প্রতিদিনের মতো গতকাল সন্ধ্যার আবছা আলোয় জাওয়াদ অরিজিতের পিছনে পিছনে বাঁশতলা রোডের দিকে রওনা হয়। সেখানে পৌঁছেই সে একটি পুরোনো দোকানের পেছনে লুকিয়ে পড়ে। যেখান থেকে হলুদ রঙের বিল্ডিংটা পরিষ্কার দেখা যেত। অরিজিত নিয়মিত এই বিল্ডিংটিতে আসে, কিন্তু কেন আসে? সেটাই ছিল জাওয়াদের কাছে রহস্য।
অরিজিত ভেতরে ঢোকার প্রায় পনেরো মিনিট পর চোখ পড়ে মূল ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসা এক ব্যক্তির দিকে। প্রথম মুহূর্তে সে চিনতে পারে না। হাঁটু পর্যন্ত নেমে আসা লম্বা ওভারকোট, ছোট করে কাটা চুল, মুখ শুকনো...ধারালো, সম্পূর্ণ চেহারাটাই ছিল নতুনত্বে ভরপুর, যেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের পরিচয় লুকানোর চেষ্টা করছে। কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতেই তার মনে বিদ্যুৎ চমকের মতো আঘাত লাগে, এ তো গুলনূর!
সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরে প্রচণ্ড মানসিক তুফান শুরু হয়। সে দেয়ালে হাত রেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। গুলনূর এখানে কেন? অরিজিতের সাথে তার সম্পর্কই বা কী? এই ছদ্মবেশে কোথায় যাচ্ছে?
এর মধ্যেই, গুলনূর ও অরিজিত গাড়িতে উঠে বসে, যার ভেতরে আগে থেকেই বসে আছে নওয়াজ বাহাদুর। জাওয়াদের চোখ সংকুচিত হয়ে আসে।
এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে সে দৌড়ানো শুরু করে। তার হৃদস্পন্দন এত দ্রুত ছুটছে যে মনে হচ্ছে বুক থেকে বেরিয়ে আসবে। বাঁশতলা রোডের শেষ প্রান্তে পৌঁছে সে তার নিজের গাড়িতে উঠে বসে এবং সাবধানতার সাথে গুলনূরদের গাড়ির পিছু নিতে শুরু করে।
পিছু নেওয়ার পথটি তার নিকট দীর্ঘ... জটিল রূপে ধরা দেয়। গুলনূরদের গাড়ি বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে এগিয়ে চলছিল। কখনো প্রধান সড়ক দিয়ে, কখনো সরু গলি দিয়ে। জাওয়াদ সাবধানে দূরত্ব বজায় রেখে তাদের অনুসরণ করতে থাকে, যাতে ধরা না পড়ে। প্রায় এক ঘণ্টা পর তাদের গাড়ি ব্লুমুন ক্লাবের সামনে এসে থামে। গুলনূর ও নওয়াজ বাহাদুর ছদ্মবেশে ক্লাবের মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
জাওয়াদ ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু দারোয়ান তাকে জানিয়ে দেয়, ক্লাবের সদস্য না হলে প্রবেশাধিকার নেই। জাওয়াদের মনে তীব্র হতাশা ও অস্থিরতা দেখা দেয়। যে করেই হোক তাকে ভেতরে যেতে হবে। সে ক্লাবের বিশাল কাঠামোর চারপাশে ঘুরে ঘুরে বিকল্প প্রবেশপথ খোঁজতে থাকে। আধো অন্ধকারের মধ্যে সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে চলে। ক্লাবের পেছনের অংশে পৌঁছে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি গ্যারেজ।
গ্যারেজের ভেতর প্রবেশ করে কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখতে পায় একটি অর্ধ-খোলা দরজা। সেখানে একজন দারোয়ান একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার হাতে জ্বলন্ত একটি সিগারেট, মুখ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে।
জাওয়াদ পকেট থেকে কয়েকটি নোট বের করে দারোয়ানের দিকে এগিয়ে যায়। সে বিনম্র কণ্ঠে গল্প বানিয়ে বলে, ভেতরে তার এক বন্ধু আছে, যার সাথে জরুরি দেখা করতে হবে। কিন্তু প্রধান ফটকের নিয়মকানুনের কারণে প্রবেশ করতে পারছে না। দারোয়ান প্রথমে সন্দেহের চোখে তাকায় এবং মাথা নাড়িয়ে অস্বীকার করে। কিন্তু যখন জাওয়াদ তার হাতে কিছু অতিরিক্ত নোট তুলে দেয়, তখন তার চোখে লোভের আগুন জ্বলে ওঠে। কিছুক্ষণ ভেবে-চিন্তে অবশেষে রাজি হয়। সে একটি শর্তসাপেক্ষ সম্মতি দেয় যে, যদি কোনো সমস্যা হয় তবে সে কিছুই জানে না।
গ্যারেজ থেকে একটি প্রশস্ত হলরুমে প্রবেশ করে জাওয়াদ। চারপাশে নিঃশব্দতা, শুধু দূরে কোথাও হালকা সঙ্গীতের আওয়াজ ভেসে আসছে। সে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে হলরুম পেরিয়ে একটি দীর্ঘ করিডোরে প্রবেশ করে।
হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ে পাশের আরেকটি করিডোর দিয়ে গুলনূর দ্রুত পায়ে দৌড়াচ্ছে, ঠিক যেদিক দিয়ে সে এসেছে — হলরুমের দিকে। তার চলার ভঙ্গিতে তাড়াহুড়ো। জাওয়াদের হৃদয় এক লহমায় দ্রুততর হয়ে ওঠে। সে নিঃশব্দে গুলনূরের পিছু নেয়। হলরুমের কাছে পৌঁছে যা দেখে, তাতে তার সমস্ত বিশ্বাস ও ধারণা আরও একবার চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। যে দারোয়ান তাকে সাহায্য করেছিল, এখন মেঝেতে পড়ে আছে নিথর দেহ নিয়ে। আর গুলনূরের চোখেমুখে রক্তের ছিটে, হাতে রক্তমাখা ছুরি।
জাওয়াদের হৃদয়ে অনিয়ন্ত্রিত কাঁপুনি শুরু হয়। যেন পুরো পৃথিবী তার পায়ের নিচে থেকে সরে যাচ্ছে। যে মানুষটিকে সে এতদিন চিনেছে, বিশ্বাস করেছে - সে কেবল একজন প্রতারকই নয়...সে একজন খুনিও!
—————
রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে গাড়িটি এগিয়ে চলছে দুই ঘণ্টা ধরে। হেডলাইটের আলোকরশ্মি অন্ধকারে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে গাড়িটি থামে। সামনে একটি অর্ধনির্মিত দোতলা বাড়ি। গাড়ির আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এর বিষণ্ণ রূপ। বছরের পর বছর ধরে অসমাপ্ত হয়ে আছে এই স্থাপনাটি। উপরের তলার কাজ অর্ধেক সম্পন্ন হয়েই থমকে গিয়েছে। দেয়ালগুলো অনুচ্চ, আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ছাদহীন অবস্থায়। প্রকৃতির রুদ্র আঘাতে ইটের গায়ে শৈবালের সবুজ দাগ, বর্ষার জল আর রোদের তাপে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে নির্মাণ উপাদান।
এলাকাটি সম্পূর্ণ নির্জন। জনবসতি থেকে বহু দূরে এই প্রান্তিক স্থান। চারপাশে কেবল পাহাড়ি ঢালু জমি বিস্তৃত, উঁচু-নিচু ভূমির অবয়ব অন্ধকারে আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। দূরে দূরে কয়েকটি গাছের কালো ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে তাদের পাতার মৃদু খসখসানি।
জাওয়াদ ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। সাথে সাথে চারদিকে নেমে আসে নীরবতা। এই নিস্তব্ধতায় কেবল ভেসে আসে দূর থেকে একটি পেঁচার একঘেয়ে ডাক - হু হু হু।
পাশের সিটে গুলনূর বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস একদম স্বাভাবিক, নিয়মিত, যেন কিছুই ঘটেনি। কোনো অস্বাভাবিকতার লক্ষণ নেই তার মধ্যে। জাওয়াদ গাড়ির ভেতরের ক্ষীণ আলোয় তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। কিছু কিছু মেয়ের মুখকে শুধু সুন্দর বললে ভুল হয়, তাদের চেহারায় যেন মায়ার নদী বয়ে যায়। এমন সব মানুষের দিকে তাকিয়ে কখনও কঠোর হওয়া যায় না, হৃদয় বিগলিত হয়ে পড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এরকম মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি ছলনাময়ী হয় - ঠিক যেমন গুলনূর!
কী অপার শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে! কী নিশ্চিন্ততায় ঘুমাচ্ছে! দেখে মনে হচ্ছে যেন অনেক দিন পর এমন গভীর, নিরবচ্ছিন্ন ঘুমে মগ্ন হয়েছে। মুখজুড়ে কোনো উদ্বেগের রেখা নেই, কোনো অপরাধবোধের ছায়া পড়েনি। যেন সবকিছু স্বাভাবিক, যেন কোনো অন্যায় বা পাপকর্ম সে কখনো করেনি।
জাওয়াদ আরও নিকটে সরে এসে গুলনূরের মুখের দিকে নিবিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তার মুখজুড়ে রক্তের দাগগুলি এখন শুষ্ক হয়ে গিয়ে গাঢ় বাদামি আবরণের মতো লেপ্টে রয়েছে। গালের একদিকে, চিবুকের নিচে এই রক্তাক্ত চিহ্নগুলি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। পোশাক-পরিচ্ছদেও অনুরূপ অবস্থা। রক্তের ছিটেফোঁটা দাগ ছড়িয়ে আছে। হাতের কব্জিতেও রক্তের চিহ্ন। কী অনায়াসেই না একজন মানুষ খুন করল!
জাওয়াদ ভাবে, প্রকৃতপক্ষে গুলনূর কে? তার প্রকৃত পরিচয় কী? তার অতীত জীবন কেমন? এমন শান্ত, এমন অপরূপ সুন্দর একটি মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে কোন জীবনের গল্প ?
সত্যি বলতে, তার অন্তরে একটা গোপন আতঙ্ক কাজ করছে। সে স্বীকার করতে চায় না, কিন্তু সত্যি এটাই যে, সে গুলনূরকে ভয় পাচ্ছে। একজন মানুষ কীভাবে এমন ঠান্ডা মাথায় অন্য আরেকটা মানুষকে হত্যা করতে পারে!
তার মধ্যে কোনো ক্রোধের উত্তাপ নেই, কোনো আবেগের তরঙ্গ নেই। যেন হত্যাকাণ্ড তার নিকট একটি স্বাভাবিক কর্ম, নিত্যদিনের একটি রুটিনের মতো।
জাওয়াদ ঘাড় সোজা করে বসে। গভীর শ্বাস নিয়ে তার ভয় দূর করার চেষ্টা করে। গুলনূরের হাত বাঁধা আছে, ভয়ের কী প্রয়োজন! তবুও তার মনে একটা তীব্র অস্বস্তি কাজ করে যাচ্ছে। এই নির্জন স্থানে, এই গভীর অন্ধকারে, একজন খুনীর সাথে একা থাকার চিন্তাটাই তাকে অস্থির করে তুলছে।
সে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে চারদিকে তাকায়। দূরে পাহাড়ের ঢালে কিছু গাছের ছায়া দেখা যাচ্ছে, আকাশে মেঘের আড়ালে চাঁদ লুকিয়ে আছে। এখানে কেউ তাদের খুঁজে পাবে না। জায়গাটা জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে অনেক দূরে। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে অনেকটা উপরে উঠতে হবে বাড়িটা পর্যন্ত পৌঁছাতে।
গুলনূরের পাশের দরজাটা খুলে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়! কী নিষ্পাপ দেখাচ্ছে ওকে! ঠোঁট দুটো পাতলা, সামান্য ফুলে গেছে। শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে। নিশ্বাসের সাথে তাল মিলিয়ে তার বুক উঠানামা করছে নিয়মিত ছন্দে।
জাওয়াদের অন্তরে বিরাট দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তার মনের এক অংশ বলে, এমন শান্তিময় ঘুমটা নষ্ট করার কী প্রয়োজন? গভীর ঘুমে থাকা একজন মানুষকে জাগানোটা তার কাছে পাপের মতোই মনে হচ্ছে। কিন্তু মনের অন্য অংশ বলে, একজন প্রতারক, একজন খুনীর শান্তিতে ঘুমানোর কোনো অধিকার নেই! যা সে করেছে, তার পর তার এমন নিশ্চিন্তে ঘুমানো উচিত নয়। তবুও সে কোনো কারণে তাকে ডাকতে পারছে না। হাত বাড়িয়ে আবার গুটিয়ে নেয়। হয়তো মানুষ বড় বৈচিত্র্যময় বলেই, বেইমানদের প্রতিও তারা সদয় থাকে। এটা কি পৃথিবীর অদ্ভুত নিয়ম, নাকি শুধুই মনের নরমতার পরিণতি?
গুলনূরের ঘুষি খেয়ে নাকটা এখনো ব্যথা করছে। সেই তীব্র যন্ত্রণার কথা মনে পড়তেই তার রাগ হয়। গুলনূর যদি এতটা নিষ্ঠুর হয়ে তাকে আঘাত করতে পারে, তাহলে সে কেন একটু ঘুম ভাঙাতে পারবে না? সে কর্কশ গলায় চিৎকার করে ওঠে, 'এই, ওঠো!'
গুলনূর ধীরে ধীরে চোখের পাতা খুলে। প্রথম মুহূর্তে তার দৃষ্টি অস্পষ্ট, কিছুই বুঝতে পারে না। ঘুমের জড়তায় আচ্ছন্ন হয়ে জাওয়াদের দিকে তাকায়। তারপর নিভু নিভু চোখে চারপাশে দেখে মৃদু বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, 'আমরা কি পৌঁছে গেছি? এটা কোথায়?'
তার কণ্ঠে এমন নির্ভরতা, যেন জাওয়াদ তার চালক। আর সে একজন নিশ্চিন্ত পর্যটক, যার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। জাওয়াদ গুলনূরের বাহু চেপে ধরে তাকে গাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে কঠিন গলায় বলে, 'হাঁটো।'
গুলনূর এখনও সম্পূর্ণ জাগ্রত হয়ে উঠতে পারেনি। তার চেহারায় বিভ্রান্তি ও বিস্ময়। পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় টলতে থাকে। আহত গলায় বলে,, 'আস্তে ধরো, ব্যথা লাগছে।'
'সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।'
জাওয়াদ গুলনূরকে সামনে ধাক্কা দিতে দিতে এগিয়ে চলে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উপরের দিকে। ঢালের পথটি ইট-সিমেন্টের পাকা, কিন্তু দীর্ঘ অবহেলায় নানা জায়গায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তাদের পদচারণায় নুড়িপাথর খসে খসে গড়িয়ে পড়ে। গুলনূর এখনও পুরোপুরি সচেতন নয়, ফলে প্রতি পদক্ষেপেই হোঁচট খেতে থাকে।
'সাবধানে হাঁটো,' জাওয়াদ বিরক্তির সুরে বলে।
পাঁচ মিনিটের পথ পেরিয়ে তারা অবশেষে বাড়িটির প্রবেশদ্বারের সামনে এসে পৌঁছায়। এখানে এসে জাওয়াদ নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়। দরজার তালা খুলতে গেলে তো গুলনূরকে ছেড়ে দিতে হবে। এই সুযোগে যদি সে পালিয়ে যায়! চতুর জাওয়াদ গুলনূরকে নিজের সামনে রেখে পিছন থেকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। এভাবে তাকে নিজের বন্দিত্বে রেখেই দরজার তালা খোলার প্রচেষ্টা চালায়।
জাওয়াদের বুক গুলনূরের পিঠের সাথে নিবিড়ভাবে মিশে যায়। গুলনূর তীব্র অস্বস্তিতে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। তার নিশ্বাস দ্রুততর হয়ে ওঠে। বুকের ভেতর হৃদয় যেন ঢাকের মতো বাজতে থাকে। নিজেকে সংযত রেখে বলে, 'কী করছো? জড়িয়ে ধরেছ কেন? দূরে যাও।'
জাওয়াদের থুতনি গুলনূরের কাঁধের উপর স্থির হয়ে আছে। গুলনূরের দেহ থেকে এক মনোহর সুগন্ধ ভেসে আসে - ফুলের পারফিউমের মতো। এই ঘ্রাণে জাওয়াদের মাথা ঘুরতে শুরু করে, হাত কাঁপতে থাকে। তালাটাও যেন তার অবাধ্য হয়ে ওঠে, খুলতেই চায় না!
গুলনূরের কণ্ঠস্বর ক্রমশ আরও কোমল হয়ে আসে, 'আমি কোথাও পালাবো না। প্লিজ দূরে যাও।'
জাওয়াদ তার এই আবেদনে কর্ণপাত করে না। আরও কিছুক্ষণ চেষ্টায় তালা খুলে যেতেই গভীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর গুলনূরকে একটা জোরালো ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়।
ঘরটি আয়তনে বেশ বড়, কিন্তু একদম শূন্য। শুধুমাত্র এক কোণায় একটি পুরাতন কাঠের চেয়ার এবং একটি ভাঙা টেবিল অবহেলায় পড়ে রয়েছে। জাওয়াদ গুলনূরকে সেই চেয়ারে বসিয়ে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলে। গুলনূর অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে বলে, 'কী চাও আমার কাছে? জলদি বলে সেটা নিয়ে আমাকে ছেড়ে দাও।'
জাওয়াদ এমনভাবে তাকায় যেন গুলনূরকে জ্যান্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। কঠিন গলায় বলে, 'গলা উঁচিয়ে কথা বলবে না।'
'একশোবার বলব।'
'গলা টিপে মেরে ফেলব।'
'তাই করো, দস্যু কোথাকার।'
জাওয়াদ তেড়ে এসে তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে, 'আর তুমি...তুমি কি? একটা প্রতারক, একটা ছলনাময়ী, একটা খুনি!'
'আমি কোনো প্রতারণা করিনি।'
'মিথ্যাবাদী। আর কি কি গুণ আছে তোমার?'
'তুমি যেচে বিয়ে করতে চেয়েছো আমাকে। আমি করতে চাইনি। তোমাকে আমার কস্মিনকালেও পছন্দ ছিল না।' গুলনূর একটানে বলে ফেলে।
'তুমি ছলনা করেছো। তোমার ফাঁদে ফেলেছো আমাকে।'
'তুমি যেচে ফাঁদে পড়েছো।'
'তাহলে স্বীকার করছো, ফাঁদ পেতেছিলে?'
গুলনূর নিশ্চুপ।
জাওয়াদ দাঁতে দাঁত পিষে বলে, 'কালসাপ।'
গুলনূর মিনমিনে গলায় পাল্টা বলে, 'ঢোড়া সাপ।'
জাওয়াদ রক্তচোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে একে একে সব জানালা খুলে দেয়। বাইরে তখন ভোর হচ্ছে। পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে।
·
·
·
চলবে……………………………………………………