চিত্রলেখার সংসার - পর্ব ০৩ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          চিত্রলেখা গরুর গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে মিঠাইপুরের মাটিতে পা দিতেই শরীর ছুঁয়ে গেল প্রশান্তির এক দমকা পবন। রাস্তার একপাশে ধানক্ষেত ঘেঁষে কিছুক্ষণ চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল ও। মাথার উপরে গাছের ছায়া। বেনামি হাওয়ায় ভেসে আসছে কিছু মিষ্টি সুগন্ধ। হয়তো আশপাশে কোথাও ফুলের গাছ আছে। বুকভরে শ্বাস নিলো মেয়েটা। বেশ ভালো লাগছে। 

প্রায় চারমাস পরে নিজ গ্রামে নিজের পদযুগল রেখেছে। কিন্তু বাড়ি অবধি যেতে মন চাইছে না। সকলের বিকৃত কথাবার্তা শুনতে মন সায় দিচ্ছে না একটুও। সবাই যখন জানবে টাকা নিতে এসেছে তখন তো ভাবী, মা হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিবে। কীভাবে সেইসব সামাল দিবে অসুস্থ আব্বাটা। ওদিকে ভাইজান তো এইসবে উদাসীন। চিত্রলেখার একবার মনে হলো এই জীবনের থেকে মৃত্যু শ্রেয়। পরক্ষণেই মন তীব্র বিরোধিতা করল‌। মোটেও না। ওর যে এখনো শহুরে বাবুর সাথে সুন্দর একটা সংসার করা বাকি আছে। ওকে সেইজন্য হলেও বাঁচতে হবে তো। দুঃখের দিন ঠিক ফুরিয়ে যাবে।

এখন দুপুরবেলা। সূর্যের অবস্থান ঠিক মাথা বরাবর। চিত্রলেখা আর দাঁড়াল না। এখান থেকে বিশটা মিনিট হাঁটলেই ওদের বাড়ি। বড়ো একটা শ্বাস ফেলে বাড়ির উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলো। একপর্যায়ে হাঁটতে হাঁটতে গাছের ছায়া শেষ হয়ে এলো। রাস্তার দুপাশের সুউচ্চ গাছগুলো ছেড়ে আসতেই সূর্যের তীব্র দাবদাহে শরীর জ্বলে উঠল। এখনো পাঁচ মিনিট মতো হাঁটতে হবে। নিকাবের একপাশ উঠিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলো। পরপরই দ্রুত পা চালাল বাড়ির দিকে।

বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে উচ্চস্বরে কথাবার্তার আওয়াজ। চিত্রলেখার একটু কৌতূহল জাগল মনে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সামনে। উঠানে পা রাখতেই দেখল পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই উপস্থিত বাড়িতে। আব্দুল সাত্তার, চিত্রলেখার আব্বা সূর্যের এই তীব্রতা দিব্যি সহ্য করে উঠানের একপাশে থম মেরে বসে আছেন। যেন এইসবে ওনার কোনো খেয়াল নেই। ঘটনা বুঝতে আর বাকি রইল না ওর। পর মুহূর্তেই ভাইজানকে রাম দা হাতে আব্বার দিকে ছুটে যেতে দেখেই চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে এলো। অথচ কেউ থামাচ্ছে না ভাইজানকে। সবাই ভয়ে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু মজা ঠিকই নিচ্ছে। এক সেকেন্ডের জন্য চিত্রলেখার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। পরক্ষণেই ছুটে গেল সেদিকে। ভাইয়ার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আব্বাকে আড়াল করে দাঁড়াল। চিল্লিয়ে উঠল,

"ভাইজান দোহায় লাগে থাইমা যান আপনে। এমনডা করবেন না। শান্ত হন একডুখানি।"

চিত্রলেখার কণ্ঠ শুনতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ওর ভাই চৈত্রিক। তাকাল নিজের বোনের দিকে। আঁখি জোড়ার হিংস্রতা মিইয়ে এলো খানিকটা। কিন্তু হাতের রাম দা ফেলল না। কোনো কথা ছাড়াই ওকে ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। চিত্রলেখা তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে যেয়ে দূরে পড়ল। ঘরের সামনে খোলা জায়গায় ইট দিয়ে একটুখানি উঁচু করা আছে। রাতের বেলা ওখানেই বসে একটু জিরোয় সকলে। দুর্ভাগ্যবশত ইটের সাথে কপালে আঘাত লেগে তৎক্ষণাৎ গলগলিয়ে র ক্ত বেরিয়ে এলো। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবারও ছুটে যেয়ে চৈত্রিকের পা দুটো জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল,

"ভাইজান মোর কসম আপনে থাইমা যান। ঘরে যাইয়া বসুন। মুই সবডা জাইনা আব্বারে বুঝাইমু। আপনে শান্ত হন।"

চৈত্রিক অধর নাড়িয়ে কিছু বলতে নিবে তক্ষুনি হায় হায় করতে করতে বাড়িতে প্রবেশ করলেন চিত্রলেখার সৎ মা কমলা বেগম। নামের সাথে মুখের আদলের ও ভীষণ মিল। পুরাই কমলা সুন্দরী। যদিও সেই রুপ এখন ক্ষয়ে এসেছে‌ সংসার নামক যুদ্ধে নিজেকে বলিদান করে। এতক্ষণ মাঠে ছিলেন। অন্যের জমিতে জন খাটছিলেন। একজন খবর দিতেই ছুটে এসেছেন। মানুষটা এগিয়ে এসেই স্বামীর কাছে ধপ করে বসে পড়ল। এখনো চিত্রলেখাকে খেয়াল করেননি উনি। কপাল চাপড়াতে শুরু করলেন,

"মিনসেরে কইছিলাম চলো মোর বাপের বাড়িত চইলা যাই। গেলা না। এ কেমন ছাওয়াল জন্মাইছ দেহ এহন। ছাত বেলা মাইরতে আসে তুমারে। একদিন এমনেই তুমার প্রাণডা যাইবো গা।" ওনার কান্নার বেগ বাড়ল। এতকিছুতেও আব্দুল সাত্তার পুরোপুরি নীরব। চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। মনের মাঝে কী চলছে বোঝা দুষ্কর। চিত্রলেখা তখনো চৈত্রিকের পা জড়িয়ে বসে আছে। চৈত্রিক ওর দিকে তাকাতেই ফের বলল,

"ভাইজান মোর কথাডা শুনেন। ঘরে যান আপনে।" 

এতক্ষণে একটু সাহস করে এগিয়ে আসলো অয়ন্তিকা। চৈত্রিকের পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে ডাকল, "ঘরে চলুন আপনে। আপনের মা আইছে ঝামেলা পাকাইবো‌। দেখছেন লাই ক্যামনে মরা কান্দন জুড়িছে‌।"

"একদম চুপ। ওই রাক্ষসী মহিলা আমার মা হতেই পারে না। সৎ মা কখনো আপন হয় না। ওই মহিলা আমার জীবনটা জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছে।" একটু থেমে চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, "সাথে আমার বোনের ও।" 

শেষের কথাটা আস্তে বলায় কারোর কান অবধি পৌঁছাল না। হঠাৎ এমন পশুর মতো গর্জনে ভয় পেয়ে ছিটকে কয়েক হাত দূরে সরে গেল অয়ন্তিকা। কয়েক মিনিট সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে কাঁপা কাঁপা পায়ে ওখান থেকে কেটে পড়ল। পাছে যদি ওকে মেরে বসে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম।নিজের মুখের কথা শেষ করে পাশেই শব্দ করে রাম দা টা ছুঁড়ে ফেলে চিত্রলেখার থেকে নিজের পা জোড়া ছাড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল চৈত্রিক। যাওয়ার আগে অবশ্য হুংকার ছুঁড়ে সবাইকে বাড়ি ফাঁকা করে দিতে বলেছে। ও যেতেই সবাই আস্তে ধীরে বাড়ির আঙ্গিনা থেকে সরে পড়ল। রয়ে গেল হাতেগোনা কয়েকজন। 

চিত্রলেখা ভাইজানের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। ওর শান্তশিষ্ট ভদ্র ভাইজান কত্ত পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওর আগের ভাইজানকে খুব মনে পড়ে। যে সবসময় বইয়ের মাঝে ডুবে থাকত। বাবা, মায়ের বড়ো নেওটা ছিল। মায়ের মৃত্যু, বাবার একটা ভুল সিদ্ধান্ত সব লন্ডভন্ড করে দিলো। সুন্দর একটা সংসার জাহান্নামে পরিণত হলো। হাহ্!

এতক্ষণে চিত্রলেখাকে দেখতেই কমলা বেগম এর রাগ কয়েক গুন বাড়ল। এই কপালপুড়ি আবার নিশ্চয় টাকা নিতে এসেছে। কমলা বেগমের ধারণা ওনার সুন্দর জীবনটা জাহান্নাম বানিয়েছে চিত্রলেখা। চৈত্রিককে বিগড়ে দিয়েছে মেয়েটা নিজেই। মা মরা বোন বলতে পাগল ছিল তো ছেলেটা। আগেপিছে না ভেবে মানুষ জন না মেনে ছুঁড়ে দিলেন কিছু তিক্ত বাণ। মায়ের আওড়ানো কঠিন বাক্য কর্ণগোচর হতেই চিত্রলেখা ভাবনা চ্যুত হলো। কেবল শুনল সবটা। পাল্টা একটা শব্দ উচ্চারণ করে প্রতিবাদ করল না।

"এই কপালপুড়ি এইহানে আইছে কির লাইগা? আমার জীবনডা নস্ট কইরাও তুর সান্তি হয় লাই? নিশ্চয় টেকা লইতে আইছছ। টেকা কী গাছে ধরে?"

মেয়ের সম্পর্কে এমন কটুকথা শুনতে নারাজ আব্দুল সাত্তার। এই পর্যায়ে ধমকে উঠলেন কমলা বেগমকে, "আহ্! থাইমা যাও। মোর মাইয়া মুই দেইখ্যা লমু। তুমি নিজ কাজে মন দাও গিয়ে‌। মোর মাইয়ারে নিয়ে ভাবা লাগব না।" পরপরই চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে মুখে মিছে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন, "আম্মা তুমি ঘরে যাও দেখি। একডু জিরিয়ে লও। মুই পানি বাতাসা জোগাড় করতাছি।"

স্বামীর এমন কথা শুনতেই খেকিয়ে উঠলেন কমলা বেগম, "হয় পারো তো কেবল মোর লগে চিল্লাইতে। পানি বাতাসা কী ওই মা গি র ঝি শউর বাড়িত থেইক্যা লইয়া আইছে? মোর টেকা দিয়া কেনা ওইসব জুটব না উর কপালে।"

আব্দুল সাত্তার এই পর্যায়ে রক্তচক্ষু দিয়ে তাকালেন কমলা বেগমের দিকে। পাশে পড়ে থাকা রাম দা টা ইশারায় দেখিয়ে হিসহিসিয়ে উঠলেন, "এই রাম দা দিয়া তুমার শরীল থেইক্যা গলাডা দুই ভাগ কইরা দিমু মুই। মুখডা সামলাও। ও মোর মাইয়া। ওরে মুই খাওয়ামু। দূর হও সামনে থেইক্যা।"

কথায় কথা বাড়ে। তার উপর চিত্রলেখার শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে আসছে। মাথা যন্ত্রণায় দুচোখ ঝাঁপসা হয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। ছোট্ট করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল, " মোর খাওন লাগবে না মা। আপনে আব্বার লগে ঝামেলা পাকাইয়েন না। রাইত টা থাইকা কাইল চইলা যামু।"

কথাটা বলেই রান্নাঘরের পাশের নিজের জন্য নির্ধারিত একটা ছাপড়া দেওয়া ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। কমলা বেগম আরও কিছু বলতে নিচ্ছিলেন কিন্তু স্বামীর ভয়ংকর দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারলেন না। মুখ ঝামটা দিয়ে নিজ কাজে চলে গেলেন। ওনার পিছু পিছু দুই মেয়ে ছুটল। আস্তে ধীরে বাড়িটাও ফাঁকা হয়ে এলো। আব্দুল সাত্তার মাটিতে বসেই রইলেন। আলগোছে চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। বুক চিরে বেরিয়ে এলো পাঁজর কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস। আহ্ জীবন! ছোট্ট একটা জীবনে কতই না রঙ্গ তামাশা! আর দারিদ্র্যতা তা যেন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

••••••••••

একচালা করে কোনোরকমে ক্ষয়ে যাওয়া পুরোনো জং ধরা টিন এঁটে রাখা। চারপাশে পাটকাঠির বেড়া। টিনের একটা দরজা আর পাটকাঠির বেড়া কেটে একটা জানালা করা আছে। যার পাল্লটা আবার টিনের। ঘরের ভেতরে আসবাবপত্র বলতে ওই একটা আধভাঙা চৌকিই আছে। চিত্রলেখা দুপুরে ঘরে প্রবেশ করতেই দেখল ভেতরের অবস্থা ভীষণ শোচনীয়। বোঝা যাচ্ছে ও না থাকায় বিগত মাসগুলোতে কেউ এই ঘরে পা রাখেনি। চারপাশে নোংরা সাথে মাকড়সার জাল তো আছেই। একদণ্ড বিশ্রাম না নিয়ে নিজেই ঘন্টা খানেক সময় ধরে সবটা পরিষ্কার করেছে। তারপর পুকুরে যেয়ে গোসল দিয়ে ভাবীর কাছে থেকে একটা বালিশ চেয়ে এনেছে। ভাবী মুখটা কালো করলেও দিয়েছে। তারপর একেবারে বিশ্রাম নিয়েছে মেয়েটা। আব্বা এসেছিল খাবার হাতে নিয়ে কিন্তু তা চিত্রলেখার গলা দিয়ে নামেনি। দুই, তিন লোকমা মুখে দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। এতে আব্বা নামক মানুষটা যে খুব কষ্ট পেয়েছে সেটা চিত্রলেখা জানে। কিন্তু ও নিজেও তো অপারগ। ভাত গলা দিয়ে না নামলে কীভাবে খাবে? সারাদিন না খাওয়ার দরুন বিকেলের দিকে শরীর আরও বেশি খারাপ লাগছিল। জ্বর বেড়েছিল। ভাগ্য ভালো শাশুড়ি দুইটা ঔষধ দিয়েছিল সঙ্গে। সেগুলো খেয়ে শরীর একটু ভালো লাগছে এখন। 

বিছানার একপাশে জানালা ঘেঁষে বসে আছে চিত্রলেখা। জোৎস্না বিলাসে মগ্ন। জানালার ফাঁকা গলিয়ে প্রবেশ করছে ঝিরিঝিরি মারুত। জুড়িয়ে দিচ্ছে ক্লান্ত চিত্ত, কায়া। সুবিশাল অম্বরে লক্ষ্য লক্ষ্য নক্ষত্রের মেলা। তার মধ্যিখানে বসে আছে সুন্দরী গোল চন্দ্রমা। দিব্যি নিজের নজরকাড়া রুপ প্রদর্শন করে চলেছে প্রকৃতির বুকে। জানালার পিছনের উঠান পেরিয়ে দৃশ্যমান ধানক্ষেত গুলো মৃদু সোনালী আলোয় ঝলমল করছে। মাঝেমধ্যে বেনামি হাওয়ায় নৃত্য করছে লম্বা ধানের শীষ গুলো। কী মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! এ যেন এক রুপকথার রাজ্য। চিত্রলেখার মুগ্ধ দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ। এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে বসেছে নিজের জীবনের সকল যাতনা। ইস! জীবনটা যদি রুপকথার গল্পের মতো সুন্দর হতো! 

"নায়িকা চিত্রলেখা?"

সুমিষ্ট ভাবনার মাঝেই ভাইজানের কণ্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই চিত্রলেখা চমকে পাশে ফিরল। একটা প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে চৈত্রিক। ভাইজানকে দেখতেই চিত্রলেখার মুখে হাসি ফুটে উঠল। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, "কও ভাইজান।"

"কেমন আছিস? তখন খুব বেশি ব্যথা পেয়েছিস?"

বহু বছর পরে ভাইজানের মুখ থেকে সেই চিরচেনা সম্বোধন সাথে এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনতেই চিত্রলেখার বুকটা কেঁপে উঠল। ভাইজান ওকে ভালোবেসে নায়িকা ডাকত। ওনার চোখে চিত্রলেখা নাকি এতটাই সুন্দর। ছোট্ট বেলায় এই নিয়ে চিত্রলেখা হেসে কুটিকুটি হতো। পানিতে টলমল করছে ওর নেত্র যুগল। ম্লান হাসল, "উঁহু, লাগে লাই। মুই ভালা আছি ভাইজান।"

চৈত্রিকের হঠাৎ কী হলো কে জানে! দুই পা এগিয়ে এসে অনেকগুলো বছর পর চিত্রলেখার মাথায় স্নেহের হাত রাখল, 

"সবসময় ভালো থাকিস নায়িকা। এইখানে খাবার আর মলম আছে। রাতে খেয়ে কপালে লাগিয়ে নিস।" অতঃপর চিত্রলেখাকে একটা শব্দ উচ্চারণের সুযোগ দেওয়া হলো না। খাবারের প্যাকেট টা বিছানায় রেখে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল চৈত্রিক। মনে হলো এক প্রকার পালিয়ে গেল ছেলেটা। কিন্তু কার থেকে পালাল? চিত্রলেখার থেকে? মেয়েটা ছলছল নয়নে সেদিকে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই ভাইজানের ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পেরেই প্রাণবন্ত হাসল। সুন্দরীতমা শশীর দিকে তাকিয়ে বলল, 

"আমারে দেইখ্যা আবার হিংসে করিস না। ভাইজান মোরে এখনো আগ্গের মতোনই ভালাবাসে। কেবল প্রকাশ করবার পারে না।"

খিলখিলিয়ে হেসে উঠে ভাইজানের আনা প্যাকেটটা খুলল। দৃশ্যমান হলো খিচুড়ি আর ডিম ভাজি। চিত্রলেখার ভীষণ পছন্দের খাবার। আনন্দ কয়েক গুণ বাড়ল ওর। ভাইজান ওর পছন্দের খাবার ও মনে রেখেছে। খুশির পানি গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। কাঁদতে কাঁদতেই পরম তৃপ্তির সাথে সবটা খেল মেয়েটা। কপালে মলম ও লাগাল। চিত্রলেখারা যে এমনই। যৎসামান্য ভালোবাসা পেলেই তারা নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হিসেবে দাবী করে। অথচ সেই সামান্য ভালোবাসাটুকুই যেন ওদের ভাগ্যে থাকে না।রাতটাই কিয়ৎসময়ের জন্য ঘরের মধ্যিখানে বসন্ত উঁকি দিলো যেন। 

••••••••••

হাতের সবকাজ শেষ করে নিজ ঘরে বিছানায় বসে আব্বার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে চিত্রলেখা। ও জানে মা ঘুমিয়ে গেলে আব্বা ঠিক আসবে। হলোও তাই। ওকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। চোরের মতো ঘরে প্রবেশ করলেন আব্দুল সাত্তার। মেয়ের পাশটাই বসে স্নেহে মোড়ানো কণ্ঠে ডাকলেন, "আম্মা, তুমার শরীলডা এহন ভালা আছেনি?"

চিত্রলেখা আব্বাকে দেখতেই ওনার হাঁটুতে মাথা রেখে শুয়েছে ইতোমধ্যে। সেভাবেই জবাব দিলো, "খুব ভালা আছি আব্বা।"

মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আব্দুল সাত্তার। শান্তিতে চোখজোড়া বুজে নিলো চিত্রলেখা। কতগুলো মাস এমন প্রশান্তি অনুভব করেনি মেয়েটা। পরক্ষণেই ভাবুক হলো। দোটানায় পড়ে গেল ও। আব্বাকে টাকার কথা বলবে নাকি বলবে না। একটা দিনেই বুঝেছে সংসারের অবস্থা ভালো না। টানাপোড়েন বেড়েছে। ওদিকে ওর শখের পুরুষ। এই বিষাক্ত দোটানা মস্তিষ্ক খুবলে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর। মেয়ের অবস্থাটা বাবা নামক মানুষটা খুব করে বুঝলেন। জানতে চাইলেন, "তুমার বাড়ির কর্ত্রী এইবার কয় টেকা চাইয়াছে আম্মা?"

চিত্রলেখা বন্ধ নয়ন জোড়া মেলে তাকাল। কিছুসময় আব্বার কুঁচকে যাওয়া মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই কয় মাসে বয়সের ছাপ পড়ে গেছে আব্বা নামক বটবৃক্ষের মুখমণ্ডলে। দিন ও বুঝি এভাবেই ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। মুহুর্তেই চিত্রলেখার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। গলায় কান্নারা দলা পাকিয়ে আসলো। তবুও নিজেকে সামলিয়ে আস্তে করে বলল, "দুইডা হাজার টেকা আব্বা। জোর লাই। না পারিলে দেওন লাগব না। মুই ঘুইরা কাইলকে চইলা যামু।" 

মেয়ের কথাতে আব্দুল সাত্তারের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে এলো। পর মুহূর্তেই নিজেকে ঠিকঠাক রাখার প্রয়াস চালালেন। মেয়েকে নিজের অসহায়ত্ব, দূর্বলতা বুঝতে দিতে চাইলেন না। আশ্বস্ত করলেন, "আইচ্ছা মুই চেইষ্টা করমু। জোগাড় হইলে কাইলকে দুপুর নাগাদ পাইয়া যাবা। এমনেও তুমার বিয়ের যৌতুকের টেকাডা এহনো পরিশোধ করবার পারি লাই। যাইহোক এহন ঘুমাও দেহি। অনেক রাইত হইয়াছে। তুমার শরীলডাও ভালা না।"

"আইচ্ছা আব্বা। শুনো তো তখন ভাইজান তুমারে মাইরতে নিছিল ক্যান?" 

"আরে তেমন কিছুনা আম্মা। তুমার মায়ের লগে ওর ঝামেলার শেষ লাই। বাদ দাও তুমার ভাইজানের কথা। উর রাগ কমিলে আবার আগের মতোই হইয়া যাইবো গা। তুমি থাইকো মুই যাই।"

উঠে চলে গেলেন আব্দুল সাত্তার। চিত্রলেখার চোখে ঘুম ধরা দিলো না। দুহাতের সাহায্যে বালিশে ভর দিয়ে উপুড় হয়ে শুলো। দৃষ্টি যেয়ে উঠানে থামল। দেখল বাবা উঠানে পায়চারি করছে। বুঝে গেল বাবার এই অস্থিরতার কারণ। একটু পরেই ওখানে ভাইজানকে আসতে দেখে একটু অবাক হলো বৈকি! চৈত্রিক আর আব্দুল সাত্তার ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কী সব আলোচনা করল। আলোচনা শেষ হতেই ছেলের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে ঘরে চলে গেলেন আব্দুল সাত্তার। চৈত্রিক এমনই হয়ে গেছে এখন। রাগলে পশুতে পরিণত হয়ে যায়। কী বলছে, কী করছে হুশ থাকে না। রাগ কমলে পরবর্তীতে আবার ও নিজ রুপে ফিরে আসে। চৈত্রিক, চিত্রলেখার ঘরের জানালার দিকে এক নজর তাকাতেই ভাই বোনের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলল। চিত্রলেখা মুচকি হাসলেও অপরপক্ষ নির্লিপ্ত। ঘরে চলে গেল চৈত্রিক। 

নিঃসঙ্গ চিত্রলেখার আবারও হঠাৎ বুক ভার হলো। ভীষণ মনে পড়ছে শহুরে বাবুকে। উনি যদি ফিরে এসে একটাবার সবটা ঠিক করে দিতেন। নিজের দেওয়া কথাটা রাখতেন। সবাইকে বলতেন এইসব টাকা, টাকা খেলা বন্ধ করো তোমরা। কেন যেন আজ ভাগ্যের উপর ভীষণ হাসি পাচ্ছে চিত্রলেখার। কিন্তু কেন? আব্বার অসহায়ত্ব দেখে? নাকি নিজের অসহায়ত্ব অনুভব করে? জলে পরিপূর্ণ আঁখি যুগল নিয়ে মনগহীন থেকে গুনগুনিয়ে সুর তুলল,

আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা
ভাঙা বেড়ার ফাঁকে 
অবাক জোৎস্না ঢুইকা পড়ে
হাত বাড়াইয়া ডাকে
হাত ইশারায় ডাকে 
কিন্তু মুখে বলে না 
আমার কাছে আইলে বন্ধু 
আমারে পাইবা না।
·
·
·
চলবে………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp