রাজ তখনও সুমনার ঘরে বসে আছে। অচেনা চারদেয়ালের মধ্যে এক প্রকার গৃহবন্দি হয়ে। কি করবে ভেবে না পেয়ে হাতে ধরছে ফোন, কিন্তু সেখানে তার দৃষ্টি নেই, মন তো নয়ই। মনের মধ্যে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে সুমনার এরকম ভাবে ডাকার কারণ কি? তার মন পড়ে আছে—দরজার ওপারে সুমনার কাছে। যেখান থেকে ভেসে আসছে কানাঘুষোর অস্পষ্ট শব্দ, যেন প্রতিটি উচ্চারণেই তার অনাহূত উপস্থিতির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হচ্ছে। নতুন একটি পরিবেশ, তার উপর এমন পরিস্থিতি!রাজের ভিতরে একপ্রকার অস্বস্তি, মৃদু শ্বাসের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ওদিকে সুমনা রান্নাঘরে গিয়ে দেখে, বয়াম গুলো খালিই! তেমন নাস্তার আইটেম বলতে কিচ্ছু নেই। শুধু বয়ামে কয়টা বিস্কিট পড়ে আছে। একবার ভাবে, চা দিয়ে বিস্কিট কি দিবে? পরক্ষণেই মনে হলো, যেমনই হউক রাজ তো নতুন জামাই। প্রথমবার এসেছে। সেই প্রথমবারেই সামনে চা বিস্কিট রাখাটা কেমন বেমানান হবে? তারউপর এখন দুপুর! সব মিলিয়ে সে ভাত দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলো। রান্নাঘরে গিয়ে ঢাকনা উল্টিয়ে দেখে গরুর গোস্ত মাছ আর ডাল রান্না করা হয়েছে কোনমতে! খাবারগুলো দেখে সুমনা কেনো জানি হাসলো। সে তো মা'কে বলেছিলো রাজ আসছে তারপরেও এটুক আয়োজন? ফ্রীজ থেকে শষা, টমেটো কেটে নিয়ে নিজেই সালাদ বানাতে লাগলো। তারপর গ্যাসে দু'টো ডিম সেদ্ধ বসিয়ে দিলো। ডিম সেদ্ধ হতেই সেগুলো ভূনা ভূনা করে রান্না করলো। ব্যস এগুলোই সে বাটিতে করে পরিবেশন করে নেয়। আশ্চর্যজনক ভাবে সুমনাকে সাহায্য করতে তার মা এগিয়েও আসলো না। অথচ আগে মেয়েকে রান্নাঘরে পাও দিতে দিতেন না! সব কেমন বদলে গেলো, সুমনার এক সিদ্ধান্তে! সেদিকে আর পাত্তা না দিয়ে, সুমনা রুমের জন্য পা বাড়ালো। আধখোলা দরজাটি শব্দহীনভাবে ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল সুমনা।
তার হাতে একখানা ট্রে—তাতে সাজানো সব খাবার।
সুমনা কোনো কথা বলে না, কেবল ট্রেটি বিছানার এক প্রান্তে রাখে। রাজ তার দিকে তাকায়, দীর্ঘ দৃষ্টিতে, যেন এক নিঃশব্দ অনুসন্ধান চালাচ্ছে। তারপর স্বর নরম করে শুধায়—
“তুমি খেয়েছো?”
“না।”
“তাহলে চল, একসাথে খাই।”
সুমনা মাথা নাড়লো—না।
চোখদুটি নিচু, ঠোঁটে যেন কোনো কথাই আর উচ্চারণযোগ্য নয়। রাজ এবার তার কণ্ঠে খানিক গাম্ভীর্য এনে বলে উঠলো,
“সুমনা, সব ঠিক তো? আচমকা আমাকে ডেকে পাঠালে, অথচ নিজের মুখে কিছুই বললে না!”
“তোমার সঙ্গে চলে যেতে চাই।”
রাজ যেন মুহূর্তে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তার চোখে প্রশ্ন, কপালে চিত্রিত বিস্ময়।
“এইভাবে? হঠাৎ?”
সুমনা চোখ তুলে তাকায় না, শুধু বলে,
“হ্যাঁ। ঠিক এইভাবে। এই সম্পর্কের প্রহসন আর সহ্য হচ্ছে না তাই। রাজ, তুমি অন্তত এমন এক আশ্রয় দিও যেখানে আমি অভিযোগমুক্ত হতে পারি। একটা সংসার হবে আমার। ছোট্ট হলেও সমস্যা নেই। সংসারটা কেবল আমারই হবে। আমি আর কিচ্ছু চাই না। দিবে না তুমি?”
রাজ এতোক্ষণ চুপ করে ছিলো। যেনভাষা হারিয়ে গেছে। সে শুধু ধীরে হাত বাড়িয়ে দেয়, সুমনার কাঁধে রাখে সেই স্পর্শে বোঝা যায় তার সম্মতি তার প্রতিশ্রুতি। সুমনা সব ভেঙে না বললেও, রাজের কিছু বুঝতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক পালিয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছে। এগুলো যে শুনতে হবে তা দু'জনেই জানতো। সেজন্য রাজ তেমন অবাকও হলো না, মানাও করলো না। সম্পর্কে থাকাকালীনই জানতো এরকম কিছু হবে, কোনো একদিন!
“ঠিকআছে, আমার বউ বাচ্চা আমার কাছেই থাকবে। এ তো আরো ভালো ব্যাপার!”
সুমনা আর কিছু বললো না। রাজ চুপচাপ খাবার খেতে লাগলো। এর ভেতর কেউই আসলো না রুমের ভেতর। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাজ ঘুমিয়ে পড়ে। সুমনা আলমারি খুলে সব জামাকাপড় বের করে। তার সব জামাকাপড়ই রয়ে গেছে, নেওয়া হয়নি। এবার সব কাপড়গুলোই নিয়ে নিবে ভাবছে। একে একে সমস্ত জামাকাপড় সব নামিয়ে ভাঁজ করতে লাগলো
সবগুলো কাপড় ভাঁজ করতে করতে ঘন্টা খানেক সময় চলে গেলো চোখের পলকেই। রাজ তখন ঘুম থেকে উঠে গেছে! এর ভেতরই দরজায় আওয়াজ শুনে সুমনা তাকিয়ে দেখে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে।
“আসবো?”
সুমনা চটজলদি উত্তর করে,
“এ কি কথা আব্বু! তোমার যখন ইচ্ছে তখনই আসবে!”
সুমন রহমান ভেতরে ঢুকে বসলেন। রাজ তৎক্ষণাৎ শ্বশুর মশাইকে সালাম দিলেন।
“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?”
সুমন রহমান কন্ঠে গাম্ভীর্য এনে উত্তর করে,
“আছি। তা শুনলাম আমার মেয়েকে নাকি নিয়ে যাবে?”
“জ্বি, অনেকদিন তো থাকলো। এবার যাওয়ার সময় এসেছে!”
সুমন রহমান বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর কিছুটা আক্ষেপের সুরেই বলতে আরম্ভ করলো,
“এখন তো আমার মেয়ের সাথে আরো একজনও আছে। সামনে তোমার খরচ বাড়ছে বৈ কমছে না।”
সুমনা বুঝে গেলো, তার বাবা ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো সে, পাছে কেউ না আবার কিছু বলে ফেলে!
“আমি আমার সর্বচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছি।”
“তোমার মা কেমন আছে?”
“ভালো আছেন। মায়ের দেখাশোনা আপাই করছে।”
“বেশ, ভালো হলেই ভালো।”
সুমন রহমান রাজের সাথে এমনি করে টুকটাক কথা বলতে লাগলো। তবে পুরো কথোপকথনে উনার গাম্ভীর্য ভাব বজায় রেখেই। সুমনা ভয়ে ছিলো, এই না জানি তার বাবা কিছু বলে বসে। কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। সুমন রহমানও চলে যায়। সুমনা সব গোছগাছ করে ফেলে।
“তোমার সব রেডি করা শেষ?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে বোরখা পড়ে ফেলো।”
রাজের কথা মতন সুমনা বোরখা পড়ে রেডি হয়ে যায়। এতক্ষণ যাবত নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে রাখলেও এবার ভেতরটা কেঁদে উঠে! না চাইতেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে বেয়ে নিকাব ভিজে যাচ্ছে! হাতে সাইড ব্যাগটা নিয়ে, কাপড়ের বড় ব্যাগটা রাজের হাতে ধরিয়ে দিলো। সুমনা ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখে তার মা আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছে। মা'কে কান্নারত অবস্থায় দেখে সুমনা আরো ভেঙে পড়লো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে গিয়ে বলে উঠলো,
“মা?”
হাফসা বেগম পেছন ঘুরেই কেঁদে ফেললেন! তা দেখে সুমনা নিজেও কান্নায় ভেঙে পড়লো। মা বোধহয় কান্নারত কন্ঠে কিছু বলেওছিল সুমনা সেটা ভালো করে শুনতে পায়নি। এক পর্যায় হাফসা বেগম সুমনাকে অবাক করে দিয়ে রাজের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলে,
“আমার মেয়ে নিজেই নিজের পথ ধরেছে। ওকে একটু দেখে রাখিও। আমার একটাই মেয়ে। বড় আদরের!”
রাজও প্রতি উত্তরে বাধ্য ছেলের মতন মাথা নাড়ালো। যার অর্থ হ্যাঁ, সে সুমনাকে ভালোভাবেই রাখবে। এবার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুমনা গিয়ে দাঁড়ালো দাদীর কাছে। দিলরুবা বেগম কি কাঁদছে? সুমনা বোঝার চেষ্টা করেও পারলো না। দাদীর সামনে যেতেই দাদী তাকে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন! কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে! বাচ্চাদের মতন কাঁদছে। কেউ বলবে না, এই সেই তর্জন গর্জন করা দিলরুবা বেগম! কেমন অসহায় হয়ে কাঁদছে! দু চোখ বেয়ে পানির স্রোত নেমেছে। স্নেহভরা হাত দু খানা সুমনার মাথায় রাখলো। যেমন করে ছোটোবেলায় সুমনাকে মাথায় হাত দিয়ে আদর করে দিয়ে তাতে একশো টাকার একটা নোট গুঁজে দিতো তেমনি। যেনো এখনো বাচ্চা সুমনাকে তিনি আদর করছেন! দু হাত ভরে সুমনার মাথা ধরে চোখমুখ ধরে আদর করে দিলো। এই স্নেহময়ী দাদীর সাথে তখনকের দাদীকে চিনে উঠতে পারছিলো না সুমনা!
“একটু পরই সন্ধ্যা হইয়া যাইব, এই অবস্থায় যাওন কি ঠিক হইব? কাইলকা যাইতি!”
সুমনার তলা কেঁপে উঠে, কথা বলতে গিয়ে! তবুও বলে,
“না দাদী, কিছু হবে না।”
“ভালা থাহিস বইন, বেশি বেশি কইরা ভাত খাবি। না হইলে পেডের মইধ্যে যে আছে, পুষ্ট হইতো না! ভালো মতন কইরা খাবি মনে থাকবো? আর অসুবিধা হইলে এনে আইয়া পড়বি।”
সুমনা বাধ্য মেয়ের মতন মাথা নাড়ালো। এইতো তার দাদী সকালেও কত কথা শোনালো। আর এখন যাবার সময় ভিন্ন রূপ। এক মুহুর্তের জন্য সুমনার মনে হলো, যদি সবার সাথে সম্পর্কটা আগের মতনই থাকত! কিন্তু না, যা হয়ে গেছে তা হয়েইছে। সুমনা নিজ হাতে করেছে। এখন ভেবেও লাভ নেই। সে বাবাকে খুঁজতে লাগলো। পেয়েও গেলো, সুমন রহমানকে। তার বাবা ছোটো থেকেই নরম মনের মানুষ। অন্তত সুমনার ক্ষেত্রে! বড্ড ভালোবেসেছিল মেয়েটাকে। তার প্রতিদানে সুমনা এভাবে হিংসুটের মতন নিজের কথা ভেবে সবাইকে কষ্ট দিয়ে চলে যাচ্ছে! শেষবারের মতন আব্বু বলে ডাক দিতে গিয়ে ও পারলো না। কোথাও একটা যেন আঁটকেই গেলো! কবে এত পর হয়ে গেলো সে?সুমন রহমান মেয়ের যাওয়ার আভাস পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। সুমনা ভালোভাবে লক্ষ্য করলো তার বাবা হাত দিয়ে চোখ মুছছেন। চোখ দু'টো লাল। তিনি যে কেঁদেছে সেটা স্পষ্ট! এত বড় হয়েছে অথচ কখনো বাবার চোখে পানি দেখেনি। আজ দেখলো, এবং সেটা তার নিজের জন্য! কোথাও গিয়ে যেন সুমনার খারাপ লাগাটা আরো বেড়ে গেলো। কেনো এমন হলো? কেঁদেও কূল পাচ্ছে না এরকম অবস্থা!
“চল, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।”
সুমনা অবাক হয়ে বাবাকে শুধোয়,
“গাড়ি কেনো আব্বু? এখান থেকে দশ মিনিট হাঁটলেই তো গাড়ি।”
“ওখানে যাওয়ার জন্যই অটো নিয়েছি, নিচে দাঁড়িয়ে আছে চল। গরম পড়েছে খুব।”
আরো একবার সুমনার চোখ দু'টো ভিজে উঠলো। গরমের মধ্যে রোদের ভেতর দিয়ে সুমনার হেঁটে যেতে কষ্ট হবে বলে, বাবা আগেভাগেই এটুকু পথের জন্য গাড়ি ঠিক করে রেখেছে। এই ছোটো ছোটো খেয়াল, আদর যত্ন গুলো কে করবে তাকে? এতো ভালোবাসা ঠেলে সুমনা পাড়ি জমাচ্ছে সুখের আশায়! কবে যে বাবার সাথে নীরবে দুরত্বটা তৈরী হয়ে গেলো সেটা নিজেও বুঝলো না। গাড়িতে উঠে বসলো। বাবা নির্দেশনা দিয়ে দিলো খুব সাবধানে যাতে গাড়ি চালায়। শেষবারের মতন ভেজা চোখে বাবা মা সবাইকে দেখে নিলো। মুক্তা মেয়েটা কোচিং এ চলে গেছে। বিদায়ও নেওয়া হলো না। মেয়েটা আদৌও জানতো তো তার আপা চলে যাচ্ছে? জানলেও কি সে আসতো! হয়ত না! আপার সাথে ও যে সে দুরত্ব এঁটেছে। এক ছাঁদের তলায় থেকেও সবার থেকে এতোটা দূরে থাকা যায়, এবং সেটার কষ্ট যে কতখানি, সেটা খুব ভালোভাবেই টের পেলো সুমনা কান্না যেন ভেতর থেকে ঠেলে ঠেলে আসছে! বন্ধ হবার নামই নেই। সুমনার বারংবার মনে হচ্ছে, সে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে সবার থেকে। অনেক দূরে। বাড়িটার দিকে শেষবার তাকিয়ে রইলো সুমনা। সেই জানালা, সেই দেয়াল—সবই খুব চেনা। কিন্তু একে একে সেই চেনা জিনিসগুলোর গায়ে অভিমান, গ্লানি আর গুমোট এক স্মৃতির প্রলেপ লেগে গেছে।
একটা জীবন তো বেছে নিতে হবে তাকে। ভালোবাসা, যা টাকায় হয় না—মন দিয়ে হয়। সে সেই পথেই হেঁটে গেলো। রাজের হাত ধরে।
পেছনে পরে রইলো, তার কত শত স্মৃতি, জন্মদাতা পিতা মাতা!
আর সামনে?
সেখানে অপেক্ষায় একটি নতুন জীবন। নিজেও জানে না, আসলে এর পরনতি কি! শুধু এক রাশ স্বপ্ন নিয়ে হেঁটে চলেছে।
—————
সুমনা রাজের হাত ধরে দ্বীতিয় বারের মতো এই অচেনা বাড়ির চৌকাঠ পেরোয়। গেটের ভেতরে ঢোকার পর থেকেই তার বুকের ভেতর যেন অজানা আশঙ্কার ঢেউ উঠতে থাকে। হেঁটে হেঁটে যতটা সামনে এগোয়, ততই যেন পিছিয়ে পড়ে তার নিজের পরিচিত পৃথিবীটা। বাড়ির উঠোন পেরিয়ে দরজার সামনে এসে রাজ ধীরে বললো,
“চলো, তোমার ঘরে নিয়ে যাই। মা ঘুমাচ্ছেন এখন।”
সুমনা চুপচাপ মাথা নাড়ে। তার চোখে কিছুটা ক্লান্তি। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো এক তরুণী—ফর্সা গায়ের রং, চোখে হালকা কাজল, হাতে মোবাইল, ঠোঁটে মুঁচকি হাসি। রাজের বড় বোন।
“কেমন আছে? রাস্তায় কষ্ট হয় নাই তো?”
সুমনা হালকা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়,
“না, ঠিক আছি।”
রাজ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জানায়,
—“মা একটু আগে ঘুমিয়ে গেছেন। তোমাকে দেখলে অবশ্য খুশি হতেন। কাল সকালে কথা বলবে। এখন ওনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।”
সুমনা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে। বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই একটা অবোধ্য শূন্যতা তার চারপাশে ঘিরে রেখেছে। এই ঘরের দেওয়ালগুলো, দেয়ালে টাঙানো পারিবারিক ছবি—সবই তার কাছে অপরিচিত, অথচ আজ থেকে এগুলোই তার চিরচেনা আপন ঠিকানা হয়ে উঠবে। ঘরের দরজা খুলে দিলো রাজ। বিছানায় পরিপাটি চাদর, এক কোণে কয়েকটা বই, জানালার পর্দা অল্প বাতাসে দুলছে। সুমনা ধীরে পা ফেলে ঘরে ঢোকে। ব্যাগটা এক কোণে রাখে। চারদিকে একবার তাকায়—এই ঘরেই এখন থেকে তার সমস্ত দিন-রাত্রি,হাসি-কান্না, অভিমান ও অবাধ্যতা জমা হবে।ক্লান্তিতে শরীরটা ভার হয়ে এসেছে। রাজ কিছু বলার আগেই সে মাথা নিচু করে বলে
“আমি একটু শুয়ে নিই?”
রাজ শুধু মাথা নাড়ে।বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই একটা ভারমুক্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। মনে হয় যেন অনেক দূর পথ পেরিয়ে অবশেষে কোথাও একটু আশ্রয় মিললো। বালিশে মুখ রেখে চোখ বন্ধ করে। ঘুম যেন ঠিক এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিলো। সমস্ত ক্লান্তি, জড়তা, উদ্বেগ আর নতুন জীবনের আতঙ্ক—সবকিছুকে গিলে ফেলে এক তীব্র নিদ্রা এসে ভর করে তার চোখে। অন্ধকার ঘরের ভিতর সুমনার নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে ভারী থেকে হালকা হয়ে আসে। ঘুমিয়ে যায় সে।
নিঃশব্দে।ঘুম ভাঙলো হালকা এক ডাকের শব্দে—
"সুমনা উঠবে? আমি ভাত এনেছি। খেয়ে নাও একটুখানি।"
আঁধোঘুমের ভেতরেও রাজের কণ্ঠটা চিনে নিতে ভুল হয় না সুমনার। চোখ খুলে দেখে, রাজ বিছানার ঠিক পাশে বসে আছে, একটা ট্রে’র উপর পাতলা ভাত, ডাল আর একটু ভাজি নিয়ে। মুখে অদ্ভুত এক মায়া মিশ্রিত হাসি। ক্লান্ত মুখ,তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ঘুমচোখে সুমনা ধীরে উঠে বসে।
"একটু হাত-মুখ ধুয়ে আসি।"
বলেই উঠে পড়ে। ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসতেই দেখে রাজ ভাতের থালাটা একপাশে টেনে নিয়ে বসে আছে।
“তুমি বসো, আমিই খাইয়ে দিচ্ছি!”
সুমনা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। হয়তো বলে ফেললে দৃশ্যটার মাধুর্য নষ্ট হয়ে যেত। রাজ তার ডান হাতে একটু ভাত তুলে সুমনার মুখের কাছে ধরে।
“মুখ খোলো।”
সুমনা চুপচাপ মুখ খোলে।
খাওয়া শেষে রাজ নিজেই থালাটা সরিয়ে রাখে। তারপর নীরবতায় বিছানাটা গুছিয়ে দেয় ধীরে ধীরে।
“চলো, আরাম করো।”
বলে সুমনার হাত টেনে নিয়ে আসে বিছানায়। সুমনা আবার শুয়ে পড়ে। চুপচাপ। মুখটা জানালার দিকে। জানালার বাইরে রাতের অন্ধকারে কোনো পাখি ডেকে উঠছে, অথবা কোনো পুরনো স্মৃতি। ধরা দেয় বাবা মায়ের কান্নারত মুখটা!
ঘরটা অন্ধকার নয়, আবার পুরো আলোকিতও না।
সুমনা চুপচাপ শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ, কিন্তু ঘুমাচ্ছে না। রাজ পাশে এসে ধীরে ধীরে হাত রাখে তার কাঁধের কাছে। শরীরটা কাছাকাছি আনলেও শব্দ করে না। নিঃশব্দে হাত রাখে সুমনার হাতের উপর। উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে সুমনা শরীর জুড়ে। সুমনা কিছু বলে না। শুধু নিঃশ্বাসটা একটু গাঢ় হয়। যেন এক অজানা বেদনার ভেতরও আশ্রয় খোঁজে।
রাজের আঙুলগুলো ধীরে ধীরে ছুঁয়ে যেতে থাকে তার চুল, গাল, নরম ত্বকে। সুমনা চোখ বন্ধ করে রাখে, কোনো তাড়াহুড়া নেই, রাজকে সে দূরে ঠেলে দেয় না। বরং দুই হাত তুলে ধরে তার গলা জড়িয়ে ধরে। রাজ তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়, তারপর চুমু নামে গাল বেয়ে গলার কাছে। ধীরে ধীরে স্পর্শ বাড়তে থাকে। সুমনার নিঃশ্বাস গাঢ় হয়, বুকের ভেতর একটা দুলুনি ওঠে, যেন কোনো ছেঁড়া পাল তুলে সে নিজেকে রাজের কাছে সমর্পণ করতে চায়।এরপর রাজের হাত একে একে খুঁজে নেয় সুমনার আঙুল, বাহু, কোমর—যত্ন করে, ভালোবেসে। সুমনাও আর দূরে সরে না। বরং চোখ বন্ধ করে তার সমস্ত সংশয় মুছে দেয় রাজের স্পর্শে।
রাতের নিঃশব্দতায়, তারা দু’জন ধীরে ধীরে একে অপরের ভিতরে মিশে যায়। গড়ে ওঠে দাম্পত্যের এক গভীর, কোমল, এবং অনির্বচনীয় শুরু।
·
·
·
চলবে……………………………………………………