চিত্রলেখার সংসার - পর্ব ০৮ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          বেলা পড়ে এসেছে। গোধূলি লগ্নে রাঙা পশ্চিমাকাশ। সেই পুকুরঘাটে পানিতে পা ডুবিয়ে পাশাপাশি বসে আছে চিত্রলেখা এবং কাব্যতা। চিত্রলেখা নিজে যেয়ে আপাকে ডেকে এনেছে। রাতের রান্নার দায়িত্ব তারা নিজেই নিয়েছে। ওর নতুন ভাবীর জন্য নিজ হাতে রান্না করবে নাকি। এইসবে চিত্রলেখা উদাসীন। যার যা ইচ্ছা করুক। আব্বাস উদ্দিন সেই দুপুরে বেরিয়ে গেছেন আর বাসায় ফেরেনি। জাবেদা বেগমের মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। ঘরের দাওয়ায় বসে স্বামী ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। মাঝেমধ্যে কাঁদছে আর চিত্রলেখাকে গালি দিচ্ছে। এইসব যেন চিত্রলেখা দেখেও দেখেনি। 

চিত্রলেখার দৃষ্টি নিবিষ্ট বাতাসের সনে নৃত্যে মজে থাকা পানির ঢেউয়ে। অপরদিকে কাব্যতা মুচকি হেসে একদৃষ্টে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মেয়েটার মাঝের পরিবর্তন ঠিক উপলব্ধি করতে পাচ্ছে। এতেই যেন ওর খুশির শেষ নেই। কেবল এই পরিস্থিতিতে সেটুকু মন খুলে প্রকাশ করতে ব্যর্থ। চিত্রলেখাকে ও ব্যাক্তিত্ব সম্পূর্ণ নারী রুপে দেখতে চায়। যেন কেউ ওকে আঘাত করার পূর্বে শতবার ভাবে। অষ্টাদশী চিত্রলেখা কঠিন স্বত্বাধিকারী হয়ে ওঠুক। যার ব্যক্তিত্ব থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরবে। মানুষ ওকে দেখবে, নিজেদের সন্তানদের ওর মতো বানাতে চাইবে। বোকা চিত্রলেখা আগুন রুপে নতুন করে আবর্তিত হোক। নিজের ভালোবাসার মানুষটার থেকে ঠকে যাওয়ার মতো বিশ্রী অনুভূতি আর দুটো নেই ওই ধরিত্রীতে। 

কাব্যতা একটু কাশল। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। বুঝল মেয়েটা গভীর ভাবনায় মগ্ন। কাঁধ এগিয়ে বাহুতে ধাক্কা দিতেই চিত্রলেখা ধ্যান চ্যুত হলো। তাকাল ওর দিকে। হাসল কাব্যতা,

"কী রে কুন খানে হারাইছছ কোকিলা?"

"কোথাও না আপা।"

"ওদিকে সব ঠিকঠাক আছে নি?"

"না।"

কাব্যতার কপালে ভাঁজ পড়ল, "ক্যান আবার কী হইলো?"

"উনি তালাকনামা বানাইয়া লইয়াছে। মোরে কয় মুই যা কমু তাই হইবে। ও আপা মোর এহন কী করা উচিত?"

সবপ্রশ্ন একপাশে ফেলে রাখল কাব্যতা। চোখদুটো বৃহদাকার ধারণ করল। তবে ও যেটা ভেবেছিল সেটাই ঘটতে চলেছে। ওর মুখের হাসি মুছল না। হঠাৎ আপার এমন চাহনিতে চিত্রলেখা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বুঝল না কিছুই। কাব্যতা সেভাবেই বলল, "তুই কী চাস ক তো দেখি।"

"মুই কিচ্ছু বুঝতাছি না আপা। তুমি মোরে সমাধান দাও আপা। মোর নিজেরে কেমন মৃ ত মৃ ত লাগতাছে।"

"নারীর আত্মসম্মানের উপরে কখনোই অনুভূতি হতে পারে না কোকিলা।"

ছোট্ট একটা বাক্য অথচ তার ভাবার্থ সুবিশাল। খুব সহজেই সবটা বুঝে গেল চিত্রলেখা। জায়গামতো সুক্ষ্মভাবে তীর ছোড়াটা এই প্রথমবারের মতো কাজে দিলো। চিত্রলেখার আঁখি জোড়া ছলছল করে উঠল। আপা কত ভালো। ওকে সবসময় সঠিক রাস্তাটাই দেখায়। এই পৃথিবীতে আপার মতো করে কেউ ওকে বুঝবে না। বুঝতে পারেই না। কাব্যতাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল চিত্রলেখা। ফুঁপিয়ে উঠল, 

"আপা তুমি মোর চোখ দুইডা খুইলা দিয়াছ। মুই এখন নিজের কথা ছাড়া আর কারুর কথা ভাবব লাই। মোর কেউ লাই আপা।"

কাব্যতা খুব খুব খুশি হলো। চিত্রলেখাকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে মাথার হাত বুলিয়ে দিলো, "এইতো মোর লক্ষ্মী কোকিলা। সবসময় নিজেরে ভালাভাসবি। ছাইড়া যা এই সংসার। এইখানে তোর কপালে দুঃখ ব্যতীত সুখ লাই। যাবি মোর লগে মোর বাড়িত?"

চিত্রলেখা এই প্রস্তাবে একটু ইতস্তত করল, "কিন্তু কাকিমা?"

"মারে মুই সামলাইয়া লইব।"

হ্যাঁ, বলতে যেয়েও থামল চিত্রলেখা। হঠাৎ একটু ভাবুক হলো। জীবনে দুমুঠো ভাতের জন্য তো কেবল অন্যের লাঞ্ছনা গঞ্জনা শুনেই গেল। আর কত শুনবে? জীবনটা তো ওর। এবার না হয় নিজেই নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করবে। নিজেই নিজের দায়িত্বটুকু নিবে। দেখা যাক জীবন ওকে কতদূর নিয়ে যায়। সাথে সাথেই নাকচ করে দিলো, "না আপা, তুমি মোর জন্যি খুব কইরাছ। আর না। এবার সবডা মুই করমু। তুমি মোর সঙ্গ দিলেই চলবে আপা। মোর যে মাথা রাখবার জন্যি একটা বিশ্বস্ত বুক লাই তুমি ছাড়া।"

"কিন্তু কী করতে চাইছিস তুই?"

"সেইডা পরে কমু তোমারে।"

"আইচ্ছা, এই দেহে যতক্ষুণ প্রাণ আছে ততক্ষুণ মুই তোর লগে আছি কোকিলা। কোনো একদিন তোরে তোর মতোই একডা হতভাগীর গল্প শুনাইমু। তখন বুঝবি মানুষ শত কষ্ট বুকে চাইপাও বাইচা থাকবার পারে। হাসিমুখে থাকবার পারে। মোর বিশ্বাস তুই ও পারবি কোকিলা।"

"মুই পারমু আপা, মোরে পারতেই হইবো।" 

চিত্রলেখা আরও কিছু বলতে নিচ্ছিল কিন্তু তৎক্ষণাৎ বাড়ির ভেতর থেকে জাবেদা বেগমের কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো সাথে আব্বাস উদ্দিনের উচ্চ গলার আওয়াজ। ওরা দুজনেই একটু অবাক হলো। পরপরই উঠে দাঁড়াল চিত্রলেখা। আর থাকল না ওখানে। কাব্যতার উদ্দেশ্য বলল, "আপা মুই যাইগা। মনে হইতাছে ঝামেলা পাইকাছে বাড়িত।"

চলে যাচ্ছিল চিত্রলেখা অকস্মাৎ কী যেন ভেবে পদ যুগল থামাল। পিছু ফিরল। দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা ভালোবাসা উপচে পড়ছে। শোনা গেল মেয়েটার ম্লান কণ্ঠস্বর, "আপা মুই কোনো ভুল করিলে মোরে ক্ষমা কইরা দিও। হয়তো ক্ষমা চাওয়ার জন্য মুই আর না থাকিতেও পারি।"

কথাটা কাব্যতার বুকে তীরের মতো বিঁধল। মস্তিষ্কে ঝড় তুলে দিলো। ও পিছন থেকে চিল্লাল, "কোকিলা মোরে না কইয়া তুই আমারে ছাইড়া যাইবি না। মুই সখী সারা হইয়া যামু।"

সবটাই শুনল চিত্রলেখা। কিন্তু চলন্ত পা জোড়া থামাল না। কেবল চোখ ফেটে কয়েক ফোঁটা পানি বেরিয়ে এলো। জীবন সবসময় এক থাকে না। নিজেকে চিনতে হলে, জানতে হলে নিজের স্থান পরিবর্তনের বড্ড প্রয়োজন।

••••••••••

চিত্রলেখা বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখতেই দেখল উঠানে বসে বসে কপাল চাপড়াচ্ছেন জাবেদা বেগম আর গুনগুনিয়ে কাঁদছেন। আব্বাস উদ্দিন ওনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। তারা একপাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। কী আশ্চর্য ! মায়ের দুঃখে মেয়ে হাসে। এই বুঝি দেখার বাকি ছিল।রুহানি আর সাহিল নিজেদের ঘরের দরজাটার সামনের দাঁড়ানো। মুখটা মলিন দুজনেরই। চিত্রলেখাকে দেখতেই জাবেদা বেগমের কান্নার বেগ বাড়ল, 

"ওরে মা গির ঝি তুই মোর কপালডা পুড়াইলি রে। তোর শ্বউর কী কয় শুইনা যা চিত্রা। এ মোর কী ক্ষতি হইয়া গেল রে।"

চিত্রলেখার অধরে হাসির রেশ ছড়াল। পাত্তা দিলো না ওনার কথা। এগিয়ে গেল সাহিলের দিকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখল। যেন ওই দৃষ্টি দিয়েই কিছু বোঝাতে চাইছে। মুখে না বলা কথাগুলো চোখদুটোতে উঁকি দিচ্ছে। অথচ ওই দুর্বোধ্য নিষ্প্রভ দৃষ্টি বুঝল না সাহিল। 

"ঘর থেইক্যা তালাকনামা লইয়া আনেন।"

সাহিল অতি আশ্চর্যে বাকরুদ্ধ। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। মস্তিষ্ক যেটা বলছে সেটা মন মানতে নারাজ। রয়ে সয়ে জানতে চাইল, "ওটা তুমি কী করবে?"

"সেইডা আনলেই না দেইখবেন।"

সুযোগ পেয়েছে রুহানি। হাতছাড়া করবে নাকি? উঁহু মোটেও নয়। সাহিলকে ঠেলে ঠুলে ঘরের মধ্যে পাঠিয়ে দিলো। বেশ সময় নিয়েই বাইরে এলো সাহিল। হাতে তালাকনামাটা জ্বলজ্বল করছে। রুহানি ওটা একটানে কেড়ে নিলো। হাসিমুখে এগিয়ে দিলো চিত্রলেখার দিকে। চিত্রলেখা প্রাণহীন দৃষ্টি পাতা জুড়ে ভাসমান হলো। পরক্ষণেই তাকাল সাহিলের দিকে। শুধাল,

"আপনারে তালাক দেওয়ার জন্যি এখন মোর কী করা লাগবো?"

সাহিল এটা একদমই মেনে নিতে পারছেনা। রুহানির উপর বেশ মেজাজ খারাপ হলো। বেশি বোঝে সবসময়। মন চাইল কানের নিচে একটা দিতে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। ও মুখ খোলার আগেই রুহানি ফরফর করে বলতে শুরু করল, 

"তোমাকে একটা স্বাক্ষর করতে হবে।"

চিত্রলেখা বুঝল না, "সেইডা আবার কী?"

"তোমার নাম লিখতে হবে। পারো তো?"

"মুই পারি। মোর ভাইজান মোর নামডা লেখা শেখায়ছিল মুই যখন ছোট্ট আছিলাম। আচ্ছা একডা কলম দেন দেখি।"

"ভেবে করছ তো চৈত্র? সময় আছে এখনো। একটু ভেবেচিন্তে নিতে সিদ্ধান্ত।"

সবাই এতক্ষণে নীরব দর্শক ছিলেন। কিন্তু সাহিলের এই প্রশ্নে অদ্ভুত চোখে তাকাল ওর দিকে। রুহানি চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে।আব্বাস উদ্দিন চান এটাই হোক। ওই জানোয়ার সমতূল্য ছেলের হাত থেকে মুক্তি পাক নিষ্পাপ অবুঝ মেয়েটা। তাই তো থামাচ্ছেন না। আর জাবেদা বেগম? উনি আছেন নিজের শোক নিয়ে। তারা সে তো তার মতো সবসময়। সাহিল কথাটা বলেই জিভ কাটল। তাকাল সবার দিকে। রুহানির দিকে তাকাতেই বুঝল ওর উপর দিয়ে ঝড় যাবে আরেক দফা। রুহানি কোনো কথা ছাড়াই গটগট পায়ে ঘরের মধ্যে চলে গেল। 

এমন প্রশ্নে চিত্রলেখার নিজের উপরই রাগ হলো। নিজেকে এতটাই স্বস্তা বানিয়ে ফেলেছে ও? যখন যার যেটা মন চায় সেটাই বলে দিচ্ছে ওকে। ও কি হাতের পুতুল নাকি? তবুও হৃৎপিণ্ডে একটা যন্ত্রনা ঠিক উঁকি ঝুঁকি দিলো। তীব্র অনিহা নিয়ে শান্ত অথচ সিক্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করল চিত্রলেখা,

"ভালোবাসাটা আমার জন্য ভীষণ প্রয়োজন ছিলো শহুরে বাবু। কিন্তু বিচ্ছেদ? ওটা আমাদের দুজনের জন্যই বড্ড বেশি প্রয়োজন। আমার আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।"

এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে সাহিল বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। শেষ বারের মতো শোনা 'শহুরে বাবু' ডাকটা বুকের মাঝে গেছে গেল যেন। অদ্ভুতভাবে একটা ভালোলাগা কাজ করল। রুহানি ফিরে এলো হাতে একটা কলম নিয়ে। এগিয়ে দিলো চিত্রলেখার দিকে। চিত্রলেখা কলমটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

"কোনখানে লিখমু?"

রুহানি দেখিয়ে দিলো। হাত কাঁপছে মেয়েটার। এতক্ষণে চোখের কোণে জল‌ জমল। ওষ্ঠপুটে খেলে গেল তাচ্ছিল্যের হাসি। কম্পিত হাতে নিজের নামটা লিখে দিলো। ব্যস! মুক্তি। সবরকমের কষ্ট থেকে মুক্তি ওর। সাহিল নামক ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি। রুহানি সাহিলের দিকে তাকাল। এই পর্যায়ে ওর নিজেকে অসহায় অনুভব হলো। কিন্তু কেন জানে না ছেলেটা। চিত্রলেখার হাত থেকে তালাকনামা নিয়ে নিলো। নিজের নামটা লিখতে যেয়ে বারকয়েক থামল। অতঃপর নিজেও সাইন করে দিলো। সমাপ্তি ঘটল বিষাক্ত একটা সম্পর্কের। রুহানি এতক্ষণে প্রাণবন্ত হাসল। যেন কোনো অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে। ও মনে করেছিল এই গাইয়া অবুঝ ছ্যাঁচড়া মেয়েটা বোধহয় এতো সহজে কাঁধ থেকে নামবে না। কিন্তু এ তো মেঘ না চাইতেই পানি। বোকা রুহানি নারী হয়েও নারী বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অজ্ঞ। যেই নারী দাস হতে পারে সেই নারী পুরো একটা সাম্রাজ্য শাসনের ক্ষমতাও রাখে।

চিত্রলেখা তাকাল সাহিলের দিকে। মুখে কোনো কথা বলল না। কেবল একদলা থুথু ছুড়ে ফেলল উঠানে। যেন সাহিলকে নীরবে নিভৃতে ওর অবস্থানটা বুঝিয়ে দিলো। ওই থুথুর মতোই ছুড়ে ফেলেছে ওকে। সাহিল সহ উপস্থিত সকলেই বুঝল সবটা। তীব্র অপমানে সাহিলের মুখটা থমথমে হয়ে উঠল। রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁতে দাঁত চাপল, "তোমাকে তো আমি দেখে নিবো চৈত্র। এতো সহজে ছাড়ছি না। আমাকে করা প্রতিটা অপমানের জের আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলব।"

কথাগুলো ভীষণ আস্তে বলেছে। কারোর কর্ণগোচর হওয়া সম্ভব নয়। তবুও কি চিত্রলেখা শুনল সবটা? হয়তো! হয়তো না। মেয়েটার মুখের হাসি যেন সরছে না আজ। অগ্রসর হলো শ্বশুরের দিকে। সামনাসামনি দুরত্ব রেখে দাড়াল, "কী হইয়াছে আব্বা? আম্মা ওমনে কান্নাকাটি করে কির লাইগা।"

"তোমার মা'র সতীন আনবার ব্যবস্থা করতাছি তার লাইগা ওমন মরা কান্না জুইড়াছে।"

"মাইয়া দেখছেন নি?"

"দেইখ্যা আইছি মা। বয়সডা একডু কম। তবে সুন্দরী আছে।"

জাবেদা বেগম ততক্ষণে ফিরে তাকিয়েছেন ওদের দিকে। ভাবলেন হয়তো মেয়েটা আব্বাস উদ্দিনকে বোঝাবে। অথচ উনি সহ সবাইকে অবাক করে দিয়ে চিত্রলেখা বলে বসল, "কাজডা মন্দ না আব্বা। যে যেই ভাষাতে বুঝে তারে সেই ভাষাতেই বুঝানো উত্তম।"

উপস্থিত সকলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখার দিকে। এই চিত্রলেখা সম্পূর্ণ নতুন ওদের কাছে। এই মেয়ে সেই ভোলাভালা চিত্রলেখা হতেই পারে না। এত আঘাত নিঃশব্দে সয়ে যাওয়া চিত্রলেখার এই রুপ ভীষণ অপ্রত্যাশিত। তবে কী শেষ আঘাতটা এতোটাই গভীর ছিল? যা মেয়েটাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে। 

আব্বাস উদ্দিন চিত্রলেখার মাথায় হাত রাখলেন, "দূর থেইক্যা সবসময় তুমার পাশে রবো মা। তুমি ভালা থাইকো। এই পরিবারের সবকয়ডা শয়তান। তুমি কুনুদিন ভালা থাকবার পাইরতে না এইহানে। সৃষ্টিকর্তা তুমায় সবকিছু দুহাত ভরে দিক মা।"

চিত্রলেখা উত্তরে কেবল মুচকি হাসল। মুখে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। অতঃপর আর দাঁড়াল না ওখানে। চলে গেল নিজের ঘরে। ও যেতেই যেন সবার হুশ ফিরল। জাবেদা বেগমের মস্তিষ্ক দাপিয়ে চলল আরও একটা কথা। একি সর্বনাশ হয়ে গেল। মেয়েটা যে এই সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তাহলে ছোট বাবুকে দেওয়া কথা? ওত গুলো টাকা? কীভাবে কী করবেন উনি। যা করার আজকে রাতেই করতে হবে। শুধুমাত্র আজকের রাতটাই সময় আছে ওনার কাছে। নিজের দেওয়া কথা রাখতে না পারলে ওনার পরিণতি যে খুব করুণ হবে সেটা আর ভাবার অবকাশ রাখে না। সবটা ভাবতেই কণ্ঠনালী শুকিয়ে এলো জাবেদা বেগমের। কী করবেন ভেবে পেলেন না। যেভাবেই হোক ছোট বাবুকে খবর দিতে হবে। কিন্তু কীভাবে দিবেন। মাথায় হাত দিয়ে ভাবনায় বিভোর হয়ে পড়লেন। একদিকে স্বামী হারানোর যাতনা অপরদিকে সাজানো গোছানো পরিকল্পনা ঘেটে ঘ হয়ে যাওয়া। মুহূর্তেই যেন উনি উন্মাদ হয়ে উঠলেন।

রুহানি একঝলক সাহিলের দিকে তাকিয়ে মুখটা কঠিন করে ফেলল। সাহিল চেয়েও হাসতে পারল না। মানাতে পারল না রুহানিকে। বুকের কোথাও একটা সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হচ্ছে। যাকে সবসময় ফেলনা ভেবে এসেছে তার জন্য এমনটা হতেই পারে না। আর হলেও মানতে নারাজ ও। রুহানি নিজেও হয়তো স্বামীর মতিগতি বুঝতে পারল। অমনিই হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। তারা রান্নাঘর থেকে কলসি উঠিয়ে নিলো। গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে পুকুরঘাটের দিকে হাঁটা ধরল। বেশ মজাই পাচ্ছে এইসবে। যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফল ভোগ করবে। সেটা আজ নয়তো কাল। ও এই কথাটাতেই চরম পর্যায়ের বিশ্বাসী। প্রকৃতি সবকিছু দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিতে পছন্দ করে। এটা প্রকৃতির দান। প্রকৃতি কখনো কার্পন্যতা পছন্দ করে না।
·
·
·
চলবে………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp