসার, লড়াই করার। এই দীর্ঘ পথচলায় একঘেয়েমি আসবেই, ভুল হবে, কথার আঘাত লাগবে, কখনো কখনো দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু যারা ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে জানে, যারা অহংকারের দেয়াল ভেঙে বারবার ফিরে আসতে জানে, তারাই পারে সেই সম্পর্ক বাঁচাতে। আর যারা নিজের আমিতে আটকে থাকে, তারা কেবল একে অপরকে হারিয়ে ফেলে। আমরা বহুবার সম্পর্কের দাগ মুছে আবার নতুন করে লিখেছি আমাদের গল্প। চেষ্টাটা অবশ্য বেশির ভাগ সময় তৈমুরেরই ছিল। ওর ধৈর্য, ওর জেদ, আর ওর ভালোবাসাই আমাদের সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রেখেছিল। অনেকে বলে, একটা সম্পর্কের ভার দুজনকেই সমানভাবে নিতে হয়। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, সব সম্পর্কেই একজন একটু বেশি দেয়, একটু বেশি ভাঙে, আবার একটু বেশি জোড়েও। আমাদের গল্পে, সেই মানুষটা ছিল তৈমুর। ও বুঝিয়েছিল, ভালোবাসা মানে সমান সমান নয়। ভালোবাসা মানে প্রতিযোগিতা নয় যে, কে বেশি দিল, কে কম দিল তার হিসেব করতে হবে। ভালোবাসা আসলে একরকম দান, যেখানে হিসেব রাখলে প্রেমটা শুকিয়ে যায়। তোদের সম্পর্কে না হয় তুই বেশি দিবি।

কথা শেষ করেই হাসল অলকানন্দা। 
তার একমাত্র মেয়ে, রূপকথা, মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল, 'বাবা বেস্ট… আমি কি বাবার মতো হতে পারব?'

অলকানন্দা মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল, 'কেন পারবি না? তুইতো তোর বাবারই মেয়ে। শুধু বুঝে চলবি, কোনটা ক্ষমা করা যায়, কোনটা যায় না।'

রূপকথা মায়ের কোলে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করল, 'বাবা কি আর তোমার গায়ে হাত তুলেছিল?'

'না। কখনো না। আমরা একে অপরের ছায়া হয়ে পাশে ছিলাম, যখন রোদ ছিল, যখন ঝড়ও।'

বলেই অলকানন্দা চোখ তুলে তাকাল দেয়ালের ছবিটার দিকে। ছবিতে তৈমুর দাঁড়িয়ে আছে, গাঢ় নীল স্যুটে, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে সম্মাননা হাতে। দেশের শীর্ষ শিল্পপতিদের একজন হিসেবে পেয়েছিল বর্ষসেরা সম্মাননা।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে, আলোর নিচে মাইক হাতে নিয়ে সেদিন বলেছিল, 'মানুষ সাধারণত সাকসেস দেখে, তার পেছনের মানুষটাকে নয়। আমি ভাগ্যবান, কারণ আমার পেছনে শুধু একজন স্ত্রী নয়, ছিল একজন সহযোদ্ধা, একজন বন্ধু। সে না থাকলে, আমি হয়তো আজ এই মঞ্চে দাঁড়াতাম না। এই অ্যাওয়ার্ড যদি কারও প্রাপ্য হয়, তবে তা পুরোপুরি আমার স্ত্রী অলকানন্দার। আমি শুধু তার ছায়ায় হেঁটে এসেছি।'

রূপকথা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সেই ছবির দিকে। সে মা-বাবার গল্প থেকে উপলব্ধি করল, সম্পর্ক মানেই দুজনের একসঙ্গে সুখে থাকা না। সম্পর্ক মানে, একজন ক্লান্ত হলে অন্যজন তার জন্য পথ ধরে বসে থাকা। একজন হারিয়ে গেলে, আরেকজন আলো জ্বেলে তার জন্য অপেক্ষা করা। ভালোবাসা মানে, যে পারে, সে একটু বেশি ভালোবাসে।

রূপকথা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিল, রাগ-অভিমান ভুলে আজই কাবিরের কাছে ফিরে যাবে।
·
·
·
সমাপ্ত……………………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp