তুমি আমার বসন্ত - পর্ব ১৫ - আমেনা আক্তার আখি - ধারাবাহিক গল্প

          মুনায়া বেগমকে ডিসচার্জ করে সকালে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। তনু সেই থেকে মুনায়া বেগমের হাত ধরে রেখেছে, মেয়েটা এখনো হাত ছাড়েনি। একটু পরপর ফুপিয়ে উঠছে শুধু। তাবাসসুম এসেছে রান্নাঘরে, মুনায়া বেগমের জন্য খাবার বানাতে। তাবাসসুম স্যুপ বানিয়ে মুনায়া বেগমের ঘরে আসলো। তনু তখন ফোনে কথা বলছে। তোফায়েল সাহেব ফোন দিয়েছেন হয়ত। তাবাসসুম এগিয়ে গিয়ে মুনায়া বেগমের শিয়রে বসলো। তনু তখন মায়ের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলো। মুনায়া বেগম নাকোচ করলেন। তিনি ফোন ধরলেই এখন স্বামীর বকা শুনবেন। এই দুর্বল শরীরে তার আর ইচ্ছে হলো না, এত বকাঝকা আর শাষণ শোনার।

তনু বাবাকে বলে ফোন রাখল। তাবাসসুম মুনায়া বেগমের দিকে এক চামচ স্যুপ এগিয়ে দিলো। মুনায়া বেগম না চাইতেও চোখ-মুখ কুঁচকে মুখে নিলেন। 

মুনায়া বেগমকে খাওয়ানোর মাঝে কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। তাবাসসুম তনুর দিকে তাকালো। তনু মুনায়া বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার চেহারা কেমন নিষ্প্রভ হয়ে রয়েছে। তাবাসসুমের আর তনুকে উঠাতে ইচ্ছে হলোনা। নিজেই স্যুপের বাটি রেখে উঠে দাঁড়ালো। 

দরজা খুলতেই দেখলো রুশান দাঁড়িয়ে আছে। সেই যে কালকে মুনায়া বেগমকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিল। ওদের সাথেই সকালে ফিরেছে। তাবাসসুম হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় আসে, রুশান না থাকলে মুনায়া বেগমের কি অবস্থা হতো আজকে? তনু একা কি করতো? ভাবতেই ভিতরটা ধ্বক করে উঠে ওর। 

সারারাত জাগায় রুশানের মুখ কেমন গ্লান হয়ে আছে। ওই ক্লান্ত, নিবন্ত মুখের পানে তাকিয়ে তাবাসসুম বলে উঠল—

“আপনাকে রেস্ট নিতে বলেছিলাম?”

রুশান তাবাসসুমের মুখপানে তাকিয়ে থেকে বলল—

“আন্টির সাথে দেখা করতে এসেছিলাম একটু।”

তাবাসসুম রুশানের সামনে থেকে স্বরে দাঁড়ালো। রুশান ভিতরে ঢুকল। মুনায়া বেগমের রুমে আসলো একেবারে। মুনায়া বেগমের মাথার কাছে রাখা টুলে বসল। মৃদু স্বরে মুনায়া বেগমকে ডেকে জিজ্ঞেস করল—

“এখন কেমন লাগছে আন্টি?”

মুনায়া বেগম রুশানের পানে তাকিয়ে মৃদু হাসার চেষ্টায় বললেন—

“একটু ভালো লাগছে বাবা। আজকে তুমি না থাকলে!”

“এখন এসব কথা রাখুন আন্টি৷ একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন। চিন্তার কারণে আপনার এমন হয়েছে। এতসব চিন্তা না করে একটা জব্বর ঘুম দিন তো। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

মুনায়া বেগম হাসলেন। হাত বাড়িয়ে রুশানের মাথায় কাছে নিলেন। ইশারায় রুশানের মাথা নিচু করতে বললেন তিনি। রুশান মাথা নিচু করতে মুনায়া বেগম রুশানের মাথায় হাত রাখলেন। চোখের কোণে চিকচিক করতে থাকা পানি নিয়ে বললেন—

“তুমি অনেক বড় হও বাবা।”

পুনরায় বললেন—

“কাল থেকে তুমিও নাকি ঘুমাও নি? জেগে চোখ মুখের কি অবস্থা বানিয়েছো। ঘরে গিয়ে এখন একটু ঘুমিয়ে নাও বাবা।”

রুশান মাথা নাড়লো। মুনায়া বেগমের পানে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালো। চোখ ছোট ছোট করে বলল—

“আপনিও এখন ঘুমিয়ে নিন। আমি তনুর কাছে সবটাই শুনবো এখন থেকে।”

মুনায়া বেগম হাসলেন৷ তাবাসসুম সবটাই খেয়াল করলো। তার অদ্ভুত শান্তি লাগছে। তার মা-বোনের পাশে একটা ছায়া আছে তাহলে। এই লোকটা থাকতে তার মা-বোনের কোনো ক্ষতি হবেনা এতটুকু তাবাসসুম মানতে পারে। 

তাবাসসুম রুশানের পিছু পিছু আসলো৷ রুশান গেটের কাছে আসতে, তাবাসসুম কিছু বলতে নিতেই দেখল, শাফান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাবাসসুমের আর কিছু বলা হলোনা। রুশান চলে গেল। শাফান ভিতরে ঢুকতে তাবাসসুম দরজা আটকিয়ে দিল। শাফান কোনো কথা না বলেই মুনায়া বেগমের ঘরের দিকে গেল। তাবাসসুম গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ালো শাফানের পাশে। 

“এখন কেমন লাগছে মামী?”

মুনায়া বেগম চোখ খুলে শাফানকে দেখে হেসে বললেন—

“আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো লাগছে।”

“কিছু খেয়েছো? ঔষুধ খেতে হবে।”

মুনায়া বেগম মাথা নাড়লেন মৃদুভাবে। শাফান একবার তাবাসসুমের দিকে তাকালো। গাঢ় কন্ঠে বলল—

“পানি নিয়ে আয়।”

তাবাসসুম পানি নিয়ে আসতে, শাফান মুনায়া বেগমকে ঔষুধ খাইয়ে দিলো। অতঃপর বলল—

“এখন রেস্ট নাও। তোমার শরীর আর মস্তিষ্ক দুটোরই বিশ্রাম প্রয়োজন।”

মুনায়া বেগম এর ও কেমন চোখ লেগে আসছে। তবুও সে ঘুমন্ত ছোট মেয়ের পানে তাকিয়ে, মেয়ের মাথায় হাত রেখে তাবাসসুমের উদ্দেশ্যে বলরেন—

“ওকে ডেকে একটু খাইয়ে দিস তোফা। মেয়েটা রাত থেকে কিছুই খায়নি।”

“খাইয়ে দিবো মা। তুমি ঘুমাও এখন। চোখ বন্ধ করো।”

মুনায়া বেগম আর কথা বাড়ালেন না। চোখ বন্ধ করে নিলেন। তাবাসসুম বাইরে আসলো এবারে। শাফনও ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। তাবাসসুমকে বাইরে আসতে, শাফান তাবাসসুমকে মুনায়া বোগমের সব ঔষুধ বুঝিয়ে দিয়ে বলল—

“ঠিকভাবে খাওয়াতে পারবি তো?”

তাবাসসুম মাথা নাড়লো। শাফান এবার তাবাসসুমের মাথায় হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,

“চিন্তা করিস না। আন্টি ঠিক হয়ে যাবেন। আবার সেই আগের মতো।”

—————

তাবাসসুম দুপুরের খাবার রান্না করে ভাবলো রুশানকে দিয়ে আসবে। লোকটা রাত থেকে বোধহয় না খেয়ে রয়েছে। সকালেও তো কিছু খায়নি বোধহয়। তাবাসসুম মমতা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল—

“ফুফু, রুশান মানে উনিও তো বোধহয় কিছু খাননি। আমি কি উনাকে খাবার দিয়ে আসবো?”

মমতা বেগম মাছের ঝোল করছিলেন। রাতে মুনায়া বেগমের খবর শুনে উনার প্রেশার উঠে গিয়েছিল। তবুও রাতটুকু হাসপাতালে কোনোরকম পার করে, সকালে বাড়িতে এসে ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এখন একটু ভালো লাগায় তাবাসসুমের সাথে রান্নায় হাত লাগিয়েছেন।
সহসা তাবাসসুমের কথা শুনে তাবাসসুমের পানে তাকিয়ে বলল—

“ছেলেটা সেই রাত থেকে আমাদের জন্য কষ্ট করছে। এখন এতটুকুই কে করে বল? আমাদের জন্য না খেয়ে থাকবে? না! তুই বরং ওকে খাবার দিয়ে আয়।”

তাবাসসুম মাথা নাড়লো। একটা বাটিতে ভাত আর একটা বাটিতে তরকারি বেড়ে তাবাসসুম রওনা হলো দো তলার দিকে৷ দোতলায় এসে রুশানের ইউনিটের কলিং বেল চাপল। এবার গুনে গুনে তিনবার চাপল৷ রুশান দরজা খুলল না। হয়ত এখনো ঘুমিয়ে আছে। তাবাসসুম আবার কলিং বেল চাপল। এবার ক্ষাণিক বাদেই দরজা খুলে গেল। তাবাসসুম সম্মুখে তাকালো। সামনে তাকাতে দেখল রুশান উদাম শরীরে ঘুমুঘুমু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সহসা কোনো পুরুষকে এভাবে দেখে দুকদম পিছিয়ে গেল তাবাসসুম। লজ্জা পেয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিলো। রুশান ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল—

“কিছু বলবেন? আন্টির শরীর কেমন এখন?”

“মা ঘুমুচ্ছে।”

তাবাসসুম এবার রুশানের দিকে খাবারের বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল,

“খাবার। রাত থেকে তো বোধহয় না খেয়েই আছেন৷ ধরুন।”

রুশান কিছুক্ষণ সময় নিয়ে খাবারের বাটিটা ধরলো। তাবাসসুম এবার রুশানের পানে তাকালো। তবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না রুশানের সেই তীক্ষ্ণ দু জোড়া চোখের সামনে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জলে ভরে ওঠা চোখ নিয়ে বলল—

“ধন্যবাদ ঝগড়াটে। আজকে আপনি না থাকলে মা আর তনুর কি হতো আমি সত্যি কল্পনা করতে পারছি না।”

রুশান তাবাসসুমের অশ্রু ভিজে থাকা চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে বলল—

“যা ঘটেনি তা ভেবে কেন কষ্ট পাচ্ছেন তাহলে? সবসময় ভালোটা ভাবুন তাবাসসুম। খারাপ তো না ভাবলেও আমাদের কষ্ট দিবে।”

তাবাসসুম রুশানের পানে তাকালো। রুশার তাবাসসুমের চেহারা দেখে হেসে দিয়ে বলল—

“আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। খেয়ে বিশ্রাম নিন যান।”

রুশানের কথা শুনে তাবাসসুম চলে এলো। তনুকে ডেকে উঠিয়ে খাইয়ে দিলো। মুনায়া গভীর ঘুসে থাকায় ডাকলো না। ঘুম ভাঙলে নাহয় খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিবে। মমতা বেগম আর তাবাসসুম একসাথে খেতে বসলো। 

খাওয়া শেষ তাবাসসুম নিজের ঘরে আসলো৷ ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিলো, ঘুম আসতে চাইল। তবে তাবাসসুম চোখ বুজল না। মুনায়া বেগমকে ঔষুধ খাওয়াতো বাকি আছে। তাবাসসুম ফোনটা হাতে নিলো। বান্ধবীর দশবারের অধিক মিসড কল। শাফান ভাইয়ের মিসড কল। সবার নাম কেমন জ্বলজ্বল করছে। মায়ের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফোন করেছিলো হয়ত। কিন্তু কিন্তু, এইসব কলের মাঝে পনেরো মিনিচ আগে আসা মেসেজটার দিকে তাবাসসুমের চোখ পড়ল। সেই নাম্বার থেকে মেসেজ। তাবাসসুম ওপেন করে দেখলো তাতে লেখা—

“আর কখনো আমার সামনে চোখ ভেজাবে না বসন্ত কন্যা। আমার বুকের মধ্যিখানটায় অদ্ভুত তীব্র ব্যাথা হয়। আমার সামনে তোমার কান্নাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক তাহলে।”
·
·
·
চলবে……………………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp