অপরাহ্নের নিষিদ্ধ অনুভূতি - পর্ব ২৩ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          নব দিনের সূচনা। ঘড়িতে এখন আটটা বেজে পাঁচ মিনিট অথচ প্রকৃতি দেখে সেটা বোঝার সুযোগ নেই। আকাশে দখলদারিত্ব কেবল ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা কাদম্বিনীর। ঝরছে মুষলধারে বৃষ্টি। সাথে ঝড়ো হাওয়া তো আছেই। ঘোর তমসায় নিমজ্জিত চারপাশ। তন্ময়ী গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন। রাতে উদ্ভট কল্পনার সমাপ্তি কখন ঘটেছে, আর কখন যে মেয়েটা ঘুমিয়েছে তা জানা নেই ওর। ঘুমের মাঝেই অনুভব করল দুটো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওর দিকেই তাক করা। একটু নড়ে চড়ে উঠল। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ঘুম হালকা হয়ে এলো। সেকেন্ড পেরোতেই হঠাৎ আঁখি জোড়া মেলে তাকাল। ঘর জুড়ে দৃষ্টি ভেসে চলল। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। তাহলে ওটা কি মনের ভ্রম ছিল? নাকি স্বপ্ন দেখছিল? হতেও পারে!

ভাবনার মধ্যেই শব্দ তুলে ওয়াশ রুমের দরজাটা খুলে গেল। তন্ময়ী শুয়ে থেকেই ঘাড় বাঁকিয়ে সেদিকে তাকাল। তৎক্ষণাৎ অনুভব করল তীব্র ব্যথা। সবটা দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে নিলো। সদ্য স্নানিত একটা সুবিশাল উন্মুক্ত শরীর চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো। শরীরে জড়ানো কেবল একটা হাফ প্যান্ট। যা নাভির বেশ খানিকটা নিচে নেমেছে। দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো তময়ী। ঘুমের ভান ধরল। মটকা মেরে পড়েই রইল। রৌহিশের ডান হাতটা মাথার সিক্ত চুলগুলোতে চলমান। অধরপল্লব একপাশে প্রসারিত হলো। অগ্রসর হলো আলমিরার দিকে। প্রয়োজনীয় সবকিছু চলে গেল ওয়াশ রুমে। 

তন্ময়ী উঠে বসল। ডিভানে ঘুমানোর অভ্যাস না থাকায় ঘাড়টা ভীষণ ব্যথা হয়েছে। বাম পাশে ঘাড় ঘুরাতে নিলেই কটমট শব্দ শোনা গেল। অসহনীয় ব্যথায় চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণ থমকে সেভাবেই বসে রইল। অকস্মাৎ কেন যেন ভীষণ কান্না পাচ্ছে ওর। কিন্তু কারণ অজানা। ঘাড়টাতে আলতো হাতে কয়েকবার ম্যাসাজ করে ডিভানে মাথা এলিয়ে দিলো। বালিশটা বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরল। কিছুসময় পেরোতেই শ্রবণেন্দ্রিয়ে ভেসে এলো সেই দাম্ভিকতা মিশ্রিত গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বর,

"হাই, মিসেস রৌনক।"

তন্ময়ী চোখ খুলল তৎক্ষণাৎ। তাকাল কথাগুলো যেদিক থেকে ভেসে এসেছে সেদিকে। চোখের পর্দায় ভাসল ফর্মাল ব্ল্যাক আউটফিটে থাকা একটা সুদর্শন পুরুষ। যে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরিপাটি করতে ব্যস্ত। কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই তাকিয়ে রইল তন্ময়ী। বুঝল ভার্সিটিতে যাবে হয়তোবা। প্রত্যুত্তর করল,

"হ্যালো, আচ্ছা নিজের নামটা কি খুব পছন্দের আপনার?"

রৌহিশ শরীরে পারফিউম ব্যবহার করছিল। সেই অবস্থাতেই গ্লাসের ভেতর থেকে ওর দিকে তাকাল। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলল। তন্ময়ী নজর ফেরাল না। ওই দুর্বোধ্য নয়ন জোড়া ওর ভীষণ রকমের ভালো লেগেছে। অনড় চোখে তাকিয়ে রইল। রৌহিশ উত্তর দিলো না পাল্টা প্রশ্ন করল,

"হোয়াই?"

"এই যে সবসময় আমাকে মিসেস ডুবইস রৌনক ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন।"

"চোখে বেশি দেখা এবং কানে বেশি শোনা বন্ধ করো। হোয়াটএভার ঘুম কেমন হয়েছে?"

"ভীষণ ভালো।" দাঁত কিড়মিড় করে জবাব দিলো তন্ময়ী। এই মানুষটার সাথে কেন যেন কোনোভাবেই পেরে উঠছে না ও। ভালো কথা জিজ্ঞাসা করলেও সেই ত্যাড়া উত্তর দিবে। অসহ্যকর!

"তোমার সামনের রাউন্ড টেবিলে ব্রেকফাস্ট রাখা আছে। অ্যান্ড বেড সাইড বক্সের ড্রয়ারে পেইন কিলার আছে।"

প্রথম কথাটা স্বাভাবিকভাবে নিলেও শেষ কথাটা অস্বাভাবিক লাগল তন্ময়ীর কাছে। পেইন কিলার ও কী করবে? কপালে গুটি কয়েক ভাঁজের সৃষ্টি হলো। কোনোভাবে ওই ধুরন্ধর মানুষটা ঘাড় ব্যথার কথা জেনে গেছে নাকি? জিজ্ঞাসা করল,

"পেইন কিলার আমি কী করব?"

রৌহিশের হাতের কাজ শেষ। শেষবার নিজের আউটলুক দেখে বেড সাইড বক্সের উপর থেকে গাড়ির চাবির রিংটা হাতে তুলে নিলো। ঠাঁই মিলল তর্জনী আঙ্গুলে। দরজার দিকে হাঁটা ধরল। নিজের করা প্রশ্নের জবাব না পেয়ে তন্ময়ীর কপালের ভাঁজ বাড়ল। নেত্র যুগল ছোট ছোট হয়ে এসেছে। সেভাবেই রৌহিশের প্রতিটা কাজ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে এতক্ষণ। কথাটা তো বেশ জোরেই বলেছে। না শোনার চান্স নেই। তাহলে কি ইচ্ছে করে ইগনোর করছে? তা নয়তো কী! 

রৌহিশ দরজার দিকে এগিয়েই ওর পাশে পা জোড়া থামাল। প্যান্টের পকেটে দুহাত রেখে সটান হয়ে দাঁড়াল। ওষ্ঠপুটে খেলা করছে বাঁকা হাসি,

"কার কোনটার প্রয়োজন সেটা সে নিজেই বেটার জানে। বুদ্ধিমতি মেয়েদের সাথে বোকা ভাবটা ঠিক যায় না। ভার্সিটিতে দেখা হচ্ছে। টেক কেয়ার হার্ট।"

কথা শেষ করেই গটগট পায়ে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রৌহিশ। তন্ময়ী কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে চেয়ে থেকেই রাগে হিসহিসিয়ে উঠল। হস্ত জোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে ঠাঁয় বসে রইল। পরক্ষণেই টেবিলে থাকা খাবারটা ছুঁড়ে ফেলল নিচে। শোনা গেল প্লেট ভাঙার ঝনঝন আওয়াজ। খন্ড, খন্ড হয়ে ফ্লোরের একাংশ জুড়ে সবটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইল। এই মানুষটা সবসময় সবকিছু কীভাবে জেনে যায়? তন্ময়ী কখনো কোনোকিছু কেন লুকাতে পারে না? কে এই ডুবইস রৌহিশ রৌনক? আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো যে নয় সেটা অনেক আগেই বুঝেছে। কিন্তু পরিচয় কী? চুল খামচে ধরে কিছুসময় বসে থেকে ব্যালকনিতে চলে গেল। একটু সতেজ বাতাসের সংস্পর্শে যাওয়া প্রয়োজন। মনের তিক্ততা, বিষাক্ততা ওকে এক দন্ড ভালো থাকতে দিচ্ছে না। নির্মল হাওয়াতে সেটা যদি ঈষৎ কমে তাই বা কম কিসে? ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে নিজের বাসায় যাবে একবার। বৃষ্টিও ধরে এসেছে অনেকটা। সবাইকে ভীষণ মনে পড়ছে। ছোট্ট তন্ময়ের মিষ্টি কথাগুলো শোনার জন্য মনটা বড্ড ছটফট করছে। এই বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। জীবনটা এমন না হলেও পারত। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাবিজাবি আরও কতকিছু ভাবল। যার শেষে কেবল বুকচিরে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। অতঃপর ওয়াশ রুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।

—————

শেখ সাদমান, আরাধ্যা শেখ, তন্ময় নাস্তার টেবিলে বসেছে মাত্রই। শেখ সাদমানের নাইট শিফটে ডিউটি আছে আজ যার দরুন সারাটা দিন বাসাতেই কাটাবেন। ওনার মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বয়স যেন এক রাতেই দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ছাপ পড়েছে মুখাবয়ব জুড়ে। মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে একটা রাত দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছেন উনি। কী আশ্চর্য! এটাতো হওয়ারই ছিল। শুধু সময়টা এগিয়েছে এতটুকুই। আরাধ্যা শেখ নিজেও চুপচাপ হয়ে গেছেন। কথা কম বলছেন। ছোট্ট তন্ময়ের মনটা বেজায় ভার দেখাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে আপুকে সে খুব মিস করছে। ছোট পরিবারটা একজন মানুষের অনুপস্থিতিতে নুইয়ে পড়েছে একরাতেই। এখনো তো পড়ে রইল বাকি সারাটা জীবন। 

টেবিলে কেবল বসেছেই সকলে কিন্তু কারোর মুখে কোনো কথা নেই। নিজ নিজ ভাবনার জগতে বিরাজ করছে সবাই। আর না খাচ্ছে খাবার। এক পর্যায়ে আরাধ্যা শেখ নিজেকে সামলিয়ে নিলেন। বুঝলেন এভাবে চলতে দিলে এই সিচুয়েশন ওনারা কাটিয়ে উঠতে পারবেন না। মুখ ফুটে কিছু বলতে নিবেন তক্ষুনি ওনার ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। সোফার উপরে আছে ওটা। উঠে যেয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলেন। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে তন্ময়ীর নাম্বার। খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। ছলছল চোখে দ্রুত রিসিভ করলেন। শোনা গেল ওপাশ থেকে তন্ময়ীর গলা,

"আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি মা। তন্ময়কে নিচে পাঠিয়ে দাও। মনে পড়ছে ওকে খুব।"

"আর আমাদের মনে পড়ছে না?" পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লেন আরাধ্যা শেখ। এমন কথাতে ওপাশ থেকে কোনো শব্দ ভেসে এলো না। কেবল বড়ো একটা শ্বাসের শব্দ শোনা গেল পরপরই কলটাও কেটে গেল। আরাধ্যা শেখের চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ওখানেই বসে পড়লেন। শেখ সাদমান ওনার দিকে তাকাতেই খুব সহজেই ঘটনা যা বোঝার বুঝে গেলেন। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে অগ্রসর হলেন। পেছন থেকে শুনতে পেলেন আরাধ্যা শেখের ক্রন্দনরত গলা,

"কোথায় যাচ্ছ তুমি? মেয়ের সামনে কোন মুখে দাঁড়াবে?"

"যেই মুখে এতদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই মুখ নিয়েই দাঁড়াব।" থামলেন না শেখ সাদমান। চলন্ত পদ যুগলেই জবাব দিলেন অতঃপর কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেলেন।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে এখনো। তন্ময়ীর শরীরে রেইনকোট জড়ানো। বাসার সামনেই বাইক রেখে সেটাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একবার হাত ঘড়িতে নজর বোলাল। হাতে এখনো পঁচিশ মিনিট সময় আছে। আজ প্রথম ক্লাসটা রৌহিশের। তাই তো চাপ নিচ্ছে না। যাকে দুচোখে সহ্য করতে পারে না তার ক্লাস করাটাও এক প্রকার যুদ্ধ ওর কাছেই। কিন্তু আপাতত নিজের লক্ষ্যে স্থির ও। তাই তো পড়াশোনাটা ঠিকঠাকভাবে চালিয়ে যেতে চায়। এতদিনে, জীবনের এই পর্যায়ে এসে উপলব্ধি করতে পেরেছে একজন মানুষের নিজের বলতে শুধু সেই থাকে। আর কেউ না। সবাই কম-বেশি স্বার্থের জন্যই সঙ্গ দেয়। সে যেই হোক না কেন। কথাটা তেতো হলেও এটাই সত্যি। যা ওর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নিজের ভাবনাতে নিজেই তাচ্ছিল্য হাসল। 

আলগোছে নজর সামনে যেতেই মুখটা ম্লান হয়ে এলো। বাবা নামক মানুষটা একরাতেই নিজের কী হাল করেছে? সকল অভিমান একছুটে পালাতে চাইল। কিন্তু তা হতে দিলো না তন্ময়ী। এমনটা হলে যে ও কখনোই কিছু জানতে পারবে না। সবটা ওর অজানাই রয়ে যাবে। বাবাকে কোনো বিষয়ে এতোটা নির্লিপ্ত ও আজ অবধি দেখেনি। তাইতো বিষয়টা ভাবাচ্ছে খুব। ছলছল চোখে বাবার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। শেখ সাদমান পায়ে পায়ে হেঁটে এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল। হাসল অল্প করে, "আমার আম্মা, কেমন আছেন?"

ঘোর ভাঙল ওর। ফিরে এলো নিজস্ব স্বত্ত্বায়। মনগহীনে জেঁকে বসা অভিমান গুলো আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। থমথমে গলায় বলল, "ভালো থাকার জন্যই তো পর করে দিলে। তাহলে খারাপ থাকার সুযোগ কোথায়?"

মেয়ের এমন কাঠখোট্টা জবাবে শেখ সাদমানের মুখটা শুকিয়ে এলো। হারিয়ে গেল জোরপূর্বক ফুটিয়ে তোলা হাসি টুকু। কিছুক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অভিমানের মাত্রাটা বুঝতে চাইলেন‌। কতটুকু স্বার্থক হলো কে জানে? এগিয়ে এসে তন্ময়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, 

"আমি আছিতো আম্মা। আমার এই ছোট্ট জীবনটা আপনাকে ভালো রাখার জন্য ত্যাগ করতে চাই। নিজের ভুলগুলো শুধরাতে চাই। কোনো একজনকে দেওয়া নিজের কথা রাখতে চাই। আপনার থেকে সব কেড়ে নিয়ে আমি আপনাকে একটা সুন্দর জীবন দিতে চাই। সেই সুযোগটুকু করে দিন আমাকে।" 

তন্ময়ীর কী হলো কে জানে? জাপটে জড়িয়ে ধরল বাবাকে। সেভাবেই বুকের মাঝে লেপ্টে রইল। আকাশ ফুঁড়ে আবারও ঝমঝমিয়ে বর্ষণ নেমে এলো। ভিজিয়ে দিলো শেখ সাদামানের সর্বাঙ্গ। তন্ময়ীর শরীরে রেইন কোট থাকায় ও ভিজল না। কিয়ৎসময় বাবার বুকে মাথা রেখে চোখজোড়া বুজে রইল। এইতো এখন বুক জুড়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে চলেছে। শেখ সাদমান নিজেও দুহাতে মেয়েকে বুকের মাঝে মিশিয়ে নিলেন। বৃষ্টির পানির সাথে মিশে চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়া কয়েক ফোঁটা নোনা পানি ঝরে পড়ল গাল বেয়ে। টের পেলোনা কেউ। এমনকি তন্ময়ী নিজেও। ছোট্ট তন্ময়ের উপস্থিতিতে তন্ময়ী বাবার বুক থেকে মাথা তুলল। ছাতা হাতে ওদের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চাটা। তন্ময়ী ওকে অনেক আদর দিলো। ওর জন্য আনা চকলেটস, চিপস গুলো দিয়ে দিলো। অমনিই বাচ্চাটা খুশি হয়ে গেল। আপুর দুই গালে টপাটপ চুমু দিয়ে বাড়ির ভেতরে ছুটে গেল। মাকে দেখাবে আপু এত্ত কিছু দিয়েছে তাকে। তন্ময়ী আর দাঁড়াল না। বাইকে উঠে বসল। স্টার্ট দিতে নিয়েই বাবার দিকে একপলক তাকাল। ছোট্ট করে বলল,

"অভিমানের পাহাড় বাড়তে দিও না। হারিয়ে ফেলবে তোমার আম্মাকে। শরীর বেঁচে থাকলেও মনটা মরে যাবে বাবা।"

কথাটাতে কিছু তো একটা ছিল। শেখ সাদমানের বুকটা তীব্র যন্ত্রণায় চিনচিন করে উঠল। তবে খুশিও হলেন মেয়ে তাকে অন্ততপক্ষে বাবা বলে তো ডেকেছে। তন্ময়ী ততক্ষণে অনেকটা দূরে চলে গেছে। সেদিকে তাকিয়েই রইলেন। আওড়ালেন,

"আম্মা, আপনার আমৃত্যু ভালোর জন্য এতটুকু খারাপ হতেই পারে আপনার বাবা। শুধু আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। এভাবেই ভরসা রাখুন আমার উপরে।"

তন্ময়ীর বাইক চালানো অবস্থাতেই ফুঁপিয়ে উঠল। চোখ দিয়ে বারিধারা নামল। গড়িয়ে পড়ল স্বধারায়। বাবাকে এই অবস্থায় দেখে ওর একদমই ভালো লাগছে না। ওভাবে কথা বলতেও মন সায় দিচ্ছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে। হ্যাঁ, সত্যিই হচ্ছে তো। এই যে বুকের মাঝখানটাতে। কিন্তু ওই বা কী করবে? রহস্যের বেড়াজালে একেবারে মন মস্তিষ্ক পিষ্ট হয়ে গেছে। অথচ মুক্তির উপায় অজানা। এখন সেই উপায় ওর নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে।

—————

অন্ধকারের অতল গহ্বরে বুঁদ হয়ে চারপাশ। জায়গাটাতে আলো প্রবেশ করে না কয়েকশ বছর। হয়তোবা তারও বেশি। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ভ্যাপসা র ক্ত পঁচা গন্ধ। দুপাশে সারি সারি সুবিশাল ঘরের অস্তিত্ব দৃশ্যমান। একেকটা ঘর আলাদা আলাদা শব্দ গুচ্ছের সাহায্যে নামকরণ করা হয়েছে। ঘরগুলোর দরজার রঙ থেকে ডেকোরেশন সব আলাদা। নাক বরাবর চলে গেছে সোজা একটা গলি। গলির মুখেই আরও একটা ঘরের অস্তিত্ব। এটার ডেকোরেশন সবগুলোর থেকে ভিন্ন। একদম রাজকীয় ভাবে সজ্জিত ঘরটা। দরজার উপরে সাদা কালোর সংমিশ্রণে কিছু একটা লেখা আছে। ঘরের দরজাটা ওপাশ থেকে বন্ধ। বাইরের দিক থেকে ভেসে আসছে অনেকগুলো মানুষের আর্তনাদ। কী করুণ সেই আওয়াজ! একজন মানুষ কেবল নিজের সর্বস্ব হারিয়েই এভাবে কাঁদতে পারে, আর্তচিৎকার করতে পারে তার আগে নয়।

ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা রাজকীয় চেয়ার রাখা আছে। সেখানেই রাজকীয় ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে একজন যুবক। নারীর তাজা র ক্তে স্নানিত শরীর। শুভ্র রঙা শার্টটা ভিজে চুপচুপে।বাম হাতে একটা আধপোড়া ছবি এবং ডান হাতে আধপোড়া সিগারেট। যা দিয়ে কুন্ডুলি পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। ছবিটাতে কেবল কারোর দুটো নেত্র দেখা যাচ্ছে। হাতে আঁকা। ভীষণ যত্নে এঁকেছে রঙ, তুলির সাহায্যে। সেদিকেই নেশাতুর, অসহায় চোখে চেয়ে আছে যুবক। চোখদুটোতে বারকয়েক শব্দ করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। পরক্ষণেই নিজের কাজে নিজেই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সেই দানবীয় হাসির শব্দ কাপ ধরাল চারপাশে। থেমে গেল সব আর্তনাদ। একটা অদৃশ্য নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল আশেপাশের সবকিছু। যুবক হাসি থামিয়ে ছবিটার দিকে চেয়েই হিসহিসিয়ে আওড়াল,

"আমার আগুন সুন্দরী, ভালোবাসি। এই আমিটার থেকেও অনেক বেশি। এই পৃথিবীর সবকিছু একদিকে আর তুমি অন্যদিকে প্রিন্সেস। আমার এক জীবনের ভালোবাসা আমি পূর্ণ করতে এসেছি। ভালোবাসার অনলে দগ্ধ এই হৃদয় একমাত্র তোমার ভালোবাসার বর্ষণ দ্বারাই সিক্ত করা সম্ভব।"
·
·
·
চলবে...........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp