প্রেমদাহ - পর্ব ০৭ - মীরাতুল নিহা - ধারাবাহিক গল্প

          কেটে গেছে কয়েকটি সপ্তাহ। গর্ভাবস্থার পঞ্চম মাসে পা দিয়েছে সুমনা। শরীরের গঠন বদলেছে ধীরে ধীরে পেটটা এখন স্পষ্ট উঁচু হয়ে উঠেছে, যেন ভিতরে এক পৃথিবী গড়ে উঠছে নিঃশব্দে। খিদের তীব্রতা বেড়েছে অনেকখানি। কিন্তু সেই চাহিদার পাশে খাবারের যোগান হচ্ছে না! বাপের বাড়িতে মাছ মাংস দিয়েই ভাত খেতো সে। আবার সব মাছও খেত না—বাবা জানতেন কোনটা তার পছন্দ, কোনটার গন্ধেই সে মুখ কুঁচকায়। কোন কাছে কাঁটা কম, মানুষটি এককথায় বাজার থেকে আনিয়ে দিতেন সেই নির্দিষ্ট মাছটাই, যেটা সুমনা খাবে। কিন্তু এখানে? এখানে মাছ তো স্বপ্নের মতো। এই কয়দিনে সপ্তাহে বড়জোর একবার, তাও চ্যাংরা বা ছোট মাছ চোখে পড়েছে কেবল। রাজ এখনো বেকার। ইন্টারভিউয়ের প্রতীক্ষা আর প্রত্যাখ্যানের দীর্ঘশ্বাস গায়ে মেখে সে রাতগুলো পার করে দেয়। সংসার চলছে, ডাল-সবজি, আলু, মিষ্টিকুমড়ো, ভর্তা ভাতে। যেন একরকম বেঁচে থাকা, স্বাদ-আহ্লাদের তোয়াক্কা না করেই।

ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা অ্যালমারিতে রাজের ছোটবেলার কিছু টিউশনির জমানো টাকা ছিলো—সেই সামান্য সঞ্চয়ই ছিল ভরসার শেষ আশ্রয়। আর সুমনার ননাস—ছোটবেলা থেকে মেধাবী, গৃহশিক্ষকতার টাকা এনে কোনোভাবে জুগিয়ে নিচ্ছে সংসারের ছোটখাটো খরচ। তবে সে টাকাও আর ক’দিন! ফুরিয়ে আসছে দিনের হিসেবের মতো। 

ভবিষ্যতের আশঙ্কা যেন প্রতিটি নিঃশ্বাসে ভয় ধরায়। পেটের শিশুকে অনুভব করতে করতে, সুমনার মনে হয়—এই পৃথিবীটা সে কেমন উপহার দিচ্ছে তার সন্তানের জন্য? ডাক্তার দেখানো হয়নি আজও। প্রতিদিনই রাজ বলে, "কাল যাবো", কিন্তু সে কাল আর আসেই না। টাকার টানাটানির কাছে সমস্ত ইচ্ছা হার মানে। গর্ভাবস্থার এই সময়টায় আয়রন, ক্যালসিয়াম—সবই অত্যাবশ্যক। কিন্তু সেসব যেন এখন রূপকথার মতো শোনায় সুমনার কানে। ট্যাবলেটের নাম জানা আছে, কীভাবে কেনা যাবে, সেই উত্তরও অধরাই থেকে যায়। ধীরে ধীরে একটা তিক্ততা জমে উঠছে বুকের ভেতরে। একেকটা দিন, একেকটা না-পাওয়ার তালিকা হয়ে জমা হয় হৃদয়ের খাতায়। ক্ষুধা জাগে, কিন্তু ঠিকঠাক খেতে পারে না। 

এক সময় নিজেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করে সুমনা—

“এই সময়েই কেন এলো ও? এই দুঃসময়ে কেন? যখন সংসার টলোমলো, যখন নিজের চিকিৎসাটাও করাতে পারছে না!”

আরো একধাপ এগিয়ে গিয়েও ভাবে— বাচ্চাটা আছে বলেই হয়ত সে এখনো রাজের বউ হয়েই আছে! এক মুহূর্তে আবার বুকের গহীন থেকে নেমে আসে এক মমতাময় চিন্তা। চোখে ভেসে ওঠে রাজের কষ্টে মুছে যাওয়া হাসিমুখ।
"এই বাচ্চাটার কারণেই তো আমরা এখনো একসাথে আছি। না হলে—হয়তো এতদিনে রাজ ফিরে যেতো তার মায়ের বাসায়, আমি থাকতাম বাপের বাড়ি। এই একটা প্রাণ—যে আসেনি এখনো, অথচ তার উপস্থিতি সংসারকে বেঁধে রেখেছে সূক্ষ্ম এক আশার সুতোয়।"

সুমনা তখন আর নিজের কষ্ট নিয়ে ভাবে না। ভাবে ওই পেটের ছোট্ট প্রাণটা নিয়ে, যে কিছু না পাওয়ার মধ্যেও বেঁচে আছে। বুকের ভেতর থেকে আসে একটা অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা—
“তোর জন্যই তো সব। এই কষ্ট, এই অভাব, এই কান্না—সব মেনে নিচ্ছি শুধু তোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।”

—————

শ্বাশুড়ি মা এসে ঢুকলেন। হাতে কিছু নেই। মুখে হাসিও নেই। সোজা এসে বললেন,
— “চা টা করে দে তো মা, মাথাটা কেমন যেন ভার লাগতাছে।”

সুমনা চুপ করে তাকিয়ে রইলো ভদ্রমহিলার মুখে। প্রথমদিকে তিনি মাঝেমাঝে রান্নাঘরে ঢুকে চাল ধুয়ে দিতেন, ডাল বসিয়ে দিতেন, কখনো বা রান্নাতে কাঁধে কাঁধ মিলাতেন। কিন্তু দিন যত গেছে, ছেলের বউয়ের ওপর তার নির্ভরতা যেন আঠার মতো লেগে বসেছে। রাজও ঘরে থাকাকালীন সুমনাকে তেমন কাজ করতে দিতো না। খেয়াল রাখতো। যদিও এ অল্প ক'জন মানুষের সংসারে ওই রান্না টুকু বাদে তেমন বিশেষ কাজ নেই। 

সুমনার বিরক্তি হলো। সে কিছু বললো না। পেটের ভেতরে কেমন জানি মোচড় দিচ্ছে। ক্ষুধা লেগেছে। সোজা গিয়ে ভাতের হাঁড়িতে ঢাকনা খুললো। তরকারি তো বহু আগেই শেষ। এক কোণায় একটু ঘন ডাল পড়ে আছে। রান্না তার ননাস আসলে বাজার আনলে সন্ধ্যায করতে হবে। ভাত নিয়ে বসল সে। শুধু ভাত। ফলের গন্ধও নেই ঘরে। ভালো ভালো খাবারের স্বাদ আজকাল স্মৃতির কাছাকাছি। মাঝে মাঝে রাজ কিছু আনলেও—তাও সেই তুলনায় তেমন কিছুই হয় না। তার মন চায় নতুন কিছু খেতে। তেলে ভাজা পাকোড়া, টক দই, ঝাল বেগুনভাজি—এসব কল্পনাতেই এখন। মন চাইলেও মুখে বলতেও পারে না, খেতেও পারে না! সেই সামর্থ্য এখনো তার স্বামীর হয়েই উঠেনি।

হাতের আঙুল ডুবিয়ে ভাতে নাড়ল একবার। খেতে ইচ্ছেই করছিল না। অথচ পেটটা কেমন যেন চিৎকার করে উঠছিলো ভেতরে ভেতরে। খিদের গহ্বরে পড়ে যাওয়া মানুষ কেমন হয়—সে এখন বোঝে।এক গ্রাস মুখে দিলো। গলা দিয়ে নামতে চাইছে না। তবু খেতে হলো। কারণ তার ভেতরে আরেকটা প্রাণ বেঁচে আছে, যে শুধু তার ওপর নির্ভর করে। চোখ তুলে দেখে, শ্বাশুড়ি মা বিছানায় বসে পা উঁচু করে দিয়েছেন। সুমনা এক রাশ বিরক্তি নিয়েই খেতে লাগলো,

ঘরের দরজাটা সাঁ করে খুলে গেলো। রাজ ঢুকলো। মুখ থমথমে। ক্লান্ত চোখে চারপাশটা একবার দেখে চুপচাপ ব্যাগটা নামিয়ে দিলো কোণের চেয়ারটায়।
সুমনা তখন খাটে বসে জানালার বাইরের আকাশ দেখছিল,। বিকেলের আলো একটু একটু করে নেমে আসছে ঘরে। ঘরটা ভারী নীরবতায় ডুবে ছিলো।

সুমনা নরম স্বরে বলল,,

“ইন্টারভিউ তো কত দিচ্ছো!”

রাজ জুতা খুলে ধীরে ধীরে বিছানার এক কোণে বসে। কণ্ঠটা ভারী হয়ে আসে,

 “রেজাল্ট এখনো দেয়নি। বলেছে, কিছুদিন পরে জানাবে। হয়তো সময় লাগবে।”

সুমনা চুপ করে থাকে এক মুহূর্ত। তারপর মৃদু কণ্ঠে বলে,
“আমি এখনো ডাক্তার দেখাতে পারিনি। কিন্তু খুব দরকার ওটা। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না একদম। কেমন জানি লাগে একপ্রকার। বোঝাতে পারবো না। গতবার ডাক্তার বলেছিল চেকআপ করতে, বিলম্ব করলে খারাপ কিছু হয়ে গেলেও সমাধান করানো যাবে না।”

রাজ চোখ বন্ধ করে ফ্যানের বাতাসটুকু গায়ে মেখে নেয়। তারপর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

“আসলেই, এভাবে কত? আমি কত চেষ্টা করছি পারছি না!” 

রাজের অসহায় কন্ঠ সুমনারও ভাল্লাগলো না। তবুও আশ্বস্ত করে বলে,

“চিন্তা করো না।”
“তোমার বাবাকে কল দিবে? দেখি কিছু টাকা পাঠাতে পারে কি না। তোমাকে তো এভাবে ফেলে রাখা যাচ্ছে না! কোনো উপায় নেই আর সুমনা!” 

সুমনা তাকিয়ে থাকে তার দিকে। বলার কিছু থাকে না। দেখে মনে হচ্ছে রাজ খুব ক্লান্ত। তারপর আস্তে উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে রাজের হাতে ধরিয়ে দেয়। রাজ গ্লাসটা নেয়, কিন্তু চুমুক দেয় না। শুধু নিঃশব্দে বসে থাকে—যেন দুজনেই নিজের নিজের দুঃখে ডুবে আছে। ফ্যানের বাতাসে তার চুল উড়ছে একটু একটু করে। ঘরের বাতাস ভারী। ছাদের কোনায় নাম না জানা প্রাণী ডাকছে ক্ষীণস্বরে।

সুমনা পাশে চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। বুকের ভেতরে এক ধরনের অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করে। হঠাৎ সে ভাবতে থাকে—

"রাজের চাকরি কবে হবে? কবে টাকা আসবে? এই না-থাকা টাকা দিয়ে কীভাবে বাঁচানো যাবে আমাদের বাবুকে? যদি এখন চিকিৎসা না করাই, আর যদি পরে কোনো সমস্যা হয়? কেবল টাকার কথা ভেবে যদি ওর শরীরের ক্ষতি হয়? আমি কি সেটা মেনে নিতে পারবো?"

সে উঠে গিয়ে তাকে রাখা মোবাইলটা নিয়ে আসে। রাজ চেয়ে থাকে, কিছু বলে না। সুমনা ওর চোখের দিকে না তাকিয়ে ধীরে ধীরে বাবার নামটা খুঁজে বের করে। তারপর একটু থেমে, গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে কল দিয়ে দেয়।

ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে পরিচিত কণ্ঠ,
 “হ্যালো মা? কী খবর তোমার?”

সুমনা চোখ বন্ধ করে রাখে এক মুহূর্ত। কণ্ঠটা যেন মন ছুঁয়ে যায়। সে খুব শান্তভাবে বলে,

 “আসসালামু আলাইকুম, আব্বু। ভালো আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ মা। তুই কেমন আছিস? শরীর ঠিক আছে তো?”

সুমনা এক চিলতে হাসির ছায়া গলায় এনে বলে,

“হুম্, মোটামুটি। তোমার কেমন যাচ্ছে দিনকাল?”
“আমার চলে যায় রে।”

সুমনা এবার একটু থামে। তারপর নিচু স্বরে বলে,

 “আব্বু, একটা কথা বলার ছিলো একটু টাকা দরকার ছিলো। আমার শরীরটা ঠিকঠাক লাগছে না কিছুদিন ধরে। ডাক্তার দেখাতে বলেছে কিছু চেকআপ করাতে। ওদের বাসায় এখন একটু টানাটানি চলছে। তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে একটু বলি, যদি কিছু সাহায্য করতে পারো। অল্প কিছু টাকা হলেও হবে।”

ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর খুব মায়াময় কণ্ঠে বাবা বলে,

“আগে বলিস নি কেন? এই অবস্থায় হেলাফেলা করা যায় নাকি! আমি এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

এই সময়েই পাশের ঘর থেকে দাদীর শব্দ ভেসে আসে।

— “আরে আমি তো আগেই কইছিলাম! এই ছেলেটা ঠিক না! এখনই টাকা চায়, আইজ ডাক্তার দেহাইব কাইল কইব সিজারে জন্য টাকা, পরশু কইব ফার্নিচার দিতে! যৌতুক চাই! আর কি চাইব চাইবো কেডা জানে!”

সুমনার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। দাদী হয়তো সরাসরি কিছু তাকে বলছে না, কিন্তু কথা যে তারই দিকে, সেটা বুঝতে সময় লাগে না। 

“আহ্ আম্মা!, চুপ করেন!” 

আরও একটু তীক্ষ্ণ হয়ে আসে দাদীর কণ্ঠ। 

 “আল্লাহ জানে বিয়া হইসে, নাকি টানাটানির জিন্দেগির তলা ঢুকায়ে দিছি! মাইয়াডারে কি এমন কথা কইতে পারতাম যদি ভালা ছেলে দেখে দিতাম?”

সুমনার গাল বেয়ে টুপটাপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে কিছু বলে না, সুমনা মনে মনে ভাবে, 

“এই মানুষটিই তো আমাকে সবচেয়ে বেশি আদর করতো, মা বকলে দাদীর আচলের তলায় গিয়ে লুক্তো! আজ তিনিও সুযোগ পেয়ে এমন কথা শোনাচ্ছেন!” 

চোখ বেয়ে নেমে আসে টুপটাপ অশ্রু। রাজ তখনো চুপ করে বসে, তার চোখে জল ছলছল করে।
দুজনেই জানে—এই টানাটানির সংসারে ভালোবাসা হয়তো খুব দামি কিছু নয়, কিন্তু সেই একটুকু ভালোবাসার জন্যই এখনো টিকে আছে সব।

ফোনটা রাখার পর সুমনা চুপ করে বসে থাকে। খুব একটা শব্দ করে না, কিন্তু তার বুকের ভেতরটা যেন ধ্বসে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। রাজ পাশে বসে, কিন্তু কিছু বলার সাহস পায় না। সে বাইরে বারান্দায় যায়। রাত অনেকটা গড়িয়ে গেছে। ফ্যানের ঘূর্ণি শব্দ ছাড়া যেন কিছুই নেই চারপাশে। সুমনা চুপচাপ পাশে শুয়ে আছে, চোখ খোলা—তবু দৃষ্টি নেই কোথাও। মাথার ভেতরে শুধু শব্দহীন ভেসে বেড়াচ্ছে কথার কাঁটা, টাকা, ডাক্তার, দাদীর খোঁচা মারা কণ্ঠ। হঠাৎ রাজ ধীরে ধীরে পাশে এসে বসে। অনেকটা সময় একদৃষ্টিতে সুমনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর খুব আস্তে হাতটা বাড়িয়ে দেয় তার মাথার উপর। সুমনার চোখ বুজে আসে। যেন সেই হাতের বুলিয়ে দেওয়া ভালোবাসার ছোঁয়াতেই সমস্ত যন্ত্রণাকে পাশ কাটিয়ে ঘুম এসে পড়ে চোখের কোণে।রাজ ধীরে ধীরে উঠে, ফ্যানটা একটু কমিয়ে দেয়। মোবাইলটা নিঃশব্দ করে পাশে রাখে। তারপর আলো নিভিয়ে সেও পাশে শুয়ে পড়ে—চুপচাপ, নিঃশব্দ, যেন এই নীরব ভালোবাসাটুকুই এখন তার কাছে একমাত্র সম্বল।

জানালার ফাঁক গলে ঢুকছে রোদের কণা। ঘুম ভাঙে সুমনার। চোখ খুলে প্রথমেই ফোনটা হাতে নেয়।
মেসেজে দেখে বাবা টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। সুমনার চোখে জলের ধারা আসে আবার, তবে এবার সেটা যেন ধন্যবাদের, কৃতজ্ঞতার, হালকা হয়ে ওঠার চোখের জল।
সে পাশে তাকিয়ে বলে,
 “রাজ, আব্বু টাকা পাঠিয়েছে। আজকেই যাই ডাক্তারের কাছে।”

রাজ চোখ মেলে তাকায়, তারপর মাথা হেঁট করে ছোট্ট করে হাসে।

 “চলো। আজ যেন দেরি না হয়।”

দু’জনে একসাথে চুপচাপ বসে আছে সারি দেওয়া চেয়ারগুলোয়। রাজ ফোন হাতে সময় দেখে নিচ্ছে বারবার। চারপাশে সাদা অ্যাপ্রোন পরা মানুষ, অসুস্থের মুখ, কাশির শব্দ, বাচ্চার কান্না—সব মিলিয়ে চেম্বারটা জীবনেরই একটা ক্যানভাস। চেম্বার থেকে ডাক আসে—

দুজন একসঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। ভেতরে ঢুকে সুমনা চুপচাপ বসে পড়ে। রাজ পেছনে দাঁড়িয়ে। ডাক্তার চোখে চশমা টেনে সুমনাকে দেখে বলেন,

 “আপনি তো এখন মোটামুটি ঠিক আছেন। পেটের হালকা গ্যাস, কিছু হরমোনাল সমস্যা মনে হচ্ছে। আর বেবির, ওজন কিছুটা কম এসেছে। চিন্তা করবেন না। এখনো অনেক সময় আছে! আমি কিছু ওষুধ দিচ্ছি, আর কয়েকটা টেস্ট দিচ্ছি, কাল রিপোট দেখিয়ে নিবেন এসে। রোগী না আসলেও হবে। আবারো বলছি, চিন্তার কিছু নেই। খাবার নিয়মমতো খাবেন, পানি বেশি খাবেন। এই সময় কিন্তু খাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।” 

সুমনা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।রাজ পেছন থেকে বলে,
 “ডাক্তার, সিরিয়াস কিছু না তো?”

ডাক্তার হালকা হেসে বলেন,

 “না না, একদম না। তবে সাবধানে থাকবেন। টেনশন করবেন না। এই মুহুর্তে মা'কে যত ভালো রাখবেন, বাচ্চা ও তত ভালো থাকবে।”

চেম্বার থেকে বেরিয়ে রাজ সুমনার দিকে তাকিয়ে বলে,

 “চল, এখন বাসায় যাই। কাল আবার আসতে হবে।”

সুমনা কিছু বলে না। কেবল ধীরে ধীরে হাঁটে রাজের পাশে পাশে। তাদের মাঝে, অভাবে কিছুই নেই, তবু ভালোবাসাটুকু আছে—যা বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে সুমনা আর রাজ রিকশার খোঁজ করছে। দুপুরটা গড়িয়ে এসেছে। রোদ নরম হলেও শহরের ভিড়, কোলাহল, আর তপ্ত বাতাসে হাঁটাহাঁটি করতে করতে দুজনেই ক্লান্ত।
হঠাৎ একটা মোড়ের মাথায় চোখ যায় সুমনার—একটা ছোট্ট টং দোকান, প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিলে দু’চারজন বসে খাবার খাচ্ছে।সেই জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে, গন্ধে ভেসে আসছে এলাচ দারচিনি-মাংসের মাদকতা।কাচ্চি বিরিয়ানি!
সুমনা থেমে যায়। চোখ একটু বড় হয়ে আসে। মুখে শিশুর মতো এক দুষ্টু হাসি—

 “রাজ.ওটা দেখো! গন্ধ আসছে না? কত দিন হলো বিরিয়ানি খাইনি! আজ না হয় এক প্লেট খাই, কেমন?”

রাজ একটু থেমে যায়। মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে খুঁজে দেখে।

পকেট ফাঁকা। সকালেই বাবার পাঠানো পাঁচ হাজার টাকাটা প্রায় পুরোটাই শেষ হয়ে গেছে।ডাক্তার, টেস্ট, ফল—সব মিলিয়ে। রইলো শুধু একটা ভাঁজ করা পঞ্চাশ টাকা। রাজ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সুমনার হাসি তখনো ফুটে আছে মুখে। কিন্তু রাজ চোখ নিচু করে বলে,

“টাকা নাই, সুমনা। এই মুহূর্তে খাওয়ানোর মতো কিছুই নাই আমার হাতে।”

সুমনা প্রথমে যেন কিছু বুঝতে পারে না। তারপর হঠাৎ সেই হাসিটা মুছে যায় মুখ থেকে। রাগে পরিনত হয় চোখমুখ! 

“এইটুকু দিতে পারো না তুমি? আমি হাজার টাকার জিনিস চেয়েছি? না লাখ টাকার জিনিস চেয়েছি?”

রাজ মাথা নিচু করে বলে,

“ওটুকুও দিতে পারছি না, আমি সুমনা। আমার কাছে টাকা থাকলে আমি পৃথিবীর সবকিছু তোমার পায়ের কাছে এনে দিতাম! কিন্তু আমি অপারগ।”

“এত না পারলে, কিসের জন্য বিয়ে করলে তাহলে?”

সুমনার নরম কন্ঠ বদলে গিয়ে কেমন কর্কষ হয়ে উঠে! রাজ একটু চমকে যায়। মুখটা সাদা হয়ে যায়, চেনা সুমনাকে কেমন অচেনা লাগছে, এতোদিনের তুলনায়! সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর নিচু গলায় বলে,

 “ভালোবেসেছি, তাই বিয়েও করেছি। ”

 সুমনা, দাঁড়িয়ে হঠাৎই বলে উঠল,

“ভালোবেসে বিয়ে করেছো? খাওয়াতেও পারছো না! ভালোবাসলে মানুষ এমন করে? 

রাজ থেমে যায়, এবার তারও রাগ চড়ে যায়, মাথায়। মুখ শক্ত করে বলে,

“হ্যাঁ, ভালোবেসে বিয়ে করেছি। চেষ্টা করছি সব দিতে, কিন্তু সবসময় পারা যায় না। এটা বুঝতেও কষ্ট হয় তোমার?”

সুমনা যেন আরও ক্ষেপে যায়, মুখ ঘুরিয়ে তির্যক চোখে তাকায়,

 “খাওয়াতে পারো না, ঠিক আছে। তাহলে বাচ্চা কেন নিয়েছো? এত বড় দায়িত্ব নিতে চাওনি, তাহলে কেন বাচ্চা!”

রাজ চোখ বন্ধ করে ফেললো এক মুহূর্ত। যেন বুকের ভেতর তীব্র কিছু মোচড় দিচ্ছে। ধীরে ধীরে বলে,

 “বাচ্চা চলে এসেছে। আর বিশ্বাস করো, এই বাচ্চাটাই আছে বলেই আজও তুমি আছো, সংসারটা আছে।”

সুমনার মুখ কালো হয়ে গেলো। আগের মতনই রাগত স্বরে বলে,

“ তুমি জানো না? প্রেগন্যান্সিতে কত কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হয় একজন মেয়ের! কত পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়? সেখানে আমি ডাল ভাত, এসব খেয়ে যাচ্ছি! যা কখনো খাইও নি! বাপের বাড়িতে তো মাছ ছাড়া ভাতও খাইনি! যা ইচ্ছে আব্বু এনে দিতো! এদিকে আবার সংসারের কাজও করি! আবার বাচ্চার ওজনও কম এসেছে শুনেছো তো? কেনো কম এসেছে, বুঝেছো নিশ্চয়ই? অবশ্য এসবই কপাল আমার! অবশ্য, কপালটা গড়েছে কে জানো? তুমি! তুমি, রাজ! তোমার হাতেই লেখা আমার এই কপাল!”

 এক দমে কথাগুলো বললো সুমনা। রাগ যেনো, ভেতর থেকে তার সব কথা বলিয়ে দিচ্ছে! বড়বগ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে! রাজের এবার ধৈর্য্যর বাঁধ যেন ভেঙে গেলো!

“তাহলে যাও! যাও তোমার বাপের বাড়ি! ওখানে খেয়েদেয়ে থাকা যাবে নিশ্চিন্তে! মাছ মাংস, ভালো মন্দ খাবারে ডুবে থাকবে। ভালোভাবে খাবে। ভালো পড়বে, আমি পারছি না, এই অভাবের মধ্যে সব দিতে। এত কথা শুনাচ্ছো কেনো? জানতে না আমাকে? যাও তুমি! চলেই যাও, তোমার বাপের বাড়িতে! যেখানে ভালো থাকবে!” 

সুমনা স্তব্ধ হয়ে যায় এক মুহূর্ত। ভাবেনি রাজ এভাবে তাকে চলে যেতে বলবে। অভাবের ভেতরও সে রাজের ভালোবাসা আর যত্নের ভেতরই দিন পার করছিলো। আর রাজ এত শক্ত শক্ত কথা বললো? তাকে চলে যেতে বললো! যার জন্য সব ছেড়ে এসেছে, সেই মানুষটাই? আরেক ধাপ এগিয়ে দাঁড়িয়ে সোজা চোখে তাকিয়ে বলে,

“হ্যাঁ, যাব! একটুও কষ্ট করতে হবে না সেখানে—না আমাকে, না আমার বাচ্চাকে! বাচ্চা নিয়ে আমি কোনো কিছু সহ্য করতে পারবো না, মানে না! ওখানেই আমি ভালো থাকবো!” 

রাস্তার পাশে কয়েকজন লোক তাকিয়ে থাকে। চারপাশে কোলাহল, তবুও এই দু’জনের চারপাশটা এক অদৃশ্য আগুনে জ্বলছে। রাজ কিছু বলে না, মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সুমনা চোখ মুছে সোজা রাস্তার দিকে হাঁটা দেয়।
·
·
·
চলবে……………………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp