তাবাসসুম ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে বসার ঘরের দিকে আসলো। অনেক্ষণ ভেজা হয়েছে আজকে। সবটাই রুশান নামক পুরুষটার দোষ। এখন তার ঠান্ডা না লাগলে হয়েছে। মুনায়া বেগম এমনিতে তাকে বকার উপরে রেখে দিয়েছে। ঠান্ডা লাগলে তার লেভেল আরও উচ্চতায় যাবে।
নাক ডলতে ডলতে সে বসার ঘরে আসলে। দেখর সোফায় চোখ-মুখ গম্ভীর করে শাফান বসে রয়েছে। অবাক হলো তাবাসসুম। এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে শাফান ভাই কখন এলেন?
তাবাসসুম এগিয়ে গেল শাফানের দিকে। নিকটবর্তী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কখন এসেছেন শাফান ভাই?”
শাফান উত্তর করলো না। তার দৃষ্টি টিভির মাঝে। নিজেকে টিভিতে খুবই মনোযোগী দেখাতে চাচ্ছে সে। কিন্তু তাবাসসুম তা বুঝলো নাকি জানা নেই। সে আবার প্রশ্ন করলো,
“কখন এসেছেন? একাই এসেছেন?”
শাফান টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, তাবাসসুমের দিকে তাকালো এবার। ধমকের সুরে বলল,
“আমার সাথে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছিস? একা যখন দেখছিস, একাই এসেছি। এত প্রশ্ন করার কি আছে?”
তাবাসসুম মাথা নিচু করে নিলে। অকারণে শাফান ভাইয়ের এসব ধমকাধমকি কোনোকালেই তাবাসসুমের পছন্দের না। তেমনি আজও রাগ হলো। খারাপও লাগল। মুখ ভার করে বলল,
“কখন এসেছেন দেখেনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“সেটা দেখবি কিভাবে? আপনি তো ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে ব্যস্ত ছিলেন।”
তাবাসসুম মাথা নিচু করেই রাখলো। শাফান ভাই তাকে ভিজতে দেখেছে! সে যে শাফানের সাথে ভিজেছে সেটাও দেখেছে নিশ্চিয়। এখন আবার ধমকাধমকি শুরু হবে এনার। তাবাসসুম যা শোনার জন্য এখন মোটেও রাজি নয়। তাই রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। এখন এককাপ কড়া আদা চা না খেলে ঠান্ডা থেকে তার রেহাই নেই।
তাবাসসুম রান্নাঘরে এসে চুলোয় চায়ের পানি বসালো। পানি ফুটতে চাপাতি দিলো সেটাতে। তখন সহসা পাশে শাফানকে খেয়াল করল। বুকে হাত গুজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে এদিকপানেই।
“কিছু বলবেন শাফান ভাই?”
শাফান তাবাসসুমের মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল।
“আমার জন্য এককাপ চা করিস।”
“আচ্ছা।”
মিনিট দুয়েক পেরুলো, শাফান নড়চড় করলো না।একই যায়গায় একইভাবে দাঁড়িয়ে তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে রইল। তাবাসসুমের এবার অস্বস্তি হলো। এভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কেন শাফান ভাই? তার মুখে কি কিছু লেগে আছে? জিজ্ঞেস করবে শাফান ভাইকে? একবার ভাবল করবে। আবার ভাবল করবে না। মনের এই সিদ্ধান্তহীনতার মাঝে শাফান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
“তোকে বলেছিলাম তোহা। ওই ছেলেটার সাথে মিশবি না। কথা বলবি না।”
তাবাসসুমের এবার হঠাৎ ই খুব রাগ হলো। শাফান ভাই প্রায় সময় এই কথাটা নিয়ে পড়ে থাকেন। এতদিনে রুশানকে যতটুকু তাবাসসুম চিনেছে। রুশান মোটেও খারাপ ছেলে নয়। শাফান ভাইয়ের এত কিসের সমস্যা তাবাসসুম বুঝলো না।
তাবাসসুম শাফানের কথার বিপরীতে একটু রাগ নিয়ে জবাব দিলো।
“আমি এখন ছোট নেই শাফান ভাই। আমাকে এখন বলে দিতে হবেনা কার সাথে মিশবো আর কার সাথব মিশবো না।”
শাফান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তাবাসসুমের কথায় অবাক হলো। তাবাসসুম এভাবে কোনোসময় তার সাথে কথা বলেনা। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল শাফান। পরক্ষণেই চাপা ধমকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“খুব বড় হয়ে গেছিস তুই?”
“খুব বড় হয়েছি নাকি জানিনা। তবে ভালো খারাপটা অন্তত বুঝতে শিখেছি শাফান ভাই। আর রুশান মোটেও খারাপ লোক নয়।”
“খুব ভালো খারাপ শিখে গেছিস তুই? মুখে মুখে তর্ক করাও শিখে গেছিস? এই কয়েকদিনেই বুঝে গেছিস ওই ছেলে খারাপ নাকি ভালো?”
শাফানের শক্ত গলার কন্ঠের বিপরীতেও তাবাসসুম স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“হ্যা বুঝেছি।”
শাফানের শরীর রাগে কেঁপে উঠল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তাবাসসুমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। তাবাসসুম সেদিক পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিলো।
তাবাসসুম তখন চায়ের কাপে চা ঢালছে। তখন মুনায়া বেগম রান্নাঘরে আসলো। এসেই তিনি তাবাসসুমের পানে প্রশ্ন ছুড়লেন।
“শাফানের সাথে ঝগড়া করেছিস তুই?”
তাবাসসুম মুনায়া বেগমকে এতক্ষণ খেয়াল করেনি৷ গলার স্বর শুনে তাকালো মুনায়া বেগমের পানে৷ মুনায়া বেগম মেয়েকে পুনরায় একই প্রশ্ন করলেন।
তাবাসসুম বুঝে উঠতে পারলো না ঝগড়া কখন করলো সে? শাফান ভাই তো তাকে ধমকে ধমকে কথা বললো। তাবাসসুম চা ঢালা রেখে মায়ের পানে তাকিয়ে বলল,
“ঝগড়া করবো কেন মা?”
সঙ্গে সঙ্গে মুনায়া বেগম বলে উঠলেন,
“ছেলেটা রেগে চলে গেল কেন? শাফান অল্পতে রাগার ছেলে নয়। কি করেছিস?”
তাবাসসুম সত্যি বুঝলো না সে কি করেছে?যার জন্য রেগেমেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে। রুশানের সাথে মিশতে বারণ করেছে,সে শুধু বলেছে রুশান খারাপ ছেলে নয়। এতে রেগেমেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে? অদ্ভুত লোক।
তাবাসসুম রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে বলল,
“আমি দেখছি দাঁড়াও।”
তাবাসসুম ঘর থেকে নিজের ফোন এনে শাফানের ফোনে ডায়াল করলো। প্রথমবারে ধরলো না। দ্বিতীয়বারে, তৃতীয়বার কেটে দিলো। এভাবেই চললো কতক্ষণ। বার দশেক ফোন দেওয়ার পরও ধরলো না শাফান।
এদিকে মুনায়া বেগেম সোফায় বসে চিন্তা করছেন।
“ছেলেটার কোনো বিপদ হলোনা তো? রেগে বেড়িয়ে গেছে এমনিতেই।”
তাবাসসুম মায়ের পাশে গিয়ে বসে বলল,
“কিছু হয়নি মা। রাগ করে ফোন তুলছে না হয়তো।”
তাবাসসুমের কথা বলা শেষ হতে ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখলো শাফারের কল। তাবাসসুম মুনায়া বেগমের পানে তাকিয়ে বলল,
“তোমার শাফান বাবা ফোন দিয়েছেন। এবার চিন্তা বন্ধ করো। অসুস্থ হয়ে পড়বে তুমি।”
কথাগুলো বলেই ফোন রিসিভ করলো তাবাসসুম। কানে তুলে বলল,
“হ্যালো, শাফান ভাই। আপনি কোথায়?”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসলো না। তাবাসসুম ভ্রু কুঁচকে নিলো। পুনরায় বলল,
“কোথায় আপনি? শুনতে পাচ্ছেন শাফান ভাই?”
ওপাশ থেকে গম্ভীর আওয়াজ ভেসে আসলো এবার।
“কি জন্য ফোন দিয়েছিস?”
“আপনি রেগে বেড়িয়ে গেছেন কেন?”
“কেন গিয়েছি তুই জানিস না?”
তাবাসসুম সে কথার উত্তর দিলো। মূলত সে তর্ক করতে চাইছে না। তাই বলল,
“মা চিন্তা করছে শাফান ভাই। আপনি বাড়িতে আসুন। খেয়ে তারপর বাড়ি যাবেন।”
“সম্ভন না। আমি অনেকটা পথ চলে এসেছি। তুই মামীকে বুঝিয়ে বল।”
“পারবো না আমি। মা চিন্তা করছে আপনার জন্য। আসুন।”
“তুই চিন্তা করছিস না?”
তাবাসসুম সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
“করছি। এবার আসুন।”
শাফান আলতো হাসলো। বলল,
“আসছি। ফোন রাখ।”
তাবাসসুম ফোন রাখতে গিয়েও আবার কানে ধরল, শাফানকে কিছু বলতে বোধহয়। কিন্তু ফোন কানে ধরতেই অবাক হলো। অপরপ্রান্ত থেকে শাফানের স্বর এখনো ভেসে আসছে ক্ষীণভাবে। যেটুকু তাবাসসুম বুঝলো,
“তুই আমাকে সত্যি বুঝিস না নীলাঞ্জনা? আর কতকাল জ্বালাবি আমায়?”
তাবাসসুম কানে নীলাঞ্জনা নামটাই বেজে উঠল কেবল। নীলাঞ্জনা, শাফান ভাইয়ের হবু বউ? কিন্তু...!
·
·
·
চলবে……………………………………………………